ভারতকে পাকিস্তানের এমএফএন, চাপে বাংলাদেশ! by আসজাদুল কিবরিয়া
অনেকটা নাটকীয়ভাবেই পাকিস্তানের দিক থেকে ঘোষণাটা আসে। সেটা প্রতিবেশী ভারতকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) অন্যতম স্তম্ভ এমএফএন (মোস্ট ফেভারড নেশন) বা সম-অধিকার মর্যাদা দেওয়া। ডব্লিউটিওর সদস্য হওয়ার পরও পাকিস্তান ভারতকে এত দিন পর্যন্ত এ সুবিধা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। অবশ্য ভারতও পাকিস্তানকে এ সুবিধা দেওয়া থেকে দীর্ঘদিন বিরত ছিল।
২ নভেম্বর পাকিস্তানের মন্ত্রিপরিষদ ভারতকে এমএফএন সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়। যদিও এরপর কয়েক দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। এমএফএন সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা আপাতত দেওয়া হচ্ছে না—এমন ভাষ্য পাকিস্তানের দিক থেকেই আসে। আবার পাকিস্তান ‘এমএফএন দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি’—এমন আশ্বাসও মেলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। তবে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনকে সামনে রেখে পাকিস্তানের এ সিদ্ধান্ত তাৎপর্যবাহী।
বস্তুত ডব্লিউটিএর দুটি মূল স্তম্ভের একটি হচ্ছে এমএফএন। অপরটি হলো: ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট বা জাতীয় মর্যাদা। আর এ দুটি স্তম্ভ রচিত হয়েছে জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড বা গ্যাটের মৌলনীতি অবৈষম্যের (নন-ডিসক্রিমেশন) ওপর ভিত্তি করে। আর গ্যাট থেকেই ডব্লিউটিওর আত্মপ্রকাশ।
এমএফএন বলতে বোঝানো হয়, এ সংস্থার সদস্য হিসেবে কোনো দেশ আরেক দেশকে এমন কোনো বাড়তি সুবিধা দেবে না, যা বাকি সব সদস্য দেশকে দেয়নি। তার মানে যদি কোনো দেশ অন্য কোনো দেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশেষ কোনো শুল্কছাড় দেয়, তাহলে দ্বিতীয় দেশটি প্রথম দেশের জন্য সবচেয়ে পছন্দের জাতি (এমএফএন) হয়ে যায়। তবে এ শুল্কছাড় শুধু দ্বিতীয় দেশের জন্য নয়, বাকি সব দেশের জন্যই দিতে হবে। তাহলেই এমএফএন নীতিটি পরিপালিত হবে।
একইভাবে যদি কোনো দেশ অভ্যন্তরীণ শিল্প সুরক্ষার জন্য আমদানি করা কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে বাড়তি শুল্ক আরোপ করে, তাহলে তা সব দেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। একক কোনো দেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে আরোপ করা যাবে না। সুতরাং এমএফএন সুবিধার মানে হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমঅধিকার বা সমভাবে বিবেচনার সুবিধা।
মজার বিষয় হচ্ছে, ডব্লিউটিএতে এমএফএন সুবিধাটি ব্যতিক্রমী রাখা হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। এ তথ্য উল্লেখ করে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা বলা হয়েছিল যে ভারত ও পাকিস্তান সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রক্রিয়ায় একে অন্যকে এমএফএন মর্যাদা বা সুবিধা দেবে। অন্য কোনো দেশের জন্য এ রকম ছাড় দেওয়া হয়নি।’ অবশ্য গ্যাট দলিলে এমএফএনের অনেক ব্যতিক্রম রয়েছে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট সে রকম দুটি ব্যতিক্রম সেখানে এমএফএন মর্যাদা অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়।
মনজুর আহমেদ অবশ্য মনে করেন, ভারতকে এমএফএন সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে পাকিস্তান মূলত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ককে জোরদার করার দিকে অগ্রসর হবে। এতে সাফটায় খুব একটা প্রভাব পড়বে না। তাঁর মতে, কার্যত বাংলাদেশই সাফটার আওতায় বাণিজ্য করছে। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোকে। একইভাবে ভারত ও নেপালের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে কোনো দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেনি।
বাস্তবে অবশ্য এমএফএনকে ‘কিছুটা অদ্ভুত’ বলেই বিবেচনা করা হয়। জাতীয় মর্যাদাও এমএফএনের মতো আরেকটি স্তম্ভ। এর আওতায় কোনো দেশই বিদেশি আমদানি করা বা কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। একবার কোনো দেশে কোনো পণ্য প্রবেশ করলে সেই দেশের সমজাতীয় অভ্যন্তরীণ পণ্যের মতো শুল্ক, নিয়ন্ত্রণবিধি ইত্যাদি ওই আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্র প্রযোজ্য হবে।
ভারত পাকিস্তানকে এমএফএন মর্যাদা দেয় ১৯৯৬ সালে। সে হিসেবে ভারত কর্তৃক এমএফএন মর্যাদা বা সুবিধা পাওয়ার ১৫ বছর পরে পাকিস্তান ভারতকে একই মর্যাদা দিতে যাচ্ছে। এত দিন পর্যন্ত পাকিস্তান সর্বোচ্চ এক হাজার ৯৩৩টি পণ্যসামগ্রীকে ভারত থেকে আমদানিযোগ্য বিবেচনা করত। এ পণ্যের তালিকাকে বলা হয় ইতিবাচক তালিকা (পজিটিভ লিস্ট)। ২০০৪ সালে সাফটা (দক্ষিণ এশীয় অবাধ বাণিজ্য চুক্তি) আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হওয়ার পরই পাকিস্তান জানিয়ে দেয় যে ভারতকে সাফটার আওতাতেও তারা এমএফএন মর্যাদা দেবে না। কেননা, এমএফএন দিলে ভারতীয় সকল পণ্য (নেতিবাচক তালিকার বাইরে) শুল্কমুক্তভাবে আমদানির বাধ্যবাধকতা তৈরি হতো।
পাকিস্তান অবশ্য এমএফএন দেওয়ার বিপরীতে ভারতীয় বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা অপসারণের শর্তটি জুড়ে দিয়েছে। এটা তাৎপর্যবহ। বাংলাদেশও ভারতের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অশুল্ক বাধার মুখে পড়ে। এসব অশুল্ক বাধা অপসারণের জন্য বহু দিন থেকে দেনদরবারও করে আসছে বাংলাদেশ।
আবার পাকিস্তান ইতিবাচক তালিকার বদলে নেতিবাচক তালিকায় যাওয়ার কথাও জানিয়েছে। এটা হলে কোনো কোনো পণ্য শুল্কছাড় ও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না, সেটা স্পষ্ট হবে। তবে কোনো পণ্য আমদানিতেই কোনো বাধা থাকবে না।
তবে পাকিস্তানের এসব উদ্যোগ সাফটাকে কতটা অর্থবহ করবে, তা অনিশ্চিত। বরং এটা ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নসহ বৃহত্তর কিছু বাণিজ্যিক রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, ২০০৫ সালে ডব্লিউটিওর হংকং সম্মেলনের স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নত বিশ্বে শতভাগ বাজার সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি রোধ করতে পাকিস্তান প্রকাশ্যেই বড় ভূমিকা রেখেছিল। আর তাই বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সর্বোচ্চ ৯৭ শতাংশ পণ্যে বাজার সুবিধাপ্রাপ্তির ঘোষণা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পাকিস্তান প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেও নেপথ্যে ভারতের সমর্থনের বিষয়টিও আর অজানা নয়।
পাকিস্তান এমন একটি সময়ে ভারতকে এমএফএন মর্যাদা দেওয়ার কথা জানিয়েছে, যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে পাকিস্তানের তৈরি পোশাক দুই বছরের জন্য ২০ শতাংশ হারে শুল্কছাড়ে প্রবেশাধিকারের চেষ্টা করছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে সহায়তা হিসেবে অনুদানের বদলে এ বাণিজ্য ছাড় পেতে ইতিমধ্যে পাকিস্তান অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এতে সম্মত। কিন্তু এ সুবিধা পেতে হলে ডব্লিউটিওর অনুমোদন লাগবে। কেননা, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পাকিস্তান কোনোভাবেই বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশের সমধর্মী সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়।
আর তাই প্রায় বছর খানেক আগেই পাকিস্তানের জন্য যখন ইইউ ডব্লিউটিওতে এ বাণিজ্যছাড়ের জন্য আবেদন করে, তখন বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা আপত্তি জানায়। বিশেষত, ভারতের আপত্তিটা ছিল অনেক জোরালো। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় যে এটা এমন একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করবে, যা অন্যদেরও এ রকম ছাড় পেতে উৎসাহিত করবে। অথচ তা হবে ডব্লিউটিওর নীতিবিধির পরিপন্থী।
ঘটনাচক্রে ভারত ইদানীং তার আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যা পাকিস্তানকে নতুনভাবে আশান্বিত করে। তবে গত সপ্তাহে জেনেভায় এ-সংক্রান্ত এক বৈঠকে বাংলাদেশে আবারও আপত্তি জানালে বিষয়টি আর অগ্রসর হতে পারেনি। ডব্লিউটিওর বিধান অনুসারে কোনো একটি সদস্য দেশ কোনো বিষয়ে আপত্তি জানালে, তা আর অনুমোদন করা যাবে না।
ইইউ ৭৫টি পণ্যে পাকিস্তানকে শুল্কছাড় দিতে চেয়েছে। এর মধ্যে আটটি তৈরি পোশাক পণ্য রয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশও ব্যাপকভাবে রপ্তানি করে থাকে। সঙ্গত কারণেই পাকিস্তান এসব পণ্যে শুল্কছাড় পেলে বাংলাদেশ বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। তা ছাড়া ইউরোপ এখন বড় ধরনের আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যতে সেখানে মন্দা দেখা দিয়ে চাহিদা কমে যেতে পারে, যা আবার বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানির গতি শ্লথ করে দেবে। এই অবস্থায় পাকিস্তানি পণ্য শুল্কছাড় পেলে তা তা বাংলাদেশের জন্য বাড়তি চাপ হবে।
বাংলাদেশের আপত্তি পাকিস্তানকে যারপরনাই ক্ষুব্ধ করেছে। পাকিস্তান সরকার গত বৃহস্পতিবারই মালদ্বীপে শুরু হওয়া দুই দিনের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে পৃথকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। আশ্বাস চেয়েছে যেন বাংলাদেশ কোনো আপত্তি না জানায়।
কিন্তু বাংলাদেশের দিক থেকে এ ধরনের কোনো আশ্বাস দেওয়ার অবকাশ নেই। তা ছাড়া এমএফএন মর্যাদা দেওয়ার বিনিময়ে পাকিস্তান ভারতের কাছ থেকে ডব্লিউটিওতে এই বাণিজ্যছাড়ের বিষয়ে সহযোগিতার প্রত্যাশা করছে, তা এখন স্পষ্ট।
এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে অনেকটাই একমত পোষণ করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া হয়েছে। আর তাই বাংলাদেশকে কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারত যেন বাংলাদেশের বিপক্ষে চলে না যায়, সে চেষ্টা করতে হবে।’
বস্তুত ডব্লিউটিএর দুটি মূল স্তম্ভের একটি হচ্ছে এমএফএন। অপরটি হলো: ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট বা জাতীয় মর্যাদা। আর এ দুটি স্তম্ভ রচিত হয়েছে জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড বা গ্যাটের মৌলনীতি অবৈষম্যের (নন-ডিসক্রিমেশন) ওপর ভিত্তি করে। আর গ্যাট থেকেই ডব্লিউটিওর আত্মপ্রকাশ।
এমএফএন বলতে বোঝানো হয়, এ সংস্থার সদস্য হিসেবে কোনো দেশ আরেক দেশকে এমন কোনো বাড়তি সুবিধা দেবে না, যা বাকি সব সদস্য দেশকে দেয়নি। তার মানে যদি কোনো দেশ অন্য কোনো দেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশেষ কোনো শুল্কছাড় দেয়, তাহলে দ্বিতীয় দেশটি প্রথম দেশের জন্য সবচেয়ে পছন্দের জাতি (এমএফএন) হয়ে যায়। তবে এ শুল্কছাড় শুধু দ্বিতীয় দেশের জন্য নয়, বাকি সব দেশের জন্যই দিতে হবে। তাহলেই এমএফএন নীতিটি পরিপালিত হবে।
একইভাবে যদি কোনো দেশ অভ্যন্তরীণ শিল্প সুরক্ষার জন্য আমদানি করা কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে বাড়তি শুল্ক আরোপ করে, তাহলে তা সব দেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। একক কোনো দেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে আরোপ করা যাবে না। সুতরাং এমএফএন সুবিধার মানে হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমঅধিকার বা সমভাবে বিবেচনার সুবিধা।
মজার বিষয় হচ্ছে, ডব্লিউটিএতে এমএফএন সুবিধাটি ব্যতিক্রমী রাখা হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। এ তথ্য উল্লেখ করে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা বলা হয়েছিল যে ভারত ও পাকিস্তান সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রক্রিয়ায় একে অন্যকে এমএফএন মর্যাদা বা সুবিধা দেবে। অন্য কোনো দেশের জন্য এ রকম ছাড় দেওয়া হয়নি।’ অবশ্য গ্যাট দলিলে এমএফএনের অনেক ব্যতিক্রম রয়েছে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট সে রকম দুটি ব্যতিক্রম সেখানে এমএফএন মর্যাদা অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়।
মনজুর আহমেদ অবশ্য মনে করেন, ভারতকে এমএফএন সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে পাকিস্তান মূলত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ককে জোরদার করার দিকে অগ্রসর হবে। এতে সাফটায় খুব একটা প্রভাব পড়বে না। তাঁর মতে, কার্যত বাংলাদেশই সাফটার আওতায় বাণিজ্য করছে। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোকে। একইভাবে ভারত ও নেপালের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে কোনো দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেনি।
বাস্তবে অবশ্য এমএফএনকে ‘কিছুটা অদ্ভুত’ বলেই বিবেচনা করা হয়। জাতীয় মর্যাদাও এমএফএনের মতো আরেকটি স্তম্ভ। এর আওতায় কোনো দেশই বিদেশি আমদানি করা বা কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। একবার কোনো দেশে কোনো পণ্য প্রবেশ করলে সেই দেশের সমজাতীয় অভ্যন্তরীণ পণ্যের মতো শুল্ক, নিয়ন্ত্রণবিধি ইত্যাদি ওই আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্র প্রযোজ্য হবে।
ভারত পাকিস্তানকে এমএফএন মর্যাদা দেয় ১৯৯৬ সালে। সে হিসেবে ভারত কর্তৃক এমএফএন মর্যাদা বা সুবিধা পাওয়ার ১৫ বছর পরে পাকিস্তান ভারতকে একই মর্যাদা দিতে যাচ্ছে। এত দিন পর্যন্ত পাকিস্তান সর্বোচ্চ এক হাজার ৯৩৩টি পণ্যসামগ্রীকে ভারত থেকে আমদানিযোগ্য বিবেচনা করত। এ পণ্যের তালিকাকে বলা হয় ইতিবাচক তালিকা (পজিটিভ লিস্ট)। ২০০৪ সালে সাফটা (দক্ষিণ এশীয় অবাধ বাণিজ্য চুক্তি) আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হওয়ার পরই পাকিস্তান জানিয়ে দেয় যে ভারতকে সাফটার আওতাতেও তারা এমএফএন মর্যাদা দেবে না। কেননা, এমএফএন দিলে ভারতীয় সকল পণ্য (নেতিবাচক তালিকার বাইরে) শুল্কমুক্তভাবে আমদানির বাধ্যবাধকতা তৈরি হতো।
পাকিস্তান অবশ্য এমএফএন দেওয়ার বিপরীতে ভারতীয় বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা অপসারণের শর্তটি জুড়ে দিয়েছে। এটা তাৎপর্যবহ। বাংলাদেশও ভারতের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অশুল্ক বাধার মুখে পড়ে। এসব অশুল্ক বাধা অপসারণের জন্য বহু দিন থেকে দেনদরবারও করে আসছে বাংলাদেশ।
আবার পাকিস্তান ইতিবাচক তালিকার বদলে নেতিবাচক তালিকায় যাওয়ার কথাও জানিয়েছে। এটা হলে কোনো কোনো পণ্য শুল্কছাড় ও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না, সেটা স্পষ্ট হবে। তবে কোনো পণ্য আমদানিতেই কোনো বাধা থাকবে না।
তবে পাকিস্তানের এসব উদ্যোগ সাফটাকে কতটা অর্থবহ করবে, তা অনিশ্চিত। বরং এটা ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নসহ বৃহত্তর কিছু বাণিজ্যিক রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, ২০০৫ সালে ডব্লিউটিওর হংকং সম্মেলনের স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নত বিশ্বে শতভাগ বাজার সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি রোধ করতে পাকিস্তান প্রকাশ্যেই বড় ভূমিকা রেখেছিল। আর তাই বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সর্বোচ্চ ৯৭ শতাংশ পণ্যে বাজার সুবিধাপ্রাপ্তির ঘোষণা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পাকিস্তান প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেও নেপথ্যে ভারতের সমর্থনের বিষয়টিও আর অজানা নয়।
পাকিস্তান এমন একটি সময়ে ভারতকে এমএফএন মর্যাদা দেওয়ার কথা জানিয়েছে, যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে পাকিস্তানের তৈরি পোশাক দুই বছরের জন্য ২০ শতাংশ হারে শুল্কছাড়ে প্রবেশাধিকারের চেষ্টা করছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে সহায়তা হিসেবে অনুদানের বদলে এ বাণিজ্য ছাড় পেতে ইতিমধ্যে পাকিস্তান অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এতে সম্মত। কিন্তু এ সুবিধা পেতে হলে ডব্লিউটিওর অনুমোদন লাগবে। কেননা, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পাকিস্তান কোনোভাবেই বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশের সমধর্মী সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়।
আর তাই প্রায় বছর খানেক আগেই পাকিস্তানের জন্য যখন ইইউ ডব্লিউটিওতে এ বাণিজ্যছাড়ের জন্য আবেদন করে, তখন বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা আপত্তি জানায়। বিশেষত, ভারতের আপত্তিটা ছিল অনেক জোরালো। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় যে এটা এমন একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করবে, যা অন্যদেরও এ রকম ছাড় পেতে উৎসাহিত করবে। অথচ তা হবে ডব্লিউটিওর নীতিবিধির পরিপন্থী।
ঘটনাচক্রে ভারত ইদানীং তার আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যা পাকিস্তানকে নতুনভাবে আশান্বিত করে। তবে গত সপ্তাহে জেনেভায় এ-সংক্রান্ত এক বৈঠকে বাংলাদেশে আবারও আপত্তি জানালে বিষয়টি আর অগ্রসর হতে পারেনি। ডব্লিউটিওর বিধান অনুসারে কোনো একটি সদস্য দেশ কোনো বিষয়ে আপত্তি জানালে, তা আর অনুমোদন করা যাবে না।
ইইউ ৭৫টি পণ্যে পাকিস্তানকে শুল্কছাড় দিতে চেয়েছে। এর মধ্যে আটটি তৈরি পোশাক পণ্য রয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশও ব্যাপকভাবে রপ্তানি করে থাকে। সঙ্গত কারণেই পাকিস্তান এসব পণ্যে শুল্কছাড় পেলে বাংলাদেশ বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। তা ছাড়া ইউরোপ এখন বড় ধরনের আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যতে সেখানে মন্দা দেখা দিয়ে চাহিদা কমে যেতে পারে, যা আবার বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানির গতি শ্লথ করে দেবে। এই অবস্থায় পাকিস্তানি পণ্য শুল্কছাড় পেলে তা তা বাংলাদেশের জন্য বাড়তি চাপ হবে।
বাংলাদেশের আপত্তি পাকিস্তানকে যারপরনাই ক্ষুব্ধ করেছে। পাকিস্তান সরকার গত বৃহস্পতিবারই মালদ্বীপে শুরু হওয়া দুই দিনের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে পৃথকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। আশ্বাস চেয়েছে যেন বাংলাদেশ কোনো আপত্তি না জানায়।
কিন্তু বাংলাদেশের দিক থেকে এ ধরনের কোনো আশ্বাস দেওয়ার অবকাশ নেই। তা ছাড়া এমএফএন মর্যাদা দেওয়ার বিনিময়ে পাকিস্তান ভারতের কাছ থেকে ডব্লিউটিওতে এই বাণিজ্যছাড়ের বিষয়ে সহযোগিতার প্রত্যাশা করছে, তা এখন স্পষ্ট।
এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে অনেকটাই একমত পোষণ করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া হয়েছে। আর তাই বাংলাদেশকে কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারত যেন বাংলাদেশের বিপক্ষে চলে না যায়, সে চেষ্টা করতে হবে।’
No comments