আইনের শাসন যখন শক্তির শাসন by আলমগীর মহিউদ্দিন
চার পাশের, এমনকি বিশ্বের চলমান ঘটনাপ্রবাহ প্রতিদিনকে বোদ্ধা মানুষদের
কাছে ক্রমেই অর্থহীন করে তুলছে। এমন একটি দিন নেই যখন হৃদয়বিদারক,
অগ্রহণীয় ও অনৈতিক ঘটনা ঘটেছে না।
শুধু
বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার দিকে একটু দৃকপাত করলেই এ ঘটনাপ্রবাহের ভয়াবহতা
অনুভব করা যায়, যদিও এটা খণ্ডচিত্র মাত্র। গুম, খুন, ধর্ষণ, দখল, অবিচার,
কুবিচার, মিথ্যাকথন, অপবাদ, অপপ্রচার, হানাহানি, সংঘর্ষসহ এমন কোনো অসম্ভব
ঘটনা নেই, যা কোনো-না-কোনোটি সংঘটিত হচ্ছে না। অথচ এসব ঘটনাপ্রবাহের
প্রণেতা স্বল্পসংখ্যক মানুষ বলে পরিচিত অমানুষ। এরা এমনটি করতে পারছে কারণ
এরা ক্ষমতাবান, কখনো গোষ্ঠীগতভাবে, কখনোবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলে। এ
ঘটনাপ্রবাহগুলো সমাজের সাধারণ মানুষদের শুধু স্তম্ভিতই করছে না, তাদের এক
ভয়ের সাগরে ঠেলে দিয়েছে। সেখানে এরা নিয়তির বিধান বলে সব প্রতিবাদ,
আত্মরক্ষা অথবা সংগঠনের ইচ্ছাটাও হারিয়ে ফেলেছে।
এই স্বল্পসংখ্যক শক্তিশালী মানুষ শুধু একটি বিষয়ের পেছনে নিরন্তর ঘুরছে। তা হলো মুনাফা। এবং এই মুনাফার জন্য তাদের প্রয়োজন হচ্ছে ক্ষমতা। তাই সমাজ এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চিন্তার রাজ্যের যতগুলো পন্থা আছে তার ব্যবহার করছে অবিরাম। এবং এরা সতর্ক যেন সমাজের এবং রাষ্ট্রের বিশাল জনগোষ্ঠী কোনো ক্রমেই সংগঠিত হতে না পারে, আর প্রতিবাদ বা অন্যায়ের আলোচনাও যেন সে লক্ষ্যে না হয়। বিশেষ করে তারা তাদের অধিকার নিয়ে না ভাবতে পারে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের জন্য। তাদের জীবনধারণের জন্য সহজ এবং নিরাপদব্যবস্থা সৃষ্টি করে। এই মুনাফালোভীরা অনুভব করল জনগণকে এই সহজ ও নিরাপদ জীবনের আশ্বাস দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের অধিকারটাই হলো তাদের শোষণের প্রধান হাতিয়ার। তাদের ভাবনার ফলশ্রুতি হলো ভয়ের রাজত্বের সৃষ্টি। এরা জানে ভীত ও যন্ত্রণাকিষ্ট মানুষ অতি সহজেই আত্মসমর্পণ করে। মার্কিনি লেখক করি রবিন নিউ ইয়র্কের জ্যাকোবিন সাহিত্য ম্যাগাজিনে ‘ল্যাংগুয়েজ অব ফিয়ার : সিকিউরিটি অ্যান্ড মডার্ন পলিটিক্স’ নিবন্ধে এসব মুনাফাখোরদের সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এরা খানিকটা আন্তর্জাতিক। এরা নানা বর্ণে বিস্তৃত এবং একে অপরকে এ বিষয়ে সহায়তা করে থাকে। এদের কাছে সর্বশেষ যে কর্মকাণ্ডটি সবচেয়ে বেশি ফলদায়ক হয়েছে তা হলো ‘নিরাপত্তাকে’ ঘিরে। এরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সমাজের নিরাপত্তা অথবা জাতির নিরাপত্তার নামে অসম্ভব সব ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। অবশ্য এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষের যেন কোনো না অধিকারই থাকে, সে গণতন্ত্রী হোক না কেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিরাপত্তার বিষয়টি তারাই নির্ধারণ করছে। আর এর সংজ্ঞা নিরূপণে জনগণ এমনকি বোদ্ধাজনদেরও কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারাই ঠিক করছে কোন কথাটি, কোন ভবিষ্যতের ঘটনাটি নিরাপত্তার প্রতি হুমকি। জনগণ তা হুমকি বা বিপজ্জনক মনে করে কি না, সে বিষয়টি একেবারে গৌণ। আসলে এই শোষক মুনাফাখোরেরা কখনো শাসকের লেবাসে বা কখনো তাদের দোসর হিসেবে এই নিরাপত্তার নামে জনজীবনকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। করি রবিন মন্তব্য করেছেন, ‘এরা নিরাপত্তা বলতে বুঝে তাদের শাসন ও শোষণের সুরক্ষিত স্থায়িত্ব।’ তাই তাদের কর্মকাণ্ডকে যে প্রতিহত করতে পারে অথবা যারা প্রতিবাদ করবে, তাদের নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে। এদের বিরুদ্ধে তখন রাষ্ট্রীয়, দলীয় বা ব্যক্তিগত কর্মসূচি নেয় এসব বাধাকে নির্মূল করতে। এর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নে, যেখানে শক্তির শোষণ আইনের শাসনকে প্রতিস্থাপন করে। প্রায়ই এর জন্য অনৈতিক আইনও করে। যখন আইনের শাসন হয় শক্তির শাসন, তখন সোভিয়েত গুলাগের মতো মানুষ নিজেদের ভুলতে থাকে। তবে বিভিন্ন দেশে এ কর্মকাণ্ডের প্রকাশ বিভিন্নভাবে। ‘উন্নত দেশে’ একধরনের আর তৃতীয় বিশ্বে খানিকটা অমার্জিত। যেমন প্রতিপক্ষকে গুম করা অথবা বহুল আলোচিত পদ্ধতি ‘এনকাউন্টারে’ নির্মূল করা। কখনো রাজনৈতিক সংঘাত ও সংঘর্ষের সৃষ্টি করে প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষকে হত্যা করা। এ হত্যাকাণ্ডগুলো কখনো দলীয় অথবা রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারীদের দিয়েও করানো হয়। কবি রবিন তার অনুসন্ধানে দেখিয়েছেন, এই নিরাপত্তার অজুহাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস এবং বিনাশ হয়েছে। কোনো মতাদর্শ (আইডিওলজি) বা ধর্মীয় কারণে এমন ধ্বংস ও বিনাশ হয়নি। বিখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক জন ডান এবং বার্নাড উইলিয়ামস বলেছেন, যেহেতু জনগণের সর্বপ্রকার নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তাই এই ক্ষমতাসীন মুনাফাখোরেরা এই ‘নিরাপত্তা’ বিষয়টি জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সবচেয়ে সহজ পন্থা হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের প্রতিপক্ষকে নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে নির্মূল কর্মকাণ্ড শুরু করে। এমনকি প্রকাশ্যে তারা ‘নির্মূল’ কথাটিও ব্যবহার করতেও দেখা যায়। এ জন্য তারা ব্যাপক ভীতির রাজ্য কায়েম করে। আসলে নিরাপত্তার নামে জনগণের অধিকার হরণ এবং প্রতিপক্ষকে নির্মূলকরণ সবচেয়ে সহজ।
অবশ্য ক্ষমতাবানেরা সামাজিক অস্থিরতার কর্মকাণ্ডটি গ্রহণ করে তাদের শেষ অবস্থানে। যখন তারা অনুভব করতে শুরু করে, জনগণ তাদের তথাকথিত দেশভক্তিমূলক কথাবার্তা ও নিরাপত্তার বক্তব্যে সন্দেহ করছে। প্রয়োজনীয় ত্যাগে সাড়া দিচ্ছে না, তখনি সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই নির্মূল কর্মকাণ্ড গ্রহণ করে। যেমন কোনো বক্তব্য, কোনো প্রতিবাদীর সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য বক্তব্যও নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিশেষ করে এ বক্তব্য যদি এই লুটেরা গোষ্ঠীর নেকাবের একটি প্রলেপও খুলে দেয়। তখনই দেখা যায় এই ‘নিরাপত্তা’ নিয়ে ক্ষমতাবানদের কী প্রচণ্ড কর্মতৎপরতা। অথচ বোদ্ধাজনদের বক্তব্যে জনগণের অধিকার বা যন্ত্রণার বক্তব্যগুলো খণ্ডনের চেষ্টা কখনো করে না। এর অন্যতম কারণ এসবের পেছনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতিই প্রধান। আর এ বিষয়টি থেকে জনগণের মনোযোগ ফেরাতেই এমন কর্মতৎপরতা। যেমন কোনো প্রতিপক্ষ বা প্রতিবাদী যদি জনগণের যন্ত্রণা ও অধিকার নিয়ে বক্তব্য দেন বা কোনো প্রবন্ধ লেখেন, এবং তা ক্ষমতাবানদের কর্মকাণ্ডে সত্যিকারের চিত্রের একাংশও প্রকাশ পায়, তারা এটা ঢাকতে সেই প্রতিপক্ষ বা প্রতিবাদীকে রাষ্ট্রদ্রোহীর দোষারোপে তণি আপ্লুত করে। এমনকি হাস্যকর বিচারের মাঝ দিয়ে প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়। দেখা যায়, নিয়ন্ত্রিত বিচারালয় দিয়ে প্রতিপক্ষকে, বিশেস করে যারা নৈতিকতা সত্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলছে, ফাঁসি, কারাদণ্ড দিয়ে একদিকে ভীতির রাজ্য কায়েম করছে, অন্য দিকে বাধা অপসারণের চেষ্টা করছে। তবে এটা নতুন নয়। জার্মানির হিটলার এ পন্থাগুলো নিপুণভাবে অনুসরণ করেছে। হিটলার সংবাদমাধ্যম, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং শিক্ষাকে দখল করে তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি দৃষ্টান্ত ছিল বিচারব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় শান্তিরক্ষা বাহিনীকে একযোগে ব্যবহার। সে এক দিকে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে শারীরিকভাবে অপসারণ করত, অপর পক্ষে বিচারালয়ের মাধ্যমে এ কাজের সমর্থন নেয়া হতো। অন্য কথায় গুম, হত্যা বা সামাজিক সংঘর্ষের দায়িত্ব প্রতিপক্ষের অপর চাপিয়ে নির্বিঘেœ সে কাজগুলো নিজেরাই সম্পন্ন করত। এ জন্য নিত্যনতুন আইনও তৈরি করা হয়। হিটলার সংবাদমাধ্যমগুলোকে তার প্রচারণার হাতিয়ার বানিয়ে নেয়। এর ফলে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে পড়ে। অর্থাৎ নিষ্ঠুরতার প্রাতিষ্ঠানিকতা এমনভাবেই আধুনিক তথাকথিত আলোকিত জগতে পেল। এ জন্যই কোথাও কোনো অঘটন ঘটলেই এখন প্রথম সন্দেহের দৃষ্টি যায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দিকে। এ সন্দেহ তখন আরো দৃঢ় হয় যখন দেখা যায় সরকারি অনুসন্ধান স্লথ বা সরকারের দায়িত্বশীলেরা এ ব্যাপারে বিস্ময়কর বক্তব্য দিচ্ছে। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান ও তার মন্ত্রীরা এমন অনৈতক বেআইনি বক্তব্য দিচ্ছে তা শুনতেও লজ্জা পাচ্ছে। যেমন তাদের নিয়ন্ত্রিত বিচারক একটি শাস্তি দিলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কিন্তু জনগণকে আসল সমস্যা ভুলে থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে রাস্তাঘাট দলীয় কর্মীদের দিয়ে দখল করে বিশাল প্রচারণার অবতারণা করলো। তা যে তাদের জনগণের কাছে আরো অগ্রহণীয় করে তুলছে, তা তাড়া মানতে চাইছে না। এটা সবাই হিটলারকে নিন্দা করে, তবে অনুসরণ করে তাকে মনেপ্রাণে। অবশ্য প্রযুক্তির উন্নতির কারণে এই হিটলারি নিষ্ঠুরতা পরিশীলিত হচ্ছে। এখন কোনো বিষয় নিয়েই, বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো নিরপেক্ষ আলোচনা করাও সম্ভব নয়। সবচেয়ে মজার মন্তব্য করেছেন সাবেক মার্কিন সহকারী অর্থমন্ত্রী পল ক্রেইগ রবার্টস। তিনি অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে বললেও তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সারা বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে। তিনি বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সত্যের কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে?’ তিনি এ মন্তব্যটি করেছেন কয়েকজন ‘হুইসিল ব্লোয়ারদের’ (সত্যকথকদের) সম্পর্কে লিখতে গিয়ে। এরা উইকিলিকসকে মার্কিনি অপকর্মের কথা ফাঁস করে দেয়। এদের ওপর যে অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে তা অতুলনীয়। এমনকি সরকারের বিশ্বস্ত কেউও যদি কিছু সত্য বলে থাকে তাকেও এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যেমন মেজর জেনারেল আন্তনীয় তাগুবার অবস্থা। বিশ্ব সমালোচনার প্রেক্ষিতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আবু গ্রাইব জেলে কয়েদিদের অপর অত্যাচার করা হয় কি না, তা অনুসন্ধান করে সরকারের কাছে রিপোর্ট করতে। সরকার আশা করেছিল জেনারেল হিসেবে তিনি অপকর্মের কাহিনীটা চেপে যাবেন। অথচ জেনারেল তাগুবা একটি পেশাগত চমৎকার সত্য রিপোর্ট দেন। রবার্টস লিখেছেন, ‘এত ভালো কাজের জন্য তাগুবার পদোন্নতি না করে, তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এটা অহরহ ঘটছে। এভাবে সত্যিকারের মানবসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। অথচ এই সত্য-কথনে মানবতা, মানুষ এবং রাষ্ট্র উপকৃত হয় এবং সামনে এগিয়ে চলে। কারণ এই মানবসম্পদ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং সত্য বলতে অভ্যস্ত।’ রবার্টস বলেছেন, ‘এর ফলে সব সরকারের সত্য বলার লোক কমে যাচ্ছে। কারণ সত্য বললে পদ, যোগাযোগ, আর সামাজিক জীবন এবং এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারটুকু হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।’ আলজাজিরার অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর শুরু হয়েছিল সত্য কথনের মাঝ দিয়ে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয় নিয়ে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্ব নিয়ে যে গল্প ফাঁদে তার পরিষ্কার চিত্র উপস্থাপনার জন্য। দেখা গেল সে দেশের সরকার এবং মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা শক্তিবর্গ আলজাজিরাকে ধমক দিচ্ছে, সেন্সর করছে এবং একপর্যায়ে এর কাবুল এবং বাগদাদ অফিসও আক্রমণের শিকার হলো এবং তাদের সাংবাদিক নিহত হলো। এরপর যা হওয়ার তাই হলো। আলজাজিরা সাবধান হলো এবং পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের বিকৃতিকে অনুসরণ করতে শুরু করল। রবার্টস দেখিয়েছেন কেমনভাবে সত্য অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং বক্তব্যগুলো সরকার বস্তাবন্দী করে রেখে নতুন উদ্যমে অনাচারের রাজ্য কায়েমের চেষ্টা করে। তিনি একটি উদাহরণ দিয়েছেন। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশনকে বন্ধ করার জন্য মামলা করা হয়, তখন দেখা যায় এই চ্যারিটিটি ইউএসএইড এবং জাতিসঙ্ঘের অনুমোদিত প্যালেস্টাইনিদের সাহায্য করছে। এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টেরও অনুমতি আছে। তাই প্রথমবারের মামলায় সরকার হেরে যায়। ইসরাইলের চাপে পড়ে মামলাটি আবার চাঙ্গা হলে, কোর্ট এর বিরুদ্ধে গোপন এবং অজ্ঞাত ‘এক্সপার্ট আইনজ্ঞের’ প্রতিবেদন দেয়ার অনুমতি দেয়। এবং এই বিজ্ঞ ব্যক্তির কোর্টের সামনে আসারও প্রয়োজন পড়ে না। এবং কোর্ট এই হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশনকে বন্ধ করে দেয়ার হুকুম দেয়। রবার্টস বলেছেন, ‘এমনভাবেই সত্যের মৃত্যু হলো এবং অনৈক্যের বিজয় হলো।’ আর বিচারের প্রহসন দিয়ে নিষ্ঠুরতার প্রাতিষ্ঠানিকতার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকল। এ চিত্রগুলো যেন এ দেশের একান্ত। বিশেষ করে ক্রেইগ রবার্টসের বর্ণিত কোর্টের সাম্যের অনৈতিক নতুন পদ্ধতি এবং সরকারের সাথে গাঁটছড়া যে বিচারকে লজ্জা দেয় তার প্রকাশগুলো।
তবে নিরাপত্তার অজুহাতও যদি প্রয়োজনীয় ফল না দেয়, তখন ক্ষমতাবনেরা ‘ঘৃণাকে’ ব্যবহার করে। ঘৃণাকে ব্যবহার করে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। কারণ যুগে যুগে এই ঘৃণার ব্যবহার করে প্রচণ্ড সামাজিক উন্মাদনার সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেটা সেন্টার ফর ননভায়োলেন্সের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মাইকেল ন্যাগলার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘ঘৃণা একটি প্রচণ্ড শক্তি কোনো সন্দেহ নেই, তবে এই ঘৃণাই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যকেও ভেতর থেকেই ধ্বংস করেছে।’ তিনি দুঃখ করে বলেছেন, ‘এখন বিশ্বের মুনাফাখোর ক্ষমতালোভী তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য এই ঘৃণাকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। সেই গ্রিক প্রজ্ঞার কথা এখন সবাই ভুলতে চাইছে।’ যদি কোনো সাম্রাজ্য বা শক্তি তাদের শেষ সময়ে পৌঁছে, তখন সে পাগল হয়ে যায়।’ গোষ্ঠীগতভাবে ক্ষমতাবানেরা এই পাগলামি করতে থাকলে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা হয় ঠিকই, তবে ক্ষমতাবানদের প্রস্থানের পথ নিশ্চিত হতে থাকে।
এই স্বল্পসংখ্যক শক্তিশালী মানুষ শুধু একটি বিষয়ের পেছনে নিরন্তর ঘুরছে। তা হলো মুনাফা। এবং এই মুনাফার জন্য তাদের প্রয়োজন হচ্ছে ক্ষমতা। তাই সমাজ এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চিন্তার রাজ্যের যতগুলো পন্থা আছে তার ব্যবহার করছে অবিরাম। এবং এরা সতর্ক যেন সমাজের এবং রাষ্ট্রের বিশাল জনগোষ্ঠী কোনো ক্রমেই সংগঠিত হতে না পারে, আর প্রতিবাদ বা অন্যায়ের আলোচনাও যেন সে লক্ষ্যে না হয়। বিশেষ করে তারা তাদের অধিকার নিয়ে না ভাবতে পারে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের জন্য। তাদের জীবনধারণের জন্য সহজ এবং নিরাপদব্যবস্থা সৃষ্টি করে। এই মুনাফালোভীরা অনুভব করল জনগণকে এই সহজ ও নিরাপদ জীবনের আশ্বাস দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের অধিকারটাই হলো তাদের শোষণের প্রধান হাতিয়ার। তাদের ভাবনার ফলশ্রুতি হলো ভয়ের রাজত্বের সৃষ্টি। এরা জানে ভীত ও যন্ত্রণাকিষ্ট মানুষ অতি সহজেই আত্মসমর্পণ করে। মার্কিনি লেখক করি রবিন নিউ ইয়র্কের জ্যাকোবিন সাহিত্য ম্যাগাজিনে ‘ল্যাংগুয়েজ অব ফিয়ার : সিকিউরিটি অ্যান্ড মডার্ন পলিটিক্স’ নিবন্ধে এসব মুনাফাখোরদের সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এরা খানিকটা আন্তর্জাতিক। এরা নানা বর্ণে বিস্তৃত এবং একে অপরকে এ বিষয়ে সহায়তা করে থাকে। এদের কাছে সর্বশেষ যে কর্মকাণ্ডটি সবচেয়ে বেশি ফলদায়ক হয়েছে তা হলো ‘নিরাপত্তাকে’ ঘিরে। এরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সমাজের নিরাপত্তা অথবা জাতির নিরাপত্তার নামে অসম্ভব সব ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। অবশ্য এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষের যেন কোনো না অধিকারই থাকে, সে গণতন্ত্রী হোক না কেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিরাপত্তার বিষয়টি তারাই নির্ধারণ করছে। আর এর সংজ্ঞা নিরূপণে জনগণ এমনকি বোদ্ধাজনদেরও কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারাই ঠিক করছে কোন কথাটি, কোন ভবিষ্যতের ঘটনাটি নিরাপত্তার প্রতি হুমকি। জনগণ তা হুমকি বা বিপজ্জনক মনে করে কি না, সে বিষয়টি একেবারে গৌণ। আসলে এই শোষক মুনাফাখোরেরা কখনো শাসকের লেবাসে বা কখনো তাদের দোসর হিসেবে এই নিরাপত্তার নামে জনজীবনকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। করি রবিন মন্তব্য করেছেন, ‘এরা নিরাপত্তা বলতে বুঝে তাদের শাসন ও শোষণের সুরক্ষিত স্থায়িত্ব।’ তাই তাদের কর্মকাণ্ডকে যে প্রতিহত করতে পারে অথবা যারা প্রতিবাদ করবে, তাদের নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে। এদের বিরুদ্ধে তখন রাষ্ট্রীয়, দলীয় বা ব্যক্তিগত কর্মসূচি নেয় এসব বাধাকে নির্মূল করতে। এর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নে, যেখানে শক্তির শোষণ আইনের শাসনকে প্রতিস্থাপন করে। প্রায়ই এর জন্য অনৈতিক আইনও করে। যখন আইনের শাসন হয় শক্তির শাসন, তখন সোভিয়েত গুলাগের মতো মানুষ নিজেদের ভুলতে থাকে। তবে বিভিন্ন দেশে এ কর্মকাণ্ডের প্রকাশ বিভিন্নভাবে। ‘উন্নত দেশে’ একধরনের আর তৃতীয় বিশ্বে খানিকটা অমার্জিত। যেমন প্রতিপক্ষকে গুম করা অথবা বহুল আলোচিত পদ্ধতি ‘এনকাউন্টারে’ নির্মূল করা। কখনো রাজনৈতিক সংঘাত ও সংঘর্ষের সৃষ্টি করে প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষকে হত্যা করা। এ হত্যাকাণ্ডগুলো কখনো দলীয় অথবা রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারীদের দিয়েও করানো হয়। কবি রবিন তার অনুসন্ধানে দেখিয়েছেন, এই নিরাপত্তার অজুহাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস এবং বিনাশ হয়েছে। কোনো মতাদর্শ (আইডিওলজি) বা ধর্মীয় কারণে এমন ধ্বংস ও বিনাশ হয়নি। বিখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক জন ডান এবং বার্নাড উইলিয়ামস বলেছেন, যেহেতু জনগণের সর্বপ্রকার নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তাই এই ক্ষমতাসীন মুনাফাখোরেরা এই ‘নিরাপত্তা’ বিষয়টি জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সবচেয়ে সহজ পন্থা হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের প্রতিপক্ষকে নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে নির্মূল কর্মকাণ্ড শুরু করে। এমনকি প্রকাশ্যে তারা ‘নির্মূল’ কথাটিও ব্যবহার করতেও দেখা যায়। এ জন্য তারা ব্যাপক ভীতির রাজ্য কায়েম করে। আসলে নিরাপত্তার নামে জনগণের অধিকার হরণ এবং প্রতিপক্ষকে নির্মূলকরণ সবচেয়ে সহজ।
অবশ্য ক্ষমতাবানেরা সামাজিক অস্থিরতার কর্মকাণ্ডটি গ্রহণ করে তাদের শেষ অবস্থানে। যখন তারা অনুভব করতে শুরু করে, জনগণ তাদের তথাকথিত দেশভক্তিমূলক কথাবার্তা ও নিরাপত্তার বক্তব্যে সন্দেহ করছে। প্রয়োজনীয় ত্যাগে সাড়া দিচ্ছে না, তখনি সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই নির্মূল কর্মকাণ্ড গ্রহণ করে। যেমন কোনো বক্তব্য, কোনো প্রতিবাদীর সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য বক্তব্যও নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিশেষ করে এ বক্তব্য যদি এই লুটেরা গোষ্ঠীর নেকাবের একটি প্রলেপও খুলে দেয়। তখনই দেখা যায় এই ‘নিরাপত্তা’ নিয়ে ক্ষমতাবানদের কী প্রচণ্ড কর্মতৎপরতা। অথচ বোদ্ধাজনদের বক্তব্যে জনগণের অধিকার বা যন্ত্রণার বক্তব্যগুলো খণ্ডনের চেষ্টা কখনো করে না। এর অন্যতম কারণ এসবের পেছনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতিই প্রধান। আর এ বিষয়টি থেকে জনগণের মনোযোগ ফেরাতেই এমন কর্মতৎপরতা। যেমন কোনো প্রতিপক্ষ বা প্রতিবাদী যদি জনগণের যন্ত্রণা ও অধিকার নিয়ে বক্তব্য দেন বা কোনো প্রবন্ধ লেখেন, এবং তা ক্ষমতাবানদের কর্মকাণ্ডে সত্যিকারের চিত্রের একাংশও প্রকাশ পায়, তারা এটা ঢাকতে সেই প্রতিপক্ষ বা প্রতিবাদীকে রাষ্ট্রদ্রোহীর দোষারোপে তণি আপ্লুত করে। এমনকি হাস্যকর বিচারের মাঝ দিয়ে প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়। দেখা যায়, নিয়ন্ত্রিত বিচারালয় দিয়ে প্রতিপক্ষকে, বিশেস করে যারা নৈতিকতা সত্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলছে, ফাঁসি, কারাদণ্ড দিয়ে একদিকে ভীতির রাজ্য কায়েম করছে, অন্য দিকে বাধা অপসারণের চেষ্টা করছে। তবে এটা নতুন নয়। জার্মানির হিটলার এ পন্থাগুলো নিপুণভাবে অনুসরণ করেছে। হিটলার সংবাদমাধ্যম, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং শিক্ষাকে দখল করে তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি দৃষ্টান্ত ছিল বিচারব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় শান্তিরক্ষা