বিদ্যুতে ভর্তুকি তুললে সর্বক্ষেত্রে ব্যয় বাড়বে by নাজমুল ইমাম

বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেবে সরকার। এ জন্য ধাপে ধাপে বাড়বে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুৎ নিয়ে এ পরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছে সরকার। রেন্টালে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে গিয়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় পর্যায়ক্রমে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে। তবে সরকার চায় গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে। এ জন্য ২০১৩ সালের মধ্যে দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভর্তুকি দেবে সরকার। ২০১৫ সালে আর


ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হবে না। অর্থাৎ উৎপাদনসহ সরবরাহ ব্যয় যা হবে সে দামে গ্রাহককে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১২ শতাংশ। বিদ্যুতের দাম বাড়লে এটা আরও বাড়বে। বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া হলে বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। বিশেষ করে সাধারণ গ্রাহকের দুর্ভোগ বাড়বে। বাড়বে শিল্প উৎপাদন খরচ। ২০২১ সাল নাগাদ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পেঁৗছে দেওয়ার কথা থাকলেও ভর্তুকি একেবারে তুলে দেওয়া হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকের পক্ষে বিদ্যুৎ ব্যবহার করাও কঠিন হবে।
জানা গেছে, সরকার পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি তুলে দিতে চাইলেও রেন্টাল কেন্দ্রের কারণে তা কঠিন হয়ে পড়ছে। গত সপ্তাহেও পিডিবি সরকারের কাছ থেকে অক্টোবরের ভর্তুকি বাবদ ৭২৯ কোটি টাকা নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মধ্য রাত থেকে জ্বালানি তেল এবং রোববার থেকে বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম বৃদ্ধির ফলে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ২৫ পয়সা করে বেড়েছে। এতে চলতি অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে পিডিবির আর্থিক ক্ষতি বাড়বে ৪৩২ কোটি
টাকা। এর ফলে এ অর্থবছর শেষে বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকায় পেঁৗছবে। জ্বালানি ও কয়লার দাম বৃদ্ধির সঙ্গে লোকসান বেড়ে যাওয়ায় আরেক দফা বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্যবৃদ্ধি চেয়ে শিগগির বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) আবেদন করা হবে বলে পিডিবি সূত্র জানিয়েছে।
পিডিবির চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির গতকাল সন্ধ্যায় সমকালকে বলেছেন, ধাপে ধাপে যাতে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমে আসে সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা এগোচ্ছি। এ খাতকে টেকসই করতে বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় মূল্য সমান হতে হবে। তবে এটা এখনই করা সম্ভব নয়। নতুন করে জ্বালানি তেল ও কয়লার দাম বৃদ্ধির ফলে কী প্রভাব পড়ছে এখন সেটা দেখা হচ্ছে। এর ফলে বাড়তি লোকসান লাঘবে সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া না গেলে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির জন্য বিইআরসিতে আবারও প্রস্তাব দেওয়া হবে।
রোববার বিদ্যুৎ ভবনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, আগামী তিন বছর ধরে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বিদ্যুৎ খাতে আগামীতে সরকার আর ভর্তুকি দিতে চায় না বলে অর্থমন্ত্রী এ মন্তব্য করেছেন এমন ধারণা বিশ্লেষকদের। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সমকালকে বলেন, সরকারকে দুটো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর একটি হচ্ছে, ভর্তুকির প্রয়োজন আছে কি-না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ভর্তুকি দিলে কতটা দেওয়া যাবে তা নির্ধারণ করা। কিন্তু এ বিষয়ে পর্যালোচনা না করে আগামীতে বিদ্যুতের দাম বাড়বে কি; বাড়বে না সেটা বলা অবান্তর। আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থমন্ত্রী গত রোববার যেটা বলেছেন; সেটা অপ্রিয় হলেও সত্য। কারণ বিদ্যুতের দাম পর্যায়ক্রমে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সরকারের আগে থেকেই রয়েছে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যেও তা বলেছেন। বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে সরকারের উপায় নেই। কারণ এ মুহূর্তে এত ভর্তুকি দেওয়ার মতো অবস্থা অর্থনীতির নেই। তিনি আরও বলেন, সরকার হয়তো মনে করছে, তিন বছর পর বিদ্যুতের বড় বড় প্রকল্পগুলো চলে আসবে। তখন উৎপাদন খরচ অনেক কমে আসবে। এ কারণেই অর্থমন্ত্রী তিন বছরের কথা বলেছেন বলে তার ধারণা।
রেন্টালের কারণে বেশি দামে কিনে কম দামে গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থার পাশাপাশি বেশিরভাগ বিতরণ সংস্থা লোকসান দিচ্ছে। বছর বছর পিডিবির কাঁধে এ লোকসানের বোঝা বাড়ছে। সরকারের কাছ থেকে ঋণে টাকা নিয়ে এ লোকসান সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী পিডিবি সব সময় ধারেও টাকা পাচ্ছে না। এতে সংস্থাটি আর্থিকভাবে চরম সংকটের মুখে পড়েছে। তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে।
পিডিবি সূত্র জানায়, গত অর্থবছর সরকারি-বেসরকারি খাতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ খরচসহ সরবরাহে সব মিলিয়ে প্রতি ইউনিটে ব্যয় হয় ৪ টাকা ১৫ পয়সা। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে তা ৫ টাকা ১৮ পয়সা এবং নভেম্বরে ৫ টাকা ৩১ পয়সায় পেঁৗছে। ডিসেম্বর শেষে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় ৫ টাকা ৪৩ পয়সা এবং এ মাস থেকে এটা ৫ টাকা ৭৬ পয়সায় দাঁড়াবে। অথচ গত মাসে মূল্যবৃদ্ধির পর এখন ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের গড় খুচরা মূল্য পড়ছে ৩ টাকা ২৫ পয়সা। ফেব্রুয়ারিতে এটা বেড়ে হবে ৩ টাকা ৭৪ পয়সা। চলতি অর্থবছরের মধ্যে নির্মাণাধীন আরও তিনটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে পিডিবির লোকসানের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।
বর্তমানে জলবিদ্যুতে সরবরাহ ব্যয় ৩ টাকা ৪২ পয়সা; গ্যাসে ৩ টাকা ৬ পয়সা; ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলে গড়ে ১৫ টাকা ২৯ পয়সা এবং কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে ৫ টাকা ৬১ পয়সা।

No comments

Powered by Blogger.