উপকূলীয় বাঁধ-গড়তে দুইদিন ভাঙতে একদিন? by শেখ রোকন

 শিরোনামটি 'প্রেমের মরা জলে ডোবে না' শীর্ষক জনপ্রিয় লোকগীতির অংশ। গীতিকার এমন প্রেম করতে নিষেধ করেছেন যা গড়তে দুইদিন লাগলেও ভাঙতে মাত্র একদিনই যথেষ্ট।
নাগরিক 'রাশ আওয়ার'-এ এমন মরমি সঙ্গীতের কলি মাথায় এসেছিল সোমবারের সমকালে 'পাঁচ সহস্রাধিক মানুষের সব চেষ্টা নিমিষেই বিফল' হওয়ার খবর দেখে। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধসে উপকূলীয় বাঁধ নেটওয়ার্কের একটি ক্লোজার নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার মুহূর্তে ধরে যাওয়ার খবর রয়েছে সেখানে। এ স্থাপনা যেন গানের সম্পর্কের চেয়েও নাজুক!
উপকূলীয় অঞ্চলে অতি সম্প্রতি অন্তত আরও একটি নির্মাণ কাজের এমন অথবা আরও করুণ পরিণতি দেখেছি আমরা। দুর্গতি অথবা দৈন্যের খবরও অনেক সময় সংবাদমাধ্যমে কতটা নাটকীয়তা তৈরি করে, ওই অঘটন ছিল তার উদাহরণ। ১৪ ফেব্রুয়ারি সমকালের শিরোনাম_ লবণপানিমুক্ত হলো দাকোপ-কয়রা। সবিস্তারে বললে, 'ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রায় ২১ মাস পর অবশেষে রোববার খুলনার দাকোপ ও কয়রা উপজেলার সব ক্লোজার মেরামত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেনাবাহিনীর তদারকিতে মেরামত কাজ শেষ হওয়ার পর লবণপানিমুক্ত হয়েছে এ দুটি উপজেলা। এতে বেড়িবাঁধের ওপর বসবাসকারীরা বসতভিটায় ফিরতে শুরু করেছেন। জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত গৃহনির্মাণের ৭৫ কোটি টাকা আইলাদুর্গতদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।' ভালো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জোয়ারের তীব্রতা ও নোনা পানির আগ্রাসন ক্রমাগত বৃদ্ধির মুখে দুর্গত ও উদ্বিগ্ন মানুষের কাছে ভালোবাসা দিবসে এর চেয়ে ভালো খবর আর কী হতে পারে? কিন্তু তার পরদিনই, ১৫ ফেব্রুয়ারি সমকালে মন ভাঙা শিরোনাম_ 'নির্মাণের ৫ ঘণ্টা পর ভেসে গেছে কয়রার পাতাখালী ক্লোজার : ২০ হাজার মানুষ আবার পানিবন্দি!' এত অপেক্ষা, এত দুর্গতি আর প্রতিশ্রুতির এমন পরিণতি!
আমাদের মনে আছে, ২০০৭ সালে মধ্য নভেম্বরে সিডরের আঘাতে উপকূলীয় বাঁধগুলো বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো সংস্কার হতে না হতেই ২০০৯ সালের মে মাসে এসেছিল আইলা। আইলার বেগ যদিও সিডরের চেয়ে কম ছিল, ইতিমধ্যে যথেষ্ট দুর্বল ও অরক্ষিত হয়ে পড়ে থাকা বাঁধ তা সহ্য করতে পারেনি। আক্ষরিক অর্থেই বালির বাঁধের মতো ভেসে গিয়েছিল। বিশেষ করে খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলের বসতবাড়িগুলো দিনে দু'বার জোয়ারের নোনা পানিতে প্লাবিত হতে থাকল। মাঠের ফসল, গাছের ফল, মিঠা পানি ও এর মাছ তো বিনষ্ট হলোই, ওই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জন্য ঘরে থাকাই দায় হয়ে পড়ল। তারা আশ্রয় নিল ভাঙা, আধভাঙা, কর্দমাক্ত ও ছায়া-সবুজহীন বাঁধের ওপর, চট, পলিথিন, খেজুর পাতায় নির্মিত খুপরিতে।
এও জানা কথা যে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়বে। নিম্নচাপ দেখা দেবে ঘন ঘন। বাড়বে নোনা পানির আগ্রাসন। কিছু মানুষ উদ্বাস্তুও হতে পারে। কিন্তু সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এত তাড়াতাড়ি, এক-দুটি ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লাখ লাখ মানুষ নিরাশ্রয়, নিরন্ন হয়ে পড়ার কথা নয়। অভিযোজনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেটা হিসেবে ধরলে এমন দুর্গতি উপকূলীয় মানুষের আরও অনেক দিন প্রাপ্য নয়। তাদের মুক্তি ও স্বস্তির জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে উঁচু ও মজবুত বাঁধই অনেকখানি ভরসা হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি যখন স্পষ্ট হয়নি, তখন থেকে এসব বাঁধই উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে সামুদ্রিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে এসেছে। খাতা-কলমে বললে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাঁধগুলো কেবল আরেকটু উঁচু ও মজবুত করা দরকার। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন।
উপকূলীয় বাঁধ লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার জন্য কেবল সিডর বা আইলাকে দায়ী করা কঠিন। মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, সিডর ও আইলার আঘাত বাঁধ নেটওয়ার্কের সেখানেই বেশি তীব্র হয়েছে, যেখানে বাঁধ ফুটো করে চিংড়ি ঘেরে নোনা পানি ঢোকানো হয়েছে। বলাবাহুল্য, চিংড়িচাষিদের এমন বেআইনি ও আত্মঘাতী কাণ্ড স্থানীয় প্রশাসনকে সন্তুষ্ট করেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।
উপকূলীয় বাঁধ নেটওয়ার্ক কীভাবে স্থানীয় প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের অর্থ উপার্জনের উপায়ে পরিণত হয়, সে ভিন্ন আলোচনা। আমরা বলছি বাঁধগুলো নিয়ে আইলা-পরবর্তী তামাশার কথা। মনোযোগী পাঠকের মনে আছে, আইলার পরপরই বলা হয়েছিল যে, পরবর্তী বর্ষার আগেই উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজ শেষ হবে। একই ধরনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলে সাংসদ, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা গেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রীও একবার সফর করেছেন। কিন্তু পরিবর্তিত জলবায়ুর উপযোগী স্থাপনা দূর অস্ত, কোনোরকমে ঘরবাড়ি, ফসল-বাগান বাঁচানোর বাঁধই পাওয়া যায়নি। আইলার দেড় বছর পর যদিও বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে, তা কতটা ধন্বন্তরী নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার চূড়ান্ত মুহূর্তে ভেসে যাওয়া আশাশুনির চুইবাড়িয়া ক্লোজার-কাহিনী তার প্রমাণ হতে পারে।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭৫ মিটার দীর্ঘ ক্লোজারটি নির্মাণের জন্য গত বছর সেপ্টেম্বরে দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা সত্ত্বেও কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি। এর কারণ নাকি স্থাপনাটির দৈর্ঘ্য! টেন্ডারবাজির এই দেশে এমন অনীহা বিরলই বটে। সে যাই হোক, পরে 'ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর কথা বিবেচনা করে' আশাশুনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিজে নির্মাণ কাজে উদ্যোগী হন। দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তার অনুকূলে দরপত্র দাখিল করে। নভেম্বরের গোড়ায় কার্যাদেশ পাওয়ার পরপরই ক্লোজান নির্মাণের কাজ শুরু হয়। উপজেলা চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের একটি টিম এবং স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। নির্মাণ কাজে দীর্ঘসূত্রতা আমাদের দেশে প্রায় অবধারিত। কিন্তু হতে পারে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততায়, হতে পারে বাস্তুহীন আইলাদুর্গতদের ঘরে ফেরানোর নানামুখী চাপের কারণে, এই ক্লোজার নির্মাণ কাজ দ্রুতই এগিয়ে চলেছিল। প্রায় সাড়ে তিন মাস টানা কাজ করে ক্লোজারটির দুই পাশে ৫৬০ ফুটের মতো বেঁধে ফেলা হয়। বাকি ৪০ ফুটের কাজ শনিবার শেষ হওয়ার কথা ছিল।
খবরেই জানা যাচ্ছে, শনিবার সকাল থেকেই কমবেশি সাড়ে পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করছিল। বাঁধের অবশিষ্ট অথচ চূড়ান্ত ৪০ ফুট প্রাথমিকভাবে দুপুর ১টা নাগাদ বেঁধেও ফেলা হয়। তারপর যথারীতি ভরাট করার কাজ। বালির বস্তা ফেলে বিকেল ৩টার দিকে পানিস্তর থেকে চার-পাঁচ ফুট উঁচু করা হয় বাঁধটি। একপর্যায়ে, সমকালে প্রকাশিত সময় যদি ঠিক হয়, বিকেল ৫টার দিকে জোয়ারের চাপে সদ্য বেঁধে ফেলা বাঁধটি ধসে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ধসে যায় হাজার পাঁচেক মানুষের চেষ্টা আর ওই এলাকার লক্ষাধিকের বাস্তুভিটায় ফেরার স্বপ্ন।
উপকূলীয় ওই মানুষগুলোর জন্য সমবেদনার পাশাপাশি প্রশ্ন হচ্ছে, ক্লোজারটি কি যথেষ্ট কারিগরি প্রস্তুতি সহকারে নির্মাণ করা হচ্ছিল? পাউবোর সঙ্গে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর যুক্ত থাকায় সেদিক থেকে তো নিঃসন্দেহই হওয়ার কথা। কিন্তু এ ধরনের কাজের ক্ষেত্রে দুটি সংস্থার সমন্বয় অনেক সময়ই দুরূহ হয় এবং কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আনে না। ভুলে গেলে চলবে না, গত বছর যখন উপকূলীয় বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার কথা প্রথম উঠেছিল, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ তখন মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন। আবার এই ক্লোজারটি নির্মাণের চূড়ান্ত পর্ব যেভাবে সম্পন্ন হয়েছে তাও প্রশ্নাতীত নয়। বোদ্ধারা বলে থাকেন, ক্লোজার নির্মাণের ক্ষেত্রে দু'পাশ বাঁধার পর মধ্যের অংশ সম্পন্ন করাই সবচেয়ে স্পর্শকাতর। আমার মনে আছে, গত বছর জুনে বাঁধ নির্মাণের বঙ্গীয় নিজস্ব পদ্ধতি নিয়ে কলাম লিখেছিলেন শ্রদ্ধেয় পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেছিলেন, সত্তর দশকের মাঝামাঝি উপকূলীয় বাঁধ ও ভূমি উদ্ধার প্রকল্পের ব্যাপারে হল্যান্ড ও বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের মধ্যে বৈঠকে ডাচ প্রতিনিধি কীভাবে বাংলাদেশে শত হাজার বছর ধরে প্রচলিত পদ্ধতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। পরে সেটা নিয়ে তারা ডকুমেন্টারিও করে। নিশাত স্যার ওই কলামে বলেছিলেন, বাঁধ নির্মাণের চূড়ান্ত পর্ব সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অমাবস্যা-পূর্ণিমা ও জোয়ার-ভাটার কড়া হিসাব রাখতে হয়। স্পর্শকাতর অংশটি ভরাটের জন্য এমন সময় বেছে নিতে হয়, যখন জোয়ারও নয় ভাটাও নয়; স্রোত শূন্যের কোঠায় থাকে। উৎসবমুখর পরিবেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতি নিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খাত বন্ধের কাজ সম্পন্ন করতে হয়। চুইবাড়িয়া ক্লোজারের ক্ষেত্রে কি তেমন সময় বেছে নেওয়া হয়েছিল? কে জানে!
এটা ঠিক, উপকূলীয় বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারে বিলম্ব হয়ে গেছে। লাখো মানুষকে যত দ্রুত সম্ভব বসতবাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। কিন্তু তাই বলে তাড়াহুড়ো করা উচিত হবে না। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে বাঁধের মতো ব্যয়বহুল স্থাপনার জন্য বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বরাদ্দ পাওয়া অর্থ মুহূর্তেই জলে ঢালাও হবে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারা। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে দীর্ঘ ও কঠিন পথ। এর প্রস্তুতিও নিতে হবে ভেবেচিন্তে, সময় নিয়ে। কয়রা ও আশাশুনির ক্লোজার দুটির নিষ্ফল নির্মাণ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি আর কোথাও আমরা দেখতে চাই না।

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.