অতৃপ্তির নাম মাশরাফি-অলক

টেলিভিশন খুললে টক-শো। চায়ের দোকানে আড্ডা। বাসে বাদুরঝোলা হয়েও আলোচনার বিষয় বিশ্বকাপের দল। মাশরাফি বিন মুর্তজাকে না নেওয়াটা ঠিক হলো কিনা, অলক কাপালি কেন নেই ১৫ সদস্যের দলে—নাগরিক জীবন ছাড়িয়ে এসব আলোচনা দেশের আনাচকানাচে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির সমান্তরালে এ দেশের মানুষ ক্রিকেট-বোদ্ধা হয়ে উঠছে। মাশরাফির কান্নায় তারা যেমন আবেগতাড়িত, তেমনি দলে আরেকজন পেসার নিলে ভালো হতো কি না, মগ্ন সেই বিশ্লেষণেও। বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দল নিয়ে সাধারণ ক্রিকেটভক্তদের এসব বিশ্লেষণের সঙ্গে সাবেক ক্রিকেটারদের চিন্তাভাবনার খুব অমিল নেই। সাধারণের আলোচনায় যেমন মাশরাফি ও অলক, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের চিন্তায়ও তা-ই। প্রধান নির্বাচক রফিকুল আলমের দলটাকে এই মুহূর্তের সেরা দল মানলেও এই দুই ক্রিকেটারের জন্য দীর্ঘশ্বাস পড়ছে।
সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানের দলকে ‘মোটামুটি ভালো’ বললেও একটা অতৃপ্তি অনুভব করছেন, ‘বিশ্বকাপে একেবারে নতুন কাউকে নিলে সেটা জুয়া হয়ে যেত। সেদিক দিয়ে পরীক্ষিতদের ওপরই আস্থা রেখেছেন নির্বাচকেরা। তবে দু-একটা জায়গায় আরেকটু ভালো হতে পারত।’
দু-একটা জায়গা বলতে আতহার মাশরাফি ও অলকের কথাই বলেছেন। ইনজুরির পর কেন মাশরাফিকে একবার বিদেশে চেকআপ করিয়ে আনা হলো না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন আতহার। আর বিশ্বকাপ যেহেতু এখনো বেশ কয়েক দিন দূরে, মাশরাফিকে দলে রাখা যেত বলেও মনে করেন তিনি, ‘ভারত-অস্ট্রেলিয়া দলের সব ক্রিকেটারও এক শ ভাগ ফিট না। আমার মনে হয়, ১৫ জনের দলে মাশরাফিকে রাখা যেত। পরে সে ফিট না হলে আমরা রিপ্লেসমেন্ট নিতাম। প্রধান নির্বাচক বলেছেন, মাশরাফির নাকি এখনো দলে আসার সম্ভাবনা আছে, এটা তো আসলে সম্ভব না। তার জন্য তো কাউকে ইনজুরিতে পড়তে হবে।’ সাবেক ওপেনারের মতে, ১৫ জনের দলে পেসার থাকা উচিত ছিল চারজন এবং তা মাশরাফিকে নিয়েই। সে সঙ্গে বোলিং বৈচিত্র্যের জন্য অলকের পক্ষেও ভোট দিয়েছেন আতহার, ‘দলে তিনজন বাঁহাতি স্পিনার কেন? বাঁহাতি তো সাকিব-রাজ্জাক আছেই। সঙ্গে অলকের লেগ স্পিনটা থাকলে ভালো হতো। অলক সোহরাওয়ার্দীর চেয়ে অনেক ভালো ব্যাটসম্যানও। তাকে নিলে পাওয়ার প্লের ব্যাটিংয়ের জন্যও ভালো হতো।’
মাশরাফির বাদ পড়া প্রসঙ্গে প্রায় একই মত সাবেক দুই অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ ও খালেদ মাসুদের। কোচ-অধিনায়ক বরাবর ফিট মাশরাফিকে গুরুত্ব দেন, কিন্তু মাহমুদের কাছে ‘আনফিট’ মাশরাফিরও মূল্য আছে। ‘ফিট মাশরাফি তো দলে থাকবেই। আমি মনে করি, মাশরাফি এই মুহূর্তে আনফিট হলেও তাকে দলে রাখা উচিত ছিল। দলে থাকলে সে ফিটনেস ফিরে পেতে সিরিয়াস থাকত’—বলেছেন মাহমুদ। তিনিও মনে করেন, দল থেকে বাদ দিয়েও মাশরাফিকে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখানোটা অবাস্তব, ‘এটা তো কাঁদতে থাকা একটা বাচ্চাকে চকলেট দেওয়ার মতো হয়ে গেল! আর তাঁরা বলছেন, কেউ ইনজুরিতে পড়লে মাশরাফি দলে আসবে, সেটাও ঠিক না। আগে থেকেই কেন একজনের ইনজুরির অপেক্ষায় থাকব আমরা? তাতে তো আরেকজনের স্বপ্ন ভেঙে যাবে!’
আরেক সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ প্রথমে ‘ইনজুরির কাছে সবাইকেই হার মানতে হয়’ বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন মাশরাফিকে। দেশের মাটিতে হতে যাওয়া বিশ্বকাপে মাশরাফির খেলা দেখতে না পারাটা তাঁকে পোড়াবে। তবে মাসুদও মনে করেন, মাশরাফির জন্য আরেকটু অপেক্ষা করাই উচিত ছিল। বিশ্বকাপের দল নিয়ে তাঁর আরেকটা অতৃপ্তি অলকের অনুপস্থিতি, ‘অলক থাকলে খুব ব্যালান্সড হতো দলটা। এটা ঠিক, সে গত দুই বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেনি। তবে আমার মনে হয়, বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে গত নিউজিল্যান্ড বা জিম্বাবুয়ে সিরিজেই অলককে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।’ আর মাহমুদ তো দুই বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেলার কথাটাকে অজুহাতই বলছেন, ‘এটা একটা অজুহাত মাত্র। আট নম্বরে নাঈম বা সোহরাওয়ার্দী যে কারও চেয়ে অলক ভালো ব্যাটসম্যান। ৭ ওভারে ৬০ রান লাগলে সেটা অলকের পক্ষেই তোলা সম্ভব। সঙ্গে ওর লেগ স্পিনটা তো ছিলই।’
মাশরাফি-অলকের বাদ পড়া নিয়ে হতাশা আছে। তবে সাবেক এই তিন ক্রিকেটারেরই শেষ কথা—বিশ্বকাপের দলটাই এই মুহূর্তের সেরা দল। কে থাকলেন কে বাদ পড়লেন, সেসব না ভেবে বিশ্বকাপে এই দলের পাশে থাকবেন সবাই। দলটার নাম যে বাংলাদেশ!

No comments

Powered by Blogger.