বই পড়া-২ by তিতাশ চৌধুরী
জেমরিনা হক এককালে ছড়া এবং ছড়া-কবিতা লিখত। শিশু একাডেমির শিশু পত্রিকায় এবং অন্যান্য পত্রিকায়ও তার ছড়া-কবিতা প্রকাশ হতে দেখি। আমি তখন কর্মোপলক্ষ্যে কুমিল্লায় বাস করি। তখনই তার ছড়া-কবিতাগুলো আকর্ষণ করত আমাকে। এ ব্যাপারে আমি তাকে উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এ পথে আর সে তেমন এগোয়নি। এর কারণ একদিন নিজেই আবিষ্কার করি যে জেমরিনা মূলত আর্টের ছাত্রী।
আর্ট নিয়েই তখন তার চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। সুতরাং ছড়া-কবিতা লেখার দিকে তেমন মন দিতে পারেনি। তাই কোনো কাগজেই তার লেখা আর দেখা যায় না। এর মধ্যে সে আর্ট বিষয়ে পাসটাস করে একটি সরকারি স্কুলে আর্টের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে এবং আর্টের চর্চাও অব্যাহত রাখে। একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে জেমরিনা এর মধ্যে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। এ যাবত্ তার চারটি একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি দেশে এবং একটি বিদেশে অর্থাত্ প্যারিসে। প্রত্যেকটি প্রদর্শনীতেই সে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে। সে চিত্রে যে রং তুলি ব্যবহার করে তা শিল্পবোদ্ধা কিংবা তার শিক্ষকরা এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। যেমন—শিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘জেমরিনা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করলে তার ক্ষেত্রে সে আরও ভালো করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’ বেশ কিছুদিন আগে জেমরিনার পাখিবিষয়ক একটি একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে জেমরিনা যেসব পাখি ক্যানভাসে চিত্রায়িত করে তা দর্শন করে অনেক বোদ্ধাদর্শক অভিভূত হয়েছিলেন। পাখির স্বভাব, আচরণ ও ভাষা এমনভাবে দর্শকসম্মুখে উপস্থাপন করেছিল যে তা এক কথায় অপূর্ব। আমি নিজেও তা দর্শন করে মুগ্ধ ও বিমোহিত হয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, তার একটি ছবিও আমি কিনেছিলাম। চিত্রের পাশাপাশি জেমরিনা যে হঠাত্ করে আবার ছড়া-কবিতা লিখতে বসে গিয়েছিল— তা জানা ছিল না। একদিন সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি—জেমরিনার একটি ছড়া-কবিতার পুস্তকও আমার টেবিলে শোভা পাচ্ছে। আমার অনুপস্থিতে সে বইটি উপহার হিসেবে রেখে গেছে। বইটির নাম ‘শিশির পড়ে টুপ’। এটি তাত্ক্ষণিকই পাঠ করে আমি মুগ্ধ, বিস্মিত এবং অভিভূত। বইটিকে বিভিন্ন জাতের ছড়া দিয়ে সাজানো হয়েছে। এর প্রচ্ছদও এঁকে দিয়েছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত কার্টুনিসল্ট শিশির ভট্টাচার্য। জেমরিনা যে আবার ছড়া-কবিতার জগতে ফিরে আসবে তা আমাকে অবাক করেছে। তার এই ফিরে আসাকে আমি অভিনন্দন জানাই। একটু আগেই উল্লেখ করেছি জেমরিনার ছড়া কবিতা বিভিন্ন রকমের। সুখ, হতাশা-শোক, দ্রোহ, বিরহ, আদর, ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয়ক ছড়া এতে স্থান পেয়েছে। অর্থাত্ বিচিত্রধর্মী ছড়া ‘শিশির পড়ে টুপ’ বইটির অহঙ্কার ও অলঙ্কার বৃদ্ধি করেছে। জেমরিনা যদি ভবিষ্যতে চিত্রের পাশাপাশি ছড়া-কবিতা চর্চা অব্যাহত রাখে—তাহলে ছড়া সাহিত্যেও তার পদক্ষেপ গণনাযোগ্য হবে। জেমরিনার বইটিতে মোট ৩৫/৩৬টা ছড়া-কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর প্রত্যেকটি ছড়া-কবিতাই যে আকর্ষণীয় আমি তা বলব না। তবে প্রত্যেকটি ছড়ারই কোনো না কোনো আকর্ষণ আছে, স্বাদ ও গন্ব্দ আছে, ঠাট ও অহঙ্কার আছে। এগুলো পাঠক একবার পাঠ করলে তা তাকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করবেই—এ বিশ্বাস আমার আছে। জেমরিনার ছড়া-কবিতার ভাষা, শব্দচয়ন, বুননের টেকনিক, উপমা-উপ্রেক্ষা প্রতীক ও চিত্রকল্প নির্মাণ করে সে অনেক ক্ষেত্রে শক্তির পরিচয় দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিছু উদারহণ জড়ো করি। যেমন—‘কবি বলেন/জীবন হলো/অনেক চাওয়া/বন্ব্দুর কোনো হাত/জীবন হলো/বন্ব্দু খোঁজা/উষ্ণ এক উত্তাপ/বুকের ভিতর ঘিরে রাখা/কষ্ট আবর্জনা/জীবন হলো/সব লুকিয়ে/হাসির প্রতারণা’ (ধন্য, পৃ-৭)। কিংবা ভাইকে নিয়ে লেখা : ‘... যখনই চোখ বুঝি/প্রাণ যে আমার আধেক/হলো সেই কৈশোরেতে/লাটাই ঘুড়ি উড়বে না আর/আলমডাঙ্গার ঐ ক্ষেত্রে/আলমডাঙ্গার ঐ অন্যপারে/করলি কেন বাসা/ভাঙলি কেন এমন করে/মোদের ভালোবাসা’ (বাইগো আমার, পৃ-৬)। জেমরিনার দেশপ্রেম ও দ্রোহ আমাদের মর্মে স্পর্শ করে যেমন : ‘বল নারে মা বুলবুলিরা, ধান খেয়েছে কবে? ধান তো খেল পাকসেনারা একাত্তরেই হবে/বলনারে মা বুলবুলিরা/ধান খেয়েছে কবে?/ধানতো খেল লুটেরেরা স্বাধীন হলো যবে’ (বুলবুলি, পৃ-৮)। জেমরিনার কষ্টও সবার কষ্ট হয়ে দাঁড়ায়/যেমন, ‘কষ্টগুলো বুকের ভিতর/উতলে উঠা ঢেউ/পুত্রহারা মায়ের শোকে/কাঁদছে যেন কেউ/... কষ্টগুলো মেঘ হয়ে যাক/কষ্টগুলো রোদ/ সুতোর টানে কষ্টগুলো/হারিয়ে ফেলুক বোধ’ (কষ্ট, পৃ-১১)/জেমরিনার প্রতীকাশ্রিত কালেম পাখি ছড়া কবিতাটাও গণনাযোগ্য। যেমন : নীল সবুজে গায়ের বরণ/ঠোঁট দু’খানি লাল/কালেম পাখি নামটি যেতার/নাইকো ঘরের চাল/নল বনের ঐ ঝোঁপটি ঘিরে/কালেম পাখির ঘর/সব পাখিরাই বন্ব্দু যেন/কেউ যেন নয় পর’ (কালেম পাখি, পৃ-২৩)। একুশ নিয়ে দেশ নিয়েও জেমরিনার চিন্তা-ভাবনা আমাদের আক্রান্ত করে। যেমন—‘একুশ হবে দৃপ্ত শপথ/একুশ হবে শক্তি/নতুন প্রাণে জেগে উঠার/নতুন প্রাণে মুক্তি’ (একুশ, পৃ-৩২)। পুস্তকের নামে যে কবিতাটি এটি একটি শোক সঞ্চারি কবিতা। পুস্তকের মূল আকর্ষণ। এটি উপমা-উপ্রেক্ষা, প্রতীক ও চিত্রকল্পে অসাধারণ হয়ে উঠেছে। এটি চিত্রী ছড়াকারের কোনো এক ঘনিষ্ঠ বান্ব্দবীর মৃত্যুতে লেখা। ফলে বিভিন্ন অলঙ্কারের ছায়া পড়েছে এতে। কবিতা হিসেবেও এটি চমত্কার। ক্যামেলিয়া নামক বান্ব্দবীর স্মৃতির উদ্দেশ্যেই এটি নিবেদিত। পুরো কবিতাটি এখানে পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম, যেমন : সফেদ বরণ মেঘবালিকা/কেন হলি তুই চুপ্/বরফ সাগরের হিম সাগরের/কোথায় দিলি ডুব/কুসুম কুসুম জলে ডুবি/বরই পাতা জল/কেমন করে পেয়ে গেলি/ অথৈর জলের তল/নাই বা হলি আধ জ্যোত্স্নার/ ঘুমপরীদের ঘর/নাইবা হলি নিথর নিকষ/ গভীর সমুদ্দর/শিশির পড়ে টুপ/শিশির ঘাসে পিছলে পড়ে/ ক্যামেলিয়া চুপ’ (শিশির পড়ে টুপ, পৃ-৩৬)।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ব্দিক, শিক্ষাবিদ ও অলক্ত সম্পাদক
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ব্দিক, শিক্ষাবিদ ও অলক্ত সম্পাদক
No comments