গ্যাস সঙ্কটে ১০ বিদ্যুত কেন্দ্রে পূর্ণমাত্রায় উপাদন ব্যাহত- চারটি বন্ধ by রশিদ মামুন
পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় দেশের দুই হাজার ২০০ মেগাওয়াটের ১০টি বিদ্যুত কেন্দ্র পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। চারটি বিদ্যুত কেন্দ্র গ্যাস সঙ্কটের কারণে সর্বৰণিক বন্ধ রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বার বার পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির তাগাদা দিলেও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এতে দৈনিক গড়ে এক হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত কম উৎপাদন হচ্ছে। ভবিষ্যতে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেচে নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যত সরবরাহ করা হলে লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করবে। যাতে বিদু্যত সঙ্কট নিয়ে জনদুর্ভোগের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।বিদু্যত, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেচ মৌসুমে বিদু্যত উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম বড় অনত্মরায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না পাওয়া। গ্যাসের অপর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন কম হচ্ছে।
পিডিবি সেচ মৌসুমকে সামনে রেখে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল_ চার মাসের জন্য উৎপাদন এবং বণ্টনের যে পরিকল্পনা করেছে তাতে দেখা যায়, ক্রমান্বয়ে বিদু্যত সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করবে। এতে বলা হয়েছে, ফেব্রম্নয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০০ মেগাওয়াট ঘাটতি মাসের শেষ সপ্তাহে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬৪ মেগাওয়াটে দাঁড়াবে। মার্চের শুরম্নই হবে ৪৪৯ মেগাওয়াটের ঘাটতি নিয়ে ওই মাসের শেষে গিয়ে যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮৩ মেগাওয়াটে দাঁড়াবে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সম্ভাব্য ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫৭৫ মেগাওয়াট দ্বিতীয় সপ্তাহে, যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬৩৮ মেগাওয়াটে। পিডিবি সর্বোচ্চ উৎপাদনের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করায় ঘাটতি পরিমাণ প্রতিবেদনে অনেক কম দেখানো হয়েছে। প্রকৃতপৰে সেচ মৌসমে গড় সঙ্কট এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার মেগাওয়াটের উপরে হবে বলে পিডিবির অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে।
দেশে বিদু্যত উৎপাদন এবং লোডশেডিংয়ের বর্তমান চিত্রে দেখা যায়, ঢাকায় সর্বোচ্চ ৩২২ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রামে ১১১ মেগাওয়াট, খুলনায় ৯৫ মেগাওয়াট, রাজশাহীতে ৬৬ মেগাওয়াট, কুমিলস্নায় ৭৭ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহে ৪৫ মেগাওয়াট, বরিশালে ১৬ মেগাওয়াট এবং রংপুরে ৪১ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হচ্ছে। সেচ মৌসুমে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যে শীত মৌসুম শেষ হওয়ায় বাসাবাড়িতেও বিদু্যতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ বিদু্যত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবীর এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, গ্যাস সঙ্কটে বিদু্যত উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা উলেস্নখ করে পেট্রোবাংলাকে কয়েকবার চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। সেচ মৌসুমে বাড়তি বিদু্যত উৎপাদন করা না গেলে সঙ্কট উত্তরণ কঠিন হবে জানিয়ে তিনি বলেন, শীঘ্রই এ বিষয়ে উর্ধতন পর্যায়ে আলোচনা হবে।
কি প্রক্রিয়ায় আপাতত সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু পস্নান্ট ডুয়েল ফুয়েলে রূপানত্মর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে নতুন যে পস্নান্টগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলো ডুয়েল ফুয়েল পদ্ধতি রাখা হচ্ছে। তবে সব কেন্দ্র ডুয়েল ফুয়েলে রূপানত্মর করতে গেলে বিদু্যতের মূল্য বৃদ্ধি পাবে, যা বাসত্মবসম্মত হবে না।
তিনি জানান, স্বল্প সময়ে সঙ্কট উত্তরণের জন্য এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর মাধ্যমে তরল গ্যাস আমদানির মাধ্যমে সঙ্কট মেটানো সম্ভব। আগামী মার্চে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনটি কোম্পানি বাংলাদেশে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। স্বল্প সময়ে অনত্মত এক বছরের মধ্যে সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব হলে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
পিডিবি চেয়ারম্যান বলেন পেট্রোবাংলা অপরিকল্পিতভাবে গ্যাসের সংযোগ দেয়ায় সঙ্কট চরম পর্যায়ে পেঁৗছেছে। এ জন্য গ্রাহক পর্যায়ে যাঁরা এখন গ্যাসের ওপর নির্ভর করছেন তাঁদের বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পিডিবি সূত্রমতে, গ্যাসভিত্তিক বিদু্যত কেন্দ্রের জন্য সর্বোচ্চ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৯৩২ এমএমসিএফডি। চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলার ৮০০ থেকে ৮৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করার কথা রয়েছে। কিন্তু এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৬৬৫ থেকে ৭০০ এমএমসিএফডি। দৈনিক ১৮৫ থেকে ২৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় বিদু্যত কেন্দ্রগুলো পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। সম্প্রতি পিডিবি সেচ মৌসুমে দেশের বিদু্যত কেন্দ্রগুলোর সম্ভাব্য গ্যাসের চাহিদা নির্ধারণ করেছে। এতে জানুয়ারি ২০১০-এ সর্বনিম্ন চাহিদা ৮০১ এমএমসিএফডি ধরা হয়েছে। আগামী জুনে সম্ভাব্য চাহিদার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৮৫৬ এমএমসিএফডি। মেজর রিপিয়ার, পুনর্বাসনাধীন কারণে গ্যাসের চাহিদা কিছুটা কমিয়ে ধরা হয়েছে।
পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, গ্যাস সঙ্কটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কাছে জানানো হয়েছে। বিশেষ করে সেচ মৌসুমে পেট্রোবাংলা যাতে প্রতিশ্রম্নত গ্যাস সরবরাহ করে তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
একেবারেই গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ার কারণে চট্টগ্রামের রাউজান, শিকলবাহা, বাঘাবাড়ী, হরিপুরের বিদু্যত কেন্দ্রগুলো বন্ধ আছে। সম্মিলিতভাবে এ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ৰমতা ৬৮৮ মেগাওয়াট। এছাড়া আরও ৬টি বিদু্যত কেন্দ্র পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। এগুলো হচ্ছে টঙ্গী জিটি-১০৫ মেগাওয়াট, মেঘনাঘাট পাওয়ার (সিসিপিপি)-৪৫০ মেগাওয়াট, হরিপুর পাওয়ার (সিসিপিপি)-৩৬০ মেগাওয়াট, আরপিসিএল-১১০, ওয়েস্টমন্ট জিটি-৯০ মেগাওয়াট পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। গ্যাস সঙ্কটের কারণে এসব বিদু্যত কেন্দ্রের উৎপাদন অনেকৰেত্রে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে দৈনিক গড়ে এক হাজার মেগাওয়াট বিদু্যত উৎপাদন কম হচ্ছে।
গ্যাসের অপর্যাপ্ত সরবরাহ নিয়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, গ্যাস যে পরিমাণ উৎপাদন হয় তাই সকলকে ভাগ করে দেয়া হয়। পিডিবির চিঠি প্রাপ্তির কথা উলেস্নখ করে বলেন, বাড়তি গ্যাস দিতে হলে শিল্প, সারকারখানা এবং গৃহস্থালিতে সঙ্কট দেখা দেবে। পেট্রোবাংলা গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ জন্য ধৈর্য ধারণ করতে হবে। হঠাৎ করেই কিছু করে ফেলা সম্ভব নয়।
তিনি বিগত সময়ের কথা উলেস্নখ করে বলেন, গ্যাস বিরতণ কোম্পানিগুলো পেট্রোবাংলা যে পরিমাণ গ্যাস দিতে পারবে এর দ্বিগুণ পরিমাণ গ্যাস সংযোগ দিয়েছে। এতে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, নতুন সংযোগ দেয়ার আগে চিনত্মা করা উচিত ছিল গ্রাহকের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে কি না।
অন্যদিকে পিডিবি বলছে, সেচ মৌসুমে বাড়তি এক হাজার ২৮৮ মেগাওয়াট চাহিদা সৃষ্টি হবে। এর একটি বড় অঙ্কই ব্যবহার করবে পলস্নী বিদু্যতায়ন বোর্ড (পবিবো)। সেচযন্ত্র চালিয়ে রাখার জন্য দৈনিক পবিবোর বাড়তি এক হাজার ৫৪ মেগাওয়াট বিদু্যতের প্রয়োজন হবে। এছাড়া বাংলাদেশ বিদু্যত উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো)-এর দৈনিক ২১০ মেগাওয়াট, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্র্রিবিউশন কোম্পানি লি. (ওজোপাডিকো)-এর দৈনিক ২৩ দশমিক ৪ মেগাওয়াট, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. (ডিপিডিসি)-এর দৈনিক দশমিক এক মেগাওয়াট, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপস্নাই কোম্পানি লি. (ডেসকো)-এর দৈনিক দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদু্যত প্রয়োজন হবে। কিন্তু লোডশেডিং ছাড়া অতিরিক্ত চাহিদা মোকাবেলার তেমন কোন উপায় নেই। সম্প্রতি ভাড়াভিত্তিক বিদু্যত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাৰরিত হলেও সেচ মৌসুমে বিদু্যত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এতে জনদুর্ভোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দেশে সেচপাম্পগুলোর ঘনত্বর দিক দিয়ে দেখা যায় রংপুরে ঘনত্ব সব থেকে বেশি। এ অঞ্চলে সেচপাম্পের ঘনত্ব রয়েছে ২৫ দশমিক ৭২ ভাগ। এছাড়া রাজশাহীতে ১৯ দশমিক ৯৫ ভাগ, ময়মনসিংহে ১৬ দশমিক ৮১ ভাগ, খুলনায় ১৪ দশমিক ৪৩ ভাগ, কুমিলস্নায় ৮ দশমিক ৮৭ ভাগ, সিলেটে দশমিক ৯৪ ভাগ এবং বরিশালে দশমিক ২৬ ভাগ সেচপাম্পের ঘনত্ব রয়েছে। সেচের ৰেত্রে পাম্পের ঘনত্ব যে এলাকায় যত বেশি সেখানে বিদু্যত ব্যবহারের পরিমাণ তত বেশি হবে। সেচ মৌসুমে দিনের বেলা লোডশেডিং শামাল দিতে যে ১০০ মেগাওয়াট রিজার্ভ রাখা হয়েছে সেখানে বণ্টনের ৰেত্রে রাজশাহীকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। রাজশাহীতে ১০০ মেগাওয়াটের মধ্যে ২৪ মেগাওয়াট বণ্টন করা হবে। রংপুরে বণ্টন করা হবে ২২ মেগাওয়াট, খুলনায় ১২, ঢাকায় ১২, ময়মনসিংহে ১৬, কুমিলস্নায় ৯, চট্টগ্রামে ৪ এবং সিলেটে এক মেগাওয়াট বণ্টন করা হবে।
লোড ম্যানেজমেন্টের জন্য রাত ১১টা থেকে সর্বোচ্চ সকাল ৮টা পর্যনত্ম কৃষকদের সেচপাম্প চালানোসহ ৭টি পদৰেপ নেয়া হয়েছে। এসব পদৰেপের মাধ্যমে বিদু্যত সাশ্রয় সম্ভব হবে বলে মনে করছে পিডিবি।
No comments