কালের পুরাণ-বিএনপি উদ্ধারে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যৌথ প্রকল্প! by সোহরাব হাসান
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং সরকারের পুলিশ প্রশাসনের আচরণ এতটাই সমর্থক হয়ে উঠেছে যে মাঝে মধ্যে পার্থক্য করাও কঠিন হয়ে পড়ে। পুলিশ আওয়ামী লীগের কর্মীর ভূমিকায় কিংবা আওয়ামী লীগের কর্মীরা পুলিশের ভূমিকায় নেমে ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রায়-প্রত্যাখ্যাত বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে চলেছেন।
গত তিন বছরে বিএনপি আন্দোলন করে যা অর্জন করতে পারেনি ২৯-৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হঠকারী ও তুঘলকী কর্মকান্ড দলটিকে তার চেয়ে বেশি পাইয়ে দিয়েছে। চাঁদের যেমন নিজস্ব আলো নেই, সূর্যের আলো ধার করে সে অন্যকে বিলায়, তেমনি আমাদের দেশে বিরোধী দলকেও জনগণের জন্য কিছু করতে হয় না। সরকারি দল ও পুলিশই বিরোধী দলের হারানো ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট।
প্রথমে ঢাকা মহানগর পুলিশ নাশকতার আশঙ্কায় ২৯ জানুয়ারি বিএনপির নির্ধারিত গণমিছিল কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অজুহাত হিসেবে দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কথা বলে। পুলিশ দাবি করে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া তাদের দায়িত্ব। কিন্তু এক দিন পর ৩০ জানুয়ারি যথারীতি শান্তিপূর্ণভাবেই দুই দলের কর্মসূচি পালিত হলো। তাহলে আগের দিন নিষেধাজ্ঞা জারি করে পুলিশ প্রশাসন কার স্বার্থ রক্ষা করেছে?
পত্রিকায় খবর এসেছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার সামনে রেখে নাশকতার আশঙ্কায় আগামী ১ মাসের জন্য সারা দেশে সভা-সমাবেশ বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাতে রাজি হননি। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশ শর্তসাপেক্ষে বিএনপিকে গণমিছিলের অনুমতি দিয়েছে। শর্তটি হলো বিএনপির গণমিছিল নয়াপল্টন থেকে কাকরাইল হয়ে মগবাজার চৌরাস্তায় শেষ করা। মগবাজারের কথা শুনে এক সাংবাদিক-বন্ধু ঠাট্টা করে বললেন, ‘খালেদা জিয়া সঠিক গন্তব্যই বেছে নিয়েছেন।’ বিএনপির সদর কার্যালয় নয়াপল্টনে আর জামায়াতে ইসলামীর মগবাজারে।
আগের দিন মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ডেকে পরের দিন মহানগর আওয়ামী লীগের ‘নামকাওয়াস্তে’ সমাবেশ করে ক্ষমতাসীন দলটি কি ফায়দা পেতে করতে চাইছে? যাঁরা টেলিভিশনে মহানগর আওয়ামী লীগের ছোট নৌকার মাপের সমাবেশটি দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে একই সঙ্গে হাসি ও করুণার সৃষ্টি হয়েছে। যে সংগঠনটির ডজন দুয়েক সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী রাজধানীজুড়ে পোস্টারে সয়লাব করে দিয়েছেন, সেই সংগঠন বিএনপির অর্ধেক মাপের সমাবেশ করার মুরোদ দেখাতে পারেনি।
গত কিছু দিন ধরে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে যদি কেউ ‘অন্তর্ঘাত’ করে থাকে, তা করেছেন তাঁর দলের গলাবাজ নেতারাই। নেতাদের গলার আওয়াজ যত বড়, সমাবেশের আকার তত ছোট। ৩০ জানুয়ারির সমাবেশে ভাষণদানকারী একমাত্র কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ বিরোধী দলকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র ও অসাংবিধানিক উপায়ে সরকার পতনের চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঘরে বসে থাকবে না।’ (প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি, ২০১২)। কিন্তু নির্মম সত্য হলো মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগ বিএনপির গণমিছিলের পাল্টা সমাবেশ ডেকে সত্যি সত্যি ঘরে বসে ছিলেন। পত্রিকায় আরও খবর এসেছে, মহানগর আওয়ামী লীগের সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেনের বক্তব্যের সময় কর্মীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি শুরু হয়। আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপির গণমিছিলে নাশকতা ও ষড়যন্ত্র খুঁজলেও নিজ দলের কর্মীদের মারামারি ঠেকাতে পারেন না।
পুলিশের ভূমিকা আরও ন্যক্কারজনক। ২৯ জানুয়ারি ঢাকার পাশাপাশি ছয়টি বিভাগীয় শহরে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, কিন্তু চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে তো কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তার পরও সেখানে গণমিছিলে পুলিশের বাধা দেওয়া এবং গুলি করে মানুষ মারার কী যুক্তি থাকতে পারে? পুলিশের দাবি, তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়েছে। কিন্তু আত্মরক্ষার প্রয়োজনই হতো না যদি তারা নির্বিঘ্নে মিছিল করতে দিত। বিরোধী দলকে একটি মিছিল করতে দিলে কি চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে বিএনপির শাসন কায়েম হয়ে যেত? গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তে পুলিশ দুটি কমিটি গঠন করেছে। প্রশ্ন হলো, এই কমিটি কি সত্য উদ্ঘাটন করবে, না সত্যকে চিরতরে ধামাচাপা দেবে? যে পুলিশ দিনাজপুরের ইয়াসমিন হত্যা ও ধর্ষণ মামলা ধামাচাপা দেয়, সেই পুলিশ গুলিবর্ষণকারী পুলিশদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেবে, তা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।
চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে এখন ‘বিচার চাই না, পুলিশ সামলাও’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের গুলিতে চার-চারজন মানুষ মারা গেল, তাঁদের মধ্যে একজন রিকশাচালক, কোনো দলের কর্মী নন। ক্ষমতার লড়াইয়ের অসহায় শিকার এই রিকশাচালকের পরিবার-পরিজনের কী হবে তা কি নেতা-নেত্রীরা ভেবে দেখেছেন? কেউ কি তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন?
পুলিশ দুই শহরে বিএনপি ও জামায়াতের ১৩ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। দিনবদলের আওয়ামী লীগের শাসনামলে দুটি জেলায় বিএনপি ও জামায়াতের ১৩ হাজার কর্মী! আমরা যদি প্রতি জেলায় গড়ে সাড়ে ছয় হাজার নেতা-কর্মী আছেন ধরে নিই, তাহলে ৬৪ জেলায় তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় চার লাখ ১৬ হাজার। সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের এত কর্মী থাকলে তো খালেদা জিয়ার ঘোষিত গণ-অভ্যুত্থান ২০১১ সালেই হয়ে যাওয়ার কথা। তা যখন হয়নি, তখন বুঝতে হবে পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে।
অতীতে আমরা পুলিশের বহু ডিগবাজি দেখেছি। ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যে পুলিশ বিএনপির হুকুম তামিল করেছে, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর তারাই বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মহা উৎসাহে মামলা করেছে, তাদেরকে জেলে পুরেছে। আজ যারা লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে, তারা এক সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও মামলা ঠুকেছিল। দুই বড় দলের ক্ষমতালিপ্সার হাতিয়ার হিসেবে আমরা এর আগেও পুলিশকে ব্যবহূত হতে দেখেছি। আওয়ামী লীগ ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পর সারা ঢাকা শহর অবরুদ্ধ করে ফেলার কাজটি কিন্তু তখন পুলিশই করেছিল, হাওয়া ভবনের নির্দেশে। আজ তারা কার নির্দেশে ১৩ হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করল?
গত তিন বছরে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় টান পড়েছে বলে বিএনপির জনপ্রিয়তা হু হু করে বেড়েছে এটা কেউ মনে করে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের অতি-উৎসাহী নেতাদের সাম্প্রতিক আবোল-তাবোল বক্তৃতা-বিবৃতি ও পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণে বিএনপি জনপ্রিয়তা অনেকটাই ফিরে পেতে যাচ্ছে। একমাত্র যুদ্ধাপরাধের বিচার আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য ধস ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না । দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়। একই সঙ্গে চায় সুশাসন, চায় বাজার ও শেয়ারবাজারের স্থিতি, চায় সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। তিন বছর পর এসে ফাঁকা বুলিতে তারা আশ্বস্ত হবে না।
আওয়ামী লীগের নেতারা জোর গলায় বলছেন, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিএনপি গণ-অভ্যুথান দূরের কথা, একটি সফল গণ-আন্দোলনও করতে পারবে না।’ কিন্তু সরকারের পুলিশ যেভাবে দেশের প্রায় সব মানুষকে বিএনপি-জামায়াত বানিয়ে ফেলছে, তাতে আশঙ্কা হয় সরকারের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার ঘোষিত গণ-অভ্যুত্থানটা সত্যি সত্যি না ঘটে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ বাহিনীর তালিকা অনুযায়ী দেশের রাজনীতিতে এখন বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরই বড় শক্তি। চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের মতো দুটি ছোট জেলায় ১৩ হাজার নেতা-কর্মী। পুলিশের দাবি অনুযায়ী একটি জেলায় বিএনপি-জামায়ায়াতের সাড়ে ছয় হাজার কর্মী থাকলে আগামী নির্বাচনে তাদের জয় ঠেকায় কে?
আমাদের বিশ্বাস, মামলা দেওয়ার আগে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের একটি অলিখিত চুক্তি হয়েছে। পুলিশ আসামির সংখ্যা যত বাড়িয়ে বলবে, বিএনপি-জামায়াত ততই লাভবান হবে। বাংলাদেশে নেতা হতে হলে মামলা খেতে হয়। থানার হাজতখানা কিংবা জেলখানার ফটকের মধ্যে যে ফারাক, আমাদের দেশে মাস্তান ও নেতার পার্থক্য তার চেয়েও কম।
কেউ কেউ বলবেন, পুলিশ টাকা কামানোর উপায় হিসেবে হাজার হাজার লোককে আসামি করেছে। আবার বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা নেতৃত্বের আসন পাকাপোক্ত করতে পুলিশকেও মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে পারে। দাঙ্গাবাজ কর্মীও জেলখানা থেকে ফুলের মালা নিয়ে বেরিয়ে এসে দলের বড় নেতা বনে যান।
লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরসহ সারা দেশে পুলিশ বিএনপি ও জামায়াতের জনপ্রিয়তা-উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে কি না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তদন্ত করে দেখতে পারেন। লক্ষ্মীপুরে এক তাহের এবং তাঁর পুত্রদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছিল যে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনী গণজোয়ারেও আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি। মামলা দায়েরের পর বিএনপির সেই জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যাবে।
একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, যিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্র পড়ান, আলাপ প্রসঙ্গে বলেছেন, একদিনের পত্রিকা দেখে মনে হয় সরকার সঠিক পথেই আছে। কিন্তু পরের দিনই সরকারের শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতার বক্তৃতা শুনলে কিংবা পুলিশের কাজ দেখলে মনে হয় যেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হতে চায় না। এক দিন যদি জনপ্রিয়তার পারদ ৫০ ডিগ্রি উঠে যায়, পরের দিন ১১০ ডিগ্রি নামিয়ে ফেলেন নেতারা। অনেকটা শেয়ারবাজারের মতো।
সম্প্রতি সেনা ‘অভ্যুত্থানের চেষ্টা’ ব্যর্থ করে দিয়ে সরকার জনগণের কাছে যে সহানুভূতি পেয়েছিল, তার চেয়ে বেশি বিরাগভাজন হয়েছে বিএনপির গণমিছিলকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে সরকারের শক্তি নয়, দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে।
সরকার ও বিরোধী দল মিলেই যে গণতন্ত্র—আমাদের ‘মহান’ নেতা-নেত্রীরাই তা মানতে চান না। সরকারি দলের নেতারা মনে করেন, তাঁরা যা বলেন, যা করেন, তা-ই গণতন্ত্র। বিরোধী দলের নেতারা মনে করেন, সরকারের বিরোধিতাই হল গণতন্ত্র। প্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করেন, সরকার যখন তাঁদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সবকিছু করছে, তখন বখরাটা পুরো হাতিয়ে নেওয়াই গণতন্ত্র।
বিরোধী দলের নেতারা ভাবেন, ক্ষমতায় থাকতে পুরো পাঁচ বছর সংসদে ছিলাম। এখন সংসদ বর্জন করাই গণতান্ত্রিক অধিকার। তাঁরা বেতন-ভাতা নেবেন, শুল্কমুক্ত গাড়ি নেবেন, ন্যাম ফ্ল্যাটে থাকবেন, কিন্তু সংসদে যাবেন না। আপসহীন বিরোধী দল রাজপথ ছেড়ে কেন সংসদে যাবে?
সরকার, বিরোধী দল, প্রশাসন, পুলিশ—সবাই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে এবং যার যার মতো সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু দেশটির প্রকৃত মালিক যারা, সেই জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে। হায় বাংলাদেশ! হায় গণতন্ত্র!
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments