বহে কাল নিরবধি-দেশ শাসনে নৈতিক কর্তৃত্বই মুখ্য by এম আবদুল হাফিজ
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে সুশীল সমাজের বিকাশ ঘটেনি বা ঘটে থাকলেও তা দুর্বল, সেখানে দেশ শাসনের প্রধান চালিকাশক্তিই হলো রাষ্ট্র প্রদত্ত ক্ষমতা। বিভিন্ন শাসনযন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগই সেখানে প্রকারান্তরে রাষ্ট্র পরিচালনা বা দেশ শাসন।
যেখানেই নিষ্ঠা ও সততার এই ক্ষমতার প্রয়োগ হয়েছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নেতৃত্বের মেধা ও দূরদর্শিতা, সেখানে আর যা-ই হোক, শাসনের সংকট ঘটেনি। আমাদের দেশে কিন্তু নেতৃত্বে রাজনৈতিক সততা ও নৈতিকতার অভাবে এই বিশ্বজনীন ব্যবস্থাটি সফল হতে পারেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, এদের নেতারা একরকম ধরেই নিয়েছেন যে তাঁদের হাতের মুঠোয় স্থূল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাই জনগণকে বাধ্য করবে সরকারি ফরমানের বশ্যতা স্বীকার করতে। এমন ধারণা হয়তো কিছুদিন কার্যকর হয়, কিন্তু অচিরেই জনমনে নানা প্রশ্ন জাগে, যদি সরকারের ভাবমূর্তি কলুষমুক্ত না হয়। তখন তারা আর নীরবে একটি অসৎ সরকারের কর্তৃত্ব মেনে নিতে চায় না। মেনে নিতে চায় না আইন প্রয়োগের দুমুখো নীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের আচরণে ভণ্ডামি, ন্যায়নীতি বিধানে সরকারের ব্যর্থতা অথবা জনগণের দুর্দশা নিরসনে সরকারের অক্ষমতা। অনিবার্যভাবে তখন জনমনে নেমে আসে সরকারের ক্ষমতায় না হোক, আন্তরিকতায় অবিশ্বাস।
ফলে আজ আমরা সমাজের সর্বত্র দেখি সরকারের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য এবং আইনকে অমান্য করার প্রবণতা। একসময় হয়তো জনগণের ক্ষোভ অন্তরে অসন্তুষ্টি পুষে রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। এখন আমাদের চারদিকেই লক্ষ করা যাবে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আরো দেখা যাবে কর্তৃত্ব ও আইন অমান্যের প্রকাশ্য উপসর্গ। যেমন_সরকারি পদক্ষেপের অপেক্ষা না করে জনতা অহরহ নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে আইন অথবা সন্দেহভাজন অপরাধীর জন্য করছে আইনবহির্ভূত বিচারব্যবস্থা বা সরকারি আদেশ-নির্দেশের ঢালাও উপেক্ষা। অবশ্য এতে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়, সাধারণ মানুষও তাতে কম উদ্বিগ্ন নয়। তবে এও বলা যাবে না যে সরকার এতে নিরুদ্বেগ।
সব সরকারই নৈরাজ্যের বিস্তার রোধ করতে চেয়েছে এবং সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপও নিয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো আমাদের সবারই পরিচিত। কালক্ষেপণ না করে প্রতিটি সরকারই আইন প্রযোগকারী সংস্থাগুলোকে আরো জোরদার করেছে। অপরাধ দমনের নিমিত্তে উদ্ভাবিত নতুন নতুন কৌশলকে রপ্ত করেছে আমাদের ওই সব সংস্থা। নতুন নতুন অস্ত্র সরঞ্জাম দিয়ে সেগুলো সজ্জিত করেছে। আমাদের পুলিশ বাহিনীকে দিয়েছে রায়ট মোকাবিলার অত্যাধুনিক সরঞ্জাম (Equipment) এবং গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডগ স্কোয়াড। তৈরি হয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। শুধু তা-ই নয়, বিশেষ ধরনের অপরাধীর জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে বিশেষ বিশেষ আইন। উপরন্তু জনগণকে আইনানুগ করতে আমাদের নেতারা মাঠে-ময়দানে অনেক নীতিবাক্য উচ্চারণ এবং আইনশৃঙ্খলার মহিমাকীর্তন করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের উপদেশ গ্রহণ করার লোক মিলেছে কালেভদ্রে। সাধারণ মানুষ নেতাদের কথায় না হয়েছে আকৃষ্ট, না আশ্বস্ত।
ইতিমধ্যে দেশে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন তো দূরের কথা, কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করার প্রবণতা আরো তীব্র এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়েছে আরো প্রকট রূপ। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও জনগণও কিন্তু খুব একটা সুখকর অবস্থায় নেই। কেননা দুটি তিক্ত পথের একটি তো তাদের বেছে নিতে হবে। যদি তারা সরকারের আদেশ-নির্দেশ নির্বিবাদে মেনে নেয়, তাহলে তাদের তো কিছুটা বিবেক-যন্ত্রণার সঙ্গেই তা মানতে হবে। কেননা তারা জানে যে সরকারের নেতৃস্থানীয়রা ওই সব আদেশ-নির্দেশের থোড়াই তোয়াক্কা করেন। আর যদি সরকারি হুকুম প্রতিরোধ করা হয়, তাও তো ঝুঁকিপূর্ণ।
আসলে আদেশ মানার স্পৃহা একটি স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। যিনি আদেশ দেন তাঁর আচরণ থেকেই আসা দরকার আদেশ মানার প্রেরণা। আজকাল শাসকদের কাছ থেকে সে প্রেরণা পাওয়া তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এদের বেশির ভাগই ভণ্ড। শাসকের অবস্থান যদি নৈতিকতার ভিতে সুদৃঢ় করা না হয়, তাহলে তার আদেশ-নির্দেশ শোনায় ফাঁপা।
আমাদের আজকের শাসনের (Governance) যে সমস্যা, তার মূলেই রয়েছে একটি নৈতিক কর্তৃত্বের অনুপস্থিতি। আমি ওই কর্তৃত্বের কথা বলছি, যা দিয়ে বাংলাদেশের স্থপতি ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে তুলনাহীন ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় কোনো কর্তৃত্ব ব্যতিরেকেই তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত যেকোনো বাণী অলঙ্ঘনীয় আদেশে পরিণত হয়েছিল। কেননা তিনি নৈতিকতার উচ্চভূমি (Moral high ground) থেকে কথা বলেছিলেন। এটি ছিল নৈতিক কর্তৃত্বের অনুপম দৃষ্টান্ত। তবে বঙ্গবন্ধুর ইন্দ্রজালও নিঃশেষিত হয়েছিল, যখন তাঁর নৈতিক কর্তৃত্বে ধস নেমেছিল। যদিও তখন তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে। ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজির আছে।
শুধু ব্যক্তিজীবনে নয়, দেশ শাসনেও নৈতিক অবক্ষয়ের এমন একটি সময় সমাগত, যখন ভদ্রলোকরাও আইন অগ্রাহ্য করেন, ট্যাক্স দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁদের বক্তব্য : কী লাভ? ট্যাক্সের টাকা তো অসৎ নেতারাই আত্মসাৎ করবেন অথবা মন্ত্রী-আমলাদের সরকারি সফরের নামে বিদেশে প্রমোদ-ভ্রমণে বিনষ্ট হবে। তাই ট্যাক্স পরিশোধ না করে তাঁরা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার ফাঁকফোকর খুঁজতে থাকে। শিক্ষিত সজ্জনরাও আজকাল অপরাধীকে পুলিশের হাত তুলে দিতে চান না, যখন তাঁরা নিশ্চিত যে পুলিশ ঘুষের বিনিময়ে অপরাধীকে ছেড়ে দেবে এবং ওই অপরাধী দ্বিগুণ আক্রোশে তাণ্ডবে লিপ্ত হবে। তার চেয়ে কি এই ভালো নয় যে উত্তম-মধ্যম যা দেওয়ার প্রয়োজন তার বিধান তারা নিজেরাই করে। তাই এখন দেখা যায়, যত্রতত্র জনতার আদালত, ত্রস্ত বিচার ব্যবস্থা। এও একধরনের নৈরাজ্য।
ব্যাংকঋণ পরিশোধ করার উৎসাহ প্রায় কোনো ঋণগ্রহীতারই নেই; কেননা তারা দেখছে যে রাঘব বোয়ালরা কিভাবে তাদের 'কানেকশনের' বদৌলতে অনায়াসে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। তাই পরিশোধের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অনেকের লক্ষ্য কী করে ঋণ শোধ না করে পারা যায়। অনেকের মনেই আজ প্রশ্ন, সৎ থাকা বা থাকার প্রচেষ্টার মধ্যে আদৌ কি কোনো কৃতিত্ব আছে? ওই তো অমুক এবং তমুক তার কুকীর্তির ফিরিস্তিসহ দিব্যি আছে! দুর্র্নীতি, সন্ত্রাস বা রাহাজানির কারণে কেউ তাদের সমাজচ্যুত করেনি। বরং সরকারি প্রটোকল অনুযায়ী তাঁদের অনেকেই 'গণ্যমান্য' ব্যক্তি। সরকার তার কার্যকলাপে নৈতিকতার যে মান প্রতিষ্ঠা করেছে, আশ্চর্য নয় যে দেশ ও জনগণও সেই মানের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
নৈতিক কর্তৃত্বের অবক্ষয় শুরু হয় যখনই কোনো সরকার বা জাতীয় নেতৃত্ব আইনের শাসন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। একটি বিশদ আইনের কাঠামো আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে পেয়েছি। আমাদের জনপ্রতিনিধিরাও প্রচুর আইন প্রণয়ন করেছেন। শোনা যায়, আমাদের দেশ নাকি আইনের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কিন্তু আইনের প্রয়োগ এখানে কদাচিৎ হয়। আরো কম হয় পক্ষপাতহীন ন্যায়নীতির সঙ্গে এর প্রয়োগ। দেখা যায় যে সরকারের উঁচু মহলের লোকরা সর্বপ্রথম আইন ভাঙেন_তা কোনো পরিত্যক্ত বাড়ি দখলেই হোক বা পছন্দের ব্যক্তিকে কোনো পদমর্যাদা দেওয়ায়ই হোক। অতঃপর প্রশাসনের যেকোনো ধাপে অনুরূপ আইনভঙ্গের পুনরাবৃত্তি হলে সরকারের উচ্চাসনে আসীন ব্যক্তিদের তা রোধ করার সৎসাহস থাকে না। এমনি করে শুরু হয় আপসের পালা এবং চক্রাকারে আইনভঙ্গের প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
আইন উপেক্ষা করে কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী একবার কোনো ফায়দা নিলে ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে অনুরূপ ফায়দা হাসিলের সুযোগ দিতেই হবে। পুলিশকে যদি কোনো নেতা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, তাহলে কোন মুখে ওই পুলিশকে বিরত করবেন তাঁর কার্যসিদ্ধি থেকে। তাই দেখা যায়, যে যতই আস্ফালন করুক, নীতিবিবর্জিত নেতারা আসলেই কাপুরুষ। তাঁদের নৈতিক সাহস নেই, কর্তৃত্বও নেই। আইনের প্রতি যে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা তাঁরা পোষণ করেন, তা যদি জনগণকেও সংক্রমিত করে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?
আমাদের দেশে কাউকে রাজনৈতিক ফায়দা পেঁৗছাতে বা স্বজনপ্রীতি করতে সরকারি নেতারা প্রায়ই আইনের ব্যতিক্রম বা পরিবর্তন করে থাকেন। এ জন্য তাঁদের এমন সব পদক্ষেপ নিতে হয়, যা শুধু ভয়াবহই নয়, ন্যক্কারজনকও। বাংলাদেশের সব সরকারই আবাসিক প্লট বণ্টন, পারমিট প্রদান এবং কোটা (Qouta) নির্ধারণের ব্যাপারে এমন সব পদক্ষেপ নিয়ে গোটা প্রশাসনকে কলঙ্কিত করেছে। এতে আইনের প্রক্রিয়াই শুধু প্রত্যাখ্যাত হয়নি, অনুগত (Conformist) আমলার সন্ধানে প্রশাসনযন্ত্রে একাধিক বিচ্যুতি ঘটাতে হয়েছে। এহেন কেলেঙ্কারিতে লিপ্ত নেতৃত্ব তার নৈতিক কর্তৃত্ব হারাতে বাধ্য। এই কর্তৃত্ব নেই বলেই জনগণ তো দূরের কথা, দুষ্কার্যের দোসর আমলারাও নেতাদের মানেন না। একমাত্র স্বার্থান্বেষী চাটুকার ছাড়া জনগণের মধ্যেও এদের ঠাঁই নেই।
আইনের শাসন প্রবর্তনে ব্যর্থ হয়েও যে সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করে এবং তার মধ্যে শক্তির সন্ধান করে_বুঝতে হবে সে সরকার অন্তঃসারশূন্য এবং তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতেই এমন আচরণ করছে। ইতিহাস সাক্ষী যে আইন প্রণয়ন করে সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে_শুধু তারই জোরে কোনো সরকার টেকেনি। অনেক ক্ষেত্রে নিজের প্রণীত আইনেই তারা পর্যুদস্ত হয়েছে। বেশি বেশি করে শক্তি সঞ্চয়ের স্বপ্নে অন্ধ রাজনৈতিক দল বিধিবহির্ভূতভাবে নিজেদের সশস্ত্র ক্যাডার প্রতিপালন করে। ফলে দেশে একাধিক শক্তির কেন্দ্র সৃষ্টি হয় এবং তাদের ভেতরকার ত্রূদ্ধর অন্তর্দ্বন্দ্বে দল কি আদৌ লাভবান হয়? দেশে বিরাজমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখে মনে হবে, দেশে কোনো সরকার নেই। এ অবস্থায় সরকারকে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের স্বার্থে এবং নিজেদের নৈতিক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার খাতিরে তার গৃহীত অনৈতিক ভূমিকার দায়দায়িত্ব স্বীকার করতে হবে, যদিও সেই অনৈতিক ভূমিকা দেশ শাসনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে থাকে, এখন একমাত্র স্বচ্ছতাই সরকারের জন্য বহন করবে পুনরুজ্জীবনের অঙ্গীকার।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক,
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
ফলে আজ আমরা সমাজের সর্বত্র দেখি সরকারের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য এবং আইনকে অমান্য করার প্রবণতা। একসময় হয়তো জনগণের ক্ষোভ অন্তরে অসন্তুষ্টি পুষে রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। এখন আমাদের চারদিকেই লক্ষ করা যাবে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আরো দেখা যাবে কর্তৃত্ব ও আইন অমান্যের প্রকাশ্য উপসর্গ। যেমন_সরকারি পদক্ষেপের অপেক্ষা না করে জনতা অহরহ নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে আইন অথবা সন্দেহভাজন অপরাধীর জন্য করছে আইনবহির্ভূত বিচারব্যবস্থা বা সরকারি আদেশ-নির্দেশের ঢালাও উপেক্ষা। অবশ্য এতে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়, সাধারণ মানুষও তাতে কম উদ্বিগ্ন নয়। তবে এও বলা যাবে না যে সরকার এতে নিরুদ্বেগ।
সব সরকারই নৈরাজ্যের বিস্তার রোধ করতে চেয়েছে এবং সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপও নিয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো আমাদের সবারই পরিচিত। কালক্ষেপণ না করে প্রতিটি সরকারই আইন প্রযোগকারী সংস্থাগুলোকে আরো জোরদার করেছে। অপরাধ দমনের নিমিত্তে উদ্ভাবিত নতুন নতুন কৌশলকে রপ্ত করেছে আমাদের ওই সব সংস্থা। নতুন নতুন অস্ত্র সরঞ্জাম দিয়ে সেগুলো সজ্জিত করেছে। আমাদের পুলিশ বাহিনীকে দিয়েছে রায়ট মোকাবিলার অত্যাধুনিক সরঞ্জাম (Equipment) এবং গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডগ স্কোয়াড। তৈরি হয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। শুধু তা-ই নয়, বিশেষ ধরনের অপরাধীর জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে বিশেষ বিশেষ আইন। উপরন্তু জনগণকে আইনানুগ করতে আমাদের নেতারা মাঠে-ময়দানে অনেক নীতিবাক্য উচ্চারণ এবং আইনশৃঙ্খলার মহিমাকীর্তন করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের উপদেশ গ্রহণ করার লোক মিলেছে কালেভদ্রে। সাধারণ মানুষ নেতাদের কথায় না হয়েছে আকৃষ্ট, না আশ্বস্ত।
ইতিমধ্যে দেশে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন তো দূরের কথা, কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করার প্রবণতা আরো তীব্র এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়েছে আরো প্রকট রূপ। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও জনগণও কিন্তু খুব একটা সুখকর অবস্থায় নেই। কেননা দুটি তিক্ত পথের একটি তো তাদের বেছে নিতে হবে। যদি তারা সরকারের আদেশ-নির্দেশ নির্বিবাদে মেনে নেয়, তাহলে তাদের তো কিছুটা বিবেক-যন্ত্রণার সঙ্গেই তা মানতে হবে। কেননা তারা জানে যে সরকারের নেতৃস্থানীয়রা ওই সব আদেশ-নির্দেশের থোড়াই তোয়াক্কা করেন। আর যদি সরকারি হুকুম প্রতিরোধ করা হয়, তাও তো ঝুঁকিপূর্ণ।
আসলে আদেশ মানার স্পৃহা একটি স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। যিনি আদেশ দেন তাঁর আচরণ থেকেই আসা দরকার আদেশ মানার প্রেরণা। আজকাল শাসকদের কাছ থেকে সে প্রেরণা পাওয়া তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এদের বেশির ভাগই ভণ্ড। শাসকের অবস্থান যদি নৈতিকতার ভিতে সুদৃঢ় করা না হয়, তাহলে তার আদেশ-নির্দেশ শোনায় ফাঁপা।
আমাদের আজকের শাসনের (Governance) যে সমস্যা, তার মূলেই রয়েছে একটি নৈতিক কর্তৃত্বের অনুপস্থিতি। আমি ওই কর্তৃত্বের কথা বলছি, যা দিয়ে বাংলাদেশের স্থপতি ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে তুলনাহীন ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় কোনো কর্তৃত্ব ব্যতিরেকেই তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত যেকোনো বাণী অলঙ্ঘনীয় আদেশে পরিণত হয়েছিল। কেননা তিনি নৈতিকতার উচ্চভূমি (Moral high ground) থেকে কথা বলেছিলেন। এটি ছিল নৈতিক কর্তৃত্বের অনুপম দৃষ্টান্ত। তবে বঙ্গবন্ধুর ইন্দ্রজালও নিঃশেষিত হয়েছিল, যখন তাঁর নৈতিক কর্তৃত্বে ধস নেমেছিল। যদিও তখন তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে। ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজির আছে।
শুধু ব্যক্তিজীবনে নয়, দেশ শাসনেও নৈতিক অবক্ষয়ের এমন একটি সময় সমাগত, যখন ভদ্রলোকরাও আইন অগ্রাহ্য করেন, ট্যাক্স দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁদের বক্তব্য : কী লাভ? ট্যাক্সের টাকা তো অসৎ নেতারাই আত্মসাৎ করবেন অথবা মন্ত্রী-আমলাদের সরকারি সফরের নামে বিদেশে প্রমোদ-ভ্রমণে বিনষ্ট হবে। তাই ট্যাক্স পরিশোধ না করে তাঁরা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার ফাঁকফোকর খুঁজতে থাকে। শিক্ষিত সজ্জনরাও আজকাল অপরাধীকে পুলিশের হাত তুলে দিতে চান না, যখন তাঁরা নিশ্চিত যে পুলিশ ঘুষের বিনিময়ে অপরাধীকে ছেড়ে দেবে এবং ওই অপরাধী দ্বিগুণ আক্রোশে তাণ্ডবে লিপ্ত হবে। তার চেয়ে কি এই ভালো নয় যে উত্তম-মধ্যম যা দেওয়ার প্রয়োজন তার বিধান তারা নিজেরাই করে। তাই এখন দেখা যায়, যত্রতত্র জনতার আদালত, ত্রস্ত বিচার ব্যবস্থা। এও একধরনের নৈরাজ্য।
ব্যাংকঋণ পরিশোধ করার উৎসাহ প্রায় কোনো ঋণগ্রহীতারই নেই; কেননা তারা দেখছে যে রাঘব বোয়ালরা কিভাবে তাদের 'কানেকশনের' বদৌলতে অনায়াসে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। তাই পরিশোধের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অনেকের লক্ষ্য কী করে ঋণ শোধ না করে পারা যায়। অনেকের মনেই আজ প্রশ্ন, সৎ থাকা বা থাকার প্রচেষ্টার মধ্যে আদৌ কি কোনো কৃতিত্ব আছে? ওই তো অমুক এবং তমুক তার কুকীর্তির ফিরিস্তিসহ দিব্যি আছে! দুর্র্নীতি, সন্ত্রাস বা রাহাজানির কারণে কেউ তাদের সমাজচ্যুত করেনি। বরং সরকারি প্রটোকল অনুযায়ী তাঁদের অনেকেই 'গণ্যমান্য' ব্যক্তি। সরকার তার কার্যকলাপে নৈতিকতার যে মান প্রতিষ্ঠা করেছে, আশ্চর্য নয় যে দেশ ও জনগণও সেই মানের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
নৈতিক কর্তৃত্বের অবক্ষয় শুরু হয় যখনই কোনো সরকার বা জাতীয় নেতৃত্ব আইনের শাসন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। একটি বিশদ আইনের কাঠামো আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে পেয়েছি। আমাদের জনপ্রতিনিধিরাও প্রচুর আইন প্রণয়ন করেছেন। শোনা যায়, আমাদের দেশ নাকি আইনের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কিন্তু আইনের প্রয়োগ এখানে কদাচিৎ হয়। আরো কম হয় পক্ষপাতহীন ন্যায়নীতির সঙ্গে এর প্রয়োগ। দেখা যায় যে সরকারের উঁচু মহলের লোকরা সর্বপ্রথম আইন ভাঙেন_তা কোনো পরিত্যক্ত বাড়ি দখলেই হোক বা পছন্দের ব্যক্তিকে কোনো পদমর্যাদা দেওয়ায়ই হোক। অতঃপর প্রশাসনের যেকোনো ধাপে অনুরূপ আইনভঙ্গের পুনরাবৃত্তি হলে সরকারের উচ্চাসনে আসীন ব্যক্তিদের তা রোধ করার সৎসাহস থাকে না। এমনি করে শুরু হয় আপসের পালা এবং চক্রাকারে আইনভঙ্গের প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
আইন উপেক্ষা করে কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী একবার কোনো ফায়দা নিলে ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে অনুরূপ ফায়দা হাসিলের সুযোগ দিতেই হবে। পুলিশকে যদি কোনো নেতা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, তাহলে কোন মুখে ওই পুলিশকে বিরত করবেন তাঁর কার্যসিদ্ধি থেকে। তাই দেখা যায়, যে যতই আস্ফালন করুক, নীতিবিবর্জিত নেতারা আসলেই কাপুরুষ। তাঁদের নৈতিক সাহস নেই, কর্তৃত্বও নেই। আইনের প্রতি যে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা তাঁরা পোষণ করেন, তা যদি জনগণকেও সংক্রমিত করে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?
আমাদের দেশে কাউকে রাজনৈতিক ফায়দা পেঁৗছাতে বা স্বজনপ্রীতি করতে সরকারি নেতারা প্রায়ই আইনের ব্যতিক্রম বা পরিবর্তন করে থাকেন। এ জন্য তাঁদের এমন সব পদক্ষেপ নিতে হয়, যা শুধু ভয়াবহই নয়, ন্যক্কারজনকও। বাংলাদেশের সব সরকারই আবাসিক প্লট বণ্টন, পারমিট প্রদান এবং কোটা (Qouta) নির্ধারণের ব্যাপারে এমন সব পদক্ষেপ নিয়ে গোটা প্রশাসনকে কলঙ্কিত করেছে। এতে আইনের প্রক্রিয়াই শুধু প্রত্যাখ্যাত হয়নি, অনুগত (Conformist) আমলার সন্ধানে প্রশাসনযন্ত্রে একাধিক বিচ্যুতি ঘটাতে হয়েছে। এহেন কেলেঙ্কারিতে লিপ্ত নেতৃত্ব তার নৈতিক কর্তৃত্ব হারাতে বাধ্য। এই কর্তৃত্ব নেই বলেই জনগণ তো দূরের কথা, দুষ্কার্যের দোসর আমলারাও নেতাদের মানেন না। একমাত্র স্বার্থান্বেষী চাটুকার ছাড়া জনগণের মধ্যেও এদের ঠাঁই নেই।
আইনের শাসন প্রবর্তনে ব্যর্থ হয়েও যে সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করে এবং তার মধ্যে শক্তির সন্ধান করে_বুঝতে হবে সে সরকার অন্তঃসারশূন্য এবং তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতেই এমন আচরণ করছে। ইতিহাস সাক্ষী যে আইন প্রণয়ন করে সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে_শুধু তারই জোরে কোনো সরকার টেকেনি। অনেক ক্ষেত্রে নিজের প্রণীত আইনেই তারা পর্যুদস্ত হয়েছে। বেশি বেশি করে শক্তি সঞ্চয়ের স্বপ্নে অন্ধ রাজনৈতিক দল বিধিবহির্ভূতভাবে নিজেদের সশস্ত্র ক্যাডার প্রতিপালন করে। ফলে দেশে একাধিক শক্তির কেন্দ্র সৃষ্টি হয় এবং তাদের ভেতরকার ত্রূদ্ধর অন্তর্দ্বন্দ্বে দল কি আদৌ লাভবান হয়? দেশে বিরাজমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখে মনে হবে, দেশে কোনো সরকার নেই। এ অবস্থায় সরকারকে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের স্বার্থে এবং নিজেদের নৈতিক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার খাতিরে তার গৃহীত অনৈতিক ভূমিকার দায়দায়িত্ব স্বীকার করতে হবে, যদিও সেই অনৈতিক ভূমিকা দেশ শাসনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে থাকে, এখন একমাত্র স্বচ্ছতাই সরকারের জন্য বহন করবে পুনরুজ্জীবনের অঙ্গীকার।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক,
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট
No comments