গল্প- বাতাসের শব্দ by গাজী তানজিয়া

রাত তখন ৯টা। মনিপুরিপাড়া ক্রিশ্চিয়ানা হসপিটালের মধ্যম আকৃতির ভিজিটিং রুমের সারি সারি সবুজ চেয়ারগুলো অলস বসে আছে। রাতের বেলা এই হসপিটালে সাধারণত রোগী থাকে না। কারণ এটা মূলত গরীব রোগীদের জন্য একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। গরীবের রোগ থেকে থেকে ক্রনিক না হলেতো আর ডাক্তারমুখো হয় না কেউ।
তাই রাতে এ ধরনের হাসপাতালে যে এমারজেন্সি রোগি কেউ থাকবে না বলাই বাহুল্য। তাই নাইট ডিউটিতে দায়িত্বরত ডাক্তারও হাজির থাকেন না। কালেভদ্রে গভীর রাতে পাড়ার কোনো মধ্যবিত্ত রোগী এমারজেন্সি এখানে এসে পড়লে তাকে ফোন করে ডেকে আনা হয়। তাই এই অলস সময়টাতে কর্তব্যরত রিসিপশনিস্ট দেয়ালে টাঙানো ১৪ ইঞ্চি রঙিন টিভির পর্দায় ভেসে ওঠা হিন্দি সিরিয়ালে চোখ রেখে বসে আছে।
হঠাৎই হুড়মুড় করে ঢুকল চারজন মানুষ। তিনজন মেয়ে ও একজন বয়সক দাড়িওয়ালা পুরুষ। পরিপাটি পোশাকের দুজন তরুণী সবার সামনে, একটু পিছিয়ে পড়া বয়সক পুরুষ ও সবার পেছনে মলিন স্বল্পমূল্য পোশাকের প্রায় নিঃশ্বাস টেনে তুলতে অপারগ এক তরুণী। সেই যে রোগী বুঝতে অসুবিধা হয় না। সাধারণত কেউ অসুসহ বিশেষ করে গুরুতর অসুসহ থাকলে সে সব রোগী যখন কেউ হসপিটালে নিয়ে যায় তখন তাকে ছুঁয়ে থাকে তার স্বজনেরা। এই মেয়েটাকে কেউ ধরে ছুঁয়ে নেই। পরিপাটি তরুণীরা এবং বয়সক ভদ্রলোক যখন এগিয়ে গেলেন রিসিপশনের দিকে মেয়েটা তখন সবুজ চেয়ারের প্রান্ত ছুঁয়ে নিজের ভর রেখে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু বসছে না। পরিপাটি তরুণীরা রিসিপশনিস্ট-এর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
এক্সকিউজ মি!
রিসিপশনিস্ট যেন মনেপ্রাণে হিন্দি সিরিয়ালের ভেতরে ঢুকে গেছে, সেখান থেকে তাকে টেনে বের করে কার সাধ্য! পরিপাটি-১ এবার প্রায় চেঁচিয়ে বলল, এই যে শুনছেন?
রিসিপশনিস্ট পর্দায় চোখ রেখেই বলল, বলেন।
সি নিডস এমারজেন্সি ট্রিটমেন্ট।
ইংরেজি বাক্যে কাজ হয়। দুশো বছরের দাসত্বের শৃংখলে বন্দি ছিল যে কলোনিয়াল কান ও শরীর সে এবার নড়েচড়ে বসে। টিভি থেকে কোনোমতে চোখ সরিয়ে বলল,
জি্ব ম্যাম?
সি ইজ আওয়ার হাউজ মেইড, হঠাৎ অসুসহ হয়ে পড়েছে, সি নিডস এমারজেন্সি। কুইক ব্যবসহা করেন। প্লিজ কথাটা বলতে গিয়েও বলল না সে। এদের বলা বৃথা।
পরিপাটি-২ এর কোনোদিকে খেয়াল নেই- সে সেল ফোনে কাউকে ধরবার চেষ্টা করছে। হ্যালো, হ্যালো, লাইনটা কেটে গেল। শিট্!
পরিপাটি-১ : কি হলো?
পরিপাটি-২: লাইনটা পাচ্ছিই না আপা।
- ট্রাই কর। এই আপদ বিদায় করতেই হবে।
- কি ব্রোকার মহিলা যে ধরছেই না ফোন।
- এখন ধরবে কেন? এমন জিনিস আমাদের ঘাড়ে গছিয়ে দিয়ে কমিশনের হাজার টাকাতো খেয়ে বসে আছে। এখন কি আর ধরে! একটা মরা লাশ ঘাড়ে তুলে দিয়ে লাপাত্তা। আমরা ওর কি ক্ষতি করেছিলাম বলতো!
- ক্ষতি আমরা করিনি, আমরা দোষ করেছি।
- কি দোষ?
- কেন, এর আগেরবার যখন ঐ মহিলা টাকা নিয়েও কাজের লোক দিল না তখন মামী বলেছিল না ওর সাথে আর যোগাযোগ রাখবি না। কি আমরা মামীর কথা শুনিনি, আবারো ঐ মহিলাকে খবর দিয়েছি।
- কি আমরা কি করব বল? মা অসুসহ, আমার অফিস আছে তোর ভার্সিটি। উই ওয়্যার জাস্ট হেল্পলেস। বাসায় একজন কাজের লোক না থাকলে যে কী সমস্যা!
- সেটা এখন কে বুঝবে। নাও, এখন ঠেলা সামলাও। মরা মেরে খুনের দায় দাও।
- খুনের দায় দেব না। এখানে ডাক্তার দেখার পর তুই ওকে নিয়ে বাড়ি যাবি আর বাবাকে নিয়ে আমি যাব থানায়।
কেন?
- বারে, জিডি করতে হবে না? এই মেয়ে যদি মরে যায় তখন সব দোষ হবে আমাদের। তখন জেল হাজতে থাকতে হবে। অন্য কোনো উপায় থাকবে না। তখন শত বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না যে মেয়েটা আগে থেকেই অসুসহ ছিল। এদেশের মিডিয়াকে তুই চিনিস না! কোনো একটা ছুতো নিয়ে নিউজ কভার করতে পারলেই হয়।
- লাইনটা বোধহয় পেয়েছি আপা..। হ্যালো, হ্যালোঃ, হ্যালো, জরিনার মা? আপনাকে যে কতদিন ধরে বলছি ঢাকায় আসেন আর পায়রা বানুকে নিয়ে যান, আপনিতো আসছেনই না। আমরা আপনার কি ক্ষতি করেছি বলেন তো? এই রকম কাজের লোক কেউ কাউকে দেয়? হসপিটালে নিয়ে এসেছি। কি, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো, হ্যালো শুনেনঃ, কালই এসে এই মেয়েকে আপনি নিয়ে যাবেন। নইলে আমরা তাকে বাসে তুলে দিতে বাধ্য হব। পরে সে মরল কি বাঁচল সে দায়-দায়িত্ব আমাদের না।
শ্বাসকষ্ট কমিয়ে আনার প্রচেষ্টায় পায়রার নাকে নেবুলাইজার মাসক। সে ভাবছে অক্সিজেন। হসপিটালের অচেনা পরিবেশ আর নাকে চেপে বসা নেবুলাইজারে তোলা ঝড়ের বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ পেরিয়ে পায়রার কানে গিয়ে আগুনের শেলের মতো পেঁৗছে টেলিফোনের এপার থেকে বলা কথাগুলো। দীর্ঘদিন ধরে বুকের ভেতরে শ্বাস নেয়ার যে গলি পথগুলোয় পাথর চাপা দেয়া অনুভূতি ছিল সেই পাথরগুলো যখন আসতে আসতে সরে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ঝড়ের ওপার থেকে ভেসে আসা কথাগুলো যেন চেপে ধরেছে তার কণ্ঠনালী।
অবসহা বেগতিক দেখে ডাক্তার বললেন, সিষ্টার ইনজেকশান কুইক!
প্রবল ঝড়ের মাঝে কোন দূরে চলে যাওয়া পায়রাবানু হঠাৎ যেন সমবিত ফিরে পায়। ভয়ে আতঙ্ক নেবুলাইজার মাসক একটানে খুলে ফেলে সে চিৎকার করে ওঠে , না-আমি সুই (ইনজেকশান) লমুনা। না, না।
- কোনো ব্যথা পাবেন না, জাষ্ট একটা পিঁপড়ার কামড়।
- না! দোহাই আফনাগো আফা! ওমাগো ও বাবাগো-ও-ও বলতে বলতেই তার শিরায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় ইনজেকশান।
দু একটা উৎসুক মুখ রুমের সামনে উঁকি দিয়ে যায়।
পরিপাটি-১ পায়রার এই সিনক্রিয়েটে ব্যাপক বিরক্ত হয়।
পরিপাটি-২ খিল খিল করে হেসে ওঠে।
এবার ডাক্তার যারপরনাই বিরক্ত হন। আপনারা কি মানুষ! দেখছেন রোগী কষ্ট পাচ্ছে, আর আপনারা হাসছেন!
পরিপাটি-২ বিব্রত।
পরিপাটি-১ এবার রাগতস্বরে বলে ওঠে, কার ব্যাপারে ছবক দিচ্ছেন ডক্টর? যে মেয়ে সন্তানের জন্ম দিতে পারে সে ইনজেকশান দেখলে এভাবে ষাঁড়ের মতো চঁ্যাচাবে আর কেউ হাসতেও পারবে না?
কথাটা শুনে ডাক্তারের ভেতরে চন করে জেগে ওঠা রাগটা পড়ে গিয়ে বিসময়ে রূপ নেয়। তাই সে বলে, মেয়েটা একজন মা! বয়স কত ওর?
পরিপাটি-১ কাঁধ শ্রব করে বলে, আই ডোন্ট নো। সি ইজ জাস্ট আওয়ার মেইড। তাও অল্পদিন হলো জয়েন করেছে। ডাক্তার দ্রুত নিজেকে ঐ তরুণীর সামনে থেকে সরিয়ে নিতে নিতে স্বগতোক্তির মতো বলে, পনের-ষোলর বেশি হবে না। সে একজন মা! তাই নারীর পূর্ণতা শরীরে!
হঁ্যা, মা। পায়রাবানু একজন মা। তাইতো ঝড়ের বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ ভেদ করে যখন তার সমভাব্য চাকরি হারানোর কথাগুলো ভেসে আসে তখন সে উৎকণ্ঠায় আকুল হয়। তার প্রাণটা গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠে। এই কাজটা হারালে কি হবে তার সন্তানের! তার মেয়ে মরিয়ম। কিভাবে বাঁচাবে তাকে? কি খাওয়াবে তাকে পায়রা? যদি তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হয়! ফিরে যাওয়াই এখন তার নিয়তি। এক মাসও হয় নি এই বাড়িতে কাজে আসছে সে। তার মধ্যে তিনবার হাঁপানির টান উঠেছে। টান না উঠেইবা পারবে কি করে? সব কাজই পানির। ঘর মোছা, কাপড় কাচা, থালাবাসন ধোয়া, রান্নার তদারক করা, সব কিছুতে পানি। পানি জীবন আবার পানিই মরণ। তার হাত দুখানা প্রায় সারাদিন পানির তলেই থাকে। পানির সপর্শ ছাড়া কোনোদিন তার কল্পনাতেও নেই। আর ঐ অতিরিক্ত পানি ঘাঁটাঘাঁটিই তার প্রধান শত্রু। পানি ধরে ধরে তার হাতের আঙ্গুলগুলো কুঁচকে গেছে। রাত এলেই বাড়তে থাকে হাঁপানির টান, সঙ্গে জ্বর। জন্মের সাথে অভিশাপের মতো নিয়ে এসেছে এই রোগ। তার দাদা দাদী দুজনেরই ছিল হাঁপানির রোগ। বাপটাও গেল অকালে এই রোগে পড়ে। চাষাবাদ, মাছধরা; শক্ত কাজ কিছুই করতে পারত না। গোটা বর্ষাকাল আর অর্ধেক শীতকালতো কাদা সঁ্যাতসঁ্যাতে মাটির মেঝেতে হোগলা পাতার ন্যাতানো বিছানায় কাটিয়ে দিতে হতো তার বাপজানের। এরপর একদিন হঠাৎ করেই জোর হাঁপানির টান আর সব শেষ! গলায় তাবিজ, কোমরে তাবিজ, হাতে তাবিজ, কোনো তাবিজই তা রক্ষা করতে পারল না। পারল না অন্তত প্রাণটা বাঁচাতে।
বাপ মরেছে, মা মানুষের বাড়ি কামলা খেটে যা পায় তাতে তাদের দুইবেলা খাবার জোটে না। তার ওপরে পায়রা দেখতে শুনতে ভাল। কয়েকদিনের মধ্যেই ডাঙ্গর হয়ে উঠেছে। একদিন মধ্য দুপুরে দুম করে যৌবনবতী হয়ে ওঠে পায়রা। ঐ কেটো শরীরে যেন যৌবন চিহ্নের জোয়ার নেমে আসে দিনকে দিন। তারে সামলে সুমলে রেখে-ঢেকে রাখাটাই দায়। পুরুষের চোখ ঘুরেফিরে ওর বুকে এসে আটকে পড়ে। পায়রার বিয়ের সম্বন্ধও আসতে থাকে দু-এক জায়গা থেকে।
পাত্রপক্ষ সবাই পায়রাকে বিয়ে করতে ব্যাকুল কিন্তু যৌতুকে কেউ ছাড় দেবে না। ছেলের একখান রিক্সাভ্যান নয়তো নগদ দশ হাজার টাকা!
পায়রার মা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, 'মনে মনে পাত্র পক্ষের গোষ্ঠী উদ্ধার করে গালি দেয়। তারপরও বাসতব তার জান্তব ডালপালা মেলে ভয় দেখায় তারে। একেতো বাপ-হারা মেয়ে তার ওপরে অমন বেহায়ার মতো যৌবন। এরে ঘরে রাখবে কি কইরে!'
রাত বিরাতে তার কুঁড়ের পাশে হিংস কামার্ত ক্ষুধার্ত শেয়াল কুকুরের পায়চারি শুনতে পেয়ে চমকে ওঠে পায়রার মা। শেয়াল কুকুরেরা রাতে যেমন ঘুরে বেড়ায় জলজলে চোখে নখ দাঁত বের করে, দিনের বেলায়ও লালা গড়ায় তাদের লকলকে জিহ্বা বেয়ে। অথচ বিয়ের বেলায় যৌতুক! পায়রার মা তাই গ্রামের গন্ডি ছাড়িয়ে দূর দূরান্তে কাজে ছোটে মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড়ের আশায়।
বুড়ি দাদীর সাথে সারাদিন একলা কাটানো পায়রার জীবনে এই প্রথম ভালোবাসার বার্তা নিয়ে আসে ওই পাড়ার মজিদ। মফিজ পায়রাকে ভর দুপুরে ডোবার ধারে গোসল করবার সময় ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখায়। মফিজের কথায় পায়রার মন ভিজে ওঠে, চোখে জল গড়ায়। যৌতুক ছাড়া মায়ের কষ্ট ছাড়া নির্ভেজাল বিয়ে! নির্ভার আশ্রয়। আর এই স্বপ্নের ঘোর লাগা পায়রার চোখে তাকিয়ে মফিজ পায় সমর্পণের ইশারা। সে পায়রার হাতে হাত রাখে। সেই হাত বিষাক্ত সাপের মতো বিচরণ করে তার উরু, ঠোঁট, বুক, নাভী হয়ে আরো গভীর থেকে গভীরে। এক তীব্র কমপনে বৃষ্টির মাঝে ঝড়ের শব্দ ওঠে। দূর- দূর থেকে ভেসে আসা ঝড় আচমকা সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেয়।
একদিন চলতে ফিরতে পায়রা জ্ঞান হারায়। ঘন অন্ধকার নেমে আসে চরাচর জুড়ে। পায়রা পোয়াতি? বিয়া হয় নাই, পোয়াতি! চারদিকে ঢিঢি পড়ে যায়। সালিশ বসবে সালিশ। সালিশের উত্তপ্ত হাওয়া বালুঝড়ের মতো আচ্ছন্ন করে ফেলে চারধার।
সব দোষ ওই মাগির। ক্যাডায় জানে কইত্থন বাজাইয়া আইন্যা অহন আমারে দোষ দেয়। সাক্ষী আছে কেউ, কাউরে দেহাইতে পারব? মজিদ পায়রার চোখে চোখ রেখে নির্বিকার ভঙ্গিতে অস্বীকার করে সব। সব কিছু, ভুল ভালোবাসা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ভোগ-সমভোগ সব, সব কিছু।
ছিঃ ছিঃ! ছিছি! চারিদিকে এই শব্দ কোরাসের মতো গেয়ে ওঠে মানুষ। তারাই যারা পায়রাকে একটা নিশ্চিত আশ্রয় দেয় নাই, তারাই যারা যৌতুক ছাড়া তারে ঘরে তোলে নাই- তারাই । আবার তারাও যারা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে তাকে ভোগ করেছে। তাদের গলা সবার আগে শোনা যেতে লাগল।
পায়রা তার মা আর বৃদ্ধা দাদী লজ্জায়, অপমানে, ধিক্কারে মাটিতে মিশে যেতে লাগল দিনের পর দিন। পায়রার মাকে আর কেউ কাজে নেয় না। সমাজবাদ পড়েছে তারা। রাতের বেলা শ্বাপদের হাঁটাচলা আরো বেড়ে যেতে লাগল।
এর মাঝেও এতো কিছুর পরও পায়রা অপেক্ষা করে তার সন্তানের আগমনের।
এই ঘোর অমানিশায় পড়ে পায়রার মাও একদিন মুখ খোলে। মেয়েকে শাপ শাপান্ত করতেও ছাড়ে না।
'ওরে মুখপুড়ি, পিরীতে আন্ধা হইয়া গেছিলি? গতরে জ্বালা উঠছিল? অহন বোঝ! তুই নিজেই বা খাইবি কি আর প্যাডের ডারেইবা খাওয়াইবি কি? মরবি একলা মর। গুষ্টি শুদ্ধা লইয়া মরণ আইল তর! '
ঝড়ের মতো শব্দগুলো পায়রার কান ও অন্তর ভেদ করে যেতে থাকে। পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে । কেউ যেন তার শ্বাসনালী টিপে ধরেছে.. সেই প্রথম হাঁপানির টানটা টের পায় সে।
দিন যায়, তীব্র হাঁপানির টানে জমে-মানুষের ঘোর টানাটানির মধ্যে পায়রা জন্ম দেয় এক ফুটফুটে শিশুর। কিন্ত্ত কিছুদিন যেতেই তার বুকের দুধ টেনে ধু ধু মরুভূমি। একফোঁটা দুধ নেই। বাচ্ছাটা রাত দিন ক্ষিদের জ্বালায় কেঁদে চলেছে ট্যা ট্যা ট্যা এ্য এ্য এ্য। পায়রা এখন কি করে! কি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবে তার বুকের ধন! কোথায় কাজ পায় সে, কোথায়? যে কাজের বিনিময়ে সে কিনে আনতে পারবে একটু দুধ বা চালের গুঁড়ো বা নিদেনপক্ষে একটু আটা। গ্রামে কেউ তাকে কাজ দেবে না। জানে সে। তাই বুকে পাথর বেঁধে ছুটে যায় সে জরিনার মা'র কাছে।
খালা, আমারে এট্টা কাম জোগাইয়া দাও। আমার মাইয়াডারে বাঁচাও।
ক্যান, কি হইছে তর মাইয়ার?
আমি যে ওর মুখে কিছুই তুইলা দিতে পারি না। চাউলের কেজি চলিস্নশ ট্যহা আটার আরো বেশি। কাম দাও এট্টা খালা। কিন্তু সেই জইন্যে তো তর ঢাকা যাওন লাগব। আর ঐ বাচ্ছা নিয়াতো কেউ তরে কাম দিব না।
পায়রার পাঁজর ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে শব্দেরা। জানি খালা, সব জানি। জাইন্যা বুকে পাথর বানছি। আমার সোনারে আমি থুইয়া যামু মায়ের কাছে। তবু অর জানডাতো বাঁচব। আমি আমার হাতে ওরে মাইরা ফ্যালতে পারমু না।
কিন্ত্ত.., জরিনার মায়ের কপালে ভাঁজ পড়ে। তরাতো সমাজ বাদ পড়ছস। মাওলানায় ফতোয়া দিছে।
মায়ের বুকের তীব্র আর্তনাদ নিয়ে এবার লুটিয়ে পড়ে পায়রা। খালা আমার বাচ্চাডারে বাঁচাও দয়া কর খালা!
জরিনার মা এবার পটুর বিড়িতে টান দিয়ে বলে, ঠিক আছে। আমার কাছেও ঐ রুজি রোজগারডাই আগে, ঐসব সমাজ বাদ টাদ ডরাইলে আর প্যাট চলব না। ঠিক আছে তুই অহন যা। দুই এক দিনের মইদ্দে তরে খবর দিমুনে। কাউরে কিছু কইছ না, তুই অহন যা।
পায়রার কপালটাই খারাপ। কত জন্মের অভিশাপ যেন তার ওপরে। নইলে নাড়িছেড়া ধন দূরে সরিয়ে দিয়ে যে জীবিকার সন্ধানে তার পথে নামা সেখানেও সেই নিজের শরীর-ই তার সাথে বেঈমানি করল! এতোদিনে পায়রা বুঝতে পেরেছে যে তার আসল দুশমনই হলো তার শরীর। বাইরেটা দেখলে পুরুষের লোভ জাগে আর ভেতরটা ঝরঝরা ঘুণে ধরা। এইসব মেয়ে লোকের এই দুনিয়ায় জায়গা কোথায়? পায়রা জানে এতো দিন সে জানত না- এখন জানে কোথায়। 'নটি বাড়ি' সেদিন যখন এ বাড়ির মানুষেরা অভিযোগের পর অভিযোগ করছিল জরিনার মার কাছে তখন রাগের মাথায় সে বলেছে, 'তোর মতো মাগির জায়গা একটাই- নটি বাড়ি, বুঝলি নটি বাড়ি।'
একটানা ঝড়ের শব্দের অবসান হয়। নার্স আবার এসে ইনজেকশান দিয়ে যায় পায়রাকে। সে এবার নিশ্চুপ। ওপাশের ঘর থেকে ডাক্তারের সঙ্গে পরিপাটির কথোপকথন শোনা যায়।
ডাক্তার: রোগীকে আজ রাতে হসপিটালে রাখলে পারতেন।
পরিপাটি ১: সেটা সমভব না।
ডাক্তার: রাত দুটোয় রোগীকে একটা ইনজেকশান পুশ করতে হবে। সকাল ৬টায় আরেকটা। বাড়িতে কে করবে?
পরিপাটি একটু ভেবে নিয়ে.., সমভব না আমার মাও অসুসহ। আচ্ছা, অলটারনেটিভ কোনো ওষুধ দেয়া যায় না? ওরাল কিছু?
ডাক্তার: নেবুলাইজার সকাল ৬টায় আর একবার দিতে হবে।
পরিপাটি ১: ইনহেলারে হবে না?
ডাক্তার: নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো; তাই সই।
প্রেসক্রিপশন হাতে বাইরে বেরিয়ে আসে পরিপাটি।
পরিপাটি ১: চলো।
নার্স: রোগীকে যখন এখানে এনেছিলেন তখন তার অবসহা খুব সিরিয়াস ছিল। মাত্র একটা তো রাত, রোগীকে রেখে গেলে হতো না!
পরিপাটি কোনো কথা না বলে সোজা হাঁটছে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে।
নার্স: শোনেন, প্লিজ! একটা রাত, মাত্র একটা রাত। এতো যখন করেছেন একটা রাত রাখা যেত না?
পরিপাটি হেঁটেই যাচ্ছে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে।
পায়রা টলতে টলতে পেছন থেকে এসে নার্সের হাত চেপে ধরে। না বইন, আমি যাইতে পারমু। আর টাকা খরচ করাইবেন না। মনে মনে বলে, বেতনের হাজার টাকা থেকে কত কাটব কে জানে! পরিপাটি-২ তো টাকার হিসাব কইরেই চলতেছে। ঐ বেতনের ঐ কয়টা টাকা তো শুধু টাকা না, তার প্রাণ ভোমরা । ওর মধ্যে তার সন্তানের জীবন।
নার্স: কিন্ত্ত..!
অনেক ধইন্যবাদ আফা আপনাগোরে। আমার জন্য জীবনে এতো দরদ কেউ দেখায় নাই। আমি সারাজীবন এইজন্য আপনাগোরে দোয়া করমু। এখন আমার জীবনডা যায় যাউক। দোয়া কইরেন বইন, চাকরিডা য্যান থাহে।
নার্স: যদি যায়?
পায়রাবানু অদ্ভুতভাবে হাসার চেষ্টা করে বলে, তাইলে নটি বাড়ি..!
===============================
গোলাপি গল্প  বজ্র অটুঁনি অথবাঃ  উদ্ভট উটের পিঠে আইভরি কোস্ট  আনল বয়ে কোন বারতা!  ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা  বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে  উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব  বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি  অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা  খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার  কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ গাজী তানজিয়া


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.