নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-চারুকলার শোভাযাত্রা, সুইডিশের কফিন মিছিল by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
তিন দিন ধরে অন্য রকম এক আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছিলেন চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান। স্থান মাহাত্ম্যে এমনিতেই চমৎকার এক পরিবেশ, তার ওপর শিল্পীরা তাঁদের সৃজনশীলতা দিয়ে, মনের রঙে যেন রাঙিয়ে তুলেছিলেন মঞ্চ ও উৎসব প্রাঙ্গণ।
দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে এসেছিলেন প্রাক্তন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, শিল্পী-শিল্পানুরাগীসহ অনেকেই। মুর্তজা বশীর, সবিহ উল আলম, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, মনসুর উল করিমের মতো বরেণ্য শিল্পীরা যেমন এসেছেন, তেমনি এসেছেন তাঁদের এককালের ছাত্রছাত্রীরা, যাঁরা নিজেরাও আজ খ্যাতিমান। সুদূর আমেরিকা, স্পেন থেকেও এসেছেন কেউ কেউ। এদিকে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট থেকেও প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে এসেছিলেন অনেকে। গানে-গল্পে-আড্ডায় মুখর হয়ে উঠেছিল উৎসব। তার চেয়েও বড় কথা, পুরোনো বন্ধু ও সতীর্থদের কাছে পেয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন সবাই। আনন্দ বেদনার কত স্মৃতি! তবে এ বেলায় ‘স্মৃতি সতত সুখের।’ আনন্দ-শোভাযাত্রাটি ছিল সত্যিকার দর্শনীয়। বর্ণময় এ শোভাযাত্রা বয়স ভুলে নেচে-গেয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন অংশগ্রহণকারী নতুন ও পুরোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ ও চারুকলা কলেজ একীভূত হয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। ফলে নতুন আদলে পুরোনো সতীর্থ-স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আয়োজনটি সব অর্থেই লাভ করেছে ভিন্নমাত্রা।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা দরকার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ ও চারুকলা কলেজের একীভূত হওয়াটি খুব সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। দুটি প্রতিষ্ঠানকে এক করে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এ দাবির সঙ্গে ভিন্নমতও পোষণ করেছেন অনেকে। দুই পক্ষের যুক্তি, পাল্টা যুক্তির পথ ধরে জল ঘোলা হয়েছে অনেক। আইন-আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বিষয়টি। শিল্পীরা যখন তুলি ফেলে, ভাস্কর যখন তাঁর ছেনি ফেলে, শিক্ষক যখন শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার্থীদের পাঠ দেওয়ার বদলে আদালতের দ্বারস্থ হন, তখন প্রতিষ্ঠানের পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এভাবেই দীর্ঘকাল শিল্পের চর্চা হয়েছে ব্যাহত, শিক্ষার্থীরা হয়েছেন বঞ্চিত।
যা-ই হোক, আদালতের রায়ের কারণেই হোক বা বিবদমান ব্যক্তিদের শুভবুদ্ধির কারণেই হোক, চারুকলা ইনস্টিটিউট শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হলো। এতে বিভক্তি এড়িয়ে নতুন চলার পথ তৈরির একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বটে, কিন্তু সব প্রশ্ন এখানেই থেমে গেছে, এটা ভাবার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়নি। কেননা, এখনো অনেকেই বলছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাসটি ছেড়ে আসার ফলে ছাত্র-শিক্ষকেরা বঞ্চিত হয়েছেন একটি বড় বৈচিত্র্যপূর্ণ অ্যাকাডেমিক পরিবেশে বিচরণের সুযোগ থেকে, হারিয়েছেন নানা বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের সংস্পর্শে থেকে নিজের মন ও মননকে প্রসারিত করার ক্ষেত্র। এ কথাগুলো একেবারেই ছুড়ে ফেলার মতো নয়। তবে আমাদের ধারণা, এ বঞ্চনার বোধ থেকে মুক্তির পথও আছে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের হাতেই।
চারুকলা ইনস্টিটিউট ঘিরে যদি গড়ে ওঠে শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার একটি অবারিত ক্ষেত্র, যদি ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের মতো নানা ধরনের সাংস্কৃতিক তৎপরতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে এটি, সর্বোপরি যদি সৃজনশীলতার ক্ষেত্র হিসেবে এটি নগরের সব মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে, তবেই এ ইনস্টিটিউট একটি সফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকাই তুলনামূলকভাবে বেশি। নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করাটি তাঁদের প্রাথমিক দায়িত্ব। কেননা, এটি সাধারণ ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই অর্থে ব্যতিক্রমী যে এখানে নিরস পাঠদানের চেয়ে সৃজনশীলতার দিক উন্মোচন করার কাজটিই প্রধান। ছাত্র-শিক্ষকের বহুমাত্রিক সম্পর্কই এখানে ভবিষ্যতের স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলতে পারে। উৎসবের উদ্বোধন করতে এসে শিল্পী মুর্তজা বশীর যেমনটা বলেছিলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখি, চট্টগ্রামই একদিন বাংলাদেশকে শিল্প-আন্দোলনের পথ দেখাবে।’
আমাদের আশা, যে শোভাযাত্রাটি পথ পরিক্রমা করেছিল উদ্বোধনী দিনে, সে রকম একটি বর্ণময় যাত্রায় শরিক হয়ে এ ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা খুঁজে নেবে উজ্জ্বল গন্তব্য।
২.
কাপ্তাইয়ের রাস্তায় বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল এক তরুণ। বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের (সাধারণ মানুষের কাছে সুইডিশ হিসেবে পরিচিত) ছাত্র এ তরুণটি। এভাবে মোটরসাইকেল চালানো নিশ্চয়ই বেআইনি ও বিপজ্জনক। এই তরুণকে তাই নতুন বাজারের কাছে আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। ফলে আশা করা সংগত, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যাপারটির সুরাহা করবেন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটি তিনি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেন এবং এর পরিণতিতে যে পরিস্থিতিতে পৌঁছাল, ঘটনাটি তা সত্যি দুঃখজনক। ইউএনও কিছুতেই এর দায় এড়াতে পারেন না।
মোটর আরোহীকে ‘বেয়াদবির’ জন্য কান ধরতে বলা হয়েছিল। একজন শিক্ষিত তরুণের পক্ষে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে কান ধরা কী রকম গ্লানিকর হতে পারে, তা পুলিশ সদস্যদের কথা বাদ দিলাম, ইউএনওর অন্তত বোঝা উচিত ছিল। তাঁর আচরণ হতে পারত অভিভাবকসুলভ। ছাত্রটির মোটরসাইকেল বাজেয়াপ্ত করে ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ বা শিক্ষকদের মাধ্যমে যথাযথ শাস্তি দিয়ে সমঝোতা করাও সম্ভব ছিল। কিন্তু সে পথে না গিয়ে ক্ষমতার দম্ভ দেখালেন তিনি। পুলিশ বাহিনী পেটাল, দুর্ব্যবহার করল ছাত্রটির সঙ্গে। খবর পেয়ে তার ক্ষুব্ধ সহপাঠীরা ছুটে এল ঘটনাস্থলে। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ল, আর পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাল বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেধাবী ছাত্র রায়হান।
পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ছাত্ররা ছিল মারমুখী ও সহিংস। এ দাবির সত্যতা থাকতে পারে। কিন্তু যে ঘটনাটি তিল থেকে তাল হলো, তার জন্য বয়সের ধর্মে অপরিণামদর্শী তরুণদের যতটা দোষ দেওয়া যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী মনে হয় সরকারি কর্মকর্তাকে।
যে মায়ের বুক খালি হলো, ধূলিসাৎ হলো যে পিতার ভবিষ্যতের স্বপ্ন—একজন দক্ষ কর্মকর্তার প্রকৃত বিবেচনা ও পরিমিত বোধই হয়তো রোধ করতে পারত এত বড় ক্ষতি।
১৪৪ ধারা জারি করে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট বন্ধ করে দিয়ে আপাতত ঘটনা সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এর প্রতিবাদ জানিয়ে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে চট্টগ্রাম শহরে সংবাদ সম্মেলন করেছে ছাত্ররা। প্রতীকী কফিন নিয়ে মিছিল করে শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আমরা চাই, এই শোকার্ত তরুণদের দাবিগুলো আমলে নিক প্রশাসন। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হোক, যাতে এর পুনরাবৃত্তি আর না হয় কোনো দিন। যেসব অভিভাবক দূর-দূরান্ত থেকে পাহাড়-অরণ্য-হ্রদঘেরা একটি অঞ্চলে নিজের সন্তানটিকে পাঠিয়েছেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায়, তাঁদের যেন আর কোনো দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হতে না হয়।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ ও চারুকলা কলেজ একীভূত হয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। ফলে নতুন আদলে পুরোনো সতীর্থ-স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আয়োজনটি সব অর্থেই লাভ করেছে ভিন্নমাত্রা।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা দরকার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ ও চারুকলা কলেজের একীভূত হওয়াটি খুব সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। দুটি প্রতিষ্ঠানকে এক করে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এ দাবির সঙ্গে ভিন্নমতও পোষণ করেছেন অনেকে। দুই পক্ষের যুক্তি, পাল্টা যুক্তির পথ ধরে জল ঘোলা হয়েছে অনেক। আইন-আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বিষয়টি। শিল্পীরা যখন তুলি ফেলে, ভাস্কর যখন তাঁর ছেনি ফেলে, শিক্ষক যখন শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার্থীদের পাঠ দেওয়ার বদলে আদালতের দ্বারস্থ হন, তখন প্রতিষ্ঠানের পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এভাবেই দীর্ঘকাল শিল্পের চর্চা হয়েছে ব্যাহত, শিক্ষার্থীরা হয়েছেন বঞ্চিত।
যা-ই হোক, আদালতের রায়ের কারণেই হোক বা বিবদমান ব্যক্তিদের শুভবুদ্ধির কারণেই হোক, চারুকলা ইনস্টিটিউট শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হলো। এতে বিভক্তি এড়িয়ে নতুন চলার পথ তৈরির একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বটে, কিন্তু সব প্রশ্ন এখানেই থেমে গেছে, এটা ভাবার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়নি। কেননা, এখনো অনেকেই বলছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাসটি ছেড়ে আসার ফলে ছাত্র-শিক্ষকেরা বঞ্চিত হয়েছেন একটি বড় বৈচিত্র্যপূর্ণ অ্যাকাডেমিক পরিবেশে বিচরণের সুযোগ থেকে, হারিয়েছেন নানা বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের সংস্পর্শে থেকে নিজের মন ও মননকে প্রসারিত করার ক্ষেত্র। এ কথাগুলো একেবারেই ছুড়ে ফেলার মতো নয়। তবে আমাদের ধারণা, এ বঞ্চনার বোধ থেকে মুক্তির পথও আছে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের হাতেই।
চারুকলা ইনস্টিটিউট ঘিরে যদি গড়ে ওঠে শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার একটি অবারিত ক্ষেত্র, যদি ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের মতো নানা ধরনের সাংস্কৃতিক তৎপরতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে এটি, সর্বোপরি যদি সৃজনশীলতার ক্ষেত্র হিসেবে এটি নগরের সব মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে, তবেই এ ইনস্টিটিউট একটি সফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকাই তুলনামূলকভাবে বেশি। নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করাটি তাঁদের প্রাথমিক দায়িত্ব। কেননা, এটি সাধারণ ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই অর্থে ব্যতিক্রমী যে এখানে নিরস পাঠদানের চেয়ে সৃজনশীলতার দিক উন্মোচন করার কাজটিই প্রধান। ছাত্র-শিক্ষকের বহুমাত্রিক সম্পর্কই এখানে ভবিষ্যতের স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলতে পারে। উৎসবের উদ্বোধন করতে এসে শিল্পী মুর্তজা বশীর যেমনটা বলেছিলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখি, চট্টগ্রামই একদিন বাংলাদেশকে শিল্প-আন্দোলনের পথ দেখাবে।’
আমাদের আশা, যে শোভাযাত্রাটি পথ পরিক্রমা করেছিল উদ্বোধনী দিনে, সে রকম একটি বর্ণময় যাত্রায় শরিক হয়ে এ ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা খুঁজে নেবে উজ্জ্বল গন্তব্য।
২.
কাপ্তাইয়ের রাস্তায় বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল এক তরুণ। বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের (সাধারণ মানুষের কাছে সুইডিশ হিসেবে পরিচিত) ছাত্র এ তরুণটি। এভাবে মোটরসাইকেল চালানো নিশ্চয়ই বেআইনি ও বিপজ্জনক। এই তরুণকে তাই নতুন বাজারের কাছে আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। ফলে আশা করা সংগত, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যাপারটির সুরাহা করবেন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটি তিনি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেন এবং এর পরিণতিতে যে পরিস্থিতিতে পৌঁছাল, ঘটনাটি তা সত্যি দুঃখজনক। ইউএনও কিছুতেই এর দায় এড়াতে পারেন না।
মোটর আরোহীকে ‘বেয়াদবির’ জন্য কান ধরতে বলা হয়েছিল। একজন শিক্ষিত তরুণের পক্ষে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে কান ধরা কী রকম গ্লানিকর হতে পারে, তা পুলিশ সদস্যদের কথা বাদ দিলাম, ইউএনওর অন্তত বোঝা উচিত ছিল। তাঁর আচরণ হতে পারত অভিভাবকসুলভ। ছাত্রটির মোটরসাইকেল বাজেয়াপ্ত করে ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ বা শিক্ষকদের মাধ্যমে যথাযথ শাস্তি দিয়ে সমঝোতা করাও সম্ভব ছিল। কিন্তু সে পথে না গিয়ে ক্ষমতার দম্ভ দেখালেন তিনি। পুলিশ বাহিনী পেটাল, দুর্ব্যবহার করল ছাত্রটির সঙ্গে। খবর পেয়ে তার ক্ষুব্ধ সহপাঠীরা ছুটে এল ঘটনাস্থলে। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ল, আর পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাল বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেধাবী ছাত্র রায়হান।
পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ছাত্ররা ছিল মারমুখী ও সহিংস। এ দাবির সত্যতা থাকতে পারে। কিন্তু যে ঘটনাটি তিল থেকে তাল হলো, তার জন্য বয়সের ধর্মে অপরিণামদর্শী তরুণদের যতটা দোষ দেওয়া যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী মনে হয় সরকারি কর্মকর্তাকে।
যে মায়ের বুক খালি হলো, ধূলিসাৎ হলো যে পিতার ভবিষ্যতের স্বপ্ন—একজন দক্ষ কর্মকর্তার প্রকৃত বিবেচনা ও পরিমিত বোধই হয়তো রোধ করতে পারত এত বড় ক্ষতি।
১৪৪ ধারা জারি করে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট বন্ধ করে দিয়ে আপাতত ঘটনা সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এর প্রতিবাদ জানিয়ে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে চট্টগ্রাম শহরে সংবাদ সম্মেলন করেছে ছাত্ররা। প্রতীকী কফিন নিয়ে মিছিল করে শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আমরা চাই, এই শোকার্ত তরুণদের দাবিগুলো আমলে নিক প্রশাসন। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হোক, যাতে এর পুনরাবৃত্তি আর না হয় কোনো দিন। যেসব অভিভাবক দূর-দূরান্ত থেকে পাহাড়-অরণ্য-হ্রদঘেরা একটি অঞ্চলে নিজের সন্তানটিকে পাঠিয়েছেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায়, তাঁদের যেন আর কোনো দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হতে না হয়।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments