আমাদের ওয়াহিদ ভাই গোলাম সারোয়ার

আমাদের ওয়াহিদ ভাই প্রয়াত হয়েছেন তিন বছর হলো। প্রয়াণ দিনটি ছিল ২৭ জানুয়ারি ২০০৭। সময়টা এরকমই চলে। চলে আর হারিয়ে যায়। যুগে যুগে সৃষ্টির সেরা এই মানুষ নামের প্রাণীটি আরেক মানুষের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে, ভাষার সঙ্গে তথা পৃথিবীর তাবত ক্রিয়ার সঙ্গে ভালবাসার বন্ধন তৈরি করে যাচ্ছে অনবরত। আবার তা ছিঁড়েও চলেছে বিরামহীন।
সেই মানুষের আদি এবং সর্বজনচিরন্তন প্রকাশ হাসি-কান্না দু'টিরই নির্মাতা মানুষ নিজেই। আলাদাভাবে এক একজন মানুষের উপরই হয়ত নির্ভর করে সত্যিকার হাসি-কান্নার নির্মাণে পৃথিবীর এবং মানুষের সঙ্গে তার বাঁধনের জোর কত! ওয়াহিদ ভাইয়ের বাঁধনের জোরটা এখন সকলে আন্দাজ করতে পারে, অনুভব করতে পারে সন্দেহাতীতভাবে। তাঁর রেখে যাওয়া হাসি এবং তাঁর রেখে যাওয়া জীবন-কর্মের স্মৃতিচারণে এখনও কান্নায় ফুলে ফুলে ওঠেন অনেকে; কেউ আড়ালে, অগোচরে। তাঁর ভাবনায় এখনও নিথর করে, নিরবলম্বন সঙ্কটে নিপতিত করে অনেক সুজন-স্বজন-সজ্জনকে, সতীর্থ-বান্ধবকে। কিন্তু যাই ঘটুক এই জগতটাতে সেখানে থেমে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। চলতে হবে বাস্তবতায় পা ফেলে, পা তুলে। কল্পনায় এবং পরিকল্পনার পথ মাড়িয়ে-উজিয়ে। পড়ে থাকবে সমস্ত কান্না, মর্মপীড়া, ভারি হৃৎস্পন্দন পিছনের কাঠ-সুরকী-লোহার ফ্রেমে বাঁধা হয়ে এবং তাঁর সব স্মৃতি, সব ছোঁয়া, সব কর্ম চলবে সামনের দিকে উর্বর, অনুর্বর ভূমির উপর দিয়ে; মানুষের বেঁচে থাকার ত্রে দিয়ে অনেকদিন। যতদিন তাঁর ছোঁয়ার ভালবাসার মানুষগুলো বাঁচবে ততদিন। যতদিন তাঁর কর্ম থাকবে ততদিন। যেমন করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমান বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন; তেমনি থাকবেন ওয়াহিদুল হক প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
মৃতু্যর দিনে হাসপাতালভরা মানুষ, ক্রমে দুপুর গড়িয়ে চলে। আত্মীয়-অনাত্মীয়, চেনা-জানার ভিতর-বাইরে সকলে অস্থির, অধীর হয়ে প্রহর গোনে একটা ভাল খবরের জন্য। সিঁড়িতে, করিডরে, বারান্দায় সকলে আপনমনে প্রার্থনা করে। হাসপাতালের বারান্দায় রাখা কাঠের একটি বাক্সের উপরে বসা ছিল ওয়াহিদ ভাইয়ের ছোট ছেলে এষণ। চুপচাপ অথচ হচকিত এষণের মুখ থেকে মোচড়ানো একটা বাক্য বের হলো 'তোমাকে ফেরত আসতেই হবে।' যেন 'হেন কথা কে বলিতে পারে যেতে নাহি দেব।' আমি অন্তত কিছুণের জন্য আশান্বিত, আশ্বস্ত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম পিতার কাছে পুত্রের এই ডাক বিফলে যাবে না। শেষ পর্যন্ত এই ডাক পেঁৗছায়নি। ভেঙ্গে পড়ল সব তার বাঁধ। সব মিনতি। অপেমাণ শত মানুষের শত আর্জি অবশেষে হাসপাতালের দেয়ালে দেয়ালে মাথাকুটে নিঃশেষ হলো। পরশ পাথরতুল্য মানুষটি পড়ে রইল লাশ অভিধায় সাদা কাপড়ের ঢাকনায়। বিমূঢ়তাকে ভেদ করে অতি অকস্মাত ইহলোক জয় করা নিস্পন্দ দেহটিকে ঘিরে কাঙাল হয়ে উঠেছিল মন_ ওয়াহিদ ভাইয়ের শেষ গোসলের সময় উপস্থিত থাকব, তাঁর পাশে। সেটুকুও পারা যায়নি। কয়েকবার এগিয়েছিলাম। কিন্তু কী এক দুর্মর-শীতল-প্রকম্পন আমার পা দু'টিকে অসাড় করে ফেলেছিল। কে একজন পিঠে হাত রেখে বলেছিল, 'সারোয়ার ভাই, থাক। আমরা বাইরে থাকি।' আমার বাবা মারা যান ১৯৯৬ সালে। তিনিও হাসপাতালে মারা যান। ঠিক মৃতু্যর ণটিতে আমি তাঁর পাশে ছিলাম না। হঠাৎ করে বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে শরীরে যে জামা-কাপড় ছিল ঐ অবস্থাতেই ঢাকা থেকে বাড়িতে যাই। বাবা তখন হাসপাতালে। এক জামা-প্যান্ট নিয়ে একনাগাড়ে সাত দিন। ডাক্তার বললেন, একটু ভাল। বাবাকে বললাম, 'আব্বা, একদিনের জন্য ঢাকা থেকে ঘুরে আসি।' তাকিয়ে থাকলেন, বললাম 'জামা কাপড়, ছুটি'...। তাকিয়েই থাকলেন। একটু পরে মাথা কাত করে সায় দিলেন। ভেজা গামছা দিয়ে ঠোঁট দু'টি মুছে দিতে গিয়ে দেখলাম ঠোঁটের চামড়া উঠে যাচ্ছে। রেখে দিয়ে চলে এলাম। সারাদিন পর সন্ধ্যায় পেঁৗছলাম ঢাকায়, ঘুমালাম। ঘুম থেকে টেনে তুলে জানানো হলো, বাবা নেই। আবার সারাদিনে পেঁৗছলাম রংপুরে। বাবাকে গোসল করিয়ে রাখা হয়েছিল উঠোনে, আমার অপোয়। দেখলাম সৌম্য, স্বস্তিময়, মৃদু হাসির এক মুখ। সেই মুখটি যেন এগারো বছর পর ২০০৭-এ এসে দেখলাম। আবার হারালাম।
ওয়াহিদ ভাইয়ের সঙ্গে কণ্ঠশীলনের শেষ বসা হয়েছিল এক শুক্রবারে, কণ্ঠশীলনের সাপ্তাহিক সম্মিলনের দিনে। এমনিতেই সাত দিনের মধ্যে সবচেয়ে কমর্ীবহুল দিন কণ্ঠশীলনের জন্য শুক্রবার। পারতপ েসব সদস্যই উপস্থিত থাকেন সেই আয়োজনে। সেদিনেও যথারীতি উপস্থিতির সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ জন। সামনে ছিল ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস এবং ঈদের ছুটি। সেই ঈদের ছুটিতে ওয়াহিদ ভাই তালতলার বাসাতেই ছিলেন। সেখান থেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তারপর? তার আর পর নেই।
ওয়াহিদ ভাইয়ের এমন কিছু বয়স হয়েছিল তা নয়। জীবনকাল মোটেই দীর্ঘ নয় তবে তাঁর মানবতাবোধ, রাজনৈতিক চেতনা, সমাজ ভাবনা, সঙ্গীত গভীরতা, আবৃত্তি-নাটক, বিজ্ঞান বোঝাপড়ার অন্বেষণের পথ নিশ্চয় জীবনের চেয়ে অনেক অনেক বেশি দীর্ঘ ও প্রোথিত। হয়ত তিনি এমন করে আমাদের ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন, আমাদের যা কিছু ভালকে এমনভাবে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন তাতে তাঁর এই কমর্ীক-মানবিক-সাঙ্কেতিক জীবন অনিষ্টবোধ আমাদের কাছে তারুণ্যেরই এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবির আসন গড়ে তুলেছিল যে, সেখানে কোন বয়সকেই বয়স মনে হয় না। তবু বলতে পারি আরও কিছুদিন তাঁর জীবিত থাকাটা খুব প্রয়োজন ছিল।
ওয়াহিদ ভাইয়ের ৭০তম জন্মদিন অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। এ অনুষ্ঠান তাঁর প থেকে খুব অনুমোদন ছিল এমন নয়। এই আড়ম্বর তিনি পছন্দ করতেন না। একান্ত ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষের অনুরোধে ওয়াহিদ ভাইকে এই ঢেঁকি গিলতে হয়েছিল। এটিই বোধ করি প্রথম প্রকাশ্যে জন্মদিনের অনুষ্ঠান তাঁর। সেই অনুষ্ঠানে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প থেকে ফুলের তোড়া নিয়ে গিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান নূর ও সাবের হোসেন চৌধুরী। সে অনুষ্ঠানের একজন দর্শক শ্রোতা হিসেবে ওয়াহিদ ভাইয়ের উদ্ভাসিত কণ্ঠ এবং মুখাবয়ব সেদিন পর্যবেণ করেছিলাম। ওয়াহিদ ভাইয়ের আনন্দ এবং তাঁর অকৃত্রিম প্রকাশকে তাঁর সহযোদ্ধারা সবাই জানেন বৈকি! ওয়াহিদ ভাইয়ের এক লেখা পড়ে স্পষ্ট বুঝেছিলাম বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কন্যা সমতুল্য ভাবতেন, বিশ্বাস করতেন। তাঁর প থেকে পাঠানো-শ্রদ্ধা-ভালবাসার শুভেচ্ছার কারণেই বোধ করি ওয়াহিদ ভাইয়ের এতটা আনন্দচিত্ত যেমন সত্য তেমনিই আরও কিছু সত্য হচ্ছে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সেদিন দেখতে চেয়েছিলেন বলিষ্ঠ পদেেপ, রাজপথে। তাঁর ধারণায় সেদিনের আওয়ামী লীগ ছিল স্তম্ভিত, ম্রিয়মাণ। অবশ্য তা যৌক্তিক কারণেই, তবু গতিপথের রকমফের ঘটুক_প্রত্যাশা করেছিলেন ওয়াহিদুল হক। এমন নিশ্চুপকে ভেঙ্গে চতুর্দিক জেগে উঠুক তিনি চেয়েছিলেন। সত্যিকারভাবে ওয়াহিদ ভাই চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে, বাঙালিত্বকে, দেশাত্মবোধকে যাঁরা ধমনীতে বহন করছে সেই দলটি রাষ্ট্রমতায় আসুক! সেখানেই তাঁর তৃপ্তি। জানি না সত্যি কিনা, রবীন্দ্রনাথের দেশের গান 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী, ওগো মা... তোমার অভয় বাজে হৃদয় মাঝে হৃদয় হরণী'র মাঝেই হয়ত সেই শক্তিকে তিনি খুঁজেছিলেন, যেখানে বাঙালীর অসহায়ত্ব ঘুচবে। আজ তাঁর মৃতু্যর পরে বলতেই হয় সে শক্তি অন্বেষণ সত্য ছিল, যথার্থ ছিল। আজ ওয়াহিদ ভাইকে এই খবরটা পাঠাতে পারলে ভাল হতো! ওয়াহিদ ভাই, রবীন্দ্রনাথের কবিতার আবৃত্তি করছেন আপনার প্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেই রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসব হবে পৃথিবীর তাবত বাঙালীকে নিয়ে_এই সিদ্ধান্তও নিলেন শেখ হাসিনা। জয়তু শেখ হাসিনা! এমনি করে ভবিষ্যতকে দেখতে পারা মানুষ আমাদের ওয়াহিদ ভাই বেঁচে থাকুন অনাদিকাল ধরে বাঙালীর মাঝে, মানবের মাঝে _এই প্রার্থনা করি।

No comments

Powered by Blogger.