বাহিনীকে একযোগে ব্যবহার। সে এক দিকে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে শারীরিকভাবে অপসারণ করত, অপর পক্ষে বিচারালয়ের মাধ্যমে এ কাজের সমর্থন নেয়া হতো। অন্য কথায় গুম, হত্যা বা সামাজিক সংঘর্ষের দায়িত্ব প্রতিপক্ষের অপর চাপিয়ে নির্বিঘেœ সে কাজগুলো নিজেরাই সম্পন্ন করত। এ জন্য নিত্যনতুন আইনও তৈরি করা হয়। হিটলার সংবাদমাধ্যমগুলোকে তার প্রচারণার হাতিয়ার বানিয়ে নেয়। এর ফলে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে পড়ে। অর্থাৎ নিষ্ঠুরতার প্রাতিষ্ঠানিকতা এমনভাবেই আধুনিক তথাকথিত আলোকিত জগতে পেল। এ জন্যই কোথাও কোনো অঘটন ঘটলেই এখন প্রথম সন্দেহের দৃষ্টি যায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দিকে। এ সন্দেহ তখন আরো দৃঢ় হয় যখন দেখা যায় সরকারি অনুসন্ধান স্লথ বা সরকারের দায়িত্বশীলেরা এ ব্যাপারে বিস্ময়কর বক্তব্য দিচ্ছে। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান ও তার মন্ত্রীরা এমন অনৈতক বেআইনি বক্তব্য দিচ্ছে তা শুনতেও লজ্জা পাচ্ছে। যেমন তাদের নিয়ন্ত্রিত বিচারক একটি শাস্তি দিলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কিন্তু জনগণকে আসল সমস্যা ভুলে থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে রাস্তাঘাট দলীয় কর্মীদের দিয়ে দখল করে বিশাল প্রচারণার অবতারণা করলো। তা যে তাদের জনগণের কাছে আরো অগ্রহণীয় করে তুলছে, তা তাড়া মানতে চাইছে না। এটা সবাই হিটলারকে নিন্দা করে, তবে অনুসরণ করে তাকে মনেপ্রাণে। অবশ্য প্রযুক্তির উন্নতির কারণে এই হিটলারি নিষ্ঠুরতা পরিশীলিত হচ্ছে। এখন কোনো বিষয় নিয়েই, বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো নিরপেক্ষ আলোচনা করাও সম্ভব নয়। সবচেয়ে মজার মন্তব্য করেছেন সাবেক মার্কিন সহকারী অর্থমন্ত্রী পল ক্রেইগ রবার্টস। তিনি অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে বললেও তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সারা বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে। তিনি বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সত্যের কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে?’ তিনি এ মন্তব্যটি করেছেন কয়েকজন ‘হুইসিল ব্লোয়ারদের’ (সত্যকথকদের) সম্পর্কে লিখতে গিয়ে। এরা উইকিলিকসকে মার্কিনি অপকর্মের কথা ফাঁস করে দেয়। এদের ওপর যে অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে তা অতুলনীয়। এমনকি সরকারের বিশ্বস্ত কেউও যদি কিছু সত্য বলে থাকে তাকেও এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যেমন মেজর জেনারেল আন্তনীয় তাগুবার অবস্থা। বিশ্ব সমালোচনার প্রেক্ষিতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আবু গ্রাইব জেলে কয়েদিদের অপর অত্যাচার করা হয় কি না, তা অনুসন্ধান করে সরকারের কাছে রিপোর্ট করতে। সরকার আশা করেছিল জেনারেল হিসেবে তিনি অপকর্মের কাহিনীটা চেপে যাবেন। অথচ জেনারেল তাগুবা একটি পেশাগত চমৎকার সত্য রিপোর্ট দেন। রবার্টস লিখেছেন, ‘এত ভালো কাজের জন্য তাগুবার পদোন্নতি না করে, তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এটা অহরহ ঘটছে। এভাবে সত্যিকারের মানবসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। অথচ এই সত্য-কথনে মানবতা, মানুষ এবং রাষ্ট্র উপকৃত হয় এবং সামনে এগিয়ে চলে। কারণ এই মানবসম্পদ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং সত্য বলতে অভ্যস্ত।’ রবার্টস বলেছেন, ‘এর ফলে সব সরকারের সত্য বলার লোক কমে যাচ্ছে। কারণ সত্য বললে পদ, যোগাযোগ, আর সামাজিক জীবন এবং এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারটুকু হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।’ আলজাজিরার অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর শুরু হয়েছিল সত্য কথনের মাঝ দিয়ে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয় নিয়ে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্ব নিয়ে যে গল্প ফাঁদে তার পরিষ্কার চিত্র উপস্থাপনার জন্য। দেখা গেল সে দেশের সরকার এবং মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা শক্তিবর্গ আলজাজিরাকে ধমক দিচ্ছে, সেন্সর করছে এবং একপর্যায়ে এর কাবুল এবং বাগদাদ অফিসও আক্রমণের শিকার হলো এবং তাদের সাংবাদিক নিহত হলো। এরপর যা হওয়ার তাই হলো। আলজাজিরা সাবধান হলো এবং পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের বিকৃতিকে অনুসরণ করতে শুরু করল। রবার্টস দেখিয়েছেন কেমনভাবে সত্য অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং বক্তব্যগুলো সরকার বস্তাবন্দী করে রেখে নতুন উদ্যমে অনাচারের রাজ্য কায়েমের চেষ্টা করে। তিনি একটি উদাহরণ দিয়েছেন। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশনকে বন্ধ করার জন্য মামলা করা হয়, তখন দেখা যায় এই চ্যারিটিটি ইউএসএইড এবং জাতিসঙ্ঘের অনুমোদিত প্যালেস্টাইনিদের সাহায্য করছে। এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টেরও অনুমতি আছে। তাই প্রথমবারের মামলায় সরকার হেরে যায়। ইসরাইলের চাপে পড়ে মামলাটি আবার চাঙ্গা হলে, কোর্ট এর বিরুদ্ধে গোপন এবং অজ্ঞাত ‘এক্সপার্ট আইনজ্ঞের’ প্রতিবেদন দেয়ার অনুমতি দেয়। এবং এই বিজ্ঞ ব্যক্তির কোর্টের সামনে আসারও প্রয়োজন পড়ে না। এবং কোর্ট এই হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশনকে বন্ধ করে দেয়ার হুকুম দেয়। রবার্টস বলেছেন, ‘এমনভাবেই সত্যের মৃত্যু হলো এবং অনৈক্যের বিজয় হলো।’ আর বিচারের প্রহসন দিয়ে নিষ্ঠুরতার প্রাতিষ্ঠানিকতার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকল। এ চিত্রগুলো যেন এ দেশের একান্ত। বিশেষ করে ক্রেইগ রবার্টসের বর্ণিত কোর্টের সাম্যের অনৈতিক নতুন পদ্ধতি এবং সরকারের সাথে গাঁটছড়া যে বিচারকে লজ্জা দেয় তার প্রকাশগুলো।
তবে নিরাপত্তার অজুহাতও যদি প্রয়োজনীয় ফল না দেয়, তখন ক্ষমতাবনেরা ‘ঘৃণাকে’ ব্যবহার করে। ঘৃণাকে ব্যবহার করে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। কারণ যুগে যুগে এই ঘৃণার ব্যবহার করে প্রচণ্ড সামাজিক উন্মাদনার সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেটা সেন্টার ফর ননভায়োলেন্সের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মাইকেল ন্যাগলার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘ঘৃণা একটি প্রচণ্ড শক্তি কোনো সন্দেহ নেই, তবে এই ঘৃণাই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যকেও ভেতর থেকেই ধ্বংস করেছে।’ তিনি দুঃখ করে বলেছেন, ‘এখন বিশ্বের মুনাফাখোর ক্ষমতালোভী তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য এই ঘৃণাকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। সেই গ্রিক প্রজ্ঞার কথা এখন সবাই ভুলতে চাইছে।’ যদি কোনো সাম্রাজ্য বা শক্তি তাদের শেষ সময়ে পৌঁছে, তখন সে পাগল হয়ে যায়।’ গোষ্ঠীগতভাবে ক্ষমতাবানেরা এই পাগলামি করতে থাকলে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা হয় ঠিকই, তবে ক্ষমতাবানদের প্রস্থানের পথ নিশ্চিত হতে থাকে।
No comments