দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় by মোজাফ্ফর আহমদ
মধ্য মেয়াদে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের প্রতি সমর্থন কমে আসতে দেখা যায়। এ সময়কালে জনগণ সরকারের কর্মকাণ্ড ও নীতিকৌশলের বিচার-বিবেচনা করতে সমর্থ হয়। স্থিতিশীল গণতন্ত্রে মধ্য মেয়াদে জনসমর্থন থেকে পরবর্তী নির্বাচনের ফলাফলও অনুমিত হয়ে থাকে। প্রথম আলোর উদ্যোগে সম্প্রতি দৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচিত ৩০ জেলার পাঁচ হাজার খানায় চালানো জরিপ থেকে জানা যায়, দেশ যে পথে এগিয়ে চলেছে, তাকে সঠিক বলে মনে করেননি ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতা;
সঠিক বলে মনে করেছেন ৪২ শতাংশ উত্তরদাতা। ২০০৯ সালে এ পরিসংখ্যান ছিল ২৯ ও ৭০ শতাংশ। সরকারের দেশ পরিচালনায় আস্থার ঘাটতি এ সময়কালে বেড়েছে। এ ধারণার সমর্থন পাওয়া যায় যখন ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা সরকারের কার্যক্রম পরিচালনায় তাঁদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, আর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সরকারের দেশ পরিচালনায় বিমুখ হয়ে পড়েছে।
কিন্তু কেন এমন হলো? প্রথমত, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ বলে মনে করেছেন ৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন দেশে দাঙ্গা হয়েছে। সরকারের পতনের ঘটনাও ঘটেছে। মানুষের প্রতিদিনকার ঘটনা হাটবাজারে দ্রব্যমূল্যের মুখোমুখি হওয়া। এ ক্ষেত্রে অসফলতা সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মানুষের জীবনকে শঙ্কামুক্ত বা শঙ্কাযুক্ত করে রাখে। জরিপ থেকে প্রতীয়মান হয়, ২০০৯ সালে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে মনে করেছিলেন ১১ শতাংশ উত্তরদাতা, কিন্তু ২০১১-তে ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা তেমনটি মনে করছেন। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে—এমনটি যাঁরা ভেবেছেন, তাঁদের শতাংশ ৬৫ থেকে ৪৩-এ নেমে এসেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। জীবনযাত্রার মান বর্ধিত ব্যয় ও শঙ্কার কারণে নেমে এসেছে নিম্নতর স্তরে। এ জন্য সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্টিও কমে গেছে।
সুশাসন ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি। এখানেও জনগণ বঞ্চিত হয়েছে বলে মনে করেন। প্রথমত, এই তিন বছরে দুর্নীতি বেড়েছে বলে মনে করেছেন ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা; কমেছে বলে মনে করেন ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে মতামত দিয়েছেন ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা। ৩৮ শতাংশ মনে করেছেন, দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে ভেবেছেন ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা। আর স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলে ভেবেছেন ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা। চতুর্থত, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচারিক ব্যবস্থায় অবনতি ঘটেছে বলে মতামত দিয়েছেন ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা, যে পরিসংখ্যান ২০০৯ সালে ছিল ১৬ শতাংশ। বিচারিক ব্যবস্থায় উন্নতি হয়েছে মনে করছেন ৪২ শতাংশ, যা ২০০৯ সালের ৫২ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ কম। গণতান্ত্রিক সরকারের এমনই সব স্তম্ভে আস্থার ঘাটতি সরকারের কার্যক্রমে অসন্তুষ্টির প্রকাশ মাত্র। গত তিন বছরে সরকারে দলীয়করণ বেড়েছে বলে মনে করেন ৫১ শতাংশ উত্তরদাতা; কমছে বলে ভেবেছেন ২৭ শতাংশ। প্রশাসনের দলীয়করণ সুশাসনের ব্যাঘাত ঘটায়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকেও গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত দিয়েছেন বিপুলসংখ্যক উত্তরদাতা।
উন্নয়ন জনসাধারণের কাঙ্ক্ষিত একটি লক্ষ্য। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সফল হয়েছে বলে ভেবেছেন ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা। বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি ভালো হয়েছে বলে মনে করেছেন ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা। কিন্তু কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি বলে মনে করেছেন ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা। কৃষি খাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে কৃষির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু কৃষক লাভবান হয়নি—এমনটি ভেবেছেন ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা। যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামো উন্নয়নে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা। এ থেকে অনুমিত, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণের অসন্তুষ্টির মাত্রা ২০০৯ সালের তুলনায় বেড়েছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংসদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র কেবল সরকারি দল সুরক্ষা করে না, বিরোধী দলকে তার ভূমিকা পালন করতে হয়, করতে দিতে হয়। সংসদও কার্যকর হয় বিরোধী দলের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণে। গত তিন বছরে সংসদ যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তাতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ৫৩ শতাংশ; সন্তুষ্টি জানিয়েছেন ৪১ শতাংশ উত্তরদাতা। ২০০৯ সালে এ পরিসংখ্যান ছিল ৩৪ ও ৬৫ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ যথাযথ ছিল না (৬২ শতাংশ) এবং বিরোধী দলকে সংসদে আনার ব্যাপারে সরকারি দল আন্তরিক ছিল না (৫৪ শতাংশ)। তবু বিরোধী দলের সংসদে যাওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেছেন বিপুলসংখ্যক উত্তরদাতা (৮১ শতাংশ)। সংসদ পরিচালনায় গণতান্ত্রিক মানসিকতার ঘাটতির কথা সবাই বলেছেন, যেমন বলেছেন সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া নিয়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরদাতা সংবিধান সংশোধন (৫৮ শতাংশ) ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল (৭৩ শতাংশ) প্রক্রিয়াকে যথাযথ মনে করেননি।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারি দল ও তার অঙ্গসংগঠনের দায়িত্বশীলভাবে আচরণ ও উচ্চারণ করতে হয়। এখানেও এ সরকারের ঘাটতি অনেক। আওয়ামী লীগ তার কর্মীদের যথাযথভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে, এমনটি মনে করেন ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা। সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে এটিও চিহ্নিত।
গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী দল সংসদে যায় না। গত তিন বছরে সংসদের বাইরে বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, এমন মনে করেন ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা নেতিবাচক বলে মনে করেছেন ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা।
বর্তমান সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করেছে। সরকারের এ পদক্ষেপের প্রতি ২০০৯ সালে সমর্থন ছিল ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতার। কিন্তু ২০১০ সালে সরকারের পদক্ষেপকে যথাযথ মনে করেছেন ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতা, অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশ সমর্থন এক বছরে কমে যায়। ২০১১ সালে ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা সরকারের পদক্ষেপকে যথাযথ মনে করেছেন। অর্থাৎ বর্তমানে সরকারি পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন সংখ্যালঘিষ্ঠে নেমে এসেছে। এ সমর্থন কমে আসা শহরে ও গ্রামে এবং পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে একই রকম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। সময়ক্ষেপণে জনসমর্থন কি আরও কমে যাবে—এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিকৌশল। ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। তবে ২০০৯ সালে তা ছিল ৭৬ শতাংশ। সময়ান্তরে জনচেতনায় পরিবর্তন আসছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশের লাভ হয়েছে বলে মনে করেন ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা। ক্ষতি হয়েছে মনে করেন ২৭ শতাংশ উত্তরদাতা। ওই সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ার দায় বাংলাদেশ সরকারের (২২ শতাংশ), ভারত সরকারের (২১ শতাংশ) এবং উভয়ের (৪০ শতাংশ)। ভারতকে যেভাবে ট্রানজিট দিতে চাইছে, তাতে বাংলাদেশ লাভবান হবে না বলে মনে করেছেন ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা। টিপাইমুখ নিয়েও কি এমন অবস্থা?
গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি রাজনৈতিক দল। যত দায়বদ্ধ, আদর্শনিষ্ঠ ও পরিচালনায় স্বচ্ছ হয়, ততই গণতন্ত্র স্থিতি পায়। কিন্তু গত তিন বছরে রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাননি ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা। নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উত্তরণ ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং গণতন্ত্রের ভিত রচনায় প্রয়োজনীয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ও বিরোধী দলের যে সম্পর্ক, তাতে সাংঘর্ষিক অবস্থার আশঙ্কা আবার মাথা চাড়া দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্ক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করাকে সমর্থন করেননি ৭৪ শতাংশ এবং এমন সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না মনে করেন ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা। ভবিষ্যতে সাংঘর্ষিক রাজনীতি ফিরে আসবে বলে মনে করেন ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া দলীয় ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এটি নিবারণ কি সম্ভব?
গণমাধ্যম গণতন্ত্রের একটি প্রয়োজনীয় স্তম্ভ। সরকার ও তার অনুগত কর্মী বাহিনীর গণমাধ্যমের প্রতি যে আচরণ, তাকে অসমর্থনযোগ্য মনে করেছেন ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা।
এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আচরণগতভাবে গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। পরস্পরের প্রতি আচরণ শিষ্টাচারবহির্ভূত। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম চলবে কি না, এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। উত্তরদাতার ৪০ শতাংশ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে কার্যক্রম চালাতে দেওয়া ঠিক নয় বলে মনে করেছেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলের ধর্মকে অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করাকেও অনুচিত বলে মনে করেন ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মুসলিম সংস্কৃতির যে প্রভাব রয়েছে, সেখানে এমন আদর্শ ইহজাগতিক রাজনীতি কতটুকু সম্ভব?
সার্বিক মূল্যায়নে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকে ভালো মনে করেছেন ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন নেমে এসেছে ৩৮ শতাংশ। দলের চেয়ে ব্যক্তি এখানে উজ্জ্বলতর অবস্থানে আছেন।
বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে খালেদা জিয়াকে ভালো মনে করেছেন ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা। বিএনপি জোটের প্রতি সমর্থন উন্নীত হয়েছে ৪৩ শতাংশে। এখানেও দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়।
এই প্রথমবার আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির প্রতি সমর্থন বেশি। এখনই নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ৩৮ শতাংশ ও বিএনপি ৪৩ শতাংশ সমর্থন পাবে। ২০০৯ সালে এ পরিসংখ্যান ছিল ৫৬ ও ২৫; ২০১০ সালে ৪৬ ও ৩৯। আওয়ামী সরকারের এখন সতর্ক বিবেচনা নিয়ে এগোনোর সময়। আওয়ামী লীগের কারণে বিএনপির জনসমর্থন বাড়ছে।
মোজাফ্ফর আহমদ: অর্থনীতিবিদ।
কিন্তু কেন এমন হলো? প্রথমত, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ বলে মনে করেছেন ৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন দেশে দাঙ্গা হয়েছে। সরকারের পতনের ঘটনাও ঘটেছে। মানুষের প্রতিদিনকার ঘটনা হাটবাজারে দ্রব্যমূল্যের মুখোমুখি হওয়া। এ ক্ষেত্রে অসফলতা সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মানুষের জীবনকে শঙ্কামুক্ত বা শঙ্কাযুক্ত করে রাখে। জরিপ থেকে প্রতীয়মান হয়, ২০০৯ সালে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে মনে করেছিলেন ১১ শতাংশ উত্তরদাতা, কিন্তু ২০১১-তে ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা তেমনটি মনে করছেন। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে—এমনটি যাঁরা ভেবেছেন, তাঁদের শতাংশ ৬৫ থেকে ৪৩-এ নেমে এসেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। জীবনযাত্রার মান বর্ধিত ব্যয় ও শঙ্কার কারণে নেমে এসেছে নিম্নতর স্তরে। এ জন্য সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্টিও কমে গেছে।
সুশাসন ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি। এখানেও জনগণ বঞ্চিত হয়েছে বলে মনে করেন। প্রথমত, এই তিন বছরে দুর্নীতি বেড়েছে বলে মনে করেছেন ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা; কমেছে বলে মনে করেন ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে মতামত দিয়েছেন ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা। ৩৮ শতাংশ মনে করেছেন, দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে ভেবেছেন ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা। আর স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলে ভেবেছেন ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা। চতুর্থত, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচারিক ব্যবস্থায় অবনতি ঘটেছে বলে মতামত দিয়েছেন ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা, যে পরিসংখ্যান ২০০৯ সালে ছিল ১৬ শতাংশ। বিচারিক ব্যবস্থায় উন্নতি হয়েছে মনে করছেন ৪২ শতাংশ, যা ২০০৯ সালের ৫২ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ কম। গণতান্ত্রিক সরকারের এমনই সব স্তম্ভে আস্থার ঘাটতি সরকারের কার্যক্রমে অসন্তুষ্টির প্রকাশ মাত্র। গত তিন বছরে সরকারে দলীয়করণ বেড়েছে বলে মনে করেন ৫১ শতাংশ উত্তরদাতা; কমছে বলে ভেবেছেন ২৭ শতাংশ। প্রশাসনের দলীয়করণ সুশাসনের ব্যাঘাত ঘটায়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকেও গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত দিয়েছেন বিপুলসংখ্যক উত্তরদাতা।
উন্নয়ন জনসাধারণের কাঙ্ক্ষিত একটি লক্ষ্য। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সফল হয়েছে বলে ভেবেছেন ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা। বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি ভালো হয়েছে বলে মনে করেছেন ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা। কিন্তু কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি বলে মনে করেছেন ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা। কৃষি খাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে কৃষির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু কৃষক লাভবান হয়নি—এমনটি ভেবেছেন ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা। যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামো উন্নয়নে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা। এ থেকে অনুমিত, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণের অসন্তুষ্টির মাত্রা ২০০৯ সালের তুলনায় বেড়েছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংসদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র কেবল সরকারি দল সুরক্ষা করে না, বিরোধী দলকে তার ভূমিকা পালন করতে হয়, করতে দিতে হয়। সংসদও কার্যকর হয় বিরোধী দলের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণে। গত তিন বছরে সংসদ যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তাতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ৫৩ শতাংশ; সন্তুষ্টি জানিয়েছেন ৪১ শতাংশ উত্তরদাতা। ২০০৯ সালে এ পরিসংখ্যান ছিল ৩৪ ও ৬৫ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ যথাযথ ছিল না (৬২ শতাংশ) এবং বিরোধী দলকে সংসদে আনার ব্যাপারে সরকারি দল আন্তরিক ছিল না (৫৪ শতাংশ)। তবু বিরোধী দলের সংসদে যাওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেছেন বিপুলসংখ্যক উত্তরদাতা (৮১ শতাংশ)। সংসদ পরিচালনায় গণতান্ত্রিক মানসিকতার ঘাটতির কথা সবাই বলেছেন, যেমন বলেছেন সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া নিয়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরদাতা সংবিধান সংশোধন (৫৮ শতাংশ) ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল (৭৩ শতাংশ) প্রক্রিয়াকে যথাযথ মনে করেননি।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারি দল ও তার অঙ্গসংগঠনের দায়িত্বশীলভাবে আচরণ ও উচ্চারণ করতে হয়। এখানেও এ সরকারের ঘাটতি অনেক। আওয়ামী লীগ তার কর্মীদের যথাযথভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে, এমনটি মনে করেন ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা। সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে এটিও চিহ্নিত।
গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী দল সংসদে যায় না। গত তিন বছরে সংসদের বাইরে বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, এমন মনে করেন ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা নেতিবাচক বলে মনে করেছেন ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা।
বর্তমান সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করেছে। সরকারের এ পদক্ষেপের প্রতি ২০০৯ সালে সমর্থন ছিল ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতার। কিন্তু ২০১০ সালে সরকারের পদক্ষেপকে যথাযথ মনে করেছেন ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতা, অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশ সমর্থন এক বছরে কমে যায়। ২০১১ সালে ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা সরকারের পদক্ষেপকে যথাযথ মনে করেছেন। অর্থাৎ বর্তমানে সরকারি পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন সংখ্যালঘিষ্ঠে নেমে এসেছে। এ সমর্থন কমে আসা শহরে ও গ্রামে এবং পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে একই রকম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। সময়ক্ষেপণে জনসমর্থন কি আরও কমে যাবে—এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিকৌশল। ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। তবে ২০০৯ সালে তা ছিল ৭৬ শতাংশ। সময়ান্তরে জনচেতনায় পরিবর্তন আসছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশের লাভ হয়েছে বলে মনে করেন ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা। ক্ষতি হয়েছে মনে করেন ২৭ শতাংশ উত্তরদাতা। ওই সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ার দায় বাংলাদেশ সরকারের (২২ শতাংশ), ভারত সরকারের (২১ শতাংশ) এবং