আর তামাশা নয় by হামিদ মীর

ভারতের মিডিয়া বেশ উল্লসিত। পাক আর্মির সাবেক চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত শাহেদ আজিজের বই না পড়েই ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বইটির ওপর তর্ক-বিতর্ক চলছে।
তর্ক-বিতর্কের ভিত্তি হচ্ছে কারগিল যুদ্ধ সম্পর্কে বইটির বাছাইকৃত অংশ। যা কয়েকটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেছে। জিও টিভিতে ক্যাপিটাল টকে (টকশো) কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত আশফাক হোসাইনের বইয়ের উল্লেখ হওয়ায় কয়েকটি মিডিয়া কর্নেল আশফাককেও গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। ভারতীয় মিডিয়ার ধারণা, জেনারেল আজিজ ও কর্নেল আশফাকের গ্রন্থ দু’টি দ্বারা পাকবাহিনীর অনেক বদনাম হবে। এ কারণে গ্রন্থ দু’টিকে কেন্দ্র করে তারা গলা ফাটিয়ে সমালোচনা করছে। তবে এই অধমের মতে, গ্রন্থ দু’টি দ্বারা পাকবাহিনীর তি নয়, বরং উপকার হবে। বাহিনীর ত্র“টিবিচ্যুতি চিহ্নিত করার অর্থ, স্বীয় বাহিনীর সাথে শত্র“তা নয়। ওই গ্রন্থ দু’টির সবচেয়ে উপকারী দিক হচ্ছে, পাঠক কাশ্মির সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন। আর জানতে পারবেন, এই অঞ্চলে আমেরিকার পলিসি সম্পর্কে  বেশিরভাগ পাক সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিক দেশের   জনসাধারণের মতানুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকেন। হতে পারে, কিছু লিবারেল ও সেকুলার চরমপন্থীর কাছে জেনারেল শাহেদ আজিজের এই বক্তব্য খারাপ মনে হবে, ‘ম্যাসাজ পার্লারে হামলার অভিযোগে লাল মসজিদকে নারী ও শিশুসহ ভস্মীভূত করা হয়েছে।’ হতে পারে, আমি জেনারেল আজিজের গ্রন্থে উল্লিখিত কয়েকটি দাবির ঘেরবিরোধী, কিন্তু তার গ্রন্থের ১৭৭ পৃষ্ঠার ক’টি বাক্য সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখুন, যেখানে তিনি ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির এক বছরের যুদ্ধ কোর্সের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘একবার কাশ্মির পলিসির ভালো-মন্দ দিক নিয়ে খুব সমালোচনা করলাম। এটা কেমন পলিসি যে, আমরা সেখানে শত্র“সেনাকে ফাঁদে আটকানোর জন্য শুধু কাশ্মিরিদের রক্ত ঝরাচ্ছি? এই লড়াইয়ের কি কোনো শেষ আছে? এটা কি কোনো ফলাফলে পৌঁছবে, নাকি শুধু ভারতকে জালে আটকানো পর্যন্ত চলবে? কিছুণ নীরবতা। মনে হচ্ছিল যেন আমি কোনো মানসিক প্রতিবন্ধী। তারপর এই প্রসঙ্গ পাল্টে দেয়া হয়।’

কর্নেল আশফাকের গ্রন্থে কাশ্মির সমস্যার পরিপূর্ণ পটভূমি বর্ণনা করে বলা হয়েছে, কারগিল অভিযান অগোছালো পরিকল্পনামাফিক হওয়ার কারণে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক তি হয়েছে। তবে কাশ্মির সমস্যার সমাধান না হলে কারগিলের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি বারবার ঘটতে পারে। কেননা সূচনা সর্বদা পাকিস্তানের প থেকে হয়নি। ভারতও সিয়াচেনের ওপর অবৈধ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে কাশ্মির সমস্যাকে আরো জটিল করে রেখেছে।

দু’টি গ্রন্থেই জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এবং তার সহকর্মী জেনারেলদের সমালোচনা করা হয়েছে। তবে সেনাবাহিনীর জওয়ান ও অফিসারদের বীরত্ব ও সাহসিকতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। আমার ধারণা, এ গ্রন্থ দু’টি আমাদেরকে নিজেদের ভুলত্র“টি থেকে শিা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে। কর্নেল আশফাকের গ্রন্থ জেন্টেলম্যান আসতাগফিরুল্লাহ পাঠ করে জানা যায়, পারভেজ মোশাররফ নয়, বরং কারগিল অভিযানের মূল  হোতা ছিলেন নর্দান এরিয়ার কমান্ডার মেজর জেনারেল জাভেদ হাসান। যিনি কোর কমান্ডার, রাওয়ালপিন্ডি, জেনারেল মাহমুদকে সাথে নিয়ে আর্মি চিফ জেনারেল মোশাররফকে কারগিল অভিযানের জন্য রাজি করান। জেনারেল মাহমুদ History of Indo-Pak War 1965   নামে একটি গ্রন্থও লিখেছেন। এই গ্রন্থে তিনি ১৯৬৫-এর আগস্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এই অপারেশনের চূড়ান্ত পরিকল্পনা রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেডকোয়ার্টারে (জিএইচকিউ) হয়েছিল। আর্মি চিফ নারেল মুসা অপারেশনের সফলতার ব্যাপারে এতই দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন যে, এয়ারফোর্সের সহায়তা নেয়ার কোনো প্রয়োজনই মনে করলেন না। আজাদ কাশ্মির রেজিমেন্টের পাঁচ হাজার জওয়ানকে দশটি গ্র“পে ভাগ করে দখলকৃত কাশ্মিরে প্রবেশ করানো হয়। এই গ্র“পগুলো কারগিল থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মিরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো দখল করেই নিয়েছিল। কিন্তু কারগিলের দিকে অগ্রসরমান তারেক বাহিনীর কমান্ডার মেজর সিকান্দার ১৭ হাজার ফুট উঁচু টিলার ওপর শত্র“সেনার পরিবর্তে মওসুমের নির্দয়তার হাতেই বন্দী হয়ে পড়েন এবং ব্যর্থ হয়ে ফেরত চলে আসেন। শ্রীনগরের দিকে অগ্রসরমান সালাহুদ্দিন বাহিনীর কমান্ডার মেজর মানশা খানের সমস্যা ছিল, তাকে স্থানীয় জনগণ মোটেও সহযোগিতা করেনি। কাশ্মিরি মুসলমানেরা বুঝতেই পারছিল না, এরা কারা? সালাহুদ্দিন বাহিনীর ওপর ভারতীয় সেনাবাহিনী হামলা করে বসে। পাকবাহিনী ব্যাপক আকারে তিগ্রস্ত হয়ে পিছু হটে আসে। চারজন জওয়ান শত্র“র হাতে বন্দী হয়। শুধু মেজর মালিক মুনাওয়ারের কামানে গজনবি বাহিনী জম্মুর কাছে রাজৌরি গ্যারিসন সফলভাবে দখল করে নেয়। জম্মুর মুসলমানেরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল। মেজর মুনাওয়ার অসংখ্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক পেয়েছিলেন। এই ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এর কারণে ভারত ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে হামলা চালায়। এই যুদ্ধ ১৭ দিন স্থায়ী হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর মেজর মুনাওয়ারকে ফিরে আসতে বলা হলো। মেজর মুনাওয়ার ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বার্তা পাঠান, ‘যদি তিনি ফিরে আসেন তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনী রাজৌরি ও জম্মুর মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ নেবে।’ জেনারেল আইয়ুব খান এই বার্তার প্রতি কোনো ভ্রƒপেই করলেন না। শৃঙ্খলার অধীনে গজনবি বাহিনী ফিরে আসে। এরপর ভারতের সেনাবাহিনী পাকিস্তানিদের সহায়তাকারী স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের পরিবারের মেয়েদের খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে যায়। বৃদ্ধ মহিলাদের হাত পুড়িয়ে দেয়া হয়। কেননা তারা এই হাত দিয়ে পাকিস্তানিদের রুটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। তরুণীদের সাথে আরো খারাপ ব্যবহার করা হয়। রাজৌরি, পুঞ্চ ও জম্মুর ১৭ শ’ তরুণী ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি। আশ্চর্যের বিষয়, জেনারেল মাহমুদ তার গ্রন্থে নিজেই ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এর ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ করেছেন, অথচ তিনি নিজেই ভুল থেকে শিা গ্রহণ না করে কারগিল অপারেশনে জড়িয়ে পড়েন।

কারগিল অপারেশনের আরো প্রকৃত তথ্য সামনে আসার পর কারগিলের ওপর জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের দাবি উঠছে। এদাবি যথার্থ। তবে কমিশনকে এ বিষয়টা অবশ্যই যাচাই করতে হবে, কারগিল অপারেশনের মতো ভুলের পুনরাবৃত্তি কেন বারবার ঘটছে? কী কারণে ১৯৪৭ সালে কায়েদে আজমের ওপর ভরসা না করে অপরিকল্পিতভাবে ব্রিগেডিয়ার আকবর খানের তত্ত্বাবধানে উপজাতিদের একটি বাহিনীকে কাশ্মিরে প্রেরণ করা হয়েছিল? বারামুল্লাতে এই বাহিনী তাদের কমান্ডার খুরশিদ আনওয়ারের কমান্ড মানতে অস্বীকার করে এবং লুটপাট শুরু করে দেয়। পাকিস্তানের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জাহেদ চৌধুরী তার পাকিস্তান কি সিয়াসি তারিখ (পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস) গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে লিখেছেন, ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে আফ্রিদি ও মাহসুদ উপজাতির সৈন্যরা বারামুল্লাতে লুটপাট ছাড়া মেয়েদের সম্ভ্রমহানিও করে। তারা জিহাদের নামে নিজেদের কুকর্মে দু’টি দিন পার করেছিল। এই পরিস্থিতিতে ২৭ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে এয়ারফোর্সের মাধ্যমে ভারতীয় বাহিনী শ্রীনগরে অবতরণ করে কাশ্মির নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। উপজাতীয় বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর মোকাবেলা না করে পালাতে থাকে। এভাবেই কাশ্মিরে ভারতের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রখ্যাত কাশ্মিরি গবেষক জি এম মির তার কিশওয়ারে কাশ্মির কি পাঁচ হাজার সালা তারিখ  (কাশ্মির রাজ্যের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস) গ্রন্থে লিখেছেন, কাশ্মিরের অমুসলিম মহারাজা হরিসিং এবং কায়েদে আজমের মাঝে ভুপালের নওয়াবের মাধ্যমে সমস্ত বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গিয়েছিল। লর্ড মাউন্টব্যাটেন কাশ্মিরকে ভারতের সাথে সংযুক্ত করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু মহারাজা হরিসিং প্রস্তুত ছিলেন কাশ্মিরকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে। কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত রামচাঁদ কাকও মহারাজা হরিসিংয়ের সাথে ছিলেন। কিন্তু উপজাতিগুলোর বাহিনীর কর্মকাণ্ড কায়েদে আজমের সব প্রচেষ্টা ধূলিসাৎ করে দেয়। অতঃপর কায়েদে আজম তার বাহিনীর ইংরেজ প্রধান জেনারেল গ্রেসিকে শ্রীনগর থেকে ভারতীয় বাহিনীকে বের করে দিতে বললেন। কিন্তু জেনারেল এ ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করলেন।

উপজাতীয়দের বাহিনীকে কাশ্মিরে প্রেরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল সেনাসদর  জিএইচকিউতে, কারগিল অপারেশনও ছিল জিএইচকিউ-এর তৈরি ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এর পুনর্মঞ্চায়ন। এই পরিকল্পনাকারীদের নিয়ে লক্ষ্য আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। তবে অগোছাল পরিকল্পনা কাশ্মির সমস্যাকে আরো ঘনীভূত করেছে। আমরা প্রতি বছর ৫ ফেব্র“য়ারি কাশ্মিরিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে পুরো পাকিস্তানে ছুটি পালন করি। এতে কাশ্মিরিদের কী লাভ? এ ছুটির পরিবর্তে যদি ৫ ফেব্র“য়ারি পাকিস্তানের শিাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি দফতরগুলোতে কাশ্মির সমস্যার ওপর সেমিনার ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে কতই না ভালো হতো! পাকিস্তানি জনগণকে বলা হোক, এ অঞ্চলের সব নদীর পানি কাশ্মির থেকে আসে। ভারত সিন্ধু-তাস চুক্তি লঙ্ঘন করে সিন্ধুতে ড্যাম নির্মাণ করছে। সিন্ধু নদ শুকিয়ে গেলে অর্ধেক পাকিস্তান শুকিয়ে যাবে। সিন্ধু নদের বেঁচে থাকা আর কাশ্মিরের স্বাধীনতা একে অন্যের সম্পূরক। কিন্তু আমরা কি কাশ্মিরিদের খাঁটি বন্ধু? যদি পাকিস্তানের শাসকেরা বাস্তবে কাশ্মিরিদের একনিষ্ঠ খাঁটি বন্ধু হয়ে থাকেন, তাহলে বারবার তাদের সাথে এই তামাশা কেন? বন্ধ করা হোক এই তামাশা। তাদের নামে ছুটি পালনের পরিবর্তে বাস্তবমুখী কার্যকর কাশ্মির পলিসি গঠন করা হোক।

পাকিস্তানের দৈনিক জং ৪ ফেব্র“য়ারি ২০১৩

উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক: পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
       

No comments

Powered by Blogger.