সরেজমিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন-‘অপরাজিতা’ গণধর্ষণঃ নেপথ্যে আরো অনেকেই!

(গণ-ধর্ষণের ঘটনার ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে বাংলানিউজের ইনভেস্টিগেটিভ টিম যায় টাঙ্গাইলে। এই টিমে ছিলেন বিশেষ প্রতিনিধি ও চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, আউটপুট এডিটর রানা রায়হান, চিফ ফটো করেসপন্ডেন্ট জীবন আমীর।
তাদের সঙ্গে ছিলেন টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি সুমন রায় ও মধুপুর প্রতিনিধি এসএম শহীদ।)

 
মধুপুর, টাঙ্গাইল থেকে ফিরে: ‘অপরাজিতা’ গণধর্ষণের পেছনে বীথি আক্তার ইভাই মূল ভূমিকা রেখেছেন। স্থানীয় লোকজনের অনুমান, এ ঘটনার পেছনে আরো অনেকের হাত থাকতে পারে। এছাড়া সুপ্তি কম্পি‌উটার্স, স্থানীয় মধুপুর চ্যানেলকে (ডেঙ্গু চ্যানেল) ঘিরে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।

রোববার তিনদিনের রিমান্ড শেষে টাঙ্গাইলের আদালতে নেওয়া হয় চার ধর্ষককে। এরপর সেখান থেকে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়। এর আগে একদিনের রিমান্ডের পর কারগারে পাঠানো হয় মামলার এক নম্বর আসামি বীথিকে।

মামলাটি তদন্ত করছেন মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবর রহমান নিজেই। তদন্ত সম্পর্কে জানতে তিনি বাংলানি‌উজকে বলেন, “তদন্তের স্বার্থে এখনই বলা যাবে না। তবে ঘটনা সত্যি।” এর বেশি কিছু তিনি জানাতে চাননি।

তবে থানার আরেক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানায়, প্রথম দিন ৬ ডিসেম্বর ‘অপরাজিতা’কে (১৫) নেওয়া হয় মামলার দুই নম্বর আসামি এসএম নুরুজ্জামান ওরফে গেদার বাড়িতে। এরপর ১০ ডিসেম্বর রেললাইনের পাশে অর্ধচেতন অবস্থায় উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ তিনদিন সে কোথায় ছিল তা জানা যায়নি। তদন্তে আরো কেউ জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মামলার আরো তিন আসামি হচ্ছেন হারুনুর রশিদ (২৭), শাহজাহান আলী (৪০) ও মনিরুজ্জমান মনি (৩৯)।jibon-320

এদিকে, বীথির প্রতিবেশী ও নিকটাত্মীয়রা জানিয়েছেন, বীথিকে মাঝেমধ্যেই লোকজন এসে ডেকে নিয়ে যেত। মোটরসাইকেল বা প্রাইভেটকারে এসে তাকে নিয়ে চলে যেত। এমনও হতো, বীথি কয়েকদিন বাড়িতে আসেনি। এরপর বাড়িতে ফিরে তিনি অভিভাবকদের বলতেন, নাটকের কাজে তাকে বাইরে থাকতে হয়েছে ইত্যাদি।

আর সবার মতো বীথির ঘর টিনের তৈরি। শৈশবকাল থেকে বাবা-মার স্নেহবঞ্চিত বীথি চলতেন সেলাইয়ের কাজ করে। নার্সিং হোম বা গৃহপরিচারিকার কাজও করেন। আর্থিক অনটন দূর করতে বা স্বচ্ছলতার খোঁজে বীথি নাটকে ঝুঁকে পড়েন। শুরু করেন গ্রামের মঞ্চ নাটকে অভিনয় মধ্য দিয়ে। এরপর যোগাযোগ ‘ভাদাইমা’ গ্রুপের সঙ্গে।

‘ভাদাইমা’ ধারাবাহিকে অভিনয় নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। ‘ভাদাইমার হাতে চেংগু খুন’ শীর্ষক ভিডিও নাটকটিতে অভিনয় করেন বীথি। তবে পরিচালক নায়েব আলীর মতে, তাকে কেবল একটি গানে অভিনয় (কাস্ট) করানো হয়। গান ভালো না হওয়ায় সেখান থেকে তার অভিনীত অংশটুকু ফেলে দেওয়া হয়। তাহলে ভিসিডির মোড়কে বীথির ছবি বেশ বড় করে ছাপা হলো কেন?

এ বিষয়ে নায়েব আলী বাংলানিউজ বলেন, “আমি বীথিকে ঠিকমতো চিনি না। তার বাড়ি কোথায় তাও জানি না।”

নায়েব আলী বলেন, “সে একদিন এসে আমার কাছে বলল, আমি অভিনয় পারি না, নাচতে পারি। এরপর আমি তাকে একটি গানে নাচার জন্য বলি। মাত্র তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে গানটির ভিডিওচিত্র ধারণ হয়ে গেলে সে চলে যাই। যাওয়ার আগে আমি তাকে ৫০০ টাকা ধরিয়ে দিই।” যোগাযোগ হলো কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সে আমার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দিয়েছিল।”

ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মোড়কে বীথির ছবি এতো বড় করে ছাড়া হলো কেন? এ বিষয়ে পরিচালক নায়েব কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

jibon-3--20নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করা আসান বাংলানিউজকে বলেন, “এটা তো গত রমজানের আগের ঘটনা। ২৮টি নাটক আমি অভিনয় করেছি। কিন্তু মেয়েটাকে আমি চিনি না।”

নাটকের অভিনেত্রী সোনালী বলেন, “আমি স্বামীর সংসার করি। সব কোম্পানিতে কাজ করি না। ভাদাইমা চাপাবাজ, ভাদাইমা চাঁদাবাজ, ভাদাইমার হাতে চেংগু খুন, ভাদাইমার চুন্নি বউ প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেছি। তবে বীথি বা ইভা নামের কাউকে চিনি না।”

আসামিদের বসতবাড়ি ও ‘অপরাজিতা’র বাড়ি গিয়ে এমন সব তথ্য উঠে এসেছে। অনেক আসামির গ্রামে গিয়ে কোনো পুরুষ সদস্যকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে, ‘অপরাজিতা’ ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে গত কয়েকদিন ধরেই মধুপুর ও ধনবাড়ি উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এমনকি ‘অপরাজিতা’র বাড়ির সামনে খুশী কবিরের ‘নিজের‍া করি’ প্রতিবাদ সমাবেশে করেছে। এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, প্রতিবাদ সমাবেশ ‘অপরাজিতা’র বাসার সামনে কেন?

এছাড়া মধুপুর জেলা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ, উপজেলা সদরের বিভিন্ন  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের  শিক্ষার্থী,এনজিও, মানবাধিকার কর্মী এ মানববন্ধনে অংশ নেয়। বক্তারা দোষীদের ফাঁসি দাবি করে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকার সমালোচনা করেন।

গত ডিসেম্বর টানা তিনদিন ধর্ষণের শিকার হওয়া ‘অপরাজিতা’কে নিজ বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে রেললাইনের পাশে অর্ধচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। এ মুহূর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে।

প্রতিবেদকঃ আহমেদ রাজু, রানা রায়হান, সুমন রায়, এসএম শহীদ

No comments

Powered by Blogger.