বাঙালি-অবাঙালি যুগলবন্দী by আলীম আজিজ
একজন বাঙালি মুসলিম পরিবারের মেয়ে ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে প্রথম হন মুসলমান মেয়েদের মধ্যে। অন্যজন পাকিস্তানি, জন্ম ভারতের অমৃতসরে। দুজনের পরিচয় যুক্তরাষ্ট্রে; তারপর বিয়ে। এই যুগল তার পর থেকে বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের ৪০ বছরের গবেষণার ফল বাংলা ভাষা আন্দোলন; বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে লেখা সুবিশাল গ্রন্থ। প্রায় জীবনসায়াহ্নে উপনীত এই যুগল এখনো কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ নিয়ে;
এখনো তাঁদের যা কিছু স্বপ্ন এই দেশকে ঘিরেই... খুব অল্প কথায় দুজনের পরিচিতি দেওয়া মোটেও সহজ নয়। আফিয়া খাতুনের জন্ম তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গে, আর আনোয়ার দিলের জন্ম ভারতের অমৃতসরে। উপমহাদেশের একেবারে দুই প্রান্তে জন্ম নেওয়া এ দুজনের কেউ কি জানতেন, ভবিতব্য তাঁদের দুই হাত একদিন এক করে দেবে। সে কথায় আসার আগে একটু পেছনের কথা টানা যাক। নরসিংদীর করিমপুর হলো আফিয়া খাতুনের গ্রাম। তিনি যখন এই গ্রামে বেড়ে উঠেছেন, তখন কোনো মেয়ের পক্ষেই স্কুল-কলেজে পড়া প্রায় কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল। কিন্তু বাবা সেকান্দর আলী—যিনি গ্রামের লোকের কাছে ‘সেকান্দর মাস্টার’ নামে পরিচিত ছিলেন—মেয়ের শিক্ষার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় সহায় ছিলেন। এই বাবার কাছেই তাঁর ইংরেজি শেখা, যদিও অক্ষর-পরিচয় ঘটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মায়ের কাছে।
বাবা বিদ্যোৎসাহী ছিলেন বলেই গ্রামের লোকের ভ্রুকুটি অবজ্ঞা করে মেয়েকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়েছেন; পড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়েও। ১৯৩৪ সালে যখন ঢাকায় মুসলিম গার্লস স্কুল স্থাপিত হয়, মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে এসে মুসলিম গার্লস স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এই স্কুলে আফিয়া খাতুন দুই বছর পড়ার পর চলে আসেন ইডেন স্কুলে, ১৯৩৬ সালের কথা সেটা।
১৯৪০ সালে এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আফিয়া মুসলমান মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেন। ইন্টারমিডিয়েটেও একই ফল। ফলে আফিয়ার ভাগ্যে অনায়াসে জুটে যায় সরকারি বৃত্তি, যার কারণে মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি না দিয়ে আর কোনো উপায় থাকেনি বাবার।
আফিয়াই হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান নারী, যিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর পড়াশোনা সম্পন্ন করেন, সেটা ১৯৪৬ সালের কথা। এরপর (১৯৪৭) দেশ ভাগ হয়ে গেল। দলে দলে হিন্দু শিক্ষকেরা সব ভারতে চলে গেলেন—এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আফিয়া প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেন ইডেন কলেজে।
এই সময়েই, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং আফিয়া তখন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের স্ত্রী, স্বভাবতই তিনিও ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ইডেন কলেজের তাঁর বাসস্থানই তখন হয়ে উঠেছিল অনেক গোপন বৈঠকের কেন্দ্রস্থল।
ইডেন কলেজে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি ১৯৫৩ সালে নিউজিল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে লিডারশিপ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আফিয়াই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পান।
দুই.
অমৃতসরে জন্ম হলেও আনোয়ার দিল বেড়ে ওঠেন পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পেশোয়ারে। পড়াশোনায় তুখোড় আনোয়ার দিলও বৃত্তি নিয়ে রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসেবে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এটা ষাটের দশকের কথা। এখানেই আরেক রিসার্চ স্টুডেন্ট আফিয়া খাতুনের সঙ্গে তাঁর পরিচয়; এবং এই পরিচয়-বন্ধুত্ব একসময় বিয়ের মধ্য দিয়ে স্থায়ী রূপ নেয়।
তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ দুই প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব তাঁদের যুগল জীবনে দীর্ঘ সময় প্রবাসে থাকলেও তাঁদের কর্মময় জীবনের পুরোটা জুড়ে ছিল কিন্তু বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মেয়ে আফিয়াকে আনোয়ার দিল শুধু জীবনসঙ্গিনীই করেননি, বাংলার সংস্কৃতি ও মানুষকে ভালোবেসে জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেই। তাঁদের ৪০ বছরের যৌথ গবেষণার ফসল ইংরেজিতে রচনা করা ৭৭৬ পৃষ্ঠার সুবিশাল গ্রন্থ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের জন্ম। শুধু এক প্রজন্মের জন্য নয়, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরের কাছে এ বই তুলে ধরবে বাংলাদেশের ভাষা ও জন্মের ইতিহাস। কেন বাঙালি মুসলমান সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছিল? কেনই বা সেই স্বপ্নের পাকিস্তান ভেঙে একাত্তর সালে তাঁদের লড়তে হলো বাংলাদেশের জন্য? প্রথিতযশা এ দুই সমাজবিজ্ঞানী-ভাষাতত্ত্ববিদ মনে করেন, এই আন্দোলনের বীজ প্রকৃত অর্থে রচিত হয়েছিল সেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময়েই। এরই ধারাবাহিকতায় হয়েছে ভাষা আন্দোলন, দেশ ভাগ এবং সবশেষে বাংলাদেশের জন্ম। এ বই রচনায় আফিয়া বাংলা থেকে ছেঁকে নিয়েছেন যত রসদ, অন্যদিকে আনোয়ার ব্যবহার করেছেন উর্দু তথ্যভান্ডার; সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে যোগ হয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অন্য তথ্যগুলো। ২০০০ সালে শুধু শিক্ষক-গবেষকদের জন্য সীমিত আকারে এ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের বাইরে।
বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকলেও আফিয়া-দিলের হূদয়ে সদা জাগরূক ছিল বাংলাদেশ। যতবারই বাংলাদেশে এসেছেন তাঁরা, বিপুল গবেষণার রসদ নিয়ে গেছেন। যার একটি বইয়ের নাম করা যায় এক্ষুনি—বেঙ্গলি নার্সারি রাইমস: অ্যান ইন্টারন্যাশনাল পারসপেক্টিভ। এ বইতে বাংলায় প্রচলিত যত শিশুতোষ ছড়া আছে, তার সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিশুপাঠ্য ছড়ার সঙ্গে। এ বই দিয়ে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাহিত্য-পরিচয়ই আফিয়া আন্তর্জাতিক পাঠকমহলে পরিচিত করতে চেয়েছেন। এ বইয়ের পরিচয় দিতে গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস সুসান এরভিন-ট্রিপ বলেছেন: এ বইতে আফিয়া দিল যেভাবে বাংলা ও সারা বিশ্বের শিশুতোষ ছড়ার সমাবেশ ঘটিয়েছেন, তা অনেক দিন পর্যন্ত লেখক-গবেষকদের সাহায্য করবে।
তাঁর বাংলায় লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে: নিউজিল্যান্ডের পত্র, ক্যারোলাইন প্রাটের আই লার্ন ফ্রম চিলড্রেন বইয়ের বাংলা অনুবাদ (১৯৫৫), যে দেশ মনে পড়ে (১৯৫৭, ভ্রমণকাহিনি) হেলেন কেলারের লেখা মাই টিচার-এর বাংলায় অনুবাদ। এ ছাড়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা ও নাটক তরঙ্গভঙ্গ তিনি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
তিন.
এই দুই যুগলের কাজের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তাঁদের স্বপ্নে-মননে সব সময়ই আছে বাংলাদেশ। আফিয়া ও আনোয়ার দিলের বয়স এখন আশি ছাড়িয়ে গেছে; কিন্তু এই বয়সেও এ দুজন তারুণ্যের কর্মক্ষমতায় ভরপুর। সামনে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের অনেক পরিকল্পনা।
অবাঙালি আনোয়ার দিল মনেপ্রাণে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। বাংলা ও বাংলাদেশ নিয়ে লেখা বইয়ের বাইরেও তাঁর নিজস্ব বিষয়ে ভাষাতত্ত্ব ও ভাষাবিজ্ঞানের ওপর বই আছে ১৯টির মতো, যার সবগুলো প্রকাশ করেছে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা সব মিলিয়ে ৪৫।
এই কীর্তিমান ভাষাবিজ্ঞানী গবেষক তাঁর সময়ের সিংহভাগ এখন ব্যয় করছেন তাঁর ভালো লাগার পূর্ববঙ্গ নিয়ে কাজ করে। বাংলা ও বাংলাদেশ নিয়ে এরই মধ্যে প্রায় ১০টির মতো বই বেরিয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকেই। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স অতি যত্নে এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকের বইগুলো বাংলাদেশের পাঠকের জন্য প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ তাঁর স্ত্রীর দেশ। কিন্তু সেই অবিভক্ত ভারতবর্ষ, পরে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের যত বুদ্ধিজীবী কবি-সাহিত্যিক ছিলেন, এখনো বেঁচে আছেন—তাঁদের অনেকে সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় মেলামেশা ছিল, যোগাযোগ ছিল, কারও কারও সঙ্গে অটুট ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে শুরু করে শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, কাজী মোতাহার হোসেন, আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ, জয়নুল আবেদিন, মুনীর চৌধুরী, মুর্তজা বশীর—সবাই বন্ধুস্থানীয়। তাঁদের প্রত্যেককে নিয়ে দুই হাতে লিখেছেন আনোয়ার দিল। সেসব বইয়ে তাঁদের সান্নিধ্য-স্মৃতিচারণাই শুধু নয়, আছে তাঁদের কাজের নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও।
প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ছুটে আসেন এই দম্পতি। সামনে তাঁদের হাজারো পরিকল্পনা। আফিয়ার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর করিমপুরে মা মিসেস ছফুরা খাতুনের নামে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজন করবেন ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বসংস্কৃতি’ শিরোনামে আন্তর্জাতিক সেমিনার, যা প্রতিবছর ডিসেম্বরের দিকে অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে বাংলাদেশ ছাড়াও সমবেত হবেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সব ব্যক্তিত্ব। ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পাঠাগারটিও তাঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ার পরিকল্পনা করেছেন। আফিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালির্ফোনিয়ার স্যানডিয়াগোয় তাঁর কর্মস্থল অ্যালিয়ান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ওমেনস স্টাডি বিভাগের উদ্যোক্তা। তাঁরই প্রচেষ্টায় এই ওমেনস স্টাডি বিষয়টি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সবার জন্য বাধ্যতামূলক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার স্টাডিজের সঙ্গেও তিনি এ বিষয় নিয়ে সম্ভব হলে সহযোগিতামূলক কিছু করতে চান।
বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনা অনেক। দুজনই জানেন, হাতে সময় অনেক কম। তাই একমুহূর্ত সময়ও তাঁরা নষ্ট করতে চান না।
আফিয়া দিল
জন্ম: ঢাকার নরসিংদীতে। পড়াশোনা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মজীবন শুরু ইডেন কলেজে, ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে। কাজ করেছেন অধ্যাপক ও ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগে, শিক্ষকতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি, কলাম্বিয়া আর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৩ সাল থেকে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে কর্মরত আছেন ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানডিয়াগোয় অবস্থিত অ্যালিয়েন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে আছে: হেলেন কেলার আমার শিক্ষক, টু ট্র্যাডিশন অব দ্য বেঙ্গুলি ল্যাঙ্গুয়েজ, বেঙ্গুলি নার্সারি রাইমস, ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দুটি বই: চাঁদের অমাবস্যা ও নাটক তরঙ্গভঙ্গ।
আনোয়ার দিল
জন্ম: অমৃতসর, পাঞ্জাব। বড় হয়েছেন পেশোয়ারের অ্যাবোটাবাদে।
পড়াশোনা: লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজ, পেশোয়ার ইসলামিয়া কলেজ, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭৩ সাল থেকে ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন, বর্তমানে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে কর্মরত আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানডিয়াগোয় অবস্থিত অ্যালিয়েন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর আগে পাকিস্তানে ১৬ বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজির অধ্যাপক ও ভাষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। ৪০টিরও বেশি বইয়ের লেখক, সম্পাদক। এর মধ্যে ১৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের ল্যাঙ্গুয়েজ ও ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট সিরিজের অংশ হিসেবে।
তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেওয়া বইয়ের মধ্যে আছে: হিউম্যানস ইন ইউনিভার্স, নরম্যান বরলাউগ অন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার, সায়েন্স ফর পিস অ্যান্ড প্রগ্রেস।
বাবা বিদ্যোৎসাহী ছিলেন বলেই গ্রামের লোকের ভ্রুকুটি অবজ্ঞা করে মেয়েকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়েছেন; পড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়েও। ১৯৩৪ সালে যখন ঢাকায় মুসলিম গার্লস স্কুল স্থাপিত হয়, মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে এসে মুসলিম গার্লস স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এই স্কুলে আফিয়া খাতুন দুই বছর পড়ার পর চলে আসেন ইডেন স্কুলে, ১৯৩৬ সালের কথা সেটা।
১৯৪০ সালে এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আফিয়া মুসলমান মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেন। ইন্টারমিডিয়েটেও একই ফল। ফলে আফিয়ার ভাগ্যে অনায়াসে জুটে যায় সরকারি বৃত্তি, যার কারণে মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি না দিয়ে আর কোনো উপায় থাকেনি বাবার।
আফিয়াই হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান নারী, যিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর পড়াশোনা সম্পন্ন করেন, সেটা ১৯৪৬ সালের কথা। এরপর (১৯৪৭) দেশ ভাগ হয়ে গেল। দলে দলে হিন্দু শিক্ষকেরা সব ভারতে চলে গেলেন—এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আফিয়া প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেন ইডেন কলেজে।
এই সময়েই, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং আফিয়া তখন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের স্ত্রী, স্বভাবতই তিনিও ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ইডেন কলেজের তাঁর বাসস্থানই তখন হয়ে উঠেছিল অনেক গোপন বৈঠকের কেন্দ্রস্থল।
ইডেন কলেজে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি ১৯৫৩ সালে নিউজিল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে লিডারশিপ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আফিয়াই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পান।
দুই.
অমৃতসরে জন্ম হলেও আনোয়ার দিল বেড়ে ওঠেন পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পেশোয়ারে। পড়াশোনায় তুখোড় আনোয়ার দিলও বৃত্তি নিয়ে রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসেবে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এটা ষাটের দশকের কথা। এখানেই আরেক রিসার্চ স্টুডেন্ট আফিয়া খাতুনের সঙ্গে তাঁর পরিচয়; এবং এই পরিচয়-বন্ধুত্ব একসময় বিয়ের মধ্য দিয়ে স্থায়ী রূপ নেয়।
তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ দুই প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব তাঁদের যুগল জীবনে দীর্ঘ সময় প্রবাসে থাকলেও তাঁদের কর্মময় জীবনের পুরোটা জুড়ে ছিল কিন্তু বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মেয়ে আফিয়াকে আনোয়ার দিল শুধু জীবনসঙ্গিনীই করেননি, বাংলার সংস্কৃতি ও মানুষকে ভালোবেসে জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেই। তাঁদের ৪০ বছরের যৌথ গবেষণার ফসল ইংরেজিতে রচনা করা ৭৭৬ পৃষ্ঠার সুবিশাল গ্রন্থ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের জন্ম। শুধু এক প্রজন্মের জন্য নয়, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরের কাছে এ বই তুলে ধরবে বাংলাদেশের ভাষা ও জন্মের ইতিহাস। কেন বাঙালি মুসলমান সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছিল? কেনই বা সেই স্বপ্নের পাকিস্তান ভেঙে একাত্তর সালে তাঁদের লড়তে হলো বাংলাদেশের জন্য? প্রথিতযশা এ দুই সমাজবিজ্ঞানী-ভাষাতত্ত্ববিদ মনে করেন, এই আন্দোলনের বীজ প্রকৃত অর্থে রচিত হয়েছিল সেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময়েই। এরই ধারাবাহিকতায় হয়েছে ভাষা আন্দোলন, দেশ ভাগ এবং সবশেষে বাংলাদেশের জন্ম। এ বই রচনায় আফিয়া বাংলা থেকে ছেঁকে নিয়েছেন যত রসদ, অন্যদিকে আনোয়ার ব্যবহার করেছেন উর্দু তথ্যভান্ডার; সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে যোগ হয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অন্য তথ্যগুলো। ২০০০ সালে শুধু শিক্ষক-গবেষকদের জন্য সীমিত আকারে এ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের বাইরে।
বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকলেও আফিয়া-দিলের হূদয়ে সদা জাগরূক ছিল বাংলাদেশ। যতবারই বাংলাদেশে এসেছেন তাঁরা, বিপুল গবেষণার রসদ নিয়ে গেছেন। যার একটি বইয়ের নাম করা যায় এক্ষুনি—বেঙ্গলি নার্সারি রাইমস: অ্যান ইন্টারন্যাশনাল পারসপেক্টিভ। এ বইতে বাংলায় প্রচলিত যত শিশুতোষ ছড়া আছে, তার সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিশুপাঠ্য ছড়ার সঙ্গে। এ বই দিয়ে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাহিত্য-পরিচয়ই আফিয়া আন্তর্জাতিক পাঠকমহলে পরিচিত করতে চেয়েছেন। এ বইয়ের পরিচয় দিতে গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস সুসান এরভিন-ট্রিপ বলেছেন: এ বইতে আফিয়া দিল যেভাবে বাংলা ও সারা বিশ্বের শিশুতোষ ছড়ার সমাবেশ ঘটিয়েছেন, তা অনেক দিন পর্যন্ত লেখক-গবেষকদের সাহায্য করবে।
তাঁর বাংলায় লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে: নিউজিল্যান্ডের পত্র, ক্যারোলাইন প্রাটের আই লার্ন ফ্রম চিলড্রেন বইয়ের বাংলা অনুবাদ (১৯৫৫), যে দেশ মনে পড়ে (১৯৫৭, ভ্রমণকাহিনি) হেলেন কেলারের লেখা মাই টিচার-এর বাংলায় অনুবাদ। এ ছাড়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা ও নাটক তরঙ্গভঙ্গ তিনি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
তিন.
এই দুই যুগলের কাজের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তাঁদের স্বপ্নে-মননে সব সময়ই আছে বাংলাদেশ। আফিয়া ও আনোয়ার দিলের বয়স এখন আশি ছাড়িয়ে গেছে; কিন্তু এই বয়সেও এ দুজন তারুণ্যের কর্মক্ষমতায় ভরপুর। সামনে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের অনেক পরিকল্পনা।
অবাঙালি আনোয়ার দিল মনেপ্রাণে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। বাংলা ও বাংলাদেশ নিয়ে লেখা বইয়ের বাইরেও তাঁর নিজস্ব বিষয়ে ভাষাতত্ত্ব ও ভাষাবিজ্ঞানের ওপর বই আছে ১৯টির মতো, যার সবগুলো প্রকাশ করেছে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা সব মিলিয়ে ৪৫।
এই কীর্তিমান ভাষাবিজ্ঞানী গবেষক তাঁর সময়ের সিংহভাগ এখন ব্যয় করছেন তাঁর ভালো লাগার পূর্ববঙ্গ নিয়ে কাজ করে। বাংলা ও বাংলাদেশ নিয়ে এরই মধ্যে প্রায় ১০টির মতো বই বেরিয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকেই। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স অতি যত্নে এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকের বইগুলো বাংলাদেশের পাঠকের জন্য প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ তাঁর স্ত্রীর দেশ। কিন্তু সেই অবিভক্ত ভারতবর্ষ, পরে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের যত বুদ্ধিজীবী কবি-সাহিত্যিক ছিলেন, এখনো বেঁচে আছেন—তাঁদের অনেকে সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় মেলামেশা ছিল, যোগাযোগ ছিল, কারও কারও সঙ্গে অটুট ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে শুরু করে শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, কাজী মোতাহার হোসেন, আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ, জয়নুল আবেদিন, মুনীর চৌধুরী, মুর্তজা বশীর—সবাই বন্ধুস্থানীয়। তাঁদের প্রত্যেককে নিয়ে দুই হাতে লিখেছেন আনোয়ার দিল। সেসব বইয়ে তাঁদের সান্নিধ্য-স্মৃতিচারণাই শুধু নয়, আছে তাঁদের কাজের নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও।
প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ছুটে আসেন এই দম্পতি। সামনে তাঁদের হাজারো পরিকল্পনা। আফিয়ার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর করিমপুরে মা মিসেস ছফুরা খাতুনের নামে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজন করবেন ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বসংস্কৃতি’ শিরোনামে আন্তর্জাতিক সেমিনার, যা প্রতিবছর ডিসেম্বরের দিকে অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে বাংলাদেশ ছাড়াও সমবেত হবেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সব ব্যক্তিত্ব। ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পাঠাগারটিও তাঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ার পরিকল্পনা করেছেন। আফিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালির্ফোনিয়ার স্যানডিয়াগোয় তাঁর কর্মস্থল অ্যালিয়ান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ওমেনস স্টাডি বিভাগের উদ্যোক্তা। তাঁরই প্রচেষ্টায় এই ওমেনস স্টাডি বিষয়টি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সবার জন্য বাধ্যতামূলক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার স্টাডিজের সঙ্গেও তিনি এ বিষয় নিয়ে সম্ভব হলে সহযোগিতামূলক কিছু করতে চান।
বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনা অনেক। দুজনই জানেন, হাতে সময় অনেক কম। তাই একমুহূর্ত সময়ও তাঁরা নষ্ট করতে চান না।
আফিয়া দিল
জন্ম: ঢাকার নরসিংদীতে। পড়াশোনা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মজীবন শুরু ইডেন কলেজে, ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে। কাজ করেছেন অধ্যাপক ও ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগে, শিক্ষকতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি, কলাম্বিয়া আর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৩ সাল থেকে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে কর্মরত আছেন ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানডিয়াগোয় অবস্থিত অ্যালিয়েন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে আছে: হেলেন কেলার আমার শিক্ষক, টু ট্র্যাডিশন অব দ্য বেঙ্গুলি ল্যাঙ্গুয়েজ, বেঙ্গুলি নার্সারি রাইমস, ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দুটি বই: চাঁদের অমাবস্যা ও নাটক তরঙ্গভঙ্গ।
আনোয়ার দিল
জন্ম: অমৃতসর, পাঞ্জাব। বড় হয়েছেন পেশোয়ারের অ্যাবোটাবাদে।
পড়াশোনা: লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজ, পেশোয়ার ইসলামিয়া কলেজ, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭৩ সাল থেকে ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন, বর্তমানে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে কর্মরত আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানডিয়াগোয় অবস্থিত অ্যালিয়েন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর আগে পাকিস্তানে ১৬ বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজির অধ্যাপক ও ভাষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। ৪০টিরও বেশি বইয়ের লেখক, সম্পাদক। এর মধ্যে ১৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের ল্যাঙ্গুয়েজ ও ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট সিরিজের অংশ হিসেবে।
তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেওয়া বইয়ের মধ্যে আছে: হিউম্যানস ইন ইউনিভার্স, নরম্যান বরলাউগ অন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার, সায়েন্স ফর পিস অ্যান্ড প্রগ্রেস।
No comments