কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
জয় বাংলা এবং সাতই মার্চ বলতে গেলে সমার্থক। একাত্তরের পুণ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে যদি বাংলাদেশের দিকে তাকাই, তবে এটাই সত্য বলে মেনে নিতে হয়। সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী ভাষণের শেষে উচ্চারিত জয় বাংলা নিছক একটি স্লোগান ছিল না, ছিল বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এবং মুক্তির চেতনাবাহী অভয়মন্ত্র।
ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে স্বপ্নজাগানিয়া জয়ধ্বনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে জয় বাংলা ধ্বনিই ছিল আমাদের সব কর্মযজ্ঞের সার্বক্ষণিক সাথি। কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক সংস্কৃতিতেও জয় বাংলা হয়ে উঠেছিল আমাদের সম্ভাষণের ভাষা, পারস্পরিক যোগাযোগের অন্যতম হার্দিক প্রকাশভঙ্গি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। সেখানে আমাদের পরিচয় ছিল জয় বাংলার মানুষ হিসেবে। আমাদের প্রবাসী সরকারকেও জয় বাংলা সরকার বলা হতো। তার মানে একাত্তরে জয় বাংলা হয়ে উঠেছিল আমাদের অন্যতম আইডেন্টিটি। পরিচিতির পবিত্র অনুষঙ্গ।
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে স্বভাবতই ধরে নেওয়া গিয়েছিল যে জয় বাংলা হবে আমাদের সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত সম্ভাষণ। আমরা পরস্পরকে জয় বাংলা বলে সাদরে আমন্ত্রণ ও গ্রহণ করব। আবার বিদায়ও জানাব একই সম্ভাষণে। পারিবারিক সংস্কৃতিতেও এই মধুর সম্ভাষণটি হয়ে উঠবে আমাদের নিত্যসঙ্গী। মহান ভাষা-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা পথে অর্জিত স্বাধীন বাঙালির একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ও বিশুদ্ধ বাংলা সম্ভাষণ তো জয় বাংলাই। জয় বাংলার গূঢ় চেতনাতেই তো একাত্তরে সব বিভেদের ঊধর্ে্ব উঠে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল একটি জাতি নতুন ইতিহাস গড়ার লক্ষ্যে। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যাপারটি আর সে রকম থাকল না। অনেক কিছুর মতো জয় বাংলাও দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। সে তখন একমাত্র আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্লোগান। কেন জয় বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন গবেষক। সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র হয়তো ছিল; কিন্তু তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টাও তো খুব একটা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালে আওয়ামী লীগের কয়জন নেতা স্বাভাবিক জীবনচর্চায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই সম্ভাষণটি নিয়মিত ব্যবহার করেছেন! আমাদের স্থানীয় নেতা মরহুম ইমাম উদ্দিন আহমদকে দেখতাম পথ চলতে কিংবা ঘরোয়া পরিবেশেও জয় বাংলা সম্ভাষণ উচ্চারণ করতেন। পঁচাত্তরের ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পর সম্ভাষণটিকে জাতীয় ও সামাজিক জীবন থেকে প্রায় নিশ্চিহ্নই করে দেওয়ার চেষ্টা হলো। ফিরে এল পাকিস্তানি জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ বেতার যেমন রাতারাতি রেডিও বাংলাদেশ। এ রকম উদাহরণ আরো দেওয়া যেতে পারে। বাংলার চিরায়ত দর্শন ও আবহমান অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বিনষ্টের অংশ হিসেবে জয় বাংলাকেও বলি দেওয়ার চেষ্টা করা হলো জাতীয় ও সামাজিক পর্যায়ে। জয় বাংলা উচ্চারণ করা যেন তখন মহাপাপ এবং সেটা বিধর্মী সংস্কৃতির অংশ। সেই দুঃসময়ে নমস্য ওয়াহিদুল হককে দেখেছি আওয়ামী লীগার না হয়েও জয় বাংলা সম্ভাষণকে তাঁর সব কর্মে এবং প্রাত্যহিক জীবনে, হৃদয়ে এবং মুখে রেখেছেন। এ রকম শুদ্ধ মানুষ হয়তো আরো ছিলেন এবং আছেনও। আর এখন তো এমন দাঁড়িয়েছে যে আওয়ামী লীগের মিটিং মিছিল ছাড়া জয় বাংলা উচ্চারণ অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাবশ্যক এবং অনভিপ্রেত। তবু কিছু সজ্জনকে মাঝেমধ্যে দেখি সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাৎ হলে একাত্তরের অর্জিত সম্ভাষণ ব্যবহার করেন। দেখতে ও শুনতে খুবই ভালো লাগে তখন। মধ্য পঁচাত্তরের পর থেকেই পরিকল্পিতভাবে দেশে বিভাজন-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার শুরু। এই সত্য সবার জানা। এই বিভাজনের অন্যতম শিকার জয় বাংলার মতো অসাম্প্রদায়িক এবং মধুর বাংলা সম্ভাষণটি। বিভাজনের আরেক শিকার বঙ্গবন্ধুর পরিহিত বিশেষ পোশাক_মুজিব কোট নামে যার বিশেষ পরিচিতি। পঁচাত্তরের পর থেকে দীর্ঘদিন অনেক আওয়ামী লীগারকেও এই পোশাকটি পরতে দেখা যায়নি। এরই মধ্যে গজিয়ে উঠেছে এক অদ্ভুত নতুন প্রজন্ম, যাদের ইচ্ছাকৃতভাবেই শেখানো হয়েছে জাতির ভুল ও মিথ্যে ইতিহাস। যারা মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে শিখেছে জয় বাংলা হচ্ছে হিন্দুর ভাষা এবং মুজিব কোট হচ্ছে শত্রুর পোশাক। তারা এসব গভীরভাবে বিশ্বাসও করেছে এবং এখন জাতীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের দাপটও কম নয়। সত্যি বলতে কি, এই অদ্ভুত প্রজন্মের ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে খুব একটা ইতিবাচক মৌলিক কাজ হয়নি। রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে মহান মুক্তিযুদ্ধই যখন সত্যচ্যুত এবং বিভ্রান্তির চোরাগলিতে ঘুরপাক খায়, যুদ্ধাপরাধীরা যখন বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য দেখায় তখন জয় বাংলার মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! এ রকম কথা বলে অনেকেই মুরবি্ব সাজার চেষ্টা করেন। এটা দুঃখজনক। জয় বাংলা ধ্বনিতে বীর-রস আছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের প্রেরণা জোগায়, এটা সত্য। কিন্তু জয় বাংলা তো দৈনন্দিন যাপিত জীবনে বাঙালি মাত্রের প্রাণের আরামও।
মুজিব কোট প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা বলি। ষাটের দশকের শেষভাগে জেলা পর্যায়ের ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত থাকার সময়ে আমার অন্যতম প্রিয় পোশাক ছিল পাজামা-পাঞ্জাবি। শীতকালে তার সঙ্গে গায়ে উঠত হাফহাতা মুজিব কোট আর চাদর। তরুণ বয়সের প্রথম প্রেমের মতোই মুজিব কোট আমার এখনো প্রিয় পোশাক এবং ব্যক্তিগত ওয়ার্ডরোবে বিভিন্ন রঙের বেশ কয়েকটি মুজিব কোট এখনো আছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুজিব কোট পরিধান করার কারণে কত যে প্রশ্ন এবং বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে, সেসব কথা না হয় অন্য এক লেখায় লিখব। তবে এটুকু বলতে দ্বিধা নেই যে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে সরাসরি রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে বেশির ভাগ সময়ই পার করেছি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। প্রশ্ন এবং বিড়ম্বনার ব্যাপারটি কিন্তু এই ভুবনেই বেশি ঘটেছে। যারা এসবের হোতা, তাদেরই এখন মাত্রারিক্তভাবে মুজিব কোট পরিধান করতে দেখে মুচকি হাসি। অতি ভক্তি এবং ভক্তির অতি প্রদর্শনে মাঝেমধ্যে ভয়ও যে পাই
না তা নয়।
শেষ করি জয় বাংলার প্রসঙ্গ টেনেই। ছিয়ানব্বই এবং এবার দুই দফায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সরকার গঠন করল। রাজনীতির মঞ্চ উচ্চকিত হলো জয় বাংলা ধ্বনিতে। সেটাও কেবল আওয়ামী লীগেরই মঞ্চে। মহাজোটের শরিকরা কিন্তু জয় বাংলাকে নিজের ভাবে না। তবে কি সত্যি সত্যি জয় বাংলা এখন কেবল আওয়ামী লীগেরই নিজস্ব সম্ভাষণ! এবং সেটা কি কেবলই রাজনৈতিক চর্চায়! সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পারিবারিক জীবনচর্চায় নয় কেন? রাজনীতিকদের গণ্ডির বাইরে সামাজিকরাও কেন বাঙালির নিজস্ব এই অহংকারী সম্ভাষণটি ব্যাপকভাবে প্রাত্যহিক জীবনচর্চায়, সামাজিক সংস্কৃতিতে নিয়মিত ব্যবহার করছেন না! সরকার চাইলে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে জয় বাংলা সম্ভাষণ নিশ্চিত করতে পারেন। তবে সাধারণ জীবনের প্রাত্যহিকতায়, সামাজিক আচারাদিতে জয় বাংলা সম্ভাষণের ব্যবহার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পুণ্যভূমিতে শক্তভাবে দাঁড়াতে সাহায্য করবে এবং আগামী দিনে তা অত্যন্ত দরকারি। মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পরে সাতই মার্চের এই পবিত্র দিন থেকেই না হয় সেটা শুরু হোক। জয় বাংলা।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে স্বভাবতই ধরে নেওয়া গিয়েছিল যে জয় বাংলা হবে আমাদের সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত সম্ভাষণ। আমরা পরস্পরকে জয় বাংলা বলে সাদরে আমন্ত্রণ ও গ্রহণ করব। আবার বিদায়ও জানাব একই সম্ভাষণে। পারিবারিক সংস্কৃতিতেও এই মধুর সম্ভাষণটি হয়ে উঠবে আমাদের নিত্যসঙ্গী। মহান ভাষা-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা পথে অর্জিত স্বাধীন বাঙালির একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ও বিশুদ্ধ বাংলা সম্ভাষণ তো জয় বাংলাই। জয় বাংলার গূঢ় চেতনাতেই তো একাত্তরে সব বিভেদের ঊধর্ে্ব উঠে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল একটি জাতি নতুন ইতিহাস গড়ার লক্ষ্যে। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যাপারটি আর সে রকম থাকল না। অনেক কিছুর মতো জয় বাংলাও দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। সে তখন একমাত্র আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্লোগান। কেন জয় বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন গবেষক। সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র হয়তো ছিল; কিন্তু তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টাও তো খুব একটা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালে আওয়ামী লীগের কয়জন নেতা স্বাভাবিক জীবনচর্চায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই সম্ভাষণটি নিয়মিত ব্যবহার করেছেন! আমাদের স্থানীয় নেতা মরহুম ইমাম উদ্দিন আহমদকে দেখতাম পথ চলতে কিংবা ঘরোয়া পরিবেশেও জয় বাংলা সম্ভাষণ উচ্চারণ করতেন। পঁচাত্তরের ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পর সম্ভাষণটিকে জাতীয় ও সামাজিক জীবন থেকে প্রায় নিশ্চিহ্নই করে দেওয়ার চেষ্টা হলো। ফিরে এল পাকিস্তানি জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ বেতার যেমন রাতারাতি রেডিও বাংলাদেশ। এ রকম উদাহরণ আরো দেওয়া যেতে পারে। বাংলার চিরায়ত দর্শন ও আবহমান অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বিনষ্টের অংশ হিসেবে জয় বাংলাকেও বলি দেওয়ার চেষ্টা করা হলো জাতীয় ও সামাজিক পর্যায়ে। জয় বাংলা উচ্চারণ করা যেন তখন মহাপাপ এবং সেটা বিধর্মী সংস্কৃতির অংশ। সেই দুঃসময়ে নমস্য ওয়াহিদুল হককে দেখেছি আওয়ামী লীগার না হয়েও জয় বাংলা সম্ভাষণকে তাঁর সব কর্মে এবং প্রাত্যহিক জীবনে, হৃদয়ে এবং মুখে রেখেছেন। এ রকম শুদ্ধ মানুষ হয়তো আরো ছিলেন এবং আছেনও। আর এখন তো এমন দাঁড়িয়েছে যে আওয়ামী লীগের মিটিং মিছিল ছাড়া জয় বাংলা উচ্চারণ অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাবশ্যক এবং অনভিপ্রেত। তবু কিছু সজ্জনকে মাঝেমধ্যে দেখি সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাৎ হলে একাত্তরের অর্জিত সম্ভাষণ ব্যবহার করেন। দেখতে ও শুনতে খুবই ভালো লাগে তখন। মধ্য পঁচাত্তরের পর থেকেই পরিকল্পিতভাবে দেশে বিভাজন-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার শুরু। এই সত্য সবার জানা। এই বিভাজনের অন্যতম শিকার জয় বাংলার মতো অসাম্প্রদায়িক এবং মধুর বাংলা সম্ভাষণটি। বিভাজনের আরেক শিকার বঙ্গবন্ধুর পরিহিত বিশেষ পোশাক_মুজিব কোট নামে যার বিশেষ পরিচিতি। পঁচাত্তরের পর থেকে দীর্ঘদিন অনেক আওয়ামী লীগারকেও এই পোশাকটি পরতে দেখা যায়নি। এরই মধ্যে গজিয়ে উঠেছে এক অদ্ভুত নতুন প্রজন্ম, যাদের ইচ্ছাকৃতভাবেই শেখানো হয়েছে জাতির ভুল ও মিথ্যে ইতিহাস। যারা মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে শিখেছে জয় বাংলা হচ্ছে হিন্দুর ভাষা এবং মুজিব কোট হচ্ছে শত্রুর পোশাক। তারা এসব গভীরভাবে বিশ্বাসও করেছে এবং এখন জাতীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের দাপটও কম নয়। সত্যি বলতে কি, এই অদ্ভুত প্রজন্মের ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে খুব একটা ইতিবাচক মৌলিক কাজ হয়নি। রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে মহান মুক্তিযুদ্ধই যখন সত্যচ্যুত এবং বিভ্রান্তির চোরাগলিতে ঘুরপাক খায়, যুদ্ধাপরাধীরা যখন বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য দেখায় তখন জয় বাংলার মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! এ রকম কথা বলে অনেকেই মুরবি্ব সাজার চেষ্টা করেন। এটা দুঃখজনক। জয় বাংলা ধ্বনিতে বীর-রস আছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের প্রেরণা জোগায়, এটা সত্য। কিন্তু জয় বাংলা তো দৈনন্দিন যাপিত জীবনে বাঙালি মাত্রের প্রাণের আরামও।
মুজিব কোট প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা বলি। ষাটের দশকের শেষভাগে জেলা পর্যায়ের ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত থাকার সময়ে আমার অন্যতম প্রিয় পোশাক ছিল পাজামা-পাঞ্জাবি। শীতকালে তার সঙ্গে গায়ে উঠত হাফহাতা মুজিব কোট আর চাদর। তরুণ বয়সের প্রথম প্রেমের মতোই মুজিব কোট আমার এখনো প্রিয় পোশাক এবং ব্যক্তিগত ওয়ার্ডরোবে বিভিন্ন রঙের বেশ কয়েকটি মুজিব কোট এখনো আছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুজিব কোট পরিধান করার কারণে কত যে প্রশ্ন এবং বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে, সেসব কথা না হয় অন্য এক লেখায় লিখব। তবে এটুকু বলতে দ্বিধা নেই যে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে সরাসরি রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে বেশির ভাগ সময়ই পার করেছি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। প্রশ্ন এবং বিড়ম্বনার ব্যাপারটি কিন্তু এই ভুবনেই বেশি ঘটেছে। যারা এসবের হোতা, তাদেরই এখন মাত্রারিক্তভাবে মুজিব কোট পরিধান করতে দেখে মুচকি হাসি। অতি ভক্তি এবং ভক্তির অতি প্রদর্শনে মাঝেমধ্যে ভয়ও যে পাই
না তা নয়।
শেষ করি জয় বাংলার প্রসঙ্গ টেনেই। ছিয়ানব্বই এবং এবার দুই দফায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সরকার গঠন করল। রাজনীতির মঞ্চ উচ্চকিত হলো জয় বাংলা ধ্বনিতে। সেটাও কেবল আওয়ামী লীগেরই মঞ্চে। মহাজোটের শরিকরা কিন্তু জয় বাংলাকে নিজের ভাবে না। তবে কি সত্যি সত্যি জয় বাংলা এখন কেবল আওয়ামী লীগেরই নিজস্ব সম্ভাষণ! এবং সেটা কি কেবলই রাজনৈতিক চর্চায়! সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পারিবারিক জীবনচর্চায় নয় কেন? রাজনীতিকদের গণ্ডির বাইরে সামাজিকরাও কেন বাঙালির নিজস্ব এই অহংকারী সম্ভাষণটি ব্যাপকভাবে প্রাত্যহিক জীবনচর্চায়, সামাজিক সংস্কৃতিতে নিয়মিত ব্যবহার করছেন না! সরকার চাইলে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে জয় বাংলা সম্ভাষণ নিশ্চিত করতে পারেন। তবে সাধারণ জীবনের প্রাত্যহিকতায়, সামাজিক আচারাদিতে জয় বাংলা সম্ভাষণের ব্যবহার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পুণ্যভূমিতে শক্তভাবে দাঁড়াতে সাহায্য করবে এবং আগামী দিনে তা অত্যন্ত দরকারি। মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পরে সাতই মার্চের এই পবিত্র দিন থেকেই না হয় সেটা শুরু হোক। জয় বাংলা।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments