অর্থমন্ত্রী কূটনীতিকদের যা বলেছিলেন
আপনারা গতকালই অবগত হয়েছেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাপক ড. ইউনূসকে জানিয়েছে দিয়েছে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের বৈধ ব্যবস্থাপনা পরিচালক নন। তাঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক ও অধ্যাপক ড. ইউনূসের আপনাদের অনেকের মনেই বিশেষ টান আছে।
আপনাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে আমার কাছে ও আমার সহকর্মীদের কাছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে কথা বলেছেন। সে জন্য সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার মনে করছি। শুরুতেই আমি বলতে চাই, বিষয়টি যেভাবে এগিয়েছে, তাতে আমরাও খুশি নই; এটি অন্য কোনোভাবেও মীমাংসা হতে পারত। আমাদের কেউ কেউ অনানুষ্ঠানিকভাবে ড. ইউনূসের সঙ্গে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সঙ্গে সব সময়ই যোগাযোগ রেখেছিলাম।
সাম্প্রতিককালে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে গণমাধ্যমে হইচইয়ের বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে তদন্তের জন্য এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম ও এর আইনগত ভিত্তির একটি সামগ্রিক পর্যালোচনার জন্য সরকার একটি কমিটিও গঠন করে। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, ১৯৮৩ সালে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যাংকটির জন্য। এটি কোনো এনজিও নয়, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এটিও আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। ব্যাংকটিতে অধ্যাপক ইউনূসের অবস্থান বিভিন্ন কারণে জটিলতায় পড়েছে। সরকার এত দিন এটিকে হালকাভাবেই দেখেছিল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনটা যাতে মসৃণ হয়, সেটি নিশ্চিত করতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত আইনের সংশোধন করা, যাতে অধ্যাপক ইউনূসের সম্মান বজায় থাকে, গ্রামীণ ব্যাংকে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি থাকে এবং দেশের জন্য তিনি যে সম্মান অর্জন করেছেন, তা-ও যেন স্মরণীয় হয়ে থাকে।
ড. ইউনূসকে আমি বন্ধু এবং সহযোগী হিসেবেই বিবেচনা করে থাকি। দীর্ঘ চার দশক ধরে আমরা এ সম্পর্ক বজায় রেখেছি। ১৯৮২ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা-পরিকল্পনার সঙ্গে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে আমি যুক্ত ছিলাম। আশির দশক ও পরবর্তী সময়েও যেভাবে আমরা আলোচনা করতাম, সাম্প্রতিক সময়েও তাঁর সঙ্গে আমি ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করি। আমাদের ব্যক্তিগত আলোচনার বিষয় এখানে প্রকাশ করা আমি সমীচীন মনে করছি না। কারণ আমি অধ্যাপক ইউনূসকে সব সময় শ্রদ্ধা করেছি এবং বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষকে নিয়ে তাঁর উদ্বেগের প্রশংসা করেছি।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাঁকে আমেরিকায় একজন ছাত্রকর্মী হিসেবে জেনেছি। এরপর দীর্ঘ এত বছর দারিদ্র্র্য বিমোচনে তাঁর নিষ্ঠা প্রত্যক্ষ করেছি। গত ডিসেম্বরে যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম, সেটির একটি সুখকর সমাধান করার জন্য অনেক সহকর্মী ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আমি অধ্যাপক ইউনূসকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, যেহেতু তদন্ত শুরু হয়েছে, সেহেতু তাঁর উচিত হবে সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে সাময়িকভাবে দায়িত্ব ন্যস্ত করে তাঁর অবস্থানের আইনগত ত্রুটি সংশোধন করা। কমিটির পর্যালোচনা শেষ হওয়ার পর আইনগতভাবে প্রকৃত উত্তরাধিকার খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। আমরা এটাও ভেবেছিলাম, এতে একটি সুষ্ঠু পর্যালোচনা ও তদন্ত নিশ্চিত করা যাবে। সামগ্রিক বিষয়টি সমাধান করার জন্য পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশকেও আমরা কাজে লাগাতে পারব। উল্লেখ্য, সরকার তদন্ত নয়; বরং একটি পর্যালোচনা করতে চেয়েছিল, যাতে প্রতিষ্ঠানটি ও এর পরিচালক কোনোভাবেই অসম্মানিত না হন। আমার ধারণা ছিল, পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে ছয় মাসের মতো সময় লাগবে। আলোচনার সময় ড. ইউনূস তাঁর পছন্দের একজন লোককে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে চেয়েছিলেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের নেতৃত্বের বদল এবং এ প্রক্রিয়ায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে গতকালও (বুধবার) কথা হয়েছে। সেখানে তিনি শর্ত দিয়ে বলেছেন, স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে হলে উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হবে, তা না হলে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন তিনি। 'তাঁর পছন্দের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ' তৈরি করা আমার জন্য কঠিন ছিল। আমি বিশ্বাস করি না যে এত বছর ধরে একটা ধারাবাহিক ও গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য অর্জনকারী একটি প্রতিষ্ঠান নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে ধ্বংস হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত আইন তার নিজের পথে চলেছে। ১৯৯১ সালের ব্যাংকিং কম্পানি আইনের ৪৫ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতার প্রয়োগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংবাদ প্রতিবেদন দেখে আমি জানতে পেরেছি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতিক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নির্দেশনা না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। এর পরিবর্তে তিনি আদালতেই বিষয়টি সুরাহার পথ বেছে নেন।
গ্রামীণ ব্যাংক আইনের আওতায় তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সে আইনে পরিচালনা পর্ষদকে একটি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনের ১৪(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের আগাম অনুমোদন সাপেক্ষে পরিচালনা পর্ষদ এমডি নিয়োগে দিতে পারে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক কখনো সে অনুমোদন চায়নি। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে বিষয়টি ধরিয়ে দেওয়ার পরেও নয়। সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের নিরীক্ষাটি করেছিল। তাতে দেখা যায়, একজন বৈধ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছাড়াই গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমরা ভেবেছিলাম বিষয়টি সংশোধন হোক এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ হোক।
এবার আমি গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করতে চাই। জোবরা গ্রামের ছোট আকারের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে গরিব মানুষকে সাহায্য করার উদ্যোগটি অধ্যাপক ইউনূস শুরু করেছিলেন ১৯৭৬ সালে। তাদের স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে মহাজনের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি একটি প্রকল্প দাঁড় করান। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে একটি স্থিতিশীল ঋণ কার্যক্রমের আওতায় আনার জন্য ১৯৭৯ সালে তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পে দুটি বিষয় প্রমাণিত হয়। প্রথমত, গরিব মানুষকে ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া যায়। কারণ তারা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ঋণ পরিশোধ করে। দ্বিতীয়ত, জামানত ছাড়া গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়া নিরাপদ। বিশেষ করে যখন তাদের দলবদ্ধ করা যায় ও ঋণ পরিশোধে দলের সদস্যদের চাপ থাকে। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে পল্লী এলাকায় মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়।
এই প্রেক্ষাপটেই প্রকল্পটিকে একটি চার্টার্ড ইনস্টিটিউশনে পরিণত করে ক্ষুদ্রঋণ খাতে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার উদ্যোগ নিতে রাজি হয় সরকার। একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৮৪ সালে ব্যাংক বহির্ভূত আথিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত বিধিবিধান ও তদারকির আওতার বাইরে থেকে এটি শায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে। সরকারই তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। সঙ্গে একজন চেয়ারম্যান এবং বোর্ডের ১০ জন পরিচালকেও নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন আমি সরকারের অংশ ছিলাম।
১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অর্ডিন্যান্সে দুবার সংশোধন আনা হয়। একবার ১৯৮৬ সালে সরকারের শেয়ার ৬০ ভাগ থেকে কমিয়ে ২৫ ভাগে নামিয়ে আনা হয় এবং ১৯৯০ সালে যখন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগ সরকারের কাছ থেকে নিয়ে পরিচালক পর্ষদের কাছে হস্তান্তর করা হয় তখন প্রথম বোর্ডে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানসহ আট পরিচালকের নিয়োগ দিত সরকার এবং চার পরিচালক নির্বাচিত হতো শেয়ারহোল্ডারদের দ্বারা। ১৯৮৬ সালে সরকারের মনোনীত পরিচালকের সংখ্যা কমিয়ে চার জনে (চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদসহ) নামিয়ে আনা হয়, পরবর্তী সংশোধনীতে তিনজন করা হয় এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক বোর্ডের মনোনীত হন। গ্রামীণ ব্যাংক যে চাকরিবিধি সুনির্দিষ্ট করে, সেখানে গ্রামীণ কর্মচারীদের অবসরকালীন বয়স ৬০ বছর। এবং গ্রামীণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একজন গ্রামীণের কর্মচারী। এ বিষয়টি নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের দ্বিমত তৈরি হয়, যখন ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক ইউনূসের বয়স ৬০ বছর হয়। শেষ পর্যন্ত বোর্ড অধ্যাপক ইউনূসের জন্য বয়সসীমা শিথিল করে এবং পরবর্তী নির্দেশের আগ পর্যন্ত অধ্যাপক ইউনূসকে পুনর্নিয়োগ দেয়।
গ্রামীণ ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা নিয়ে সরকার গর্বিত। আমরা বিশ্বাস করি, অধ্যাপক ইউনূসের অধীন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারীরা এবং ঋণ গ্রহিতাদের অবদানের কারণে প্রতিষ্ঠানটি শুধু দেশেরই নয়, দেশের বাইরেও সম্মান অর্জন করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সফলতার কারণে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছে। এটা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯৮ সালের ভয়ানক বন্যার সময় শেখ হাসিনার সরকার গৃহহারা এবং সম্পদ খোয়ানো গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহিতাদের ঋণ মওকুফের ব্যবস্থা করেছিল। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ক্ষদ্রঋণ প্রকল্পকে শক্তিশালী করতে এবং ব্যাংকের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন, যা দেশের জন্য এখনো গর্বের বিষয়।
ব্যাংকের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে গত ২৭ বছরে এর কর্মকাণ্ড নিয়ে এবং কর্মপ্রণালি নিয়ে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। গ্রামীণ ব্যাংক কোনো এনজিও নয়। এটি মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির অধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক এর কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধানে ও অডিটে খুব স্বল্প ভূমিকা রেখেছে। যদিও এ ব্যাংক শুরু হয়েছিল সম্পদহীন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য, কিন্তু এর রয়েছে অসংখ্য ভর্তুকি প্রতিষ্ঠান এবং সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যবসা। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠান, যা সরকারের মৌলিক আইনে চালিত হওয়ার কথা।
সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের রিভিউর কথা বিবেচনা করা হয়। (আমি অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে প্রায় এক বছর আগে এ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং আমি আমার কিছু সহকর্মীকে এ বিষয়ে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানিয়েছি।) নরওয়ের টেলিভিশন সম্প্রচার গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচনা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং তা বাংলাদেশে তো বটেই, সারা পৃথিবীর প্রচারমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ বিষয়ে সরকার নরওয়ের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিবৃতি গ্রহণ করে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে আইনগত ব্যাখ্যা চায়। এদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয় নিয়ে প্রচারমাধ্যমে ঝড় ওঠে। সরকার তখন গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়াদি পরিষ্কার করার জন্য ব্যাংকের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে একটি রিভিউর সিদ্ধান্ত নেয়। আমি আপনাদের অনুরোধ করব, খুব ভালো করে খতিয়ে দেখুন, রিভিউর বিষয়গুলো। সেখানে গ্রামীণ ব্যাংকের সুনাম বা এর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপককে খাটো করার কোনো অবকাশ নেই।
গ্রামীণ ব্যাংক ও এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকার যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রিভিউ কমিটি করেছিল, তা নিম্নরূপ_
নিচে রিভিউ কমিটির টার্মস অব রেফারেন্স তুলে ধরা হলো_
১. গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণে তহবিল ট্রান্সফার বিষয়ে নরওয়ের টেলিভিশনে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এবং সে অনুসারে নরওয়ে সরকারের ব্যাখ্যা এবং বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলের গণমাধ্যমে যে ঝড় উঠেছে, সে বিষয়গুলো তদন্ত সাপেক্ষে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে।
২. গ্রামীণ পরিবারের ব্যয়ের প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে, গ্রামীণ ব্যাংক ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে হবে। গ্রামীণ ব্যাংকের সিইও বা সিএফওর সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান এবং ট্রাস্টের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে হবে। যদি কোনো অনিয়ম থাকে, তাহলে সেগুলো চিহ্নিত করে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিতে হবে।
৩. ঋণ গ্রহণ এবং সঞ্চয়ের সুদের পরিমাণ কী, ঋণ আদায় এবং অন্যান্য ফিঙ্শেনের চার্জ কিভাবে আদায় করা হয়_এসবের ওপর প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির লাইসেন্স অনুসারে মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদের সঙ্গে তুলনামূলক হার বিশ্লেষণ করতে হবে। কোনো অনিয়ম থাকলে তা দূর করার পরামর্শ দিতে হবে।
৪. গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার কী অবস্থা, তা বিশ্লেষণ করে সুপারিশ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ২০০৬ সালের মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির আইনকানুন আমলে নিতে হবে।
ক. রিভিউ কমিটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগের ও গ্রামীণ ব্যাংকের কাগজপত্র যাচাই করবে।
খ. ক্ষুদ্র ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে মতামত বা সাক্ষ্য গ্রহণ করবে কমিটি।
গ. এই রিভিউকে সাহায্য করতে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকে একটি বিশেষ অডিট করবে।
ঘ. সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক কমিটিকে সাচিবিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেবে।
ঙ. রিভিউ কমিটি পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট সাবমিট করবে।
সাম্প্রতিককালে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে গণমাধ্যমে হইচইয়ের বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে তদন্তের জন্য এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম ও এর আইনগত ভিত্তির একটি সামগ্রিক পর্যালোচনার জন্য সরকার একটি কমিটিও গঠন করে। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, ১৯৮৩ সালে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যাংকটির জন্য। এটি কোনো এনজিও নয়, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এটিও আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। ব্যাংকটিতে অধ্যাপক ইউনূসের অবস্থান বিভিন্ন কারণে জটিলতায় পড়েছে। সরকার এত দিন এটিকে হালকাভাবেই দেখেছিল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনটা যাতে মসৃণ হয়, সেটি নিশ্চিত করতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত আইনের সংশোধন করা, যাতে অধ্যাপক ইউনূসের সম্মান বজায় থাকে, গ্রামীণ ব্যাংকে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি থাকে এবং দেশের জন্য তিনি যে সম্মান অর্জন করেছেন, তা-ও যেন স্মরণীয় হয়ে থাকে।
ড. ইউনূসকে আমি বন্ধু এবং সহযোগী হিসেবেই বিবেচনা করে থাকি। দীর্ঘ চার দশক ধরে আমরা এ সম্পর্ক বজায় রেখেছি। ১৯৮২ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা-পরিকল্পনার সঙ্গে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে আমি যুক্ত ছিলাম। আশির দশক ও পরবর্তী সময়েও যেভাবে আমরা আলোচনা করতাম, সাম্প্রতিক সময়েও তাঁর সঙ্গে আমি ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করি। আমাদের ব্যক্তিগত আলোচনার বিষয় এখানে প্রকাশ করা আমি সমীচীন মনে করছি না। কারণ আমি অধ্যাপক ইউনূসকে সব সময় শ্রদ্ধা করেছি এবং বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষকে নিয়ে তাঁর উদ্বেগের প্রশংসা করেছি।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাঁকে আমেরিকায় একজন ছাত্রকর্মী হিসেবে জেনেছি। এরপর দীর্ঘ এত বছর দারিদ্র্র্য বিমোচনে তাঁর নিষ্ঠা প্রত্যক্ষ করেছি। গত ডিসেম্বরে যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম, সেটির একটি সুখকর সমাধান করার জন্য অনেক সহকর্মী ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আমি অধ্যাপক ইউনূসকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, যেহেতু তদন্ত শুরু হয়েছে, সেহেতু তাঁর উচিত হবে সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে সাময়িকভাবে দায়িত্ব ন্যস্ত করে তাঁর অবস্থানের আইনগত ত্রুটি সংশোধন করা। কমিটির পর্যালোচনা শেষ হওয়ার পর আইনগতভাবে প্রকৃত উত্তরাধিকার খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। আমরা এটাও ভেবেছিলাম, এতে একটি সুষ্ঠু পর্যালোচনা ও তদন্ত নিশ্চিত করা যাবে। সামগ্রিক বিষয়টি সমাধান করার জন্য পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশকেও আমরা কাজে লাগাতে পারব। উল্লেখ্য, সরকার তদন্ত নয়; বরং একটি পর্যালোচনা করতে চেয়েছিল, যাতে প্রতিষ্ঠানটি ও এর পরিচালক কোনোভাবেই অসম্মানিত না হন। আমার ধারণা ছিল, পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে ছয় মাসের মতো সময় লাগবে। আলোচনার সময় ড. ইউনূস তাঁর পছন্দের একজন লোককে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে চেয়েছিলেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের নেতৃত্বের বদল এবং এ প্রক্রিয়ায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে গতকালও (বুধবার) কথা হয়েছে। সেখানে তিনি শর্ত দিয়ে বলেছেন, স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে হলে উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হবে, তা না হলে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন তিনি। 'তাঁর পছন্দের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ' তৈরি করা আমার জন্য কঠিন ছিল। আমি বিশ্বাস করি না যে এত বছর ধরে একটা ধারাবাহিক ও গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য অর্জনকারী একটি প্রতিষ্ঠান নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে ধ্বংস হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত আইন তার নিজের পথে চলেছে। ১৯৯১ সালের ব্যাংকিং কম্পানি আইনের ৪৫ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতার প্রয়োগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংবাদ প্রতিবেদন দেখে আমি জানতে পেরেছি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতিক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নির্দেশনা না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। এর পরিবর্তে তিনি আদালতেই বিষয়টি সুরাহার পথ বেছে নেন।
গ্রামীণ ব্যাংক আইনের আওতায় তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সে আইনে পরিচালনা পর্ষদকে একটি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনের ১৪(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের আগাম অনুমোদন সাপেক্ষে পরিচালনা পর্ষদ এমডি নিয়োগে দিতে পারে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক কখনো সে অনুমোদন চায়নি। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে বিষয়টি ধরিয়ে দেওয়ার পরেও নয়। সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের নিরীক্ষাটি করেছিল। তাতে দেখা যায়, একজন বৈধ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছাড়াই গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমরা ভেবেছিলাম বিষয়টি সংশোধন হোক এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ হোক।
এবার আমি গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করতে চাই। জোবরা গ্রামের ছোট আকারের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে গরিব মানুষকে সাহায্য করার উদ্যোগটি অধ্যাপক ইউনূস শুরু করেছিলেন ১৯৭৬ সালে। তাদের স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে মহাজনের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি একটি প্রকল্প দাঁড় করান। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে একটি স্থিতিশীল ঋণ কার্যক্রমের আওতায় আনার জন্য ১৯৭৯ সালে তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পে দুটি বিষয় প্রমাণিত হয়। প্রথমত, গরিব মানুষকে ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া যায়। কারণ তারা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ঋণ পরিশোধ করে। দ্বিতীয়ত, জামানত ছাড়া গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়া নিরাপদ। বিশেষ করে যখন তাদের দলবদ্ধ করা যায় ও ঋণ পরিশোধে দলের সদস্যদের চাপ থাকে। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে পল্লী এলাকায় মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়।
এই প্রেক্ষাপটেই প্রকল্পটিকে একটি চার্টার্ড ইনস্টিটিউশনে পরিণত করে ক্ষুদ্রঋণ খাতে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার উদ্যোগ নিতে রাজি হয় সরকার। একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৮৪ সালে ব্যাংক বহির্ভূত আথিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত বিধিবিধান ও তদারকির আওতার বাইরে থেকে এটি শায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে। সরকারই তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। সঙ্গে একজন চেয়ারম্যান এবং বোর্ডের ১০ জন পরিচালকেও নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন আমি সরকারের অংশ ছিলাম।
১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক অর্ডিন্যান্সে দুবার সংশোধন আনা হয়। একবার ১৯৮৬ সালে সরকারের শেয়ার ৬০ ভাগ থেকে কমিয়ে ২৫ ভাগে নামিয়ে আনা হয় এবং ১৯৯০ সালে যখন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগ সরকারের কাছ থেকে নিয়ে পরিচালক পর্ষদের কাছে হস্তান্তর করা হয় তখন প্রথম বোর্ডে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানসহ আট পরিচালকের নিয়োগ দিত সরকার এবং চার পরিচালক নির্বাচিত হতো শেয়ারহোল্ডারদের দ্বারা। ১৯৮৬ সালে সরকারের মনোনীত পরিচালকের সংখ্যা কমিয়ে চার জনে (চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদসহ) নামিয়ে আনা হয়, পরবর্তী সংশোধনীতে তিনজন করা হয় এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক বোর্ডের মনোনীত হন। গ্রামীণ ব্যাংক যে চাকরিবিধি সুনির্দিষ্ট করে, সেখানে গ্রামীণ কর্মচারীদের অবসরকালীন বয়স ৬০ বছর। এবং গ্রামীণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একজন গ্রামীণের কর্মচারী। এ বিষয়টি নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের দ্বিমত তৈরি হয়, যখন ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক ইউনূসের বয়স ৬০ বছর হয়। শেষ পর্যন্ত বোর্ড অধ্যাপক ইউনূসের জন্য বয়সসীমা শিথিল করে এবং পরবর্তী নির্দেশের আগ পর্যন্ত অধ্যাপক ইউনূসকে পুনর্নিয়োগ দেয়।
গ্রামীণ ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা নিয়ে সরকার গর্বিত। আমরা বিশ্বাস করি, অধ্যাপক ইউনূসের অধীন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারীরা এবং ঋণ গ্রহিতাদের অবদানের কারণে প্রতিষ্ঠানটি শুধু দেশেরই নয়, দেশের বাইরেও সম্মান অর্জন করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সফলতার কারণে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছে। এটা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯৮ সালের ভয়ানক বন্যার সময় শেখ হাসিনার সরকার গৃহহারা এবং সম্পদ খোয়ানো গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহিতাদের ঋণ মওকুফের ব্যবস্থা করেছিল। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ক্ষদ্রঋণ প্রকল্পকে শক্তিশালী করতে এবং ব্যাংকের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন, যা দেশের জন্য এখনো গর্বের বিষয়।
ব্যাংকের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে গত ২৭ বছরে এর কর্মকাণ্ড নিয়ে এবং কর্মপ্রণালি নিয়ে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। গ্রামীণ ব্যাংক কোনো এনজিও নয়। এটি মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির অধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক এর কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধানে ও অডিটে খুব স্বল্প ভূমিকা রেখেছে। যদিও এ ব্যাংক শুরু হয়েছিল সম্পদহীন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য, কিন্তু এর রয়েছে অসংখ্য ভর্তুকি প্রতিষ্ঠান এবং সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যবসা। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠান, যা সরকারের মৌলিক আইনে চালিত হওয়ার কথা।
সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের রিভিউর কথা বিবেচনা করা হয়। (আমি অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে প্রায় এক বছর আগে এ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং আমি আমার কিছু সহকর্মীকে এ বিষয়ে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানিয়েছি।) নরওয়ের টেলিভিশন সম্প্রচার গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচনা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং তা বাংলাদেশে তো বটেই, সারা পৃথিবীর প্রচারমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ বিষয়ে সরকার নরওয়ের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিবৃতি গ্রহণ করে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে আইনগত ব্যাখ্যা চায়। এদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয় নিয়ে প্রচারমাধ্যমে ঝড় ওঠে। সরকার তখন গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়াদি পরিষ্কার করার জন্য ব্যাংকের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে একটি রিভিউর সিদ্ধান্ত নেয়। আমি আপনাদের অনুরোধ করব, খুব ভালো করে খতিয়ে দেখুন, রিভিউর বিষয়গুলো। সেখানে গ্রামীণ ব্যাংকের সুনাম বা এর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপককে খাটো করার কোনো অবকাশ নেই।
গ্রামীণ ব্যাংক ও এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকার যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রিভিউ কমিটি করেছিল, তা নিম্নরূপ_
নিচে রিভিউ কমিটির টার্মস অব রেফারেন্স তুলে ধরা হলো_
১. গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণে তহবিল ট্রান্সফার বিষয়ে নরওয়ের টেলিভিশনে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এবং সে অনুসারে নরওয়ে সরকারের ব্যাখ্যা এবং বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলের গণমাধ্যমে যে ঝড় উঠেছে, সে বিষয়গুলো তদন্ত সাপেক্ষে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে।
২. গ্রামীণ পরিবারের ব্যয়ের প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে, গ্রামীণ ব্যাংক ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে হবে। গ্রামীণ ব্যাংকের সিইও বা সিএফওর সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান এবং ট্রাস্টের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে হবে। যদি কোনো অনিয়ম থাকে, তাহলে সেগুলো চিহ্নিত করে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিতে হবে।
৩. ঋণ গ্রহণ এবং সঞ্চয়ের সুদের পরিমাণ কী, ঋণ আদায় এবং অন্যান্য ফিঙ্শেনের চার্জ কিভাবে আদায় করা হয়_এসবের ওপর প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির লাইসেন্স অনুসারে মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদের সঙ্গে তুলনামূলক হার বিশ্লেষণ করতে হবে। কোনো অনিয়ম থাকলে তা দূর করার পরামর্শ দিতে হবে।
৪. গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার কী অবস্থা, তা বিশ্লেষণ করে সুপারিশ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ২০০৬ সালের মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির আইনকানুন আমলে নিতে হবে।
ক. রিভিউ কমিটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগের ও গ্রামীণ ব্যাংকের কাগজপত্র যাচাই করবে।
খ. ক্ষুদ্র ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে মতামত বা সাক্ষ্য গ্রহণ করবে কমিটি।
গ. এই রিভিউকে সাহায্য করতে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকে একটি বিশেষ অডিট করবে।
ঘ. সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক কমিটিকে সাচিবিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেবে।
ঙ. রিভিউ কমিটি পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট সাবমিট করবে।
No comments