বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা-বিদেশির মুখে বাংলার স্তব by আশীষ-উর-রহমান

গান-বাজনা নয়, স্রেফ কথার জাদুতে গতকাল বুধবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মাত করে দিলেন উইলিয়াম র‌্যাডিচি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক এই ব্রিটিশ কবি ও বাংলা সাহিত্যের অনুবাদকের বাংলা চর্চার বয়স যে এ দেশের স্বাধীনতার সমান বয়সী!


বিশুদ্ধ উচ্চারণের পরিশীলিত বাংলায় দেওয়া মিনিট কুড়ির বক্তৃতায় শ্রোতাদের এমন মুগ্ধ করেন র‌্যাডিচি যে, মুহুর্মুহু করতালির ঢেউ বয়ে যায়। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বাংলা ভাষা ও বাঙালির ভাই বলে বরণ করে নিয়েছেন এই বিদেশিকে।
র‌্যাডিচি কথা শুরু করেছিলেন ভাষা আন্দোলন দিয়েই। বললেন, ‘বাংলা ভাষা আন্দোলন হয়েছিল বলে তার সূত্রে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে বাঙালি। সেই সূত্রে হচ্ছে এই বইমেলা। এবং সেই সূত্রেই আমি আজ মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে পারছি। এবং অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি।’
র‌্যাডিচি যখন বাংলা শেখার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি অক্সফোর্ডে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে। কিছুদিন আগেই ঘুরে গেছেন পশ্চিম বাংলার শান্তিনিকেতন। ব্রিটিশ পত্রপত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের যেসব খবর ছাপা হচ্ছিল, তা কেটে রাখতেন। ক্রমে আগ্রহ সৃষ্টি হলো বাংলা শেখার। র‌্যাডিচি বললেন, ‘যাঁর ছবি দেখে বাংলা শেখার আগ্রহ জেগেছিল, তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা মাইকেল নন, তিনি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’
ব্রিটিশ এই কবি গীতাঞ্জলি, মেঘনাদ বধ অনুবাদ করেছেন ইংরেজিতে। চর্যাপদ থেকে শামসুর রাহমান অবধি বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের সুলুকসন্ধান যে তাঁর মোটেই অজ্ঞাত নয়, তা জানা গেল গদ্যপদ্যের প্রচুর উদ্ধৃতি থেকে। গভীর আলোচনা করলেন বাংলা ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। আবৃত্তি করলেন মাইকেলের ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব’, শামসুর রাহমানের ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’।
র‌্যাডিচি বললেন, ভাষাকে বাঙালিরা ‘তুমি’ সম্বোধন করে। সে কারণে ভাষা, মানুষ, প্রকৃতি, ঈশ্বর মিলেমিশে গেছে বাঙালি মনীষীর রচনায়। ইউরোপীয় ভাষায় এমন নেই। ভাষাকে সেখানে ‘তুমি’ বলা হয় না।
বাদ পড়ল না জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও। এ নিয়ে বাংলাদেশের ঝুঁকি ও সম্ভাবনার কথা বললেন তিনি। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা পশ্চিমা দেশগুলোতে কেন পরিচিতি পাচ্ছে, তার বিশ্লেষণও এল। বললেন, এর প্রধান কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। দারিদ্র্য বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো গৎবাঁধা নেতিবাচক ভাবমূর্তির পরিবর্তন হচ্ছে যেসব কারণে, তার মধ্যে আছে পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রচুর বাঙালির কর্মসংস্থান। তাঁরা নানা ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। পাশাপাশি দুই বাঙালি অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার পাওয়া বাঙালির পরিচয়কে গৌরবান্বিত করেছে।
র‌্যাডিচি বললেন, অনেক পশ্চিমা গবেষক এখন বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। তাঁরা জানছেন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির রয়েছে দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। তাঁরা বাংলা সাহিত্য অনুবাদও করছেন।
দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর দুই দশক ধরে যে গণতন্ত্রের চর্চা চলছে, তাও বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে বলে র‌্যাডিচির ধারণা। তাঁর মতে, বাংলা ও বাঙালির সামনে যে এগিয়ে যাওয়ার আরও ব্যাপক সুযোগ আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিদেশির মুখে—তাও আবার মাতৃভাষায়—এমন প্রশংসা শুনে কার না ভালো লাগবে! অতএব বক্তৃতাজুড়ে শুধু করতালি আর করতালি।
এর পরপরই রোদ মলিন হয়ে আসা বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণ শেষে উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাংলা একাডেমীর অমর একুশের গ্রন্থমেলার।
আলোচনার পর কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা রচনার ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কবিতাটি আবৃত্তি করেন ইকবাল বাহার চৌধুরী। বাংলা ও ইংরেজিতে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শোনান মার্কিন শিল্পী জন থর্প। ‘কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা’ গেয়ে তিনিও প্রচুর করতালি কুড়ান। প্রধানমন্ত্রী একাডেমীর নবনির্মিত ভবনেরও উদ্বোধন করেন এবং মেলাচত্বর ঘুরে দেখেন।
আবার সেই চিরচেনা দৃশ্য
আনোয়ার হোসেন সস্ত্রীক বই বাছাই করছিলেন সূচীপত্রের স্টলে। একটি বই কেনাও হয়েছে। টঙ্গীতে থাকেন। সেখানে রেনেসাঁ প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড হাইস্কুলের দিবা শাখার প্রধান শিক্ষক। কবিতার প্রতি অনুরাগ প্রবল। স্ত্রীকে নিয়ে প্রথম দিনেই মেলায় চলে এসেছেন প্রাণের টানে। প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর মেলায় প্রবেশ করেছেন উদ্গ্রীব জনস্রোতে মিশে।
সেই চেনা দৃশ্য টিএসসি থেকে। রিকশা, স্কুটার, ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে নামছেন নানা বয়সী মানুষ। তরুণের দল টিএসসিতে জটলা করছে। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে পা বাড়াচ্ছে বাংলা একাডেমীর দিকে।
মেলার পরিসর বাড়বে
প্রতিবছরই মেলায় প্রকাশক, নতুন বই, লেখক ও গ্রন্থানুরাগীদের সংখ্যা বাড়ছে। তাই বহুদিন থেকেই মেলার পরিসর বৃদ্ধির কথা বলে আসছেন সবাই। স্বাগত বক্তৃতায় মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান উল্লেখ করলেন বিষয়টি। উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বললেন, বাস্তব প্রয়োজনেই মেলার কলেবর বাড়ানো দরকার। তবে আবেগটা যেন অক্ষুণ্ন থাকে, সেটা বিবেচনায় রেখে তিনি সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন। কাজেই আগামী বছর থেকে মেলা সম্প্রসারিত হচ্ছে—এমনটাই ধারণা পাওয়া গেল।
প্রথম দিনে
বরাবর যা হয় এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। প্রথম দিনে হাতেগোনা কিছু স্টলেই বই উঠেছে। ভেতরে নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। অন্তত দিন দুই লেগে যাবে চত্বরের স্টলগুলোতে বই সাজাতে। তবে মেলার টানে গ্রন্থানুরাগীরা কিন্তু প্রথম দিনেই প্রাঙ্গণ সপ্রাণ করে তুলেছিলেন।
নতুন বই
বেশ কিছু নতুন বইও এসেছে প্রথম দিনেই। প্রথমা প্রকাশনের স্টল এবার একাডেমীর উত্তর দিকের প্রবেশপথসংলগ্ন সারিতে। বই সাজানোর কাজ শেষ। ক্রেতারা উল্টেপাল্টে দেখছিলেন নতুন বই। প্রথম দিনেই এসেছে হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস রামগোলাম। এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের দুটি নতুন বই এসেছে অন্যপ্রকাশের স্টলে মেঘের ওপর বাড়ি ও রঙপেন্সিল। আগামীতে এসেছে হাসনাত আবদুল হাইয়ের শিল্পী কামরুল হাসানের জীবন নিয়ে উপন্যাস লড়াকু পটুয়া। মাওলা ব্রাদার্সে এসেছে মুনতাসীর মামুনের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক শান্তি কমিটি-১৯৭১। সূচীপত্রে এসেছে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে। নবযুগ প্রকাশনীতে এসেছে দুই বাংলার লেখকদের প্রবন্ধ নিয়ে ভীষ্মদেব চৌধুরী সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবর্ষের স্মারক গ্রন্থ প্রভাত সূর্য।
আজ বৃহস্পতিবার থেকে চালু হবে মেলার তথ্যকেন্দ্র। শুরু হবে নতুন বইয়ের প্রচার। বাড়বে গ্রন্থানুরাগীদের সমাগমও। সারা মাস সরগরম থাকবে মেলার প্রাঙ্গণ।

No comments

Powered by Blogger.