হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে ঝুঁকির মুখে ব্যাংকে এলসি by এম শাহজাহান

হলমার্ক ইস্যুতে শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, গোটা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে চাহিদাপত্র বা এলসি খোলা এ মুহূর্তে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ক্লায়েন্টদের প্রতি ব্যাংকিং খাতের আস্থা কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের উর্ধতন কর্মকর্তাদের প্রতিও বিশ্বাস রাখতে পারছে না ক্লায়েন্টরা।


অর্থাৎ হলমার্ক ইস্যুতে ব্যাংক-ক্লায়েন্টদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। আর এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। এলসি খুলতে পারছেন না তাঁরা।
সঙ্কট দ্রুত সমাধানে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আগামী ১১ সেপ্টেম্বর জরুরী সাংবাদিক সম্মেলন করার ঘোষণা দিয়েছে। হলমার্ক ইস্যুতে কি ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা ওই সাংবাদিক সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জনকণ্ঠকে বলেন, হলমার্ক ইস্যুতে পুরো অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহ বাড়ছে কিংবা এলসি খুলতে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ঋণ পেতে এমনিতেই বহু ঝামেলা ছিল, হলমার্ক ইস্যুতে সঙ্কট আরও গভীর হলো। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে যারা এ ধরনের লুটপাট করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
জানা গেছে, হলমার্কসহ আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২০ আগস্ট এলসি খোলার আগে সঠিকভাবে যাচাইবাছাই করার জন্য সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে নিদের্শনা পাঠায়। এ নিদের্শনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে একদিনের এলসি খোলার কাজ বর্তমানে চারদিন লাগছে। এ অবস্থায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা চরম বেকায়দায় পড়েছেন। তাঁরা বলেছেন, হলমার্কসহ আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মসহ বিভিন্ন কারণে সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে একদিনের মধ্যে এলসি খোলার যে একটি ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছিল, তা গত দুই সপ্তাহ ধরে নেই। একটি এলসি খুলতে বর্তমানে সময় লাগছে তিন থেকে চারদিন। এ অবস্থায় রফতানি বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলসি খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নির্দেশনা জারি হয়েছে, তা যুক্তিসঙ্গত নয়। একটি এলসি খুলতে চারদিন সময় নেয়া হলে দেশের অর্থনীতির বারোটা বেজে যাবে। কেননা এ বিষয়টির সঙ্গে দেশের কোটি মানুষের কর্মসংস্থান এবং জীবন-জীবিকার ভাগ্য জড়িত।
তিনি আরও বলেন, এ সঙ্কট দূর করতে অর্থমন্ত্রীর অনীহা থাকার কথা নয়। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের এ যুগে একটি এলসি খুলতে একদিনের বেশি সময় লাগলে তা মানায় না। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে দেশের রফতানিমুখী শিল্পে এই ছোট সঙ্কট বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কেননা লেটার অব ক্রেডিট বা চাহিদা পত্র ব্যাংকগুলো থেকে দ্রুত দেয়া না হলে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।
এছাড়াও ইতোমধ্যে এলসি খোলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানিকারকরা বিপাকে পড়েছেন। এমনিতেই বাংলাদেশের সরকারী ছুটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের দেশগুলোর (ইউরোপ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) মিল না থাকায় সপ্তাহে মাত্র চারদিন ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে। এর মধ্যে যদি হলমার্কের মতো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য রফতানিমুখী শিল্পের এলসি খুলতে সমস্যা হয়, তাহলে এটি হচ্ছে অযাচিত সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাধ্য হয়ে শুক্রবার ছুটির দিন অর্থমন্ত্রীর বাসায় জরুরী বৈঠক করেন ব্যবসায়ী নেতারা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সিদ্দিুকর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এমনিতেই তৈরি পোশাক শিল্পে নানা সঙ্কট লেগে আছে। এ অবস্থায় এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোর গড়িমসির কারণে নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। দ্রুত এ সঙ্কট নিরসন না হলে সময়মতো শ্রমিকদের বেতন দেয়া সম্ভব নয়। এরপর শ্রম অসন্তোষ দেখা দিলে এর দায়ভার ব্যাংকগুলো নিশ্চয়ই বহন করবে না। তাই দ্রুত এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, সঙ্কটের বিষয়টি রফতানিকারকদের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি দ্রুত সঙ্কট সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। বিজিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত এই সভাপতি হলমার্কের নাম উল্লেখ না করে আরও বলেন, যারা এ ধরনের কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকবে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত। গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী নামধারীর কাছে পুরো অর্থব্যবস্থা জিম্মি থাকতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.