যোগাযোগ-রেলের ‘কালো বিড়াল’ ধরবেন কবে by সাইফুদ্দীন চৌধুরী

মার এক শিক্ষক বন্ধু কয়েকদিন আগে রাজশাহী স্টেশনে ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে টিকিট না পেয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর পিয়ন কিছু টাকা বেশি দিয়ে তাঁকে স্টেশন থেকে ট্রেনের টিকিট এনে দেন। শিক্ষক শুনলেন একটু বেশি টাকা দিলে সব সময় টিকিট পাওয়া যায়। বন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, এখন দেখছি রেল পরিবহনে আরও বেহাল দশা হয়েছে। নবগঠিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার সময় রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেছিলেন, ‘গাই বুড়া, বিয়ানো


শেষ’। ক্ষমতা গ্রহণকালে মন্ত্রী মহোদয় হতাশ হয়েই বোধ করি এই মন্তব্য করেছিলেন! আদতেই রেল পরিবহনব্যবস্থায় কোনোই পরিবর্তন আসেনি। বরং সম্প্রতি অবনতির অনুপাত অনেক গুণে বেড়ে গেছে। শুধু রাজশাহী-ঢাকা পথেই নয়, দেশের সর্বত্রই আন্তনগর ট্রেনের টিকিট নিয়ে ওই তুঘলকি কাণ্ড চলছে। ট্রেনে এত ভিড়, তবু লোকসান হয় কেন? রেলের টিকিট বিষয়ে দুর্নীতির যে অভিযোগ রেলমন্ত্রীর দপ্তরে টেকনো হ্যাভেন কোম্পানি উত্থাপন করেছে, তাদের বিবরণ সত্যিই ভয়াবহ। ওই কোম্পানি রেলের টিকিটের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসূত্রতার প্রমাণ পেয়েছে। টেকনো হ্যাভেন উল্লেখ করেছে, স্টেশনগুলোর ডেটাবেইস থেকে টিকিটের বিক্রয়মূল্য মুছে ফেলা হয়, টিকিটের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয় এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কালোবাজারিদের হাতে ওই টিকিট তুলে দেওয়া হয়। প্রতিটি বিক্রীত টিকিট থেকে সার্ভিস চার্জের নামে অতিরিক্ত অর্থও আদায় করা হয়। কী ভয়াবহ চিত্র?
ট্রেন যাত্রার সময় সমস্যায় পড়ে যাত্রীরা, যখন নির্ধারিত সময় ট্রেন ছাড়া হয় না। আরও সমস্যা হয় যখন অনির্ধারিত স্টেশনে ট্রেন থামানো হয়। রাজশাহী থেকে প্রতিদিন তিতুমীর আন্তনগর ট্রেন পার্বতীপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায় সকাল সাড়ে ছয়টায়। পার্বতীপুর পৌঁছার কথা বেলা ১১টায়, কিন্তু পৌঁছায় বেলা একটায়। ট্রেনটির নিয়মিত অনির্ধারিত স্টপেজ রয়েছে হিলি স্টেশনে। সীমান্তবর্তী এই অনির্ধারিত স্টেশনে নিয়মই হয়েছে অন্তত আধঘণ্টা ট্রেন থামিয়ে রেখে চোরাচালানির মালামাল ওঠানো। রেলের একশ্রেণীর কর্মচারী এবং নিরাপত্তাকর্মী এই অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। রেল মন্ত্রণালয় সৃষ্টির আগের এই চিত্রের কোনো পরিবর্তন আসেনি।
রেল পরিবহনব্যবস্থা সুষ্ঠু করা গেলে সরকারকে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের অর্থ ভর্তুকি তো দিতেই হবে না, অধিকন্তু লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব। রেল পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন করে, একে দেশের প্রধান পরিবহন, অর্থাৎ ‘গণপরিবহন’ হিসেবে রূপান্তর করা সম্ভব। পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে রেল পরিবহন যে পর্যায়ে ছিল, তা থেকে কোনো উন্নতি হয়নি, অধিকন্তু নানা ক্ষেত্রে অবনতিই হয়েছে। বাংলাদেশ আমলে যাত্রীবাহী ট্রেনের সংখ্যা সামান্য কটি বাড়লেও মালবাহী ট্রেনের সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে। রেলপথের পরিমাণও বাংলাদেশ আমলে কিছু কমে গেছে।
এ অবস্থাকে আরও সংকটে ফেলে দিয়েছে জনবলের অভাব। রেলওয়ের এক তথ্য বিবরণী থেকে জানা গেছে, জনবল সংকটে পড়ে তিন শতাধিক রেলস্টেশনই বন্ধ হয়ে গেছে। খালাসি, ট্রেন কন্ট্রোলার, ট্রাফিক অ্যাপ্রেনটিস, গার্ড, পোর্টার, ওয়েম্যান, স্টেশনমাস্টার, টুলকিপার, ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস ও বুকিং সহকারীসহ অসংখ্য পদে জনবলের অভাব রয়েছে। কারও কারও মতে, বাংলাদেশ রেলে কমপক্ষে আধা লাখ জনবলের প্রয়োজন রয়েছে।
রেল পরিবহনব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং একে গতিশীল করতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বিশেষ আওতায় আনতে হবে। প্রথম দিকে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথগুলোর বিভিন্ন কৌণিকে উন্নতি বিধান করতে হবে, যাত্রী পরিবহন ও মালামাল পরিবহনের দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রয়োজনীয় ডিজেল, ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ করতে হবে, যাতে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে রেলব্যবস্থায় নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও রেল খাতে বেসরকারি অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে। রেল মন্ত্রণালয় অবশ্যই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সহায়তায় লাইনস অব বিজনেসের (এলওবি) মাধ্যমে রেলওয়েকে সংস্কার করতে পারেন। কমিউটার ট্রেনগুলোর দিকে মন্ত্রণালয়ের নজর দিতে হবে। যানজট নিরসনে এবং স্বল্পপথ অতিক্রমে কমিউটার ট্রেনের ভূমিকা অনেক।
আরও দুটি বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এর একটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানার আধুনিকায়ন। উনিশ শতকের শেষের দিকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের স্টিম লোকোমোটিভ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই কারখানাটি তৈরি করা হয়েছিল। ৩৫ একর জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানায় যাত্রীবাহী ও মালবাহী গাড়ির মেরামত ছাড়াও রোলিং স্টকে ব্যবহার্য বিভিন্ন যন্ত্রাংশ উৎপাদন, বৈদ্যুতিক মেশিনের মেরামত এবং বিভিন্ন নিরাপদ যন্ত্রের (সেফটি আইটেম) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো। এখনো সেসব কাজ কিছু কিছু করা হয়ে থাকে। দুঃখজনক যে পুরোনো এই কারখানার যন্ত্রপাতির অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এর আধুনিকায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অনুরূপ সংস্কার ও আধুনিকায়ন জরুরি দেশের অপর বৃহৎ রেলওয়ে কারখানা সৈয়দপুরের।
রেল পরিবহনব্যবস্থায় ব্যয় কম। অন্যান্য পরিবহনে, বিশেষ করে, সড়কপথ ও নৌপথ থেকে এই পথের দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কম। কাজেই দেশের মানুষ নিরাপদ যাত্রার জন্য রেলপথকেই বেছে নিচ্ছে। সরকার ট্রান্স এশিয়ান রেলপথ চালু করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত হয়ে পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত হবে ওই রেলপথ। আধুনিক ওই রেলপথের সঙ্গে বাংলাদেশের রেলব্যবস্থাকে মেলাতে চাইলে রেল পরিবহনের আধুনিকায়ন ছাড়া গত্যন্তর কী?
দুষ্টচক্রের হাত থেকে রেলকে বাঁচাতে হবে। রেলমন্ত্রী এ জন্যই বোধকরি রেলের ‘কালো বিড়াল’ ধরতে চেয়েছেন। তিনি শুধু কথায় নাকি আদতেও কাজ করে দেখাতে পারেন, মানুষ সেই প্রতীক্ষায় আছে।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক, অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.