কাঁটাবিদ্ধ আশরাফ
সৈয়দ
আশরাফুল ইসলাম একজন সৎ রাজনীতিক। তার বিরুদ্ধে কখনও দুর্নীতির অভিযোগ
ওঠেনি। তার আকস্মিক প্রস্থান বিদেশী কূটনীতিকদেরও অবাক করেছে। তাকে অপসারণ
করার পরপরই ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ এবং বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন
সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানা গেছে।
তার প্রস্তানকে কেবল আওয়ামী লীগের দিক থেকে দেখা হলেও এই ঘটনার আরও বড় তাৎপর্য রয়েছে। ২০১৯ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রস্তুতির সঙ্গেও এর কোন যোগসূত্র থাকতে পারে কিনা তা অনেকে খতিয়ে দেখছেন। আপাতত অনেকে তার কথিত নিষ্ক্রিয়তা, অফিস না করা এবং ক্ষমতাসীন দলের একটি প্রভাবশালী অংশের ঈর্ষা এবং তাদের তরফে কানভারি করার মতো বিষয় মিডিয়ায় বেশি আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষক এই পরিবর্তনকে এরকম কোন সাধারণ হিসেব নিকেষ থেকে দেখছেন না। অনেকের মতে বিরোধী দল ও মিডিয়া মোকাবিলায় এর প্রভাব পড়তে পারে। কারণ সৈয়দ আশরাফকে সরিয়ে সরকার প্রধানের একজন নিকটাত্মীয়কে আনা হয়েছে। আর ভবিষ্যতে বিরোধী দল মোকাবিলায় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অপেক্ষাকৃত একজন কট্টরপন্থিকে আনার সম্ভাবনা থাকবে।
সবচেয়ে বড় কথা, সৈয়দ অশরাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণকে উৎসাহিত করেননি। বরং এটাই জানা যায় যে, জাতিসংঘের দূত জর্জ ফারনান্দেজ তারানকোর সঙ্গে বৈঠককালে তিনি বিএনপির সঙ্গে চারটি বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। এক. বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তি, দুই. মামলা প্রত্যাহার, তিন. অফিস খুলে দেওয়া ও চার. সভা-সমাবেশের ওপর থেকে বাধানিষেধ প্রত্যাহার করা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধি দল বৈঠকে বসেছিল। আলোচনার শেষপর্যায়ে ওই চারটি বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়। দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর মতে, হঠাৎ মোবাইলে একটি কল আসে। আর তার পরই সমঝোতা প্রয়াস ভণ্ডুল হয়। তখন তাকে ম্লান হতে দেখা গিয়েছিল। তাকে বিব্রত মনে হয়েছিল। যদিও তিনি নিজে কখনও এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দেননি।
সৈয়দ আশরাফের একটি দীর্ঘ সময় কেটেছে বৃটেনে। সেখানকার লেবার দলীয় রাজনীতিতে বেশ ভালও অবস্থানে দীর্ঘকাল সক্রিয় থাকারও সুযোগ ঘটেছে। তিনি তার এলাকায় কম যেতেন, সচিবালয়ের তদবির থেকে নিজকে রক্ষা করতে সর্বদা সতর্ক থাকতেন। কারণ তিনি জানতেন তদবিরকারীদের শুনতে গেলেই তাকে অন্যায় পথে হাঁটতে হবে। কারণ আইন মেনে কোন তদবির হয় না। গত সপ্তাহে তিনি তাঁর নিজ শহর কিশোরগঞ্জে গিয়েছিলেন। স্থানীয় উন্নয়নে তিনি ছোটখাটো প্রকল্পে জড়াননি, বড় প্রকল্পের মধ্যে তাঁর প্রয়াত পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, কয়েক কিমি. দীর্ঘ একটি নদ খনন, কিশোরগঞ্জকে তিলোত্তমা শহরে রুপান্তর করেছেন। ওই শহরের অলিগলিও সোডিয়াম আলোয় উদ্ভাসিত। কিন্তু তবু তিনি সেখানকার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর উপরের দিকের নেতা-কর্মী, যারা মূলত রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাঁদের অনেকেই তার ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। সৈয়দ আশরাফকে অপসারণের পরে কিশোরগঞ্জের সাধারণ মানুষ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নীরবতা পালন করেছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ বলেছেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের কি বলার আছে? অথচ স্থানীয় বিএনপি নেতারা সৎ মানুষের প্রস্থান হিসেবে আক্ষেপ করেছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিস্মিত যে, এত মন্ত্রণালয় থাকতে তার হাতে কোন মন্ত্রণালয়ের ভার দেওয়াই সম্ভব হলো না। মন্ত্রী হয়ে নির্লোভ থাকা, সাধারণ জীবনযাপন করা, বাড়িগাড়ি না করা, স্বজনপ্রীতি না করা, বিলাসী জীবনে অভ্যন্ত না হওয়ার পুরস্কার (!) জুটেছে তার। সৈয়দ আশরাফকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান, তারা প্রায় এক ঘণ্টা একান্তে কথাও বলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তার দাবি, এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রস্তাব তিনি মেনে নেন। তিনি দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকতে রাজি হন, এর কারণটা তিনি পরিষ্কার করেছেন। বলেছেন, শেখ হাসিনার প্রতি তিনি অনুগত। মুজিব পরিবারের প্রতি তিনি তার পিতার মতোই রক্ত ঋণে আবদ্ধ। দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও তিনি থাকবেন। আগামী ডিসেম্বরে ওই কাউন্সিল হওয়ার কথা। তবে তার পরেও তাঁকে এই পদে দেখা যাবে বলে অনেকেই মনে করেন না।
গত মঙ্গলবার একনেকের সভায় অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি নিতান্ত একটি উপলক্ষ মাত্র। দলের ভেতরের অনেক প্রভাবশালীরই অসুবিধা হচ্ছিল তাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে রাখা। শোনা যায়, পরিবারের কাউকে ওই মন্ত্রণালয়ে রাখাটা অপরিহার্য মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু এ ধরনের বিষয় মিডিয়ায় প্রচার পায়নি। বরং তাঁর অফিস কামাই বেশ প্রচার চালানো হচ্ছে যাতে তাকে অপসারণের সিদ্ধান্তটি অধিকতর রাজনৈতিক বৈধতা লাভ করে। বলা হচ্ছে, বেশ কিছুদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। মন্ত্রণালয়ে না যাওয়া, সরকার ও দলের অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে যোগ দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে সরকার ও দলের ভেতর সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। এ ছাড়া সরকার ও দলের নিচু থেকে উঁচু স্তরের নেতাদের অনেকেই তার সমালোচনা করতেন, এর প্রধান কারণ এই নয় যে তার কারণে দল দুর্বল হয়ে পড়ছিল। বরং তার উপস্থিতির কারণে অনেকের অনেক কিছু করার ব্যাপারে সমস্যা হচ্ছিল। এমনও নয় যে, তিনি বাধা দিতেন। কিন্তু পদে থাকার কারণে বিষয়টি তার জানা থাকত, এটাই ছিল তাদের অপছন্দের।
একনেক সভায় যে প্রকল্পটি পাসের সময় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন, সেই প্রকল্পটির আওতায় সংসদ সদস্যরা আশা করেছিলেন যে, তাদের প্রত্যেকের হাতে ২৫ কোটি টাকা নগদ তুলে দেয়া হবে। কিন্তু তিনি এমন ভূমিকা রেখেছিলেন যাতে এখন আর কেউ নগদ অর্থ পাবেন না।
একজন সংসদ সদস্য বললেন, তিনি এক মাসে ১৭ দিন অফিস কামাই করেছেন। তিনি মন্ত্রণালয়ে যান না। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ সময়মতো হয়নি কিংবা কাজে দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়েছে, এমন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে ছিল না। যদিও দল থেকে নেয়া তার একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক অনিয়ম-সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে বিশেষ করে বলা হয়েছে তার এপিএস এর একাত্তরের ভূমিকা ভাল ছিল না। কিন্তু এসব অভিযোগ কোনটিই নতুন নয়, তার মন্ত্রিত্বের মতোই পুরনো। তাহলে আকস্মিকভাবে তার উপরে এই বিপর্যয় নেমে এল কেন?
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সব অমলে অনিয়মর আখড়া হিসেবে পরিচিত। এটিসহ ঢাকা ওয়াসা এবং এরকম বহু আকর্ষণীয় সংস্থায় শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ ও বদলিতে তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কারণ তিনি জানতেন এর ময়লা তিনি চাইলেও ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না। তবে ওই সব পদে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। এর অনেকগুলোই হয়েছে তার অমতে।
বেগম খালেদা জিয়ার অবরোধের পরে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল একটি বিরাট রাজনৈতিক চাল। এখন শোনা যাচ্ছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে ওই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এবং তা পদ্ধতিগতভাবে সঠিক না হওয়ায় আগের প্রস্তাব ফেরত এনে নতুন করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়। জেলা পরিষদে সরকারের মনোনীত প্রশাসক দেয়ার বিপক্ষে ছিলেন তিনি। তার মত ছিল, জেলা পরিষদে নির্বাচন করা অথবা কিছুই না করা। এ ছাড়া গত আড়াই বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১৪ জন প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে তার মত নেয়া হয়নি। এ রকম আরও কিছু পদ্ধতিগত ও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এসবের কোনটিই তাই বলে আকস্মিক ছিল না।
‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ নিয়ে বেপরোয়া দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এর প্রকল্প পরিচালক প্রশান্ত কুমার কর্মকার তাকে বাইপাস করার নজির স্থাপন করেন। তিনি রুষ্ট হন। কষ্ট পান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি তিনি। কারণ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করেন তিনি। সমপ্রতি গণমাধ্যমে প্রশান্ত কুমারের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন বেরুনোর পর তিনি তদন্ত আশা করেছিলেন। কিন্তু তা না হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এই প্রকল্প বিষয়ক ফাইলে সই দেয়া বন্ধ করে দিলেও তিনি লক্ষ্য করেন সবই আগের মতো চলছে।
এর আগে নবম সংসদে প্রথম সংসদ সদস্যদের হাতে সরাসরি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে। দল চেয়েছিল এটা সরকারি দলই পাবে। তখন তিনি এর বিরোধিতা করেন। তার কারণেই নগদে বিলির বিধান লাটে ওঠে। একনেকের সভায় ৬ হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্প পাস হল, তাতে সরকারি দলের অনেকেই নাখোশ। কারণ কেউ নগদ টাকা পাবেন না, প্রকল্প পাস হলে যথানিয়মে টাকা যাবে।
অনেকের মতে, তাকে সরানোর প্রক্রিয়া অনেক পুরনো, শুধু সময়টাই এখন বেছে নেয়া হয়েছে। ভিন্ন দল থেকে একজনকে প্রতিমন্ত্রী করাটাও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারণ এর ফলে তাকে পাশ কাটানোর প্রবণতা বিরাট একটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আমলাতন্ত্র ছড়ি ঘোরাতে পেরেছে।
গত শনিবার রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে ঢাকাস্থ হোসেনপুর সমিতির ইফতার মাহফিলে সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘আমি লাভের জন্য রাজনীতি করি না। আমার পিতা সততার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। নেতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন। এটাই আমার রক্ত।’
এক এগারোতে কোণঠাসা থাকা অংশ যারা বিলম্বে হলেও ফিরে এসেছেন, তাদের কারো চক্ষুশূল ছিলেন তিনি। দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টির জন্য তাদের কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টায় ছিল। শুধু একটি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকার জন্য এত বড় ঘটনা ঘটেনি।
অপসারিত হওয়ার পরে সৈয়দ আশরাফ প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে নজির স্থাপন করেছেন। অভিমান লুকিয়ে তিনি হেসেছেন। তার হাসি মলিন হয়নি। তিনি কোন বিরূপ মনোভাবের পরিচয় দেননি। দপ্তরবিহীন হওয়ার দুই ঘণ্টা পর যুবলীগের এক অনুষ্ঠানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী ও আশরাফের সম্পর্ক অনেক গভীর ও বিশ্বস্ততার এটা কেউ অস্বীকার করছেন না। দলের নেত্রীর প্রতি তার আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন নেই। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন তেমনি তার লন্ডন প্রবাসী ছোট বোন শেখ রেহানা স্বাভাবিকভাবেই সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে ফোনে কথা বলা বজায় রাখছেন।
অন্য সবার চেয়ে আলাদা থেকে তিনি সততার সঙ্গে মন্ত্রিত্ব করে চলছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন এক আরেক ভুবন। হঠাৎ সেখানে বিরাট ছন্দপতন হলো। তিনি কাঁটাবিদ্ধ হলেন। একজন সৎ মানুষ সততা ধরে রাখতে গিয়ে আপাতত শরবিদ্ধ হলেন। আর যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বহু অভিযোগ তারা প্রত্যেকে বহাল তবিয়তে আছেন। সৈয়দ আশরাফকে দেখে সাধারণ মানুষ বলাবলি করছেন, সত্যি ভাল মানুষের ভাত নেই।
তার প্রস্তানকে কেবল আওয়ামী লীগের দিক থেকে দেখা হলেও এই ঘটনার আরও বড় তাৎপর্য রয়েছে। ২০১৯ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রস্তুতির সঙ্গেও এর কোন যোগসূত্র থাকতে পারে কিনা তা অনেকে খতিয়ে দেখছেন। আপাতত অনেকে তার কথিত নিষ্ক্রিয়তা, অফিস না করা এবং ক্ষমতাসীন দলের একটি প্রভাবশালী অংশের ঈর্ষা এবং তাদের তরফে কানভারি করার মতো বিষয় মিডিয়ায় বেশি আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষক এই পরিবর্তনকে এরকম কোন সাধারণ হিসেব নিকেষ থেকে দেখছেন না। অনেকের মতে বিরোধী দল ও মিডিয়া মোকাবিলায় এর প্রভাব পড়তে পারে। কারণ সৈয়দ আশরাফকে সরিয়ে সরকার প্রধানের একজন নিকটাত্মীয়কে আনা হয়েছে। আর ভবিষ্যতে বিরোধী দল মোকাবিলায় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অপেক্ষাকৃত একজন কট্টরপন্থিকে আনার সম্ভাবনা থাকবে।
সবচেয়ে বড় কথা, সৈয়দ অশরাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণকে উৎসাহিত করেননি। বরং এটাই জানা যায় যে, জাতিসংঘের দূত জর্জ ফারনান্দেজ তারানকোর সঙ্গে বৈঠককালে তিনি বিএনপির সঙ্গে চারটি বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। এক. বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তি, দুই. মামলা প্রত্যাহার, তিন. অফিস খুলে দেওয়া ও চার. সভা-সমাবেশের ওপর থেকে বাধানিষেধ প্রত্যাহার করা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধি দল বৈঠকে বসেছিল। আলোচনার শেষপর্যায়ে ওই চারটি বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়। দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর মতে, হঠাৎ মোবাইলে একটি কল আসে। আর তার পরই সমঝোতা প্রয়াস ভণ্ডুল হয়। তখন তাকে ম্লান হতে দেখা গিয়েছিল। তাকে বিব্রত মনে হয়েছিল। যদিও তিনি নিজে কখনও এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দেননি।
সৈয়দ আশরাফের একটি দীর্ঘ সময় কেটেছে বৃটেনে। সেখানকার লেবার দলীয় রাজনীতিতে বেশ ভালও অবস্থানে দীর্ঘকাল সক্রিয় থাকারও সুযোগ ঘটেছে। তিনি তার এলাকায় কম যেতেন, সচিবালয়ের তদবির থেকে নিজকে রক্ষা করতে সর্বদা সতর্ক থাকতেন। কারণ তিনি জানতেন তদবিরকারীদের শুনতে গেলেই তাকে অন্যায় পথে হাঁটতে হবে। কারণ আইন মেনে কোন তদবির হয় না। গত সপ্তাহে তিনি তাঁর নিজ শহর কিশোরগঞ্জে গিয়েছিলেন। স্থানীয় উন্নয়নে তিনি ছোটখাটো প্রকল্পে জড়াননি, বড় প্রকল্পের মধ্যে তাঁর প্রয়াত পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, কয়েক কিমি. দীর্ঘ একটি নদ খনন, কিশোরগঞ্জকে তিলোত্তমা শহরে রুপান্তর করেছেন। ওই শহরের অলিগলিও সোডিয়াম আলোয় উদ্ভাসিত। কিন্তু তবু তিনি সেখানকার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর উপরের দিকের নেতা-কর্মী, যারা মূলত রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাঁদের অনেকেই তার ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। সৈয়দ আশরাফকে অপসারণের পরে কিশোরগঞ্জের সাধারণ মানুষ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নীরবতা পালন করেছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ বলেছেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের কি বলার আছে? অথচ স্থানীয় বিএনপি নেতারা সৎ মানুষের প্রস্থান হিসেবে আক্ষেপ করেছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিস্মিত যে, এত মন্ত্রণালয় থাকতে তার হাতে কোন মন্ত্রণালয়ের ভার দেওয়াই সম্ভব হলো না। মন্ত্রী হয়ে নির্লোভ থাকা, সাধারণ জীবনযাপন করা, বাড়িগাড়ি না করা, স্বজনপ্রীতি না করা, বিলাসী জীবনে অভ্যন্ত না হওয়ার পুরস্কার (!) জুটেছে তার। সৈয়দ আশরাফকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান, তারা প্রায় এক ঘণ্টা একান্তে কথাও বলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তার দাবি, এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রস্তাব তিনি মেনে নেন। তিনি দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকতে রাজি হন, এর কারণটা তিনি পরিষ্কার করেছেন। বলেছেন, শেখ হাসিনার প্রতি তিনি অনুগত। মুজিব পরিবারের প্রতি তিনি তার পিতার মতোই রক্ত ঋণে আবদ্ধ। দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও তিনি থাকবেন। আগামী ডিসেম্বরে ওই কাউন্সিল হওয়ার কথা। তবে তার পরেও তাঁকে এই পদে দেখা যাবে বলে অনেকেই মনে করেন না।
গত মঙ্গলবার একনেকের সভায় অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি নিতান্ত একটি উপলক্ষ মাত্র। দলের ভেতরের অনেক প্রভাবশালীরই অসুবিধা হচ্ছিল তাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে রাখা। শোনা যায়, পরিবারের কাউকে ওই মন্ত্রণালয়ে রাখাটা অপরিহার্য মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু এ ধরনের বিষয় মিডিয়ায় প্রচার পায়নি। বরং তাঁর অফিস কামাই বেশ প্রচার চালানো হচ্ছে যাতে তাকে অপসারণের সিদ্ধান্তটি অধিকতর রাজনৈতিক বৈধতা লাভ করে। বলা হচ্ছে, বেশ কিছুদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। মন্ত্রণালয়ে না যাওয়া, সরকার ও দলের অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে যোগ দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে সরকার ও দলের ভেতর সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। এ ছাড়া সরকার ও দলের নিচু থেকে উঁচু স্তরের নেতাদের অনেকেই তার সমালোচনা করতেন, এর প্রধান কারণ এই নয় যে তার কারণে দল দুর্বল হয়ে পড়ছিল। বরং তার উপস্থিতির কারণে অনেকের অনেক কিছু করার ব্যাপারে সমস্যা হচ্ছিল। এমনও নয় যে, তিনি বাধা দিতেন। কিন্তু পদে থাকার কারণে বিষয়টি তার জানা থাকত, এটাই ছিল তাদের অপছন্দের।
একনেক সভায় যে প্রকল্পটি পাসের সময় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন, সেই প্রকল্পটির আওতায় সংসদ সদস্যরা আশা করেছিলেন যে, তাদের প্রত্যেকের হাতে ২৫ কোটি টাকা নগদ তুলে দেয়া হবে। কিন্তু তিনি এমন ভূমিকা রেখেছিলেন যাতে এখন আর কেউ নগদ অর্থ পাবেন না।
একজন সংসদ সদস্য বললেন, তিনি এক মাসে ১৭ দিন অফিস কামাই করেছেন। তিনি মন্ত্রণালয়ে যান না। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ সময়মতো হয়নি কিংবা কাজে দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়েছে, এমন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে ছিল না। যদিও দল থেকে নেয়া তার একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক অনিয়ম-সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে বিশেষ করে বলা হয়েছে তার এপিএস এর একাত্তরের ভূমিকা ভাল ছিল না। কিন্তু এসব অভিযোগ কোনটিই নতুন নয়, তার মন্ত্রিত্বের মতোই পুরনো। তাহলে আকস্মিকভাবে তার উপরে এই বিপর্যয় নেমে এল কেন?
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সব অমলে অনিয়মর আখড়া হিসেবে পরিচিত। এটিসহ ঢাকা ওয়াসা এবং এরকম বহু আকর্ষণীয় সংস্থায় শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ ও বদলিতে তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কারণ তিনি জানতেন এর ময়লা তিনি চাইলেও ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না। তবে ওই সব পদে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। এর অনেকগুলোই হয়েছে তার অমতে।
বেগম খালেদা জিয়ার অবরোধের পরে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল একটি বিরাট রাজনৈতিক চাল। এখন শোনা যাচ্ছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে ওই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এবং তা পদ্ধতিগতভাবে সঠিক না হওয়ায় আগের প্রস্তাব ফেরত এনে নতুন করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়। জেলা পরিষদে সরকারের মনোনীত প্রশাসক দেয়ার বিপক্ষে ছিলেন তিনি। তার মত ছিল, জেলা পরিষদে নির্বাচন করা অথবা কিছুই না করা। এ ছাড়া গত আড়াই বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১৪ জন প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে তার মত নেয়া হয়নি। এ রকম আরও কিছু পদ্ধতিগত ও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এসবের কোনটিই তাই বলে আকস্মিক ছিল না।
‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ নিয়ে বেপরোয়া দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এর প্রকল্প পরিচালক প্রশান্ত কুমার কর্মকার তাকে বাইপাস করার নজির স্থাপন করেন। তিনি রুষ্ট হন। কষ্ট পান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি তিনি। কারণ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করেন তিনি। সমপ্রতি গণমাধ্যমে প্রশান্ত কুমারের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন বেরুনোর পর তিনি তদন্ত আশা করেছিলেন। কিন্তু তা না হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এই প্রকল্প বিষয়ক ফাইলে সই দেয়া বন্ধ করে দিলেও তিনি লক্ষ্য করেন সবই আগের মতো চলছে।
এর আগে নবম সংসদে প্রথম সংসদ সদস্যদের হাতে সরাসরি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে। দল চেয়েছিল এটা সরকারি দলই পাবে। তখন তিনি এর বিরোধিতা করেন। তার কারণেই নগদে বিলির বিধান লাটে ওঠে। একনেকের সভায় ৬ হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্প পাস হল, তাতে সরকারি দলের অনেকেই নাখোশ। কারণ কেউ নগদ টাকা পাবেন না, প্রকল্প পাস হলে যথানিয়মে টাকা যাবে।
অনেকের মতে, তাকে সরানোর প্রক্রিয়া অনেক পুরনো, শুধু সময়টাই এখন বেছে নেয়া হয়েছে। ভিন্ন দল থেকে একজনকে প্রতিমন্ত্রী করাটাও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারণ এর ফলে তাকে পাশ কাটানোর প্রবণতা বিরাট একটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আমলাতন্ত্র ছড়ি ঘোরাতে পেরেছে।
গত শনিবার রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে ঢাকাস্থ হোসেনপুর সমিতির ইফতার মাহফিলে সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘আমি লাভের জন্য রাজনীতি করি না। আমার পিতা সততার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। নেতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন। এটাই আমার রক্ত।’
এক এগারোতে কোণঠাসা থাকা অংশ যারা বিলম্বে হলেও ফিরে এসেছেন, তাদের কারো চক্ষুশূল ছিলেন তিনি। দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টির জন্য তাদের কেউ কেউ দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টায় ছিল। শুধু একটি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকার জন্য এত বড় ঘটনা ঘটেনি।
অপসারিত হওয়ার পরে সৈয়দ আশরাফ প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে নজির স্থাপন করেছেন। অভিমান লুকিয়ে তিনি হেসেছেন। তার হাসি মলিন হয়নি। তিনি কোন বিরূপ মনোভাবের পরিচয় দেননি। দপ্তরবিহীন হওয়ার দুই ঘণ্টা পর যুবলীগের এক অনুষ্ঠানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী ও আশরাফের সম্পর্ক অনেক গভীর ও বিশ্বস্ততার এটা কেউ অস্বীকার করছেন না। দলের নেত্রীর প্রতি তার আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন নেই। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন তেমনি তার লন্ডন প্রবাসী ছোট বোন শেখ রেহানা স্বাভাবিকভাবেই সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে ফোনে কথা বলা বজায় রাখছেন।
অন্য সবার চেয়ে আলাদা থেকে তিনি সততার সঙ্গে মন্ত্রিত্ব করে চলছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন এক আরেক ভুবন। হঠাৎ সেখানে বিরাট ছন্দপতন হলো। তিনি কাঁটাবিদ্ধ হলেন। একজন সৎ মানুষ সততা ধরে রাখতে গিয়ে আপাতত শরবিদ্ধ হলেন। আর যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বহু অভিযোগ তারা প্রত্যেকে বহাল তবিয়তে আছেন। সৈয়দ আশরাফকে দেখে সাধারণ মানুষ বলাবলি করছেন, সত্যি ভাল মানুষের ভাত নেই।
No comments