জ্বালানি-আমদানি করা কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ by মুশফিকুর রহমান
দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত ২০ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড মোট ১০৮৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য স্থানীয় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি অনুযায়ী, (আগামী ৩৬ মাসে খুলনা ও চট্টগ্রামে এবং ৪২ মাসে মাওয়ায়) উদ্যোক্তা কোম্পানি ১.৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২৮২.৬ মেগাওয়াট, খুলনার লবণচড়ায়
২৬২.৬ মেগাওয়াট ও মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় ৫২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করবে। এ জন্য সরকারকে তহবিলের জোগান, জ্বালানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমি বরাদ্দ বা উন্নয়ন করার দায় বহন করতে হবে না। ওরিয়ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ‘বিল্ড ওন অপারেট’ ভিত্তিতে পরিচালনা করবে। উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড যথাক্রমে ৩.৭৯৫ টাকা, ৩.৭৮৫ টাকা, ৪.০৯৫ টাকা দরে কিনে নেবে। বিনিয়োগকারী কোম্পানি কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি কয়লা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করে নিজেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় ভেটিং পেলে আগামী দু-এক মাস পরে এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত এবং চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে অনুস্বাক্ষরিত চুক্তির সময়সূচি অনুযায়ী, উল্লিখিত কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রই বর্তমান সরকারের মেয়াদে উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হবে না।
সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী (পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান) ২০২০ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তার প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদনের জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছে। বিশাল বিনিয়োগের বড়পুকুরিয়া ভূগর্ভস্থ কয়লাখনির নগণ্য পরিমাণ উৎপাদিত কয়লা দিয়ে বিদ্যমান বড়পুকুরিয়া ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখা ছাড়া সরকারি খাতে নতুন কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সরকারি বা বেসরকারি উভয় খাতেই দেশের মজুদ কয়লার নতুন কোনো উত্তোলন উদ্যোগও এখন অবধি অনুপস্থিত। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথাবার্তা থেকে মনে হয়, বর্তমান সরকারের সময়কালে দেশে আবিষ্কৃত কয়লাক্ষেত্রগুলোর কয়লা উত্তোলনের নতুন কোনো উদ্যোগ নেওয়ার ইচ্ছেও সরকারের নেই। এখন পর্যন্ত প্রধানত গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, তবে আমদানি করা ব্যয়বহুল তরল জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। জ্বালানি আমদানির ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বিদ্যুতের মূল্য। আমাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। ইতিমধ্যে দেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় ও বাজেট ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হয়ে সামনে এসেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি আমদানির ব্যয়। ভবিষ্যতে এ প্রবণতা বাড়বে বলেই অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করছেন।
নীতিনির্ধারকেরা যে বিবেচনাতেই আমদানি করা জ্বালানি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থার প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করুন না কেন, তা টেকসই এবং সস্তা বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা গড়তে সহায়ক হবে না। বরং এ ব্যবস্থা অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল হবে। এ জন্য কয়েকটি কারণ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারের কয়লা কিনে দেশের নদীপথ দিয়ে বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা এ দেশে নেই। এ জন্য সমুদ্রবন্দর এবং নদীপথের পরিবহনব্যবস্থা দুটোই এখনো অপ্রস্তুত। জ্বালানি কয়লার মজুদ বিশ্বে প্রচুর হলেও আমাদের দেশে যে উৎসগুলো থেকে আমদানি করা যেতে পারে (অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা) সেসব বন্দর বেশ দূরবর্তী। তা ছাড়া মহাসমুদ্রে চলাচলকারী কয়লাবাহী জাহাজগুলোর কোনোটিই আমাদের দেশের অগভীর সমুদ্রবন্দরে ভিড়তে পারবে না। ফলে ছোট ছোট জাহাজে করে কয়লা আমদানি ও পরিবহন করতে হবে। এ কারণে, কয়লার উৎসে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে কয়লা আমদানি করতে হবে। মোটামুটি বড়পুকুরিয়ার মানের কয়লা আমরা যদি ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করি, তাহলে এখন টনপ্রতি (সিঅ্যান্ডএফ) মূল্য চট্টগ্রাম বন্দরেই প্রায় দাঁড়াবে ১৩০ থেকে ১৪০ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে পোর্ট চার্জ, ক্লিয়ারিং চার্জ, শুল্ক ৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ যোগ করলে টনপ্রতি কয়লার মূল্য হবে ১৭০ মার্কিন ডলারের বেশি। অর্থাৎ প্রতি কেজি কয়লার মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ১৩.৯৪ টাকা (১ মার্কিন ডলার সমান ৮২ টাকা) । মাওয়া বা খুলনার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এই কয়লা পৌঁছাতে আরও বেশি খরচ হবে। এক ইউনিট (এক কিলোওয়াট-ঘণ্টা) বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রায় ০.৩-০.৪ কেজি কয়লা পোড়ানো দরকার হলে (বড়পুকুরিয়ার বর্তমান কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ০.৪৬ কেজি কয়লা পোড়াতে হয়) কেবল জ্বালানি কয়লার জন্য প্রতি ইউনিটে খরচ হবে প্রায় ৪.১৮-৫.৫৮ টাকা। কম তাপজনন ক্ষমতা, বেশি সালফার ও ছাইবিশিষ্ট কয়লা আমদানি তুলনামূলকভাবে সস্তায় সম্ভব। কিন্তু সে ক্ষেত্রে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বেশি কয়লা আমদানি করতে হবে এবং পরিবেশের জন্য তা হবে নেতিবাচক। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি কয়লা ছাড়াও অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি, অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য নির্ধারিত ব্যয় হয় (বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি ব্যয় ছাড়াও অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় প্রায় ১.৩০ টাকা)। এর সঙ্গে বিনিয়োগ ব্যয়, মুনাফা ইত্যাদি যোগ করলে ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিমূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। (অবশ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য থেকে প্রকৃত মূল্য ভিন্ন হলে আলাদা কথা)।
আপাত বিবেচনায় বাজারমূল্যের চেয়ে কমে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো প্রস্তাব পেলে সরকারি সংস্থা আকর্ষণীয় বিবেচনায় তা গ্রহণে আগ্রহী হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অপর সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীকে মাঠ থেকে বিতাড়ন করে কেউ সংকট সৃষ্টি করতে চায় কি না সেটিও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কর্তৃপক্ষ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে খনির উৎপাদিত কয়লা সরবরাহের জন্য উৎপাদন মূল্যের সমপরিমাণ বা টনপ্রতি প্রায় ১২৫ মার্কিন ডলার পরিশোধের জন্য দাবি করে আসছিল। অন্যথায়, খনি কর্তৃপক্ষ লোকসান কমাতে সরকারের কাছে ভর্তুকি চেয়েছে। সম্প্রতি বড়পুকুরিয়া খনির লোকসান কমাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সরকার বড়পুকুরিয়ার কয়লার টনপ্রতি ১১০ মার্কিন ডলার মূল্য নির্ধারণ করেছে। অন্যান্য ক্রেতার জন্য বড়পুকুরিয়া খনিমুখে কয়লার মূল্য প্রায় ১৪০ মার্কিন ডলার।
বিশ্ববাজারে কয়লার মূল্য বাড়ছে। চুক্তিতে উল্লিখিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর যখন উৎপাদনে যাওয়ার সময় হবে, তখন কয়লার মূল্য আরও বাড়বে বলেই বিভিন্ন সূত্র অভিমত দিচ্ছে। বিশ্বের ৪০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ কয়লা পুড়িয়ে উৎপাদিত হয়। গত বছর কয়লার ব্যবহার অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে দ্রুত বেড়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে বড় কয়লা আমদানিকারক দেশ এখনো জাপান। দেশটি ২০০৯ সালে এককভাবে কয়লা আমদানি করেছে ১৬৫ মিলিয়ন টন। চীন পৃথিবীর বৃহত্তম কয়লা উৎপাদক দেশ হলেও এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা আমদানিকারক দেশ। ২০০৯ সালে চীন আমদানি করেছে ১৩৭ মিলিয়ন টন। এরপর কয়লা আমদানির তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়া ১০৩ মিলিয়ন টন, ভারত ৬৭ মিলিয়ন টন, তাইওয়ান ৬০ মিলিয়ন টন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই ৩৮ মিলিয়ন টন। ১৯৯০ সালে বিশ্বে যেখানে কয়লার (বিটুমিনাস ও অ্যান্থাসাইট কয়লা) উৎপাদন ছিল প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন টন, সেখানে ২০১০ সালে তা সাড়ে আট বিলিয়ন টন ছাড়িয়ে গেছে। তবু কয়লার মূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। কার্বন নিঃসরণ সীমিত করার বৈশ্বিক চুক্তির বিষয়ে ডারবানে অনুষ্ঠিত ক্লাইমেট সম্মেলন মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারায় কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অন্তত আগামী দু দশক বাড়বে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশেষত এ প্রবণতা এশিয়া অঞ্চলে প্রবল হবে। চীন ও ভারতের তীব্র জ্বালানিক্ষুধার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের প্রয়োজনের নগণ্য পরিমাণ কয়লা বিরতিহীনভাবে আমদানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে তার সরবরাহ খুব সহজ কাজ হবে মনে করা ঠিক হবে না। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বড়পুকুরিয়া মানের প্রায় ২৪ মিলিয়ন টন কয়লা প্রতিবছর আমদানি করতে হবে। এ জন্য যে অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা গড়া দরকার তা এখনো শুরু করা হয়নি।
সরকার আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ যেভাবে এগিয়ে নিতে চাইছে, তাতে সস্তায় বিদ্যুৎ সরবরাহের আকাঙ্ক্ষা অনার্জিতই থেকে যাবে। আমদানি কয়লার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন মূল্যে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের উদ্যোগ নিলে বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থায় ‘জরুরি অবস্থা’ দীর্ঘ হওয়ার বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এতে চুক্তিবদ্ধ বিনিয়োগকারী অপারগ হলে কেবল একটি বা একাধিক কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে না, পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা সচল রাখতে আবারও ‘স্বল্পমেয়াদি অতি জরুরি অবস্থা’ মোকাবিলার ব্যয়বহুল ‘কুইক রেন্টাল’ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে চালাতে হতে পারে। ফলে ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ পরিকল্পনাও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, পরিবেশবিষয়ক লেখক।
সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী (পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান) ২০২০ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তার প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদনের জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছে। বিশাল বিনিয়োগের বড়পুকুরিয়া ভূগর্ভস্থ কয়লাখনির নগণ্য পরিমাণ উৎপাদিত কয়লা দিয়ে বিদ্যমান বড়পুকুরিয়া ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখা ছাড়া সরকারি খাতে নতুন কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সরকারি বা বেসরকারি উভয় খাতেই দেশের মজুদ কয়লার নতুন কোনো উত্তোলন উদ্যোগও এখন অবধি অনুপস্থিত। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথাবার্তা থেকে মনে হয়, বর্তমান সরকারের সময়কালে দেশে আবিষ্কৃত কয়লাক্ষেত্রগুলোর কয়লা উত্তোলনের নতুন কোনো উদ্যোগ নেওয়ার ইচ্ছেও সরকারের নেই। এখন পর্যন্ত প্রধানত গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, তবে আমদানি করা ব্যয়বহুল তরল জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। জ্বালানি আমদানির ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বিদ্যুতের মূল্য। আমাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। ইতিমধ্যে দেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় ও বাজেট ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হয়ে সামনে এসেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি আমদানির ব্যয়। ভবিষ্যতে এ প্রবণতা বাড়বে বলেই অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করছেন।
নীতিনির্ধারকেরা যে বিবেচনাতেই আমদানি করা জ্বালানি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থার প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করুন না কেন, তা টেকসই এবং সস্তা বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা গড়তে সহায়ক হবে না। বরং এ ব্যবস্থা অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল হবে। এ জন্য কয়েকটি কারণ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারের কয়লা কিনে দেশের নদীপথ দিয়ে বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা এ দেশে নেই। এ জন্য সমুদ্রবন্দর এবং নদীপথের পরিবহনব্যবস্থা দুটোই এখনো অপ্রস্তুত। জ্বালানি কয়লার মজুদ বিশ্বে প্রচুর হলেও আমাদের দেশে যে উৎসগুলো থেকে আমদানি করা যেতে পারে (অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা) সেসব বন্দর বেশ দূরবর্তী। তা ছাড়া মহাসমুদ্রে চলাচলকারী কয়লাবাহী জাহাজগুলোর কোনোটিই আমাদের দেশের অগভীর সমুদ্রবন্দরে ভিড়তে পারবে না। ফলে ছোট ছোট জাহাজে করে কয়লা আমদানি ও পরিবহন করতে হবে। এ কারণে, কয়লার উৎসে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে কয়লা আমদানি করতে হবে। মোটামুটি বড়পুকুরিয়ার মানের কয়লা আমরা যদি ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করি, তাহলে এখন টনপ্রতি (সিঅ্যান্ডএফ) মূল্য চট্টগ্রাম বন্দরেই প্রায় দাঁড়াবে ১৩০ থেকে ১৪০ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে পোর্ট চার্জ, ক্লিয়ারিং চার্জ, শুল্ক ৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ যোগ করলে টনপ্রতি কয়লার মূল্য হবে ১৭০ মার্কিন ডলারের বেশি। অর্থাৎ প্রতি কেজি কয়লার মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ১৩.৯৪ টাকা (১ মার্কিন ডলার সমান ৮২ টাকা) । মাওয়া বা খুলনার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এই কয়লা পৌঁছাতে আরও বেশি খরচ হবে। এক ইউনিট (এক কিলোওয়াট-ঘণ্টা) বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রায় ০.৩-০.৪ কেজি কয়লা পোড়ানো দরকার হলে (বড়পুকুরিয়ার বর্তমান কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ০.৪৬ কেজি কয়লা পোড়াতে হয়) কেবল জ্বালানি কয়লার জন্য প্রতি ইউনিটে খরচ হবে প্রায় ৪.১৮-৫.৫৮ টাকা। কম তাপজনন ক্ষমতা, বেশি সালফার ও ছাইবিশিষ্ট কয়লা আমদানি তুলনামূলকভাবে সস্তায় সম্ভব। কিন্তু সে ক্ষেত্রে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বেশি কয়লা আমদানি করতে হবে এবং পরিবেশের জন্য তা হবে নেতিবাচক। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি কয়লা ছাড়াও অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি, অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য নির্ধারিত ব্যয় হয় (বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি ব্যয় ছাড়াও অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় প্রায় ১.৩০ টাকা)। এর সঙ্গে বিনিয়োগ ব্যয়, মুনাফা ইত্যাদি যোগ করলে ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিমূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। (অবশ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য থেকে প্রকৃত মূল্য ভিন্ন হলে আলাদা কথা)।
আপাত বিবেচনায় বাজারমূল্যের চেয়ে কমে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো প্রস্তাব পেলে সরকারি সংস্থা আকর্ষণীয় বিবেচনায় তা গ্রহণে আগ্রহী হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অপর সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীকে মাঠ থেকে বিতাড়ন করে কেউ সংকট সৃষ্টি করতে চায় কি না সেটিও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কর্তৃপক্ষ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে খনির উৎপাদিত কয়লা সরবরাহের জন্য উৎপাদন মূল্যের সমপরিমাণ বা টনপ্রতি প্রায় ১২৫ মার্কিন ডলার পরিশোধের জন্য দাবি করে আসছিল। অন্যথায়, খনি কর্তৃপক্ষ লোকসান কমাতে সরকারের কাছে ভর্তুকি চেয়েছে। সম্প্রতি বড়পুকুরিয়া খনির লোকসান কমাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সরকার বড়পুকুরিয়ার কয়লার টনপ্রতি ১১০ মার্কিন ডলার মূল্য নির্ধারণ করেছে। অন্যান্য ক্রেতার জন্য বড়পুকুরিয়া খনিমুখে কয়লার মূল্য প্রায় ১৪০ মার্কিন ডলার।
বিশ্ববাজারে কয়লার মূল্য বাড়ছে। চুক্তিতে উল্লিখিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর যখন উৎপাদনে যাওয়ার সময় হবে, তখন কয়লার মূল্য আরও বাড়বে বলেই বিভিন্ন সূত্র অভিমত দিচ্ছে। বিশ্বের ৪০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ কয়লা পুড়িয়ে উৎপাদিত হয়। গত বছর কয়লার ব্যবহার অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে দ্রুত বেড়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে বড় কয়লা আমদানিকারক দেশ এখনো জাপান। দেশটি ২০০৯ সালে এককভাবে কয়লা আমদানি করেছে ১৬৫ মিলিয়ন টন। চীন পৃথিবীর বৃহত্তম কয়লা উৎপাদক দেশ হলেও এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা আমদানিকারক দেশ। ২০০৯ সালে চীন আমদানি করেছে ১৩৭ মিলিয়ন টন। এরপর কয়লা আমদানির তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়া ১০৩ মিলিয়ন টন, ভারত ৬৭ মিলিয়ন টন, তাইওয়ান ৬০ মিলিয়ন টন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই ৩৮ মিলিয়ন টন। ১৯৯০ সালে বিশ্বে যেখানে কয়লার (বিটুমিনাস ও অ্যান্থাসাইট কয়লা) উৎপাদন ছিল প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন টন, সেখানে ২০১০ সালে তা সাড়ে আট বিলিয়ন টন ছাড়িয়ে গেছে। তবু কয়লার মূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। কার্বন নিঃসরণ সীমিত করার বৈশ্বিক চুক্তির বিষয়ে ডারবানে অনুষ্ঠিত ক্লাইমেট সম্মেলন মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারায় কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অন্তত আগামী দু দশক বাড়বে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশেষত এ প্রবণতা এশিয়া অঞ্চলে প্রবল হবে। চীন ও ভারতের তীব্র জ্বালানিক্ষুধার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের প্রয়োজনের নগণ্য পরিমাণ কয়লা বিরতিহীনভাবে আমদানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে তার সরবরাহ খুব সহজ কাজ হবে মনে করা ঠিক হবে না। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বড়পুকুরিয়া মানের প্রায় ২৪ মিলিয়ন টন কয়লা প্রতিবছর আমদানি করতে হবে। এ জন্য যে অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা গড়া দরকার তা এখনো শুরু করা হয়নি।
সরকার আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ যেভাবে এগিয়ে নিতে চাইছে, তাতে সস্তায় বিদ্যুৎ সরবরাহের আকাঙ্ক্ষা অনার্জিতই থেকে যাবে। আমদানি কয়লার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন মূল্যে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের উদ্যোগ নিলে বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থায় ‘জরুরি অবস্থা’ দীর্ঘ হওয়ার বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এতে চুক্তিবদ্ধ বিনিয়োগকারী অপারগ হলে কেবল একটি বা একাধিক কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে না, পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা সচল রাখতে আবারও ‘স্বল্পমেয়াদি অতি জরুরি অবস্থা’ মোকাবিলার ব্যয়বহুল ‘কুইক রেন্টাল’ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে চালাতে হতে পারে। ফলে ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ পরিকল্পনাও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments