কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগের ভিত্তিও শোনা কথা- হত্যাকাণ্ডে অংশ নেননি কাদের মোল্লা by মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের
মোল্লাকে যে তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে তার
মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি ঘটনা হলো মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকাণ্ড।
কবি
মেহেরুন্নেসাকে হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লাকে
দণ্ডিত করে প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে অভিযুক্ত কাদের মোল্লা কবি
মেহেরুন্নেসার ঘরে প্রবেশ করেননি হত্যাকাণ্ডের সময়। হত্যাকাণ্ডে কাদের
মোল্লা সশরীরে অংশগ্রহণও করেননি। তবে যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের
তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেছেন এবং এ কাজে তার নৈতিক সমর্থন
ছিল। কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমাণ নেই।
রায়ে আরো বলা হয়েছে এ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। অর্থাৎ অভিযোগের ভিত্তি হলো সাক্ষীদের শোনা কথা।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ছয়টি অভিযোগ আনে। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রায় প্রদান করেন। দু’টি অভিযোগে যাবজ্জীবন ও তিনটিতে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয় এবং একটিতে খালাস দেয়া হয়। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগটি ছিল দ্বিতীয়। ১৩২ পৃষ্ঠার রায়ে পাঁচটি অভিযোগে কাদের মোল্লাকে দণ্ডিত করা ও একটিতে খালাস দেয়া বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রত্যেকটি অভিযোগের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে উভয় পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য, যুক্তি বিশ্লেষণসহ কেন কোন প্রেক্ষাপটে অভিযুক্তকে দণ্ড প্রদান বা খালাস দেয়া হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দুই নং অভিযোগ কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগে কাদের মোল্লাকে দণ্ডিত করা বিষয়ে রায়ে যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা এখানে শিরোনামসহ তুলে ধরা হলো :
২ নং অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ৬ নং সেকশনে নিজ ঘরে থাকা অবস্থায় স্বাধীনতাপন্থী কবি মেহেরুন্নেসা, তার মা এবং দুই ভাইকে হত্যা করে। এ হত্যায় আব্দুল কাদের মোল্লা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং হত্যাকাণ্ড ঘটানোয় সহায়তার অভিযোগ আনা হয়, যা আইনে বর্ণিত মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য।
সাক্ষী : রাষ্ট্রপক্ষ কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তিনজন সাক্ষী হাজির করে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে কবি মেহেরুন্নেসা এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার অভিযোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। রাষ্ট্রপক্ষের ২, ৪ ও ১০ নং সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন তারা জানতে পেরেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা ও তার বিহারি সহযোগী আক্তার গুণ্ডা ও অন্যরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তারা এ ঘটনা দেখেছেন তা দাবি করেননি।
আসামি নিজে ঘরে প্রবেশ করেনি এটি যদি সত্য ধরে নেয়া হয় তাহলে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হলোÑ আসামি নিজে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে সশরীরে অংশগ্রহণ করেননি।
সাক্ষ্য পর্যালোচনা : রাষ্ট্রপক্ষের ২ নং সাক্ষী শহিদুল হক মামা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমি, আব্বাস চেয়ারম্যান, আক্তার গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা, নেহাল ও অন্যরা মিলে ২৭ মার্চ কবি মেহেরুন্নেসা এবং তার দুই ভাই ও মাকে করে হত্যা করে। জেরায় তার এ দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। জেরায় তিনি আবারো বলেছেন তিনি এ ঘটনা জনতার কাফেলার কাছ থেকে শুনেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের চার নং সাক্ষী কাজী রোজী আরেকজন শোনা সাক্ষী। তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি জানতে পেরেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীরা কবি মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই ও মাকে হত্যা করেছে তাদের ঘরে প্রবেশ করে। এর পরের বাক্যেই তিনি বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে; কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে কবি মেহের এর ঘরে প্রবেশ করেছিলেন কি না তা বলতে পারেননি সাক্ষী। দুই দিন পরে তিনি অবাঙালি গুলজার ও আরেকজন বিহারির কাছ থেকে ঘটনা বিষয়ে জানতে পারেন।
এই দু’জন সাক্ষীর বক্তব্য জেরায় নির্দিষ্টভাবে অস্বীকার করা হয়নি। উপরিউক্ত শোনা কথার ভিত্তিতে আমরা একটি জিনিস পেয়েছি তা হলো আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে একটি দুর্বৃত্ত দল কবি মেহেরুন্নেসার ঘরে আক্রমণ পরিচালনা করে। এ বিষয়টি আসামি পক্ষ জেরার মাধ্যমে দূর করতে পারেনি। আসামি নিজে ঘরে প্রবেশ করেনি এটি যদি সত্য ধরে নেয়া হয় তাহলে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হলোÑ আসামি নিজে এ বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে সশরীরে অংশগ্রহণ করেননি; যদিও তিনি দুর্বৃত্তদের ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চার নং সাক্ষী।
রায়ে প্রশ্ন করা হয়েছে কবি মেহেরুন্নেসা এবং তার পরিবারকে কেন টার্গেট করা হলো? এর ব্যাখ্যায় রায়ে বলা হয় চার নং সাক্ষী কাজী রোজী জানিয়েছেন যে, মিরপুরে বাঙালিদের দুর্দশা দূর করার জন্য তারা একটি অ্যাকশন কমিটি গঠন করেছিলেন যার সদস্য ছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা। ২৫ মার্চ সকালে তারা একটি মিটিং করেন এবং বাসায় ফেরার পর তিনি জানতে পারেন যে, তার এবং কবি মেহেরের ওপর আক্রমণ করা হবে। তিনি মেহেরকে সতর্ক করে ছিলেন বাসায় না থাকার ব্যাপারে। তিনি (চার নং সাক্ষী) নিজে মিরপুর ছেড়ে গিয়েছিলেন।
রায়ে বলা হয় এ বিষয়টি জেরায় সম্পূর্ণভাবে থেকে গেছে। তাই এটা পরিষ্কার যে, স্বাধীনতাপন্থী, প্রগতিশীল নাগরিক হওয়ায় এবং বাঙালিদের দুর্দশা লাঘবে উদ্যোগী হওয়ায় ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর পরপরই আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে কবি মেহের এবং তার পরিবারের ওপর আক্রমণ চালানো হয়।
রায়ে বলা হয় ২ নং সাক্ষীর বর্ণনা থেকে এটা প্রতিষ্ঠিত যে, আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭০ এর নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী গোলাম আযমের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছে সক্রিয়ভাবে। তাই আমরা নির্ভুলভাবে এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, স্থানীয় বিহারি আক্তার গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা, নেহাল গুণ্ডা এবং অন্যান্য বিহারি গুণ্ডা আব্দুল কাদের মোল্লার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল।
অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকাণ্ড ঘটাননি বরং অন্য কোনো এক কাদের মোল্লা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আসামি পক্ষ থেকে চার নং সাক্ষীকে জেরার সময় সাজেশন দেয়া হয়। সাক্ষী তা অস্বীকার করেন। আসামি পক্ষের এ সাজেশন থেকে এটা প্রমাণিত যে, কাদের মোল্লা নামে একজন দুর্বৃত্ত এ ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে। কিন্তু সেই কাদের মোল্লা যে বর্তমানে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা নয় এ মর্মে আসামি পক্ষ কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। কাজেই এ কুকর্মে সহকারী হিসেবে আব্দুল কাদের মোল্লার জড়িত থাকার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে শোনা সাক্ষী ২ ও ৪ এর দাবি যথেষ্ট নিশ্চয়তা প্রদান করে।
এ ঘটনার ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী (১০ নং) হলেনÑ সৈয়দ আব্দুল কাইউম। তিনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে, অবাঙালিরা কবি মেহেরুন্নেসা ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে।
সাক্ষ্য মূল্যায়ন এবং প্রাপ্তি : এখানে মূলত উভয় পক্ষের যুক্তি তুলে ধরে রায়ে বলা হয় আসামি পক্ষের আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক ক নং অভিযোগ সম্পর্কে যা বলেছেন এ ক্ষেত্রেও তাই বললেন। তিনি বলেন, ইসলামী ছাত্র সঙ্ঘ এবং আল বদর কোনো সহযোগী বাহিনী ছিল না। কাজেই তিনি এর সদস্য থাকলেও বলা যায় না তিনি কোনো পাকিস্তান আর্মির সহযোগী সংস্থার সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে শুধু রাজাকার বাহিনীকে গেজেটের মাধ্যমে আর্মির কমান্ডের অধীনে সহযোগী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আব্দুল কাদের মোল্লা সে সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন এ কথা রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেনি। তিনি দাবি করেন তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
আসামি পক্ষের অপর আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছেন, অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন সাক্ষী হাজির করেছে এবং তিনজনই বলেছেন তারা এ ঘটনা শুনেছেন। তা ছাড়া আব্দুল কাদের মোল্লা এ কাজে সহায়তা করেছে মর্মে কোনো প্রমাণও রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি।
আব্দুস সোবহান তরফদার বলেন, চুতর্থ সাক্ষী কাজী রোজী ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ নামে একটি বই লিখেছেন, যা এখানে প্রদর্শন করা হয়েছে। বইটি ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। কাজী রোজী তার লেখা এ বইয়ে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লা সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করেননি। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তিনি যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতেও এ ঘটনা বিষয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।
সোবহান তরফদার বলেন, শোনা কথার কোনো মূল্য নেই। তা ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের ১০ নং সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন, কবি মেহেরুন্নেসাকে মিরপুরের স্থানীয় অবাঙালিরা হত্যা করেছে।
জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ২ ও ৪ নং সাক্ষীর শোনা কথা সম্পূর্ণরূপে নির্ভরযোগ্য এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় তাদের সাক্ষ্যের বিচারিক মূল্য রয়েছে। তিনি বলেন, সহযোগী বাহিনীর সদস্য না হলেও ‘ইন্ডিভিজুয়াল’ হিসেবে ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে তাকে বিচারের আওতায় আনা যায় যদি দেখা যায় তিনি আইনের ধারা অনুসারে অপরাধ করেছেন।
রায়ে বলা হয়, ১৯৭২ সালের আইনে শোনা কথা গ্রহণযোগ্য। যদি এর বিচারিক মূল্য থাকে তবে তার ওপর ভিত্তি করে কাজ করার এখতিয়ার রয়েছে ট্রাইব্যুনালের।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর পর ২৭ মার্চ দুর্বৃত্তরা কবি মেহেরুন্নেসার পরিবারের ওপর হামলা করে এটা প্রমাণিত এবং তিনি যে তার ঘরে নির্মম হত্যার শিকার হন তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
আসামি পক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরায় এটাও প্রমাণ করতে পারেনি যে, এটা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড, কোনো পরিকল্পিত ও সিসটেমেটিক আক্রমণের অংশ নয়। কাজেই ঘটনার বিষয়বস্তু, ঘটনা এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় এটা প্রমাণিত যে, এটা ছিল মানবতাবিরোধী একটি অপরাধ।
২ নং সাক্ষী শহিদুল হক মামার সোনা কথার সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ২৭ মার্চ আব্দুল কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমি আব্বাস চেয়ারম্যান, হাক্কা গুণ্ডা, আক্তার গুণ্ডা, নেহাল ও তাদের সহযোগীরা কবি মেহেরুন্নেসা, তার মা ও দুই ভাইকে হত্যা করে। জেরায় আসামি পক্ষ এটি অস্বীকার করেছে কিন্তু দুর্বল করতে পারেনি। সাক্ষী শহিদুল হক মামা জনতার কাফেলা থেকে এ হত্যার ঘটনা শুনেছেন। আসামি পক্ষ এটা দুর্বল করতে পারেনি। তা ছাড়া তখন সেখানে যে ভয়ানক পরিস্থিতি বিরাজ করে তাতে কোনো বাঙালির পক্ষে এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করা স্বাভাবিক বা সম্ভবপর ছিল না। কাজেই জনতার কাফেলা থেকে শোনাটাই স্বাভাবিক ও সম্ভবপর। কাজেই ঘটনা পরম্পরা, ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং স্থানীয় বিহারিদের সাথে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লার যোগসাজশ, সব বিবেচনা করলে ২ নং সাক্ষীর শোনা সাক্ষ্য বিবেচনায় নেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
চার নং সাক্ষী কাজী রোজীর শোনা সাক্ষ্য বিবেচনা করা যাক এবার। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, তার ও কবি মেহেরুন্নেসার ওপর আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হতে পারে কারণ তারা অ্যাকশন কমিটির সাথে জড়িত ছিলেনÑ যে কমিটি মিরপুরের দুর্দশাগ্রস্ত বাঙালিদের সহায়তার জন্য গঠন করা হয়েছিল। এ ঘটনা অবিকৃত রয়েছে। এটা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, স্থানীয় বিহারি আক্তার গুণ্ডা, নেহাল গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা ও অন্যান্য বিহারি গুণ্ডা আব্দুল কাদের মোল্লার সঙ্গী ছিল। কাদের মোল্লা এ গ্যাংকে অপরাধ স্থলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিল। চার নং সাক্ষী থেকে আমরা আরো প্রমাণ পেয়েছি যে আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে মেহেরুন্নেসার ঘরে প্রবেশ করেননি।
রায়ে বলা হয়, এ থেকে আমরা নির্দ্বিধায় একথা বলতে পারি যে, অপরাধ স্থলে গ্যাংদের নিয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং অপরাধ সংঘটনের সাথে অভিযুক্তের যোগসাজশের বিষয়টি এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের হাতে যে তথ্য প্রমাণ এসেছে তাতে আমরা যা পেলাম সেটি হলো আব্দুল কাদের মোল্লা দুর্বৃত্তদের নিরস্ত্র বেসামরিক ভিকটিমের (মেহেরুন্নেসা) ঘরে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব দিয়েছে কিন্তু অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমাণ নেই। কাজেই চার নং সাক্ষীর শোনা সাক্ষ্য, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, বিহারি দুর্বৃত্তদের সাথে সম্পর্ক এটা নির্দেশ করে যে, বর্বর ঘটনার সাথে তার একটা লিঙ্ক ছিল।
সেকশন ৩(২) ধারা অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যা সংঘটনের জন্য আসামিকে সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে তা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন নেই রাষ্ট্রপক্ষের। এ ধরনের অপরাধ সংঘঠনের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি যদি যেকোনোভাবে প্রমাণিত হয় তাহলে এর দায়দায়িত্ব হিসেবে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের দায় বর্তায়।
আসামি পক্ষ দাবি করেছে চতুর্থ সাক্ষী কাজী রোজী বিশ্বাসযোগ্য নন কারণ তিনি কোর্টে এসে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার নিজের লেখা বই ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ বর্ণিত তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক।
সাক্ষী শিকার করেছেন, তিনি তার বইয়ে কারো নাম উল্লেখ করেননি কারণ তখন দুর্বত্তদের বিচারের কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। তিনি আরও বলেছেন দুর্বৃত্তদের ভয়ে তিনি দায়ীদের নাম উল্লেখ করেননি। এখন যেহেতু বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাই তিনি আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে রায়ের ব্যাখ্যায় বলা হয় কারো মৌখিক সাক্ষ্য আগের বর্ণনার সাথে হুবহু মিল নাও হতে পারে। পূর্বের সাক্ষাৎকারে তাকে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিচারের সময় তাকে তা থেকে ভিন্ন প্রশ্নও করা হতে পারে। কোর্টে যখন তাকে নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন সে অতিরিক্ত তথ্য প্রদান করতে পারে। তা ছাড়া সম্ভাব্য ভয়ের কারণে তাকে এটি থেকে বিরত রাখতে পারে বলে অনুমান করা যায়। এটা অনস্বীকার্য যে, উপযুক্ত পরিবেশ পরিস্থিতি এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ঐকমত্যের অভাবের কারণে ১৯৭১ সালে সংঘটিত ভয়াবহ অপরাধের অপরাধীদের বিচারের কাজ কয়েক দশক ধরে থেমে ছিল। এ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের অবস্থান আবার চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছে কোনো বাধা ছাড়াই।
সে কারণে একজন স্বাধীনতাপন্থী
ব্যক্তি হিসেবে ঝুঁকি এবং ভয়ের কারণে চতুর্থ সাক্ষী তার বইয়ে সব কিছু
বর্ণনা করেননি যে বই তিনি তার সাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে লিখেছেন। তা ছাড়া
বইয়ে শুধু দুর্বৃৃত্তদের নাম নির্দিষ্ট করে উল্লেখ না করা এবং বইয়ে কোনো
কিছু বাদ রাখার কারণে তিনি কোর্টে শপথ নিয়ে যা বলেছেন তা টিকবে নাÑ তা
নয়।
অপরাধীদের নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে অপরাধ সংঘটনের একটি অংশ এবং এটি অপরাধ সংঘটনে নৈতিক সমর্থন, উৎসাহ যোগানোর শামিল। অভিযুক্ত সশরীরে অপরাধ সঙ্ঘটনে অংশ নেননি- শুধুমাত্র এ কারণে তাকে এর দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া যায় না, যেহেতু অভিযুক্ত নেতৃত্ব দিয়ে অপরাধীদের অপরাধ স্থলে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে নৈতিক সমর্থন এবং উৎসাহ যুগিয়েছে।
সুতরাং সরাসরি সাক্ষ্য নেই এ কারণে শোনা সাক্ষীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না।
রায়ে আরো বলা হয়েছে এ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। অর্থাৎ অভিযোগের ভিত্তি হলো সাক্ষীদের শোনা কথা।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ছয়টি অভিযোগ আনে। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রায় প্রদান করেন। দু’টি অভিযোগে যাবজ্জীবন ও তিনটিতে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয় এবং একটিতে খালাস দেয়া হয়। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগটি ছিল দ্বিতীয়। ১৩২ পৃষ্ঠার রায়ে পাঁচটি অভিযোগে কাদের মোল্লাকে দণ্ডিত করা ও একটিতে খালাস দেয়া বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রত্যেকটি অভিযোগের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে উভয় পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য, যুক্তি বিশ্লেষণসহ কেন কোন প্রেক্ষাপটে অভিযুক্তকে দণ্ড প্রদান বা খালাস দেয়া হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দুই নং অভিযোগ কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগে কাদের মোল্লাকে দণ্ডিত করা বিষয়ে রায়ে যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা এখানে শিরোনামসহ তুলে ধরা হলো :
২ নং অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ৬ নং সেকশনে নিজ ঘরে থাকা অবস্থায় স্বাধীনতাপন্থী কবি মেহেরুন্নেসা, তার মা এবং দুই ভাইকে হত্যা করে। এ হত্যায় আব্দুল কাদের মোল্লা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং হত্যাকাণ্ড ঘটানোয় সহায়তার অভিযোগ আনা হয়, যা আইনে বর্ণিত মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য।
সাক্ষী : রাষ্ট্রপক্ষ কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তিনজন সাক্ষী হাজির করে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে কবি মেহেরুন্নেসা এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার অভিযোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। রাষ্ট্রপক্ষের ২, ৪ ও ১০ নং সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন তারা জানতে পেরেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা ও তার বিহারি সহযোগী আক্তার গুণ্ডা ও অন্যরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তারা এ ঘটনা দেখেছেন তা দাবি করেননি।
আসামি নিজে ঘরে প্রবেশ করেনি এটি যদি সত্য ধরে নেয়া হয় তাহলে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হলোÑ আসামি নিজে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে সশরীরে অংশগ্রহণ করেননি।
সাক্ষ্য পর্যালোচনা : রাষ্ট্রপক্ষের ২ নং সাক্ষী শহিদুল হক মামা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমি, আব্বাস চেয়ারম্যান, আক্তার গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা, নেহাল ও অন্যরা মিলে ২৭ মার্চ কবি মেহেরুন্নেসা এবং তার দুই ভাই ও মাকে করে হত্যা করে। জেরায় তার এ দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। জেরায় তিনি আবারো বলেছেন তিনি এ ঘটনা জনতার কাফেলার কাছ থেকে শুনেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের চার নং সাক্ষী কাজী রোজী আরেকজন শোনা সাক্ষী। তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি জানতে পেরেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীরা কবি মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই ও মাকে হত্যা করেছে তাদের ঘরে প্রবেশ করে। এর পরের বাক্যেই তিনি বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে; কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে কবি মেহের এর ঘরে প্রবেশ করেছিলেন কি না তা বলতে পারেননি সাক্ষী। দুই দিন পরে তিনি অবাঙালি গুলজার ও আরেকজন বিহারির কাছ থেকে ঘটনা বিষয়ে জানতে পারেন।
এই দু’জন সাক্ষীর বক্তব্য জেরায় নির্দিষ্টভাবে অস্বীকার করা হয়নি। উপরিউক্ত শোনা কথার ভিত্তিতে আমরা একটি জিনিস পেয়েছি তা হলো আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে একটি দুর্বৃত্ত দল কবি মেহেরুন্নেসার ঘরে আক্রমণ পরিচালনা করে। এ বিষয়টি আসামি পক্ষ জেরার মাধ্যমে দূর করতে পারেনি। আসামি নিজে ঘরে প্রবেশ করেনি এটি যদি সত্য ধরে নেয়া হয় তাহলে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হলোÑ আসামি নিজে এ বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে সশরীরে অংশগ্রহণ করেননি; যদিও তিনি দুর্বৃত্তদের ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চার নং সাক্ষী।
রায়ে প্রশ্ন করা হয়েছে কবি মেহেরুন্নেসা এবং তার পরিবারকে কেন টার্গেট করা হলো? এর ব্যাখ্যায় রায়ে বলা হয় চার নং সাক্ষী কাজী রোজী জানিয়েছেন যে, মিরপুরে বাঙালিদের দুর্দশা দূর করার জন্য তারা একটি অ্যাকশন কমিটি গঠন করেছিলেন যার সদস্য ছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা। ২৫ মার্চ সকালে তারা একটি মিটিং করেন এবং বাসায় ফেরার পর তিনি জানতে পারেন যে, তার এবং কবি মেহেরের ওপর আক্রমণ করা হবে। তিনি মেহেরকে সতর্ক করে ছিলেন বাসায় না থাকার ব্যাপারে। তিনি (চার নং সাক্ষী) নিজে মিরপুর ছেড়ে গিয়েছিলেন।
রায়ে বলা হয় এ বিষয়টি জেরায় সম্পূর্ণভাবে থেকে গেছে। তাই এটা পরিষ্কার যে, স্বাধীনতাপন্থী, প্রগতিশীল নাগরিক হওয়ায় এবং বাঙালিদের দুর্দশা লাঘবে উদ্যোগী হওয়ায় ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর পরপরই আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে কবি মেহের এবং তার পরিবারের ওপর আক্রমণ চালানো হয়।
রায়ে বলা হয় ২ নং সাক্ষীর বর্ণনা থেকে এটা প্রতিষ্ঠিত যে, আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭০ এর নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী গোলাম আযমের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছে সক্রিয়ভাবে। তাই আমরা নির্ভুলভাবে এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, স্থানীয় বিহারি আক্তার গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা, নেহাল গুণ্ডা এবং অন্যান্য বিহারি গুণ্ডা আব্দুল কাদের মোল্লার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল।
অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকাণ্ড ঘটাননি বরং অন্য কোনো এক কাদের মোল্লা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আসামি পক্ষ থেকে চার নং সাক্ষীকে জেরার সময় সাজেশন দেয়া হয়। সাক্ষী তা অস্বীকার করেন। আসামি পক্ষের এ সাজেশন থেকে এটা প্রমাণিত যে, কাদের মোল্লা নামে একজন দুর্বৃত্ত এ ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে। কিন্তু সেই কাদের মোল্লা যে বর্তমানে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা নয় এ মর্মে আসামি পক্ষ কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। কাজেই এ কুকর্মে সহকারী হিসেবে আব্দুল কাদের মোল্লার জড়িত থাকার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে শোনা সাক্ষী ২ ও ৪ এর দাবি যথেষ্ট নিশ্চয়তা প্রদান করে।
এ ঘটনার ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী (১০ নং) হলেনÑ সৈয়দ আব্দুল কাইউম। তিনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে, অবাঙালিরা কবি মেহেরুন্নেসা ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে।
সাক্ষ্য মূল্যায়ন এবং প্রাপ্তি : এখানে মূলত উভয় পক্ষের যুক্তি তুলে ধরে রায়ে বলা হয় আসামি পক্ষের আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক ক নং অভিযোগ সম্পর্কে যা বলেছেন এ ক্ষেত্রেও তাই বললেন। তিনি বলেন, ইসলামী ছাত্র সঙ্ঘ এবং আল বদর কোনো সহযোগী বাহিনী ছিল না। কাজেই তিনি এর সদস্য থাকলেও বলা যায় না তিনি কোনো পাকিস্তান আর্মির সহযোগী সংস্থার সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে শুধু রাজাকার বাহিনীকে গেজেটের মাধ্যমে আর্মির কমান্ডের অধীনে সহযোগী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আব্দুল কাদের মোল্লা সে সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন এ কথা রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেনি। তিনি দাবি করেন তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
আসামি পক্ষের অপর আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছেন, অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন সাক্ষী হাজির করেছে এবং তিনজনই বলেছেন তারা এ ঘটনা শুনেছেন। তা ছাড়া আব্দুল কাদের মোল্লা এ কাজে সহায়তা করেছে মর্মে কোনো প্রমাণও রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি।
আব্দুস সোবহান তরফদার বলেন, চুতর্থ সাক্ষী কাজী রোজী ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ নামে একটি বই লিখেছেন, যা এখানে প্রদর্শন করা হয়েছে। বইটি ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। কাজী রোজী তার লেখা এ বইয়ে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লা সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করেননি। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তিনি যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতেও এ ঘটনা বিষয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।
সোবহান তরফদার বলেন, শোনা কথার কোনো মূল্য নেই। তা ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের ১০ নং সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন, কবি মেহেরুন্নেসাকে মিরপুরের স্থানীয় অবাঙালিরা হত্যা করেছে।
জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ২ ও ৪ নং সাক্ষীর শোনা কথা সম্পূর্ণরূপে নির্ভরযোগ্য এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় তাদের সাক্ষ্যের বিচারিক মূল্য রয়েছে। তিনি বলেন, সহযোগী বাহিনীর সদস্য না হলেও ‘ইন্ডিভিজুয়াল’ হিসেবে ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে তাকে বিচারের আওতায় আনা যায় যদি দেখা যায় তিনি আইনের ধারা অনুসারে অপরাধ করেছেন।
রায়ে বলা হয়, ১৯৭২ সালের আইনে শোনা কথা গ্রহণযোগ্য। যদি এর বিচারিক মূল্য থাকে তবে তার ওপর ভিত্তি করে কাজ করার এখতিয়ার রয়েছে ট্রাইব্যুনালের।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর পর ২৭ মার্চ দুর্বৃত্তরা কবি মেহেরুন্নেসার পরিবারের ওপর হামলা করে এটা প্রমাণিত এবং তিনি যে তার ঘরে নির্মম হত্যার শিকার হন তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
আসামি পক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরায় এটাও প্রমাণ করতে পারেনি যে, এটা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড, কোনো পরিকল্পিত ও সিসটেমেটিক আক্রমণের অংশ নয়। কাজেই ঘটনার বিষয়বস্তু, ঘটনা এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় এটা প্রমাণিত যে, এটা ছিল মানবতাবিরোধী একটি অপরাধ।
২ নং সাক্ষী শহিদুল হক মামার সোনা কথার সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ২৭ মার্চ আব্দুল কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমি আব্বাস চেয়ারম্যান, হাক্কা গুণ্ডা, আক্তার গুণ্ডা, নেহাল ও তাদের সহযোগীরা কবি মেহেরুন্নেসা, তার মা ও দুই ভাইকে হত্যা করে। জেরায় আসামি পক্ষ এটি অস্বীকার করেছে কিন্তু দুর্বল করতে পারেনি। সাক্ষী শহিদুল হক মামা জনতার কাফেলা থেকে এ হত্যার ঘটনা শুনেছেন। আসামি পক্ষ এটা দুর্বল করতে পারেনি। তা ছাড়া তখন সেখানে যে ভয়ানক পরিস্থিতি বিরাজ করে তাতে কোনো বাঙালির পক্ষে এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করা স্বাভাবিক বা সম্ভবপর ছিল না। কাজেই জনতার কাফেলা থেকে শোনাটাই স্বাভাবিক ও সম্ভবপর। কাজেই ঘটনা পরম্পরা, ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং স্থানীয় বিহারিদের সাথে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লার যোগসাজশ, সব বিবেচনা করলে ২ নং সাক্ষীর শোনা সাক্ষ্য বিবেচনায় নেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
চার নং সাক্ষী কাজী রোজীর শোনা সাক্ষ্য বিবেচনা করা যাক এবার। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, তার ও কবি মেহেরুন্নেসার ওপর আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হতে পারে কারণ তারা অ্যাকশন কমিটির সাথে জড়িত ছিলেনÑ যে কমিটি মিরপুরের দুর্দশাগ্রস্ত বাঙালিদের সহায়তার জন্য গঠন করা হয়েছিল। এ ঘটনা অবিকৃত রয়েছে। এটা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, স্থানীয় বিহারি আক্তার গুণ্ডা, নেহাল গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা ও অন্যান্য বিহারি গুণ্ডা আব্দুল কাদের মোল্লার সঙ্গী ছিল। কাদের মোল্লা এ গ্যাংকে অপরাধ স্থলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিল। চার নং সাক্ষী থেকে আমরা আরো প্রমাণ পেয়েছি যে আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে মেহেরুন্নেসার ঘরে প্রবেশ করেননি।
রায়ে বলা হয়, এ থেকে আমরা নির্দ্বিধায় একথা বলতে পারি যে, অপরাধ স্থলে গ্যাংদের নিয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং অপরাধ সংঘটনের সাথে অভিযুক্তের যোগসাজশের বিষয়টি এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের হাতে যে তথ্য প্রমাণ এসেছে তাতে আমরা যা পেলাম সেটি হলো আব্দুল কাদের মোল্লা দুর্বৃত্তদের নিরস্ত্র বেসামরিক ভিকটিমের (মেহেরুন্নেসা) ঘরে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব দিয়েছে কিন্তু অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমাণ নেই। কাজেই চার নং সাক্ষীর শোনা সাক্ষ্য, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, বিহারি দুর্বৃত্তদের সাথে সম্পর্ক এটা নির্দেশ করে যে, বর্বর ঘটনার সাথে তার একটা লিঙ্ক ছিল।
সেকশন ৩(২) ধারা অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যা সংঘটনের জন্য আসামিকে সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে তা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন নেই রাষ্ট্রপক্ষের। এ ধরনের অপরাধ সংঘঠনের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি যদি যেকোনোভাবে প্রমাণিত হয় তাহলে এর দায়দায়িত্ব হিসেবে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের দায় বর্তায়।
আসামি পক্ষ দাবি করেছে চতুর্থ সাক্ষী কাজী রোজী বিশ্বাসযোগ্য নন কারণ তিনি কোর্টে এসে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার নিজের লেখা বই ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ বর্ণিত তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক।
সাক্ষী শিকার করেছেন, তিনি তার বইয়ে কারো নাম উল্লেখ করেননি কারণ তখন দুর্বত্তদের বিচারের কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। তিনি আরও বলেছেন দুর্বৃত্তদের ভয়ে তিনি দায়ীদের নাম উল্লেখ করেননি। এখন যেহেতু বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাই তিনি আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে রায়ের ব্যাখ্যায় বলা হয় কারো মৌখিক সাক্ষ্য আগের বর্ণনার সাথে হুবহু মিল নাও হতে পারে। পূর্বের সাক্ষাৎকারে তাকে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিচারের সময় তাকে তা থেকে ভিন্ন প্রশ্নও করা হতে পারে। কোর্টে যখন তাকে নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন সে অতিরিক্ত তথ্য প্রদান করতে পারে। তা ছাড়া সম্ভাব্য ভয়ের কারণে তাকে এটি থেকে বিরত রাখতে পারে বলে অনুমান করা যায়। এটা অনস্বীকার্য যে, উপযুক্ত পরিবেশ পরিস্থিতি এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ঐকমত্যের অভাবের কারণে ১৯৭১ সালে সংঘটিত ভয়াবহ অপরাধের অপরাধীদের বিচারের কাজ কয়েক দশক ধরে থেমে ছিল। এ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের অবস্থান আবার চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছে কোনো বাধা ছাড়াই।
অপরাধীদের নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে অপরাধ সংঘটনের একটি অংশ এবং এটি অপরাধ সংঘটনে নৈতিক সমর্থন, উৎসাহ যোগানোর শামিল। অভিযুক্ত সশরীরে অপরাধ সঙ্ঘটনে অংশ নেননি- শুধুমাত্র এ কারণে তাকে এর দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া যায় না, যেহেতু অভিযুক্ত নেতৃত্ব দিয়ে অপরাধীদের অপরাধ স্থলে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে নৈতিক সমর্থন এবং উৎসাহ যুগিয়েছে।
সুতরাং সরাসরি সাক্ষ্য নেই এ কারণে শোনা সাক্ষীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না।
No comments