গল্প- গোলাপি গল্প by আজাদুর রহমান
অন্য দিনে কমপক্ষে ন'টার আগে জাকির বিছানা ছাড়ে না। কিন্তু প্রাইভেটের দিনগুলোর কথা আলাদা। সকাল আটটায় রহমতুলস্নাহ্ স্যারের বাসায় প্রাইভেট। ফিজিক্স সাবজেক্টটা এমনিতেই জাকিরের ভালো লাগে না। কিছু সূত্র মুখস্থ করা গেলেও গাণিতিক প্রমাণে এসে জটিলতা শুরু হয়। সাংকেতিক বর্ণ ব্যবহার করে বিটকেল ধরণের সমীকরনের সমাহার কোনমতেই জাকির মনে রাখতে পারে না।
তাঁর কেবলই মনে হয় ফিজিক্স পড়ার বদলে চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে একদল কিষাণের সাথে মাটি কাটা অনেক ভালো। একমাত্র মিতুর কারণে এরকম হাড়কিপ্টে সাবজেক্টে সে মনোযোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। মেয়েদের ব্যাচে জাকিরের ঢোকার কথা নয়। কিন্তু কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে মেয়ে বলতে পাঁচ জন। রহমতুলস্নাহ্ স্যারের ডিমান্ড এতো বেশি যে দশ জনের নিচে ব্যাচ পড়ালে তাঁর পড়তা হয় না। কিন্তু যতোদিনে মেয়েরা পড়তে আসলো ততদিনে ভালো ছাত্ররা শুরু করে দিয়েছে। অগত্যা জাকির, রসিদ এবং মাতুলদের মতো ব্যাকবেঞ্চারদের পাওয়া গেলো। জাকির আগে কখনো সরাসরি এতো কাছ থেকে মেয়েদের সাথে কথা বলেনি। একটা অন্যরকম অনুভূতি হতে লাগলো। দু দিন যাবার পরই সে বুঝতে পারলো তার সব মনোযোগ ক্রমেই মিতুর দিকে চলে যাচ্ছে। কোন কারণ নেই অথচ মিতুর মুখটা তাঁর মনের মধ্যে ঝুলে গ্যালো। ওর হাসি, কথাবার্তা, চাওনি এমনকি ওর ভর্ৎসনা পর্যন্ত মধুর লাগতে লাগলো। এখন প্রাইভেট না থাকলে দিনটাকে কানা মনে হয়। জাকির তাই নিয়ম করে সাতসকালে রহমত স্যারের বাসায় হাজির হয়। মিতুর আসতে দেরি হলে স্যারের জটিল শব্দগুলো মাথার ভিতর হিজিবিজি করতে করতে এক সময় পরস্পর ঝগড়া শুরু করে দেয় যেন। কেমন একটা অস্থির অস্থির ভাব লাগে। তখন সুঁতো ছেঁড়া হয়ে মনটা আকাশে উড়তে শুরু করে দেয়। মিতু জাকিরের চেয়ে এক বছরের ছোট। গত বছর জাকির গ্যাপ দিয়েছে। গ্যাপ দেবার অবশ্য কারণও ছিলো। প্রাইমারি থেকেই সে ভালো ছাত্র। ফাইভে এইটে স্কলারশিপের পর স্টার মার্কস্ নিয়ে এসএসসি। একজন মেধাবি, মনোযোগী এবং ভদ্র ছেলে হিসেবে জাকিরের পরিচিতি ছিলো। বলতে গেলে এখনো তাই আছে। তবে জাকির জানে সে আর সে নেই। মাঝখানে অনেক কিছু হয়ে গেছে গোপনে। বাবা মা কিছুটা অনুমান করলেও তাঁরা এখনো আমল দিয়ে সব কিছু বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। পাড়ার সকলের চোখে এখনও সে গুডবয়। কিন্তু জাকির জানে কিভাবে নেশা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার পরের তিন মাস বদলে দিয়েছে তাঁকে। মনে আছে ডিসেম্বর মাসের বিশ তারিখ। পাড়ার সিনিয়র বন্ধু শফিকের সাথে ওর নানাবাড়ি ছুটি কাটাতে গিয়েছিলো সে। বাবা-মা হাসিমুখেই যেতে দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ, একটু ঘোরাঘুরি করবে এতে দোষের কি! যশোর থেকে দিনাজপুরে পেঁৗছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। স্টেশন থেকে রিক্সার পথ। অলিগলি ঘুরে পুনর্ভবার কাছে মুন্সীপাড়ার দোতলা বাড়ি। বছর তিনেক আগে নানা মারা যাবার পর দুই মামার পরিবার আর নানীকে নিয়ে আধখঁ্যাচড়া যৌথ পরিবার। বাড়িটা চারতলার নিয়তে শুরু করা হলেও দোতলা করার পর তিনতলায় গিয়ে হাফডান অবস্থায় দশ বছর ধরে পড়ে আছে। খাওয়া দাওয়ার পর জাকিররা ছাদে উঠে এলো। পস্নাস্টারহীন দু'টো রুম। সামনেই খোলাছাদ। রাত দশটাতেই জেলা শহর নিশুতি হয়ে যাবে ভাবাই যায় না। কেবল মাঝে মাঝে দু একটা দূরবর্তী বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওরা প্যান্ট পাল্টে লুংগী পরে নেয়। জাকির আলস্যে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। সারাদিনের জার্নি শেষে ছাদের হাওয়ায় বেশ আরাম লাগছে। কিছু কথাবার্তার পর জাকির ক্লান্তচোখে শফিককে শুতে বলল। শফিকের চোখে জড়তা নেই। ব্যাগ থেকে দু'টো বোতল বের করে নিশ্চুপে ছাদের মাঝ বরাবর হেঁটে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সে। তারপর ছিপির পঁ্যাচ খুলতে শুরু করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে বোতল মুঠি করে নাকের কাছে তুলে ধরল। এবার একটু দম নিয়ে বোতলের সবটুকু তরল ঢক্ ঢক্ করে খেয়ে নিল। অনেকটা কাটা ডাবের পানি খাওয়ার মতো। জাকির এরকম দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে আশ্চর্যমুখে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে-তুই কি খাচ্ছিস ? শফিক বিব্রত বোধ করে না বরং হাসিমুখে বলে-ডাল খাচ্ছি মামা।
তাঁর কেবলই মনে হয় ফিজিক্স পড়ার বদলে চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে একদল কিষাণের সাথে মাটি কাটা অনেক ভালো। একমাত্র মিতুর কারণে এরকম হাড়কিপ্টে সাবজেক্টে সে মনোযোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। মেয়েদের ব্যাচে জাকিরের ঢোকার কথা নয়। কিন্তু কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে মেয়ে বলতে পাঁচ জন। রহমতুলস্নাহ্ স্যারের ডিমান্ড এতো বেশি যে দশ জনের নিচে ব্যাচ পড়ালে তাঁর পড়তা হয় না। কিন্তু যতোদিনে মেয়েরা পড়তে আসলো ততদিনে ভালো ছাত্ররা শুরু করে দিয়েছে। অগত্যা জাকির, রসিদ এবং মাতুলদের মতো ব্যাকবেঞ্চারদের পাওয়া গেলো। জাকির আগে কখনো সরাসরি এতো কাছ থেকে মেয়েদের সাথে কথা বলেনি। একটা অন্যরকম অনুভূতি হতে লাগলো। দু দিন যাবার পরই সে বুঝতে পারলো তার সব মনোযোগ ক্রমেই মিতুর দিকে চলে যাচ্ছে। কোন কারণ নেই অথচ মিতুর মুখটা তাঁর মনের মধ্যে ঝুলে গ্যালো। ওর হাসি, কথাবার্তা, চাওনি এমনকি ওর ভর্ৎসনা পর্যন্ত মধুর লাগতে লাগলো। এখন প্রাইভেট না থাকলে দিনটাকে কানা মনে হয়। জাকির তাই নিয়ম করে সাতসকালে রহমত স্যারের বাসায় হাজির হয়। মিতুর আসতে দেরি হলে স্যারের জটিল শব্দগুলো মাথার ভিতর হিজিবিজি করতে করতে এক সময় পরস্পর ঝগড়া শুরু করে দেয় যেন। কেমন একটা অস্থির অস্থির ভাব লাগে। তখন সুঁতো ছেঁড়া হয়ে মনটা আকাশে উড়তে শুরু করে দেয়। মিতু জাকিরের চেয়ে এক বছরের ছোট। গত বছর জাকির গ্যাপ দিয়েছে। গ্যাপ দেবার অবশ্য কারণও ছিলো। প্রাইমারি থেকেই সে ভালো ছাত্র। ফাইভে এইটে স্কলারশিপের পর স্টার মার্কস্ নিয়ে এসএসসি। একজন মেধাবি, মনোযোগী এবং ভদ্র ছেলে হিসেবে জাকিরের পরিচিতি ছিলো। বলতে গেলে এখনো তাই আছে। তবে জাকির জানে সে আর সে নেই। মাঝখানে অনেক কিছু হয়ে গেছে গোপনে। বাবা মা কিছুটা অনুমান করলেও তাঁরা এখনো আমল দিয়ে সব কিছু বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। পাড়ার সকলের চোখে এখনও সে গুডবয়। কিন্তু জাকির জানে কিভাবে নেশা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার পরের তিন মাস বদলে দিয়েছে তাঁকে। মনে আছে ডিসেম্বর মাসের বিশ তারিখ। পাড়ার সিনিয়র বন্ধু শফিকের সাথে ওর নানাবাড়ি ছুটি কাটাতে গিয়েছিলো সে। বাবা-মা হাসিমুখেই যেতে দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ, একটু ঘোরাঘুরি করবে এতে দোষের কি! যশোর থেকে দিনাজপুরে পেঁৗছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। স্টেশন থেকে রিক্সার পথ। অলিগলি ঘুরে পুনর্ভবার কাছে মুন্সীপাড়ার দোতলা বাড়ি। বছর তিনেক আগে নানা মারা যাবার পর দুই মামার পরিবার আর নানীকে নিয়ে আধখঁ্যাচড়া যৌথ পরিবার। বাড়িটা চারতলার নিয়তে শুরু করা হলেও দোতলা করার পর তিনতলায় গিয়ে হাফডান অবস্থায় দশ বছর ধরে পড়ে আছে। খাওয়া দাওয়ার পর জাকিররা ছাদে উঠে এলো। পস্নাস্টারহীন দু'টো রুম। সামনেই খোলাছাদ। রাত দশটাতেই জেলা শহর নিশুতি হয়ে যাবে ভাবাই যায় না। কেবল মাঝে মাঝে দু একটা দূরবর্তী বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওরা প্যান্ট পাল্টে লুংগী পরে নেয়। জাকির আলস্যে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। সারাদিনের জার্নি শেষে ছাদের হাওয়ায় বেশ আরাম লাগছে। কিছু কথাবার্তার পর জাকির ক্লান্তচোখে শফিককে শুতে বলল। শফিকের চোখে জড়তা নেই। ব্যাগ থেকে দু'টো বোতল বের করে নিশ্চুপে ছাদের মাঝ বরাবর হেঁটে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সে। তারপর ছিপির পঁ্যাচ খুলতে শুরু করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে বোতল মুঠি করে নাকের কাছে তুলে ধরল। এবার একটু দম নিয়ে বোতলের সবটুকু তরল ঢক্ ঢক্ করে খেয়ে নিল। অনেকটা কাটা ডাবের পানি খাওয়ার মতো। জাকির এরকম দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে আশ্চর্যমুখে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে-তুই কি খাচ্ছিস ? শফিক বিব্রত বোধ করে না বরং হাসিমুখে বলে-ডাল খাচ্ছি মামা।
জাকির হতভম্ব হয়ে গ্যালো। শফিককে বড়ই অচেনা লাগছে তাঁর। এতোদিন যে শফিককে চিনে এসেছে আজকের শফিককে তার সাথে কোনমতেই মেলাতে পারছে না সে। জাকির গলায় জোর তুলে ভর্ৎসনা করে উঠলো- ছিঃ তুই এরকম, কবে থেকে ফেনসিডিল ধরেছিস! শফিক যেন কথাগুলোর মানে খুঁজে পেল না, উল্টো ইয়ার্কি করে উঠলো-খাবা, খাইয়া দ্যাখো মামা মজা পাবা। জাকির উৎসাহ দেখালোনা উল্টো আশংকামুখে অচিন মুখপানে চেয়ে থাকলো। একটু পর শফিক মুখে দুটো চকলেট পুরে কচ কচ করে চিবুতে শুরু করে দিল। চকলেটের কুঁচি মিলিয়ে যাবার পরও সে মিনিট পাঁচেক গুম ধরে বসে থাকলো। তারপর না-খাওয়া বোতলটা হাতে ঝুলিয়ে রুমে ফেরত আসলো। নতুন কোন কথা হলো না। দুজনেই চিৎ হয়ে পড়ে থাকলো।
জাকিরের মনটা এলোমেলো ভাবনায় ভরে আছে। শফিক বিছানা থেকে ফের মেঝেতে নেমে আসলো। তারপর দ্বিতীয় বোতলের ছিপি খুলল। অর্ধেক সেবন হয়ে গেলে জাকিরের মাথায় আচমকা ভুত চেপে গেল। শফিকের হাতে ধরা বোতল ছিনতাই করার মতো করে এক ঝটকায় টান মেরে বলল-দে খাই। শফিক এতোটা ভাবেনি। আধো আলোর ভিতর সিরাপটা শেষ করে ফেলল জাকির। না, তেমন কোন উৎকট গন্ধ বা তেঁতো নেই। একটা জংলী গন্ধ মেশানো তীব্র মিষ্টিভাবের জিনিসটা। মুখে দিতেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। পেটে কৃমি কিংবা সর্দি-কাশি হলে ডিসপেনসারি থেকে গোলাপি কালাবের যেসব সিরাপ আনা হতো এটা ঠিক সেরকম। শফিক পকেট থেকে দুটো নাবিস্কো চকলেট এগিয়ে দিলো-নে নেশাটা জমবে। অগত্যা জাকির মুখে চকলেট নিয়ে চুষতে শুরু করলো। এতোক্ষণে ছাদের জোসনা আরো গাঢ় হয়ে গেছে। পাড়াশুদ্ধ ঘুম নেমেছে। নেশার কিছুই জাকির তেমন বুঝতে পারছে না। শুধু কান দুটো আগের চেয়ে গরম হয়ে আসছে। আর গলার কাছে ওম ওম ভাবের সুমিষ্ট একটা পুঁটলি ঝুলতে শুরু করেছে। মিনিট বিশেক যাবার পর চারপাশের জোসনাময় পরিবেশটা আরো পরিষ্কার হয়ে এলো জাকিরের কাছে। তাহলে কি দৃশ্যগুলো রঙীন হতে শুরু করেছে! কেমন একটা উড়- উড়- ভাবের বাতাস বইছে যেন হঠাৎ করেই। ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই শফিক গান ধরল-
তুমি আকাশ হলে
হবো আমি শঙ্খচিল
তুমি নদী হলে
হবো আমি জল-
আনমনেই ওরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। তারপর রেলিং খুলে পীচপথ ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে থাকলো। এখন কোন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে না বরং হাঁটতেই ভালো লাগছে। আধা কিলোর পর বাজার। ঝাপতোলা দোকানগুলো প্রায় সবই বন্ধ। একটা মাত্র চায়ের দোকান খোলা আছে। সফিক চিনি বেশি দিয়ে দুই কাপ দুধ চায়ের অর্ডার দিল। চা হয়ে এলে ওরা গোল্ডলিফ ধরালো। আজকের চা'টা সত্যিই অন্যরকম। চায়ের সাথে সিগারেট অদভুত লাগছে। জাকির আবেগ দমাতে পারলো না- মামা সিগারেটতো দেখি পাঙ্গাস মাছের মতো লাগছে। এরপর বিনা কারণেই ওরা পরস্পরের মুখ চেয়ে হাসতে থাকলো। শফিকরা পর পর দু'কাপ চা খেয়ে হেলেদুলে যতোক্ষণে ছাদে ফিরে আসলো ততক্ষণে মধ্যরাত। চাঁদটাও তামাবর্ণ হয়ে ডাকটিকেটের মতো আকাশে আটকে গেছে। দিনাজপুর স্টেশনে কোন একটা গাড়ি বুঝি ভিড়লো। হুইসেলটা এতো জোরে শোনা গেলো যে মনে হলো একটু নিকটেই বুঝি ট্রেনটা। বিছানায় কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গিয়ে ওরা পুরোপুরি ঝিম মেরে গ্যালো। তারপর কে কখন ঘুমিয়ে পড়লো দু'জনের কেউ তা বলতে পারলো না। পরদিন শফিকের ছোটমামা দরজা ধরে অনেক ডাকাডাকি করে যখন তাদের তুলতে পারলো তখন এগারোটা পেরিয়ে গেছে।
পরদিন বলতে গেলে এলোমেলোভাবেই পার হয়ে গেলো। বিকেলবেলা ওরা শহর ছাড়িয়ে পুনর্ভবা ব্রিজের নিচে নেমে এলো। খোলা চাতালের মতো লম্বা চর। শফিক দ্রুত কথা সেরে নিল- 'শোন্ , আমি না আসা পর্যন্ত তুই কোথাও যাবি না। চরের মধ্যেই থাকবি। পলাশবাড়ির হাশেম মামার কাছ থেকে মাল নিয়েই চলে আসবো। বেশি দেরি হবে না'। কথাগুলো বলেই সে নদীর পশ্চিম খাড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। শফিক পীচ ধরে মানুষের দলে মিশে গেলে জাকির পুনর্ভবার মাঝ বরাবর হাঁটতে শুরু করলো। চরে তেমন মানুষজন নেই। যেসব ছেলেরা ঘেঁসেল তলে ক্রিকেট খেলতে এসেছিলো তারাও ব্যাট-বল হাতে ব্রিজের দিকে চলে যাচ্ছে। জাকির অন্যমনস্কে পায়চারি করে মাঝ বরাবর এসে দাঁড়িয়ে পড়লো । নদী নয়, নদীর কঙ্কাল। দু পাশে ইলিশের পেটের মতো শাদা চর। মাঝখানে খালের মতো সামান্য প্রবাহ নিয়ে কোনমতে ছ্যাবলা নদীটা টিকে আছে। যেমন নিরিবিলি তেমন নিরাপদ। অনেকটা সীমান্তের জিরো লাইনের মতো। পূর্বপাড়ে কোতয়ালী আর পশ্চিমপাড়ে বিরল উপজেলা। ফলে 'কেউ কারো নয়' মতো অবস্থা। দু'পাড়ের থানা পুলিশের সুনির্দিষ্ট কোন আক্রমণ নেই। তাছাড়া যারা গায়ে পড়ে মুরুবি্ব ঠাওরায় তারাও সন্ধ্যের পর এতো ঝুঁকি নিয়ে চরে নামে না। নেশাখোরদের জন্য এটি একটি উৎকৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক চারণক্ষেত্রই বটে। মগরেবের আজান পড়েছে মিনিট বিশেক হয়েছে। আলোর জলে অন্ধকারের গুঁড়ো মিশতে শুরু করেছে। অন্ধকারের আগমনকে এখানে খুব আলাদাভাবে বোঝা যায়। অন্ধকার কি আলোর চেয়েও শক্তিশালী! আলো সব জায়গায় যেতে পারে না। কিন্তু অন্ধকার সেতো দেওয়ালের ওপারে যে বন্ধ বাক্স তার ভিতরেও ঢুকতে পারে। সর্বত্রই অন্ধকার, কেবল আলো এলেই সে সরতে শুরু করে। আলো অন্ধকার নিয়ে হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে জাকির এতোক্ষণে অনেক দক্ষিণে চলে আসে। ফেরা দরকার। শফিক এখনো আসেনি। নদীর কোমর জড়ানো ওপারের বাড়িঘরগুলোকে এখন রহস্যময় লাগছে। শফিক ক্যানো আসছে না! এরকম ধুঁ-ধুঁ চরে একাকি হাটতে গিয়ে জাকিরের মনটা খানিক ভয়ভাঁবি হয়ে ওঠে। শফিক ফিরলো রাত সাড়ে আটটায় এবং এসেই বোতল খুলে খাওয়া শুরু করলো। একটা একটানে শেষ করে বললো- নে। নিজের বোতলটা মুখে ঢেলে নিয়ে অন্য বোতলটা পেটের দিকে গুঁজে নিলো জাকির। সার্ট নামানোর পর বোঝার কায়দা নেই যে কোমরে বোতল জাতীয় কিছু আছে। ওরা পশ্চিমের কাঞ্চন বাজারে উঠে আসলো। সব কিছু যেন স্বাভাবিক। নাহ্ , জাকিরদেরকে কেউ কোন সন্দেহের চোখে দেখছে না। ওরা একটা টেবিলপাতা দোকানের বেঞ্চিতে বসে পড়লো। তারপর চা'য়ে চুমুক দিয়ে গোল্ডলিফ ধরালো। কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! জাকিরের মনটা আজ কেমন পলকা হাওয়ার মতো হয়ে গেছে। প্রথমবারের মতো জাকির অচেনা আনন্দভুবনের সন্ধান পেয়ে গেলো। সে যেন উড়ে বেড়াচ্ছে অথচ খুব বেশি অস্থির হতে হচ্ছে না।
এরপর প্রত্যেক বিকেলেই এভাবে ওরা কাঞ্চন ব্রিজের তলায় নেমে যায়। ফেনসিডিল খেয়ে উঠে আসে। চকলেট এবং চা যেন অমৃত। হাওয়ায় হাওয়ায় সাত দিন চলে যায়। তারপর যশোর ফিরে শফিক নিজের মতো আস্তানায় ফিরে গেলে জাকির কোন কিছুতে আর মন বসাতে পারে না। বিকেল হলেই গায়ের মধ্যে কামড়ানি শুরু হয়। তারপর সেও ঠিক খোঁজ পেয়ে যায়। মেথরপট্রির পিছনে সুড়িতলা দিয়ে নেমে গিয়ে খালের বস্তিঘরে সুফিয়া নামের এক মাদক সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে সে নিয়মিত ডালের বোতল কিনে আনে। টাকা জোগাড় করাটাই কেবল ওর সমস্যা। বাবার কাছে কত আর প্রজেক্ট দাঁড় করানো যায়। কলেজের বেতন, টিফিন খরচ, মোবাইল সেট কেনা, পিকনিকসহ নানা বাহানা তুলে টাকা নিয়েছে সে। বলতে গেলে টাকার জন্যই সে প্রাইভেটের বাহানা দিয়েছে। প্রাইভেটের মতো বেশ কয়েকটা ভণিতা তুলে কোনমতে গরীবিহালে ডালের পয়সা জোগাড় হয়ে যাচ্ছিলো বটে কিন্তু মিতুর ব্যাপারটা হঠাৎ করেই মাথায় ভেজাল শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটার মুখ মন থেকে কোনমতেই সরানো যাচ্ছে না। একসময় সেইতো বন্ধুদের সাথে চ্যালেঞ্জ করতো। আর যাই করুক প্রেমের মতো ফালতু জিনিসে সে নেই। কিন্তু মিতুর বেলায় সব উল্টাপাল্টা হয়ে গ্যালো। প্রিয় ছবি চোখের সামনে থেকে চলে গেলে যেমন একটা ইমেজ পড়ে থাকে অনেকটা সেরকম ছবি হয়ে থাকে মিতুর মুখ আর চোখজোড়া। মিতু চলে যাবার পরও কোনভাবেই ইমেজটাকে সরানো যায় না। ছায়ার মতো মাতিয়ে রাখে তার মায়াবি মুখ। শুক্র-শনিবার প্রাইভেট থাকে না, তখন নেশার মতোই অস্থির লাগে জাকিরের। কি করে বলা যায় মনের কথা। শুধু শুধু হাসি, পরস্পর চেয়ে থাকা- এইটুকু নিয়ে তো ভরসা করা যায় না। জাকিরের ভয় হয় যদি মিতু অন্যরকম কিছু করে ফেলে। বলতে গেলে ঘোরের মধ্যেই সে চিরকুট চেপে রাখে মিতুর ফিজিক্স বইয়ে। চিরকুটে একটাই কথা- মিতু পস্নাস জাকির। চিরকুট খুলে মিতু রেগেমেগে অস্থির হয়ে গ্যালো- 'ছিঃ তুমি এতো খারাপ'। জাকির কিছু বুঝে উঠতে পারে না। লজ্জায় বেরিয়ে আসে। চারদিকটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। শহরের সবাই কি তবে জেনে গেছে যে জাকির একটা খারাপ ছেলে। খামোখাই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে তার। তারপর সোজা চকেরহাট চলে যায় সে। সোবাহান মামাকে বলে দু'বোতল মাল বাসায় এনে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে। দিন গত হয়ে সন্ধ্যা নামে। রাত বাড়লে একতাল চাঁদ মাথায় করে ছাদে দাঁড়ায় জাকির। আকাশমুখো হয়ে সশব্দে চিৎকার করে ওঠে- মিতু, আমি ভালো হতে চেয়েছিলাম, প্রিয়তমা। তারপর ঢক্ ঢক্ করে দু'টো বোতল শেষ করে ফেলে। পরদিন মোবাইলে পর পর রিং বেজে যায়। এক সময় বিরক্তি মুখে সে ফোন ধরে। ওপাশ থেকে মিতুর কথা শোনা যায়- 'তুমি কেমন আছো, খুব রাগ করেছো নাকি? আজ বিকেলে ক্যানেল পাড়ে যাবো, ঠিক পাঁচটায় সোনামিয়ার ঘাটে। তুমি আসবে ?'। স্বপ্ন দেখছে না তো জাকির। নিজেকেও অচেনা লাগছে তার। হাওয়ায় উড়তে থাকে পুরো দুপুর। সব কিছু নেশাহীন হয়ে যায়। পয়মন্ত বিকেলের ঘাটে দাঁড়িয়ে জাকির রিকশা নেয়। মিতু নিজ থেকেই পাশে বসে। খানাখন্দকের ঝাঁকুনি সামলে নিতে পরস্পর ছোঁয়া লাগে। এক সময় শহরের ক্যাচক্যাচানি কমে গেলে রিকশা গ্রামের পথ ধরে। জাকির আনমনেই মিতুর হাতের ওপর হাত রাখে। আশ্চর্য! মিতু কিছুই বলে না। জাকির টের পায় তার হাত মোম হয়ে গলে পড়তে শুরু করেছে। আজগুবি সোবাহানের মুখটা মনে পড়ে যায়। চকেরহাটের ডালের কারবারি সোবাহান। একটু করে গা কামড়ানি শুরু হয় জাকিরের। সামান্য ডাল খেয়ে নিতে পারলে খুব ভালো হতো। মিতু হাতটা চেপে ধরে। জাকির ফিরে তাকায়। মিতু হাসছে, স্বচ্ছ পরিষ্কার হাসি। মিতুর মায়াবি নিষ্পাপ মুখের পতিপক্ষ হয়ে ডালের বোতলগুলো যেন উপহাস করে ওঠে। ঘোরের মধ্যেই জাকির হাহাকার করে ওঠে- মিতু আমি ভালো হতে চেয়েছিলাম, প্রিয়তমা। মিতু জাকিরের কথায় আমল দেয় না বরং হাতটা আরো কাছে তুলে নেয়।
=========================
বজ্র অটুঁনি অথবাঃ উদ্ভট উটের পিঠে আইভরি কোস্ট আনল বয়ে কোন বারতা! ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি সাইবারযুদ্ধের দামামা সরলতার খোঁজে সেই আমি এই আমি আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি ক্ষমতা ও গণতন্ত্র পানি সংকট পানি বাণিজ্য ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি একেই কি বলে আমলাতন্ত্র? আত্মসমর্পণের সেই বিকেল
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ আজাদুর রহমান
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
=========================
বজ্র অটুঁনি অথবাঃ উদ্ভট উটের পিঠে আইভরি কোস্ট আনল বয়ে কোন বারতা! ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি সাইবারযুদ্ধের দামামা সরলতার খোঁজে সেই আমি এই আমি আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি ক্ষমতা ও গণতন্ত্র পানি সংকট পানি বাণিজ্য ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি একেই কি বলে আমলাতন্ত্র? আত্মসমর্পণের সেই বিকেল
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ আজাদুর রহমান
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
No comments