লং ড্রাইভে প্রেম-ভালোবাসা by শামীমুল হক

পার্ক নয়, প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি এখন ভালোবাসার স্থান হিসেবে বেছে নিচ্ছে লং ড্রাইভকে। তাদের কথা, পার্ক এখন আর নিরাপদ নয়। সেখানে ভাসমান পতিতা, হকার, ছিনতাইকারী আর মাদকসেবীদের উৎপাত বেড়েছে বহুগুণে। এ কারণে তারা ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে লং ড্রাইভে ছুটে যাচ্ছেন। গাড়িতে বসেই হচ্ছে ভালোবাসার কথাবার্তা। মন দেয়া-নেয়া। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করে বসে পড়ছেন নির্জন কোনো স্থানে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই ভালোবাসাবাসি। তারপর ফিরে যান স্ব-স্ব ঠিকানায়। এমনই এক জুটি তাহসিন আর মৌ। দুজনই পড়েন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই ডিপার্টমেন্টে পড়ার সুবাদে দু’জনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে ধীরে ধীরে তা গড়ায় প্রেম-ভালোবাসায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কিংবা রাজধানীর কোনো কফি হাউজ, চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে মনের মতো কথা বলতে পারেন না। তাছাড়া মানুষ তাদের দিকে আড়চোখে তাকায়। এ অবস্থায় তারা সিদ্ধান্ত নেন সপ্তাহের একটি দিন লং ড্রাইভে যাবেন। রাজধানীর পল্টন থেকে প্রাইভেটকার ভাড়া নিয়ে তারা প্রায়ই চলে যান মেঘনা সেতুর পাশে নির্জন স্থানে। মেঘনা নদীকে সামনে রেখে প্রকৃতির রূপও দেখা হয়। হয় মনের মানুষের সঙ্গে ভাববিনিময়ও। তাহসিন বলেন, প্রেম শব্দটিই পবিত্র। কিন্তু সমাজের নৈতিক অবক্ষয় প্রেমকে কলঙ্কিত করছে নানাভাবে। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। আমরা চিরদিনের জন্য সংসারি হবো। সপ্তাহে একটি দিন আমরা চলে যাই মেঘনা নদীর পাড়ে। ওপাড়ে দাউদকান্দি আর এপাড়ে সোনারগাঁ। ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় খাবার দাবার নিয়ে যাই। সারা দিন মনের কথা বলি। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করি। কেমনে কেমনে সময় চলে যায় বলতেও পারি না। মৌ বলেন, আমি আমার পরিবারকে বলেই এখানে আসি। কোনো কোনো দিন চলে যাই রাজধানীর তিনশ ফুট রাস্তায়। সেখানে রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে আমরা দিন কাটাই। একে অন্যের কোলে মাথা রেখে স্বপ্ন দেখি। মৌ বলেন, এ স্বপ্ন দেখা পাপ নয়। তারপরও আমাদের সমাজে একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে একসঙ্গে দেখলে নানাজনে নানা কথা বলে। বাঁকা চোখে তাকায়। এক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো প্রয়োজন। তাহসিনের বাসা রাজধানীর বাসাবো। আর মৌদের বাসা ফকিরাপুলে। দু’জনই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। ফেসবুক, মোবাইল ফোনেও তো প্রেম ভালোবাসা হয়? প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই তাহসিন বলেন, আসলে ফেসবুক আর ফোনে কথা বলা আর সরাসরি কথা বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য। যারা প্রেমে পড়েননি তারা বুঝবেন না।
আরেক জুটি প্রয়াস ও লুপা। তারাও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। থাকেন উত্তরায়। দুজন আলাদা বিভাগে পড়লেও ক্যাম্পাসেই প্রথম দেখা। এরপর আস্তে আস্তে কাছে যাওয়া। মনের অজান্তেই একে অপরকে কাছে টেনে নেয়া। লুপা বলেন, কখন যে প্রয়াসকে নিজের করে নিয়েছি নিজেই জানি না। তাবে আমাদের প্রেম পবিত্র। আমরা আগে ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিতাম। তখনো প্রেমে পড়িনি। যেদিন থেকে আমরা প্রেমে পড়েছি সেদিন থেকে আর ক্যাম্পাসে আড্ডা দিই না। হয়তো কখনো কখনো ঘোরাফেরা করি। কিন্তু সপ্তাহের একটি দিন আমরা নিজেদের জন্য হাতে রেখেছি। ওই দিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি অজানার উদ্দেশে। কোনো নির্জন স্থান দেখে বসে পড়ি। কি কথা হয় আপনাদের মাঝে? প্রয়াস ও লুপা একসঙ্গে বলে ওঠেন, কথাতো শেষ হয় না। ভালোবাসার কথার কি শেষ আছে। জীবন সাজানো, ভবিষ্যৎ এগিয়ে নেয়া আরো কতো কি? পরিবার কি জানে আপনাদের প্রেম সম্পর্কে? লুপার কথা, না এখনো জানাইনি। তবে পরিবার আন্দাজ করতে পেরেছে। লুপার বাবা ডাক্তার। মা একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। আর প্রয়াসের বাবা ব্যবসায়ী।
লং ড্রাইভে প্রেম করতে করতে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন লতা আর রাকিব। এখন রাজধানীর পুরনো ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকেন। সংসার চালাতে লতা চাকরি নিয়েছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।  ইতিমধ্যে রাকিব মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর লতাও চাকরির পাশাপাশি বিসিএস দেবেন বলে জানান। লতার বাড়ি খুলনায়। আর রাকিবের সাতক্ষীরায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই তাদের প্রথম দেখা। রাকিব বলেন, লতার চোখ দেখেই আমি ওকে ভালোবেসে ফেলি। আর লতা জানান, অনেক দিন ও আমাকে তার ভালোবাসার কথা বলেছে। কিন্তু কোনো দিনই আমি তাকে কিছু বলিনি। একদিন লং ড্রাইভে গিয়ে তার প্রেমে পড়ে যাই। দেখি, আমি যেমন ছেলে পছন্দ করি ঠিক তেমন রাকিব। আমাদের দুজনের ভালোবাসা চলে প্রায় দুই বছর। এ সময়ে প্রায়ই লং ড্রাইভে চলে যেতাম। কখনো শ্রীমঙ্গল। কখনো টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতু। আমাদের প্রেমে ছিল দূরত্ব। ছিল শালীনতা। এখনকার বেশিরভাগ প্রেমিক-প্রেমিকাকে দেখি বেলাল্লাপনা করতে। যা দেখে দুঃখ পাই। কষ্ট লাগে। লতা বলেন, পারিবারিকভাবেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমরা সুখী পরিবার। রাকিবের কথা, একসময় ঢাকায় প্রেম ভালোবাসা ছিল পার্ক কেন্দ্রিক। প্রেমিক-প্রেমিকারা লাইন ধরে পার্কে যেতেন। সেখানে বসে মনের কথা বলতেন। ভাববিনিময় করতেন। আর এখন সেই পার্কগুলো চলে গেছে বখাটেদের দখলে। ফলে পার্কগুলো হয়ে উঠেছে  আতঙ্কের জায়গা। ফলে প্রেমিক প্রেমিকারা নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বেড়ায়। সবচেয়ে নিরাপদ হলো লং ড্রাইভে যাওয়া। গাড়িতে বসে গল্প করতে করতেই সময় চলে যায়। আবার কোনো সময় রাস্তার পাশে নির্জন জায়গা দেখে বসে পড়া যায়। এখন আধুনিক ছেলেমেয়েদের অনেকেই লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়েন। আসলে কোলাহলমুক্ত জায়গায় নিঃশ্বাস নেয়ারও একটা উদ্দেশ্য থাকে এতে।  তিনি বলেন, একটা বয়স পর্যন্ত সন্তানদের প্রতি পিতামাতার দৃষ্টি থাকে। যখন পিতামাতা বুঝতে পারেন তাদের সন্তান বুঝতে শিখেছে তখন তারা নিজেদের নিশ্চিন্ত মনে করেন। এ সুযোগে কোনো কোনো ছেলেমেয়ে পিতামাতার বিশ্বাস ভঙ্গ করে। কেউবা পিতা-মাতাকে বন্ধু মনে করে নিজের কথা শেয়ার করে। তবে আমাদের সমাজব্যবস্থা এখনো সে পর্যায়ে যায়নি। তিনি বলেন, লং ড্রাইভে গিয়ে প্রেম ভালোবাসাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখার কিছু নেই। সমাজ কিভাবে নিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু।

No comments

Powered by Blogger.