রাষ্ট্রপতির রেফারেন্স নিয়ে বেস্লদা তর্ক by মোহাম্মদ নুরাল হক্, পিএসসি
সম্ভবত দ্বিতীয়বারের মতো সুপ্রিমকোর্টে রাষ্ট্রপতির রেফারেন্স পাঠানো নিয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা শুরু হয়েছিল সংবাদ মাধ্যম ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সারা দেশে। তবে এবারের মতভেদসহ আলাপ-আলোচনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং ঝগড়া-বিবাদের উত্তাপও ছিল তুঙ্গে। কারণ, এবারের রেফারেন্সের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য ও বর্বরোচিত বিডিআরের হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে বর্তমান সরকারের দ্বিধাদ্বন্দ্বসহ ধারাবাহিক সিদ্ধান্তহীনতা।
মূল সিদ্ধান্তের বিষয় হলো, এহেন জঘন্যতম ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার বিডিআরের আইনে হবে, নাকি দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে হবে? নাকি কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে হবে? শুরুতেই পাঠকদের আইন বিশেষজ্ঞ না হয়েও আমার পক্ষ থেকে ধৃষ্টতার ঝুঁকি নিয়ে একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই—উল্লিখিত তিন ধরনের আইনই কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানসম্মত আইন। আর এই তিন ধরনের আইন যাদের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণের ভার ন্যস্ত করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন পদে তারা সবাই সংবিধানসম্মতভাবেই অলঙ্কৃত করে রাষ্ট্রীয় নানা গুরুদায়িত্ব অব্যাহতভাবে পালন করে চলেছেন। বিচার প্রক্রিয়ায় আমাদের মাঝে বিশেষভাবে উচ্চ আদালতের বেশিরভাগ আইনজীবীর দ্বারা বাছবিচার ছাড়াই মুখরোচকভাবে সচরাচর বলা হয়ে থাকে, -------- অর্থাৎ‘ চটজলদি বিচারে ন্যায়পরায়ণতাকে কবর দেয়া হয় এবং বিচারে কালক্ষেপণ ন্যায়পরায়ণতাকে রুদ্ধ করে।’ তবে অধুনা বাংলাদেশে উক্তিটির যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে বিষয়টির গুরুত্ব হারিয়ে এক ধরনের স্লোগানই হয়ে দাঁড়িয়েছে বলা যায়। মজার ব্যাপার হলো, উল্লিখিত উক্তিটি কিন্তু আসলে ধারণা বা কল্পনা-প্রকাশক। অথচ বাংলাদেশসহ যে কোনো দেশের বিচার ব্যবস্থার মূল অবস্থান কিন্তু কার্যে বা বাস্তবে পরিণত করা যায় এমন অথবা সহজ কথায় ব্যবহারিক। যে কোনো বিচার ব্যবস্থায় সন্দেহাতীতভাবে দেশের প্রচলিত আইনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্মানিত বিচারকদের ভূমিকাই মুখ্য। আর দেশের সংবিধান স্বীকৃত সব প্রচলিত আইনই সম্মানিত বিচারকদের প্রধান অবলম্বন। তবে আইনের বাইরে সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপটও সম্মানিত বিচারকদের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। এখানে সম্মানিত বিচারক বা বিচারকরা কে বা কারা, তা সহ সংবিধানসম্মত কোনো আইনই বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। বিতর্কের বিষয় হলো, সম্মানিত বিচারক বা বিচারকরা সংবিধানসম্মত আইনের মাধ্যমে নিয়োগকৃত কিনা এবং প্রচলিত আইন সংবিধান স্বীকৃত কিনা? আমরা কেউ কি বলতে পারব, বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনের আওতায় বিচার কাজে নিয়োজিত সম্মানিত বিচারকদের মধ্যে একজনও সংবিধানসম্মত নন এবং বিচার কাজে ব্যবহৃত প্রচলিত আইনগুলো সংবিধান স্বীকৃত নয়? এহেন বিষয়গুলোতে সুবিচার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে নীতিগত কোনো ভিন্নতা নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, জ্ঞাত ও অজ্ঞাত নানা কারণে গনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে, বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সুযোগ গ্রহণ করে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিবিশেষের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে। ইদানীং প্রায়ই অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে সম্মানিত বিচারকদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এমনকি সংবিধানসম্মত আইনের বৈধতা নিয়েও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়। সংবিধানসম্মত আইন কোর্ট মার্শালের ব্যাপারেও এহেন মনোভাব ইদানীং বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সঙ্গত কারণেই জাতীয় স্বার্থে যা সামগ্রিকভাবে বিশেষ উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার বিষয়। রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের পর থেকে কোর্ট মার্শাল বিষয়টি নিয়ে আলোচক ও সমালোচকদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত অজ্ঞতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, শেষ অবধি বাধ্য হয়ে সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃ বাহিনী গণসংযোগ পরিদফতর বিভিন্ন ধরনের কোর্ট মার্শালের গঠন, আকার, আওতা ও ক্ষমতাসহ কিছু কিছু একেবারেই মৌলিক প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটির বিশদ ব্যাখ্যা প্রেস রিলিজ আকারে সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের ওপর শুনানিতে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারা মনোনীত বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরিরা মূলত তিনটি মত প্রদান করেছেন। এক, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে করা সঠিক হবে না। দুই, উল্লিখিত হত্যাকাণ্ডের বিচার দেশের ফৌজদারি আইনে হওয়াই শ্রেয়। তিন, বিষয়টি সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টে পাঠানোই সঠিক হয়নি। এক্ষেত্রে, এহেন বিচারের শুরুতেই সুপ্রিমকোর্টকে না জড়িয়ে সরকারের যৌক্তিক বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তই সঠিক হতো বলে কোনো কোনো অ্যামিকাস কিউরি মত প্রকাশ করেছেন। তবে এহেন মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে দুই-একজন বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরি দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতের বিষয়ে যে ধরনের অপ্রত্যাশিত মনগড়া মন্তব্য করেছেন তা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টিসহ দেশে সংবিধানসম্মত বিভিন্ন বিচার ব্যবস্থাকে নানাবিধ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের শুনানিকালে একজন প্রবীণ ও বিজ্ঞ আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরি হওয়ার সুবাদে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় হঠাত্ করেই বললেন, ‘জিয়া হত্যা মামলায় তেরোজন কৃতী অফিসারকে কোর্ট মার্শালের বিচারে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তাই, কোর্ট মার্শালের বিচার সঠিক ও যথেষ্ট নয় বলে প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে।’ এখানে জিয়া হত্যা মামলার কোর্ট মার্শালে বিচারের সঙ্গে বিডিআরের হত্যা মামলার বিচারের কীভাবে ও কোন ধরনের মিল আছে তা আমার বোধগম্য নয়। বিষয়টি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই আমার কাছে মনে হয়েছে। আবার কথার পিঠে কথায় অতি উত্সুক কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, দু-একজন ছাড়া বিডিআরের হত্যাকাণ্ডে নিহত সবাই সেনা অফিসার। তাই কোর্ট মার্শালের বিচারকরা সেনা অফিসার হেতু বিচারের রায় সেনা অফিসারদের দিকেই প্রভাবিত হবে। এহেন উক্তির বিরোধিতা করে কেউ কেউ একই যুক্তিতে সংক্ষুব্ধ সেনা পরিবারের সদস্যদের পক্ষে বলেছেন, অভিযুক্তরা সবাই যেহেতু সেনা পরিবারের বাইরের, তাই ফৌজদারি আইনের বিচারকরাও সেনাসদস্য নয় হেতু এহেন বিচারের রায়ও অভিযুক্তদের পক্ষে চলে যেতে পারে!
আসলে, এ সবই হলো কথার কথা। কথার পিঠে কথা। মূলত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য। হতে পারে ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর আবেগ, অনুরাগ অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রোশের ফলশ্রুতি। তবে এ সবই বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই না। যাকে বলা যায় স্রেফ ভাসা-ভাসা মন্তব্য। কোনোভাবেই ও কোনো যুক্তিতেই ধর্তব্যের বিষয় নয়। কিন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ও বর্তমান পরিস্থিতিতে এহেন মন্তব্য জনমনে নানাবিধ বিভ্রান্তি ছড়াতে যথেষ্ট। আসল কথা হলো, যাদের মুখ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আসে তা-ই ধর্তব্যের বিষয় ও বিশেষভাবে লক্ষণীয়, বিশেষভাবে বিবেচনার বিষয়। এহেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের শীর্ষ আদালতের বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছ থেকে কথার কথা অথবা অহেতুক মুখ ফসকে ভাসা-ভাসা মন্তব্য কোনো যুক্তিতেই কাম্য হতে পারে না। এতে অকারণে জনমনে বিভ্রান্তিসহ বিতৃষ্ণা ছড়ায় ও জনমানুষের মনে সংবিধানসম্মত বিচার ব্যবস্থাবলি ও সম্মানিত বিচারকদের ব্যাপারে সন্দেহের জন্ম দেয়। যা দেশের সংবিধানসম্মত বিচার ব্যবস্থাগুলোর জন্য তো নয়ই, বরং জাতির জন্যও কাম্য হতে পারে না। মনে রাখা প্রয়োজন, কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে ছোট করার প্রয়াসের মাধ্যমে অন্য কেউ বা কোনো গোষ্ঠী কোনো দিনই বড় হতে পারে না। আসলে কোর্ট মার্শালের বিপক্ষে যে বিরূপ মতামত সংবাদ মাধ্যমগুলো ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেয়া হয়েছে তা মূলত এসেছে বিগত বস্লল কথিত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ঢালাও ক্ষোভ ও বিরূপ সমালোচনার জের ধরে। গত দু’বছরের কথিত তিক্ততা থেকে। কিন্তু আমার জানা মতে, বর্তমান মহাজোট সরকার বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রায় সব আইনই বর্তমান সংসদে কণ্ঠভোটে পাস করিয়েছে। আবার অল্প কয়েকটি আইন বাদে কিছু কিছু আইনকে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী আইন হিসেবে আখ্যা দিয়ে বর্তমান জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। যে কোনো ধরনের কোর্ট মার্শাল দেশের সংবিধানসম্মত একটি আদালত। কোর্ট মার্শালের বিপক্ষে অতীতেও জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি বা তেমন কোনো উল্লেখও নেই। বর্তমানেও তেমন কিছু শোনা যায়নি। তবে আমাদের সার্বভৌম জাতীয় সংসদ চাইলেই কোর্ট মার্শালের ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। কোর্ট মার্শালের এখতিয়ারসহ বিভিন্ন বিধি-বিধান পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে প্রয়োজনে যুগোপযোগী করতে পারে। তবে এহেন সিদ্ধান্তের আগেই সেনাবাহিনীর প্রচলিত সংবিধানসম্মত বিচার ব্যবস্থা কোর্ট মার্শালের বিরূপ সমালোচনা ও বিরূপ মন্তব্য কখনোই কাম্য হতে পারে না। আর যারা এহেন মন্তব্যে সদা সোচ্চার তারা নিশ্চিতভাবেই সীমাহীন হীনম্মন্যতায় ভোগেন অথবা স্বীয়, দলীয় কিংবা অন্য কারও কায়েমি স্বার্থ (ঠবংঃবফ রহঃবত্বংঃ) চরিতার্থে নিয়োজিত। মজার ব্যাপার হলো, কোর্ট মার্শালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নানাভাবে লাগামহীন কথা বলার যে সুযোগটি স্বার্থান্বেষী মহল গ্রহণ করে তার মূল কারণ হলো, এক্ষেত্রে অদালত অবমাননার কোনো ভয় নেই। বস্তুত, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের প্রয়াসে আজ মহাজোট সরকারের দ্ব্যর্থহীন ভূমিকার প্রয়োজন। এখানে মুখ্য বিষয় হলো, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহাজোট সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। দেশের আপামর জনসাধারণ ন্যায়বিচার দেখতে চায়। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দেখতে চায় স্বচ্ছতাসহ আইনের শাসন। এখানে সরকারী দল, বিরোধী দল অথবা রাজনীতির কোনো চাতুরি নিশ্চিতভাবে আত্মঘাতী হিসেবেই প্রমাণিত হবে। আর আদালতের রায়ে অপরাধী অপরাধীই, বিদ্রোহী বিদ্রোহীই ও খুনি খুনিই। দল-মত নির্বিশেষে সে যে-ই হোক না কেন। আরও মনে রাখা প্রয়োজন, নির্বাচিত যে কোনো সরকারকে দুর্বল করার প্রয়াসে যেমন বিরোধী দল শক্তিশালী হতে পারে না, ঠিক তেমনিই বিরোধী দলকে দুর্বল করার প্রয়াসে কোনো সরকার কখনোই শক্তিশালী হতে পারবে না। সময়ের ব্যবধানে এটি প্রমাণিত এবং ভবিষ্যতেও প্রমাণিত হবে নিশ্চিত। একইভাবে, রাষ্ট্রের কোনো সংগঠন কিংবা সংস্থাকে দুর্বল করে অন্য যে কোনো সংগঠন কিংবা সংস্থা শক্তিশালী হতে পারে না। সঙ্গত কারণেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার সৌন্দর্যগুলো সর্বকালেই যুক্তিযুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ আচার-আচরণের মধ্যে নিহিত। আজ সময়ের দাবি হলো, গণতান্ত্রিক পরিবেশে প্রয়োজন সরকারি দল ও বিরোধী দলের সাহসী তথা প্রায়োগিক (চত্ধমসধঃরপ) ভূমিকাসহ জাতীয় বিষয়গুলোতে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই আসল ও অগ্রগণ্য। এটা সরকারে আসীনদের এক রকমের দুর্বহ (ঙহবত্ড়ঁং) দায়ও বলা যেতে পারে। শেষ করব ছোট মুখের ছোট একটি কথা দিয়ে। কথাটি হলো, গণতান্ত্রিক পরিবেশে ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কথিত শত্রুকে পরাজিত করার মারপ্যাঁচে না গিয়ে তাদের মন জয় করার মনস্তাত্ত্বিক প্রয়াসই উত্তম। আর শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রয়াসই হলো প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদসহ সর্বকালের সর্বজনের স্থায়ী সৌন্দর্যমণ্ডিত কৌশল। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে আমাদের সামনে আনন্দ-খুশির চেয়ে শোকের নানাবিধ ঘটনাবলির উদাহরণই বেশি।
রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের ওপর শুনানিতে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারা মনোনীত বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরিরা মূলত তিনটি মত প্রদান করেছেন। এক, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে করা সঠিক হবে না। দুই, উল্লিখিত হত্যাকাণ্ডের বিচার দেশের ফৌজদারি আইনে হওয়াই শ্রেয়। তিন, বিষয়টি সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টে পাঠানোই সঠিক হয়নি। এক্ষেত্রে, এহেন বিচারের শুরুতেই সুপ্রিমকোর্টকে না জড়িয়ে সরকারের যৌক্তিক বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তই সঠিক হতো বলে কোনো কোনো অ্যামিকাস কিউরি মত প্রকাশ করেছেন। তবে এহেন মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে দুই-একজন বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরি দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতের বিষয়ে যে ধরনের অপ্রত্যাশিত মনগড়া মন্তব্য করেছেন তা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টিসহ দেশে সংবিধানসম্মত বিভিন্ন বিচার ব্যবস্থাকে নানাবিধ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সের শুনানিকালে একজন প্রবীণ ও বিজ্ঞ আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরি হওয়ার সুবাদে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় হঠাত্ করেই বললেন, ‘জিয়া হত্যা মামলায় তেরোজন কৃতী অফিসারকে কোর্ট মার্শালের বিচারে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তাই, কোর্ট মার্শালের বিচার সঠিক ও যথেষ্ট নয় বলে প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে।’ এখানে জিয়া হত্যা মামলার কোর্ট মার্শালে বিচারের সঙ্গে বিডিআরের হত্যা মামলার বিচারের কীভাবে ও কোন ধরনের মিল আছে তা আমার বোধগম্য নয়। বিষয়টি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই আমার কাছে মনে হয়েছে। আবার কথার পিঠে কথায় অতি উত্সুক কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, দু-একজন ছাড়া বিডিআরের হত্যাকাণ্ডে নিহত সবাই সেনা অফিসার। তাই কোর্ট মার্শালের বিচারকরা সেনা অফিসার হেতু বিচারের রায় সেনা অফিসারদের দিকেই প্রভাবিত হবে। এহেন উক্তির বিরোধিতা করে কেউ কেউ একই যুক্তিতে সংক্ষুব্ধ সেনা পরিবারের সদস্যদের পক্ষে বলেছেন, অভিযুক্তরা সবাই যেহেতু সেনা পরিবারের বাইরের, তাই ফৌজদারি আইনের বিচারকরাও সেনাসদস্য নয় হেতু এহেন বিচারের রায়ও অভিযুক্তদের পক্ষে চলে যেতে পারে!
আসলে, এ সবই হলো কথার কথা। কথার পিঠে কথা। মূলত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য। হতে পারে ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর আবেগ, অনুরাগ অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রোশের ফলশ্রুতি। তবে এ সবই বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই না। যাকে বলা যায় স্রেফ ভাসা-ভাসা মন্তব্য। কোনোভাবেই ও কোনো যুক্তিতেই ধর্তব্যের বিষয় নয়। কিন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ও বর্তমান পরিস্থিতিতে এহেন মন্তব্য জনমনে নানাবিধ বিভ্রান্তি ছড়াতে যথেষ্ট। আসল কথা হলো, যাদের মুখ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আসে তা-ই ধর্তব্যের বিষয় ও বিশেষভাবে লক্ষণীয়, বিশেষভাবে বিবেচনার বিষয়। এহেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের শীর্ষ আদালতের বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছ থেকে কথার কথা অথবা অহেতুক মুখ ফসকে ভাসা-ভাসা মন্তব্য কোনো যুক্তিতেই কাম্য হতে পারে না। এতে অকারণে জনমনে বিভ্রান্তিসহ বিতৃষ্ণা ছড়ায় ও জনমানুষের মনে সংবিধানসম্মত বিচার ব্যবস্থাবলি ও সম্মানিত বিচারকদের ব্যাপারে সন্দেহের জন্ম দেয়। যা দেশের সংবিধানসম্মত বিচার ব্যবস্থাগুলোর জন্য তো নয়ই, বরং জাতির জন্যও কাম্য হতে পারে না। মনে রাখা প্রয়োজন, কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে ছোট করার প্রয়াসের মাধ্যমে অন্য কেউ বা কোনো গোষ্ঠী কোনো দিনই বড় হতে পারে না। আসলে কোর্ট মার্শালের বিপক্ষে যে বিরূপ মতামত সংবাদ মাধ্যমগুলো ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেয়া হয়েছে তা মূলত এসেছে বিগত বস্লল কথিত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ঢালাও ক্ষোভ ও বিরূপ সমালোচনার জের ধরে। গত দু’বছরের কথিত তিক্ততা থেকে। কিন্তু আমার জানা মতে, বর্তমান মহাজোট সরকার বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রায় সব আইনই বর্তমান সংসদে কণ্ঠভোটে পাস করিয়েছে। আবার অল্প কয়েকটি আইন বাদে কিছু কিছু আইনকে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী আইন হিসেবে আখ্যা দিয়ে বর্তমান জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। যে কোনো ধরনের কোর্ট মার্শাল দেশের সংবিধানসম্মত একটি আদালত। কোর্ট মার্শালের বিপক্ষে অতীতেও জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি বা তেমন কোনো উল্লেখও নেই। বর্তমানেও তেমন কিছু শোনা যায়নি। তবে আমাদের সার্বভৌম জাতীয় সংসদ চাইলেই কোর্ট মার্শালের ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। কোর্ট মার্শালের এখতিয়ারসহ বিভিন্ন বিধি-বিধান পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে প্রয়োজনে যুগোপযোগী করতে পারে। তবে এহেন সিদ্ধান্তের আগেই সেনাবাহিনীর প্রচলিত সংবিধানসম্মত বিচার ব্যবস্থা কোর্ট মার্শালের বিরূপ সমালোচনা ও বিরূপ মন্তব্য কখনোই কাম্য হতে পারে না। আর যারা এহেন মন্তব্যে সদা সোচ্চার তারা নিশ্চিতভাবেই সীমাহীন হীনম্মন্যতায় ভোগেন অথবা স্বীয়, দলীয় কিংবা অন্য কারও কায়েমি স্বার্থ (ঠবংঃবফ রহঃবত্বংঃ) চরিতার্থে নিয়োজিত। মজার ব্যাপার হলো, কোর্ট মার্শালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নানাভাবে লাগামহীন কথা বলার যে সুযোগটি স্বার্থান্বেষী মহল গ্রহণ করে তার মূল কারণ হলো, এক্ষেত্রে অদালত অবমাননার কোনো ভয় নেই। বস্তুত, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের প্রয়াসে আজ মহাজোট সরকারের দ্ব্যর্থহীন ভূমিকার প্রয়োজন। এখানে মুখ্য বিষয় হলো, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহাজোট সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। দেশের আপামর জনসাধারণ ন্যায়বিচার দেখতে চায়। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দেখতে চায় স্বচ্ছতাসহ আইনের শাসন। এখানে সরকারী দল, বিরোধী দল অথবা রাজনীতির কোনো চাতুরি নিশ্চিতভাবে আত্মঘাতী হিসেবেই প্রমাণিত হবে। আর আদালতের রায়ে অপরাধী অপরাধীই, বিদ্রোহী বিদ্রোহীই ও খুনি খুনিই। দল-মত নির্বিশেষে সে যে-ই হোক না কেন। আরও মনে রাখা প্রয়োজন, নির্বাচিত যে কোনো সরকারকে দুর্বল করার প্রয়াসে যেমন বিরোধী দল শক্তিশালী হতে পারে না, ঠিক তেমনিই বিরোধী দলকে দুর্বল করার প্রয়াসে কোনো সরকার কখনোই শক্তিশালী হতে পারবে না। সময়ের ব্যবধানে এটি প্রমাণিত এবং ভবিষ্যতেও প্রমাণিত হবে নিশ্চিত। একইভাবে, রাষ্ট্রের কোনো সংগঠন কিংবা সংস্থাকে দুর্বল করে অন্য যে কোনো সংগঠন কিংবা সংস্থা শক্তিশালী হতে পারে না। সঙ্গত কারণেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার সৌন্দর্যগুলো সর্বকালেই যুক্তিযুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ আচার-আচরণের মধ্যে নিহিত। আজ সময়ের দাবি হলো, গণতান্ত্রিক পরিবেশে প্রয়োজন সরকারি দল ও বিরোধী দলের সাহসী তথা প্রায়োগিক (চত্ধমসধঃরপ) ভূমিকাসহ জাতীয় বিষয়গুলোতে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই আসল ও অগ্রগণ্য। এটা সরকারে আসীনদের এক রকমের দুর্বহ (ঙহবত্ড়ঁং) দায়ও বলা যেতে পারে। শেষ করব ছোট মুখের ছোট একটি কথা দিয়ে। কথাটি হলো, গণতান্ত্রিক পরিবেশে ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কথিত শত্রুকে পরাজিত করার মারপ্যাঁচে না গিয়ে তাদের মন জয় করার মনস্তাত্ত্বিক প্রয়াসই উত্তম। আর শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রয়াসই হলো প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদসহ সর্বকালের সর্বজনের স্থায়ী সৌন্দর্যমণ্ডিত কৌশল। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে আমাদের সামনে আনন্দ-খুশির চেয়ে শোকের নানাবিধ ঘটনাবলির উদাহরণই বেশি।
No comments