জন্ম নিয়েই ওরা দেখে বিশৃঙ্খল পৃথিবী-* নবজাতকের চিকিৎসাসেবা বেহাল * মেঝেতে ঠাঁই নিবিড় পরিচর্যা নিবিড় নয় by তৌফিক মারুফ ও ওবায়দুর রহমান মাসুম

লিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাত তলায় করিডরঘেঁষা একটি কক্ষ। খোলা জানালা দিয়ে বারবার ভেতরে উঁকি দিচ্ছিল লোকজন। কক্ষে সারি সারি অত্যাধুনিক ইনকিউবেটর। কয়েকটি ফাঁকা। কয়েকটিতে রাখা আছে নবজাতক। কারো নাকে পাইপ, কারো হাতে সংযুক্ত স্যালাইনের তার। কেউ হাত-পা ছুড়ছে, কেউ কান্নাকাটি করছে, কেউ ঘুমে মগ্ন। পাশেই দাঁড়িয়ে অভিভাবক। ঘুরে ঘুরে শিশুগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন কয়েকজন চিকিৎসক। সঙ্গে আছেন নার্স। এককথায় ইনকিউবেটর আর মানুষে মানুষে গাদাগাদি অবস্থা। বিশেষায়িত ও সংরক্ষিত কক্ষ। দরজায় লেখাও আছে 'এনসিইউ'। কিন্তু দরজা অবারিত বলে লোকজন জুতা-স্যান্ডেল নিয়েই ঢুকছে, ঘুরছে।


মিটফোর্ড হাসপাতাল বলে বেশি পরিচিত পুরান ঢাকার এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে সম্প্রতি দেখা যায়, এর ষষ্ঠ তলার করিডরে নবজাতকের ছড়াছড়ি। কেউ মেঝেতে, কেউ করিডরে রাখা খাটের ওপর। প্রসূতি বিভাগের নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে জায়গা না থাকায় নবজাতক ও সদ্য প্রসূতি মায়েদের অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে এ করিডরে। ওয়ার্ডে ঢুকে দেখা যায় শয্যায় মানুষ, মেঝেতে মানুষ। শিশু-নারী-পুরুষে ঠাসাঠাসি।
প্রতিষ্ঠানটির নবজাতক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সুনির্মল রায় বলেন, জায়গার অভাবে ওয়ার্ডের ভেতর ঠাঁই দেওয়া যাচ্ছে না। তাই বারান্দায় অনেককে ঠাঁই দিতে হয়েছে। এ ছাড়া অনেক বেডেই একাধিক নবজাতক রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, জনবল সংকট থাকার কারণে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা যায় না। রোগীর স্বজনদেরও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
শুধু এই একটি হাসপাতালেই নয়, রাজধানীসহ সারা দেশের বেশির ভাগ হাসপাতালের নবজাতক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এমন নাজুক। ফলে দেশে প্রতিবছর জন্ম নেওয়া প্রায় ৩৮ লাখ শিশু এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে বড় একটি অংশ মারা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নবজাতক চিকিৎসার বিশেষায়িত সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজেও সীমিত পরিসরে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে আসন সংকট, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ এবং এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক নেই। ফলে কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ছুটতে হচ্ছে সাধারণমানুষকে। জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান বলেন, হাসপাতালগুলোতে নবজাতক ব্যবস্থাপনার মান খুবই খারাপ। বেসরকারি কিছু হাসপাতালে কিছুটা শৃঙ্খলা থাকলেও সরকারি-বেসরকারি বাকি হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি নবজাতক চিকিৎসার উপযুক্ত নয়। তিনি বলেন, 'সরকারি বিধিমালা বা নির্দেশনা ঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে কি না, সেটা নিয়মিত মনিটরিং হয় না। আমরা এখন কিছুটা উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করার চেষ্টা করছি।'
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের নবজাতক চিকিৎসার কারিগরি ও একাডেমিক মান বেশ ভালো হলেও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে এর সুফল পাওয়া যায় না।
অধ্যাপক সুফিয়া খাতুন বলেন, হাসপাতালগুলোতে অবশ্যই শিশুবান্ধব ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি। তা না হলে কখনো নবজাতক বা শিশুদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ বলেন, শুধু দেশের কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে এ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সুযোগ আছে। এগুলো দিয়ে আর চলছে না। চিকিৎসক, নার্স এবং যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এ সেবা আরো সম্প্রসারিত করতে হবে। আমাদের আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।'
নরসিংদী সদরের ফজুরকান্দি গ্রামের তাঁতশ্রমিক আলমগীর হোসেন। তাঁর স্ত্রী আমেনা অপরিণত বাচ্চা প্রসব করেছেন। অসুস্থ শিশুটিকে নিয়ে মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে এলে বাচ্চাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখার পরামর্শ দিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন চিকিৎকরা। শিশু হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরেছেন। 'সিট খালি নাই' জানিয়ে কোথাও ভর্তি করেনি শিশুটিকে। পরে রাত ২টায় মিটফোর্ড হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। আলমগীর বলেন, 'অসুস্থ বাচ্চাটারে নিয়া সারা দিন এই হাসপাতাল থাইক্যা আরেক হাসপাতালে ঘুরছি। কোনোখানে ভর্তি করাইতে পারি না। ভাই কী যে হয়রানি হইছি বুঝাইতে পারমু না।'
শিশুবিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, '৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া অথবা আড়াই কেজির কম ওজনের শিশুরাই অপরিণত। এ ছাড়া অনেক পরিণত শিশুরও জন্মের পরপর নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। নবজাতকের শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখা, প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান, জীবাণুর সংক্রমণ থেকে শিশুকে রক্ষা এবং শিশুর বৃদ্ধির জন্য বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। এ জন্য এসব শিশুকে বিশেষায়িত স্থান এনআইসিইউতে রাখতে হবে। এনআইসিইউতে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা ঠিক রাখার জন্য ইনকিউবেটর, শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক রাখার জন্য ভেনটিলেটর এবং বিলুরুবিন নিয়ন্ত্রণে ফটোথেরাপি মেশিনসহ অন্য যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সি-ব্লকের অষ্টম তলা। গাইনি বিভাগের অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনে উদ্বিগ্নমুখে দাঁড়িয়ে আছেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা শামসুজ্জামান লিংকন। তাঁর স্ত্রী পিয়ারী বেগমের সিজারিয়ান হবে। অস্ত্রোপচার শুরুর আগে কর্তব্যরত চিকিৎসক লিংকনকে জানিয়েছেন, বাচ্চার ওজন কম। জন্মের পর তাকে এনআইসিইউতে (নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) রাখতে হবে। এ হাসপাতালের এনআইসিইউতে কোনো সিট খালি নেই। তাই বাচ্চাকে অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। লিংকন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই মুহূর্তে কোথায় যাই। বাইরের হাসপাতালে খরচ অনেক বেশি। ভাই নিজের সন্তান বাঁচানোর জন্য কলিজা কেটে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি সামান্য চাকরিজীবী, এত টাকা কিভাবে দেই?'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক ওয়ার্ডে শয্যা আছে মাত্র ১৫টি। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, আগস্ট মাসে এখানে ৪৩টি নবজাতককে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, 'আসন সংকটের কারণে যে রোগী আসে এর অনেককেই ভর্তি করানো যায় না। শুধু এখানে নয়, সারা দেশের হাসপাতালগুলোর একই অবস্থা।'
মিটফোর্ড হাসপাতালের নবজাতক পরিচর্যা ইউনিটে (এনসিইউ) ১৪টি শয্যায় বেশির ভাগ সময়ই আরো বেশি শিশুকে রাখা হয়। চিকিৎসকরা বলেন, রোগীর চাপ বেশি থাকলে কখনো কখনো এক বেডে তিনজন করেও রাখতে হয়।
হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুনির্মল রায় জানান, "এনসিইউতে আরো উন্নত যন্ত্রপাতি থাকা প্রয়োজন, যা এখানে নেই। বিশেষ করে ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজার ও সিরিঞ্জ পাম্প খুবই জরুরি। এ ছাড়া কোনো ভেনটিলেটর নেই। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হলে সনাতন পদ্ধতির 'আমবু ব্যাগ' দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস দিতে হয়। বেশি সমস্যা হলে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু গরিব অভিভাবকরা অন্য কোথাও নিতে চান না। ফলে বন্ডসই নিয়ে এখানেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। অনেক সময় বাচ্চা মারাও যায়।"
এ হাসপাতালে একটি এনআইসিইউ চালুর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে থাকলেও বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি নেই।
মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম ফরিদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এনআইসিইউ স্থাপন আপাতত করা হচ্ছে না। খুব শিগগিরই হাসপাতালে একটি আইসিইউ চালু হচ্ছে। সেখানে দুটি বেড দেওয়া হবে নবজাতকদের জন্য।'
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৪০ শয্যার নবজাতক ইউনিটেও সমস্যার অন্ত নেই। এখানকার ছয়টি ইনকিউবেটরের কোনো না কোনোটি প্রায়ই নষ্ট থাকে। রোগীর চাপ বেশি বলে এক ইনকিউবেটরে দুজন করে বাচ্চা রাখা হয়। কোনো ভেনটিলেটর না থাকায় শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা নিয়ে আসা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যায় না। বাইরের হাসপাতালে রেফার করতে হয়। আবার অনেক গরিব রোগীর জন্য বাইরের ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে রোগীর স্বজনদের বন্ডসই নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট একজন চিকিৎসক।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হিসাব থেকে দেখা গেছে, ২০১০ সালে এ হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটে ২৮৫৪ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৯৪৪ জন শ্বাসকষ্টের, অপরিণত ও কম ওজনের ৭৫১ জন, রক্তে সংক্রমণ নিয়ে ৩৪৭ এবং ২৯৭ জন নবজাতকের জন্ডিস ছিল। ভর্তি হওয়া মোট নবজাতকের মধ্যে ৪৪৬ জন মারা গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এনআইসিইউতে ভর্তি হতে পারেনি, এমন শিশুর সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বেশি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, বর্তমানে যা আছে তা দিয়েই মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে বাইরের হাসপাতালগুলোয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আরো বলেন, 'আমাদের এখানে একটি আদর্শ নিওনেট সেন্টার করার প্রক্রিয়া চলছে। এটা বাস্তবায়িত হলে আদর্শ এনআইসিইউ হবে।'
৫৫০ শয্যার ঢাকা শিশু হাসপাতালে নবজাতক ওয়ার্ডে ৩০টি শয্যা আছে। এ ছাড়া এনআইসিইউতে আছে ১০টি শয্যা। আটটি ইনকিউবেটরের মধ্যে দুটি নষ্ট। তিনটি ভেন্টিলেটরের মধ্যে একটি নষ্ট। ফলে চাপ থাকলেও রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, শিশু হাসপাতালের আসন অনুপাতে এনআইসিইউতে সিট থাকার কথা ৫৫টি। কিন্তু আসন না বাড়িয়ে শুধু হাসপাতালের সৌন্দর্যবর্ধন করা হচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, 'আমাদের পরিচালকের একটি বেসরকারি ক্লিনিক আছে। এখানে উন্নত করলে ওনার হাসপাতালে রোগী যাবে না। তাই এনআইসিইউর সিট বাড়ানো হচ্ছে না।'
সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করে নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, 'আমাদের এখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০টি শিশু আসে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু আসন সংকটের কারণে আমরা বড়জোড় তিন-চারজনকে ভর্তি করতে পারি। বাকিদের ফেরত যেতে হয়।' দেশের অন্যতম এ শিশুবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরো বলেন, 'এখনকার অভিভাবকরা নবজাতকের যত্নে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। ফলে হাসপাতালগুলোয় চাপ বাড়ছে। এ জন্য প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে নবজাতকদের যত্নে এ ধরনের ইউনিট থাকলে ঢাকার হাসপাতালগুলোয় চাপ কমত।

No comments

Powered by Blogger.