সমকালীন প্রসঙ্গ-বাংলাদেশের অপরাধীর শাস্তিব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে by বদরুদ্দীন উমর

বাংলাদেশে জনজীবন আজ যেভাবে বিধ্বস্ত ও বিপন্ন, তার অনেক জটিল কারণ থাকলেও এক কথায় বলা চলে এটা হলো, অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা বাস্তবত ভেঙে পড়া।
বাংলাদেশে এখন অপরাধের মাত্রা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যার তুল্য কোনো কিছু এ দেশে তো আগে দেখা যায়ইনি, এমনকি এখনও দুনিয়ার হাতেগোনা কয়েকটি দেশে দেখা যাবে অথবা এই পর্যায়ে, এত ব্যাপক আকারে কোথাও দেখা যাবে না। বাংলাদেশে ঘটতে থাকা অপরাধের বৈচিত্র্যের দিকে তাকালে মনে হবে, এর তুল্য কিছু কোনো দেশেই নেই। এ দেশেও আগে যা কোনোদিন কল্পনাও করা যেত না, আজ তা-ই দেখা যাচ্ছে। শুধু দেখা যাচ্ছে তা-ই নয়, এসব পরিণত হয়েছে এক সাধারণ ব্যাপারে।
বাংলাদেশে এখন অপরাধ যত রকম আছে তার মধ্যে চুরি-ঘুষখোরির মতো দুর্নীতি ও লুটতরাজই প্রধান। প্রতারণা থেকে হত্যাকাণ্ড_ অনেক প্রকার অপরাধই এই অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি আগে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে; কিন্তু এর কোনো পরিবর্তন তো দূরের কথা, তার সম্ভাবনা পর্যন্ত এখন দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু এদিক দিয়ে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
বাংলাদেশে অপরাধ কত বিচিত্র ফলগামী হয়েছে তার দৃষ্টান্ত হলো এখানে নদী, লেক, এমনকি সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত ভূমিদস্যুতার কবলিত হওয়া। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ হলো এক অসাধারণ ব্যতিক্রম। অন্য অনেক দেশে চুরি, দুর্নীতি, দস্যুতার অনেক ভয়াবহ ধরন থাকলেও নদী, লেক, সমুদ্র দখল করার মতো ব্যাপার দেখা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে এটা এখন পরিণত হয়েছে এক অতি পরিচিত ব্যাপারে। এমন দিন নেই যখন সংবাদপত্রে এ ধরনের দস্যুতার খবর থাকে না। শুধু তা-ই নয়, দেশের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শত শত নদী ও জলাধারের কথা বাদ দিলেও রাজধানী ঢাকা শহরের আশপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা দখল হতে থাকার ওপর সচিত্র রিপোর্টও নিয়মিতভাবেই কয়েক দিন পরপর প্রকাশিত হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই ঘোষণা দেওয়া হয় তারা এভাবে দখল হওয়া নদী, লেক ইত্যাদি দখলমুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ঘোষণার পর মাঝে মধ্যে এসব দখলদার উচ্ছেদের একটা মহড়াও দেখা যায়। কিন্তু এই উচ্ছেদ কাজ শেষ হওয়ার পরই পূর্ববর্তী দখলদাররা একই জায়গা আবার নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। এই খেলা এক নিয়মিত ব্যাপার। এটা এভাবে ঘটার কারণ দখলকারীরা জানে যে, সমালোচনার চাপে সরকার মাঝে মধ্যে তাদের উচ্ছেদ করলেও এবং তাদের তৈরি বাড়িঘর ভেঙে দিলেও তাদের জন্য এমন কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই যা তাদের এই অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। দখলদারদের বাড়িঘর ভেঙে দিলেও তাদের জেল-জরিমানা অথবা অন্য কোনোভাবে শাস্তির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তারা এক ধরনের নিরাপত্তা বোধ করে। এই নিরাপত্তা বোধের কারণ, যারা এভাবে নদী, লেক ইত্যাদি দখল করে তাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বস্তুতপক্ষে শাসকশ্রেণীর লোক হিসেবে যে কোনো সরকারের সঙ্গেই এদের সম্পর্ক একই প্রকার। যে কোনো ধরনের ভূমিদস্যুতাই এক অপরাধ; কিন্তু নদী, লেক ইত্যাদি দখল হলো খুবই বড় ধরনের অপরাধ। দেশ ও জনগণের এই সম্পদ লুণ্ঠনের এই অপরাধের জন্য কোনো প্রকৃত শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় তারা অপ্রতিহত।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, এই দখল কাজ শুরু হয়ে চলতে থাকা এবং সম্পন্ন হওয়া কোনো গোপন অথবা চোখের আড়ালে থাকার ব্যাপার নয়। জনগণের ও সরকারের নাকের ডগাতেই এ অপরাধ হয়ে থাকে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে যেমন স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিরোধ হয় না, তেমনি সরকারি কর্তৃপক্ষও এটা দেখেও দেখে না। শুরুতেই যদি এই দখল কাজে বাধা দেওয়া হয় তাহলে এ কাজ কারও দ্বারা সম্ভব হয় না। কিন্তু সে রকম কোনো বাধা না থাকায় এই অপরাধ প্রবণতা সংক্রামক রোগের মতো এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং দেশের এমন কোনো নদী ও জলাশয় নেই, যা অল্পবিস্তর এই দখলদারদের কবলিত হয়নি।
বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার পার্শ্ববর্তী চারটি নদীই দীর্ঘদিন ধরে দখল হয়ে আসছে। এমনকি সদরঘাটের আশপাশের এলাকায়ও এটা ঘটছে। সরকারি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কতখানি উদাসীন থাকলে এভাবে দখল কাজ চলতে পারে, এটা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না। অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা স্বাভাবিকভাবেই যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, সেই পরিস্থিতিই এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এদিক থেকে সরকারের অবস্থা এমন যে, কোনো সমালোচনা ও চাপই তাদের এ ব্যাপারে কোনো প্রকৃত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা তো দূরের কথা, প্রভাবিত করতেও পারে না। শুধু মাঝে মধ্যে এ ক্ষেত্রে যা হয় তা হলো নদী দখল বন্ধের জন্য সরকারি ঘোষণা এবং দখলদার উচ্ছেদের মহড়া। এই প্রতারণাপূর্ণ ঘোষণা ও দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযানের পর দখলদাররা যে আবার নিজেদের দখল নদীর ওপর কায়েম করে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে অপরাধ কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে এবং শাস্তির কোনো ব্যবস্থা অপরাধীদের জন্য না থাকায় অপরাধের হাত কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, তার একটা ধারণা দেওয়ার জন্যই নদী, লেক, সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত দস্যুদের দ্বারা দখল হওয়ার বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা হলো। এ প্রসঙ্গে যা মূলত গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, অপরাধের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা। কোনো অপরাধের ঘটনা ঘটলে অপরাধীকে শনাক্ত করা ও শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা ও কমিয়ে আনার সব থেকে কার্যকর উপায়। বাংলাদেশে অপরাধের সংখ্যার তুলনায় শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীর সংখ্যা এত কম, যা ভাবলে অবাক হতে হয়।
নদী দখলের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য একটি বিষয়ও এখানে উল্লেখ করা দরকার। সব নদীর ক্ষেত্রেই অল্পবিস্তর প্রযোজ্য হলেও ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর ক্ষেত্রে এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নদীগুলোর পার্শ্ববর্তী জায়গায় শত শত ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এসব ফ্যাক্টরির বর্জ্য পদার্থ নদীগুলোতে পড়ে নদীর পানি এমনভাবে দূষিত করেছে, যাতে এগুলো এখন পরিণত হয়েছে মৃত নদীতে। এই মৃত নদীগুলোতে মাছসহ সব জলজ প্রাণী বিপন্ন হওয়াই নয়, প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে এসেছে। কালো ও দুর্গন্ধময় হয়ে নদীর পানি শুধু জলজ প্রাণীদের জীবনই বিপন্ন ও ধ্বংস করছে তা-ই নয়, জনজীবনের জন্যও নদীর পানির এ অবস্থা রীতিমতো বিপজ্জনক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই বিপদ ও হুমকিকে বাধ্যতাবশত শিরোধার্য করেই ঢাকার জনগণ বসবাস করছেন। ঢাকার অবস্থাই সরকারি ঔদাসীন্যে যখন এই রকম, তখন দেশের অন্যান্য এলাকার নদীগুলো ও তার পার্শ্ববর্তী অবস্থা যে অপরাধীদের তৎপরতার ফলে কী অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা বলাবাহুল্য।
অপরাধ বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে এখানে শুধু নদী, লেক ইত্যাদি দখলের কথা বলা হলেও অপরাধের ধরন যে কত বিচিত্র, এ বিষয়ে দেশের জনগণের ভালোই ধারণা আছে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এর রিপোর্ট যেভাবে নিয়মিত দেখা যায় তার থেকে তো বটেই, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেও জনগণ অপরাধের জগৎ এবং অপরাধের বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিচিত।
শেষ করার আগে আবার বলা দরকার, বাংলাদেশের অবস্থা আগে এ রকম ছিল না। কিন্তু এদিক দিয়ে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটার মূল কারণ, একের পর এক সরকারের আমলে অপরাধীর প্রতি কর্তৃপক্ষের নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি, অপরাধীর জন্য প্রকৃতপক্ষে কোনো কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা, অপরাধের বিস্তৃতি থেকে নৈরাজ্যের ব্যাপকতা বৃদ্ধি, সবকিছুর কারণ এটাই। এ পরিস্থিতি বর্তমান সরকারের আমলে এমন অবনতিপ্রাপ্ত হয়েছে, যার পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। এ অবস্থা পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা বর্তমান শাসনব্যবস্থায় আছে, এমনটি মনে করার কারণ নেই। উপরন্তু এ অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে থাকার আশঙ্কাই ষোলোআনা। এ প্রক্রিয়া প্রতিরোধের একমাত্র উপায় জনগণের সক্রিয় প্রতিরোধ। এই জনপ্রতিরোধের কোনো বিকল্প এ ক্ষেত্রে নেই। এই প্রতিরোধ কীভাবে ঘটবে, এটাই এখন ভাবনার বিষয়।

২৮.২.২০১১

No comments

Powered by Blogger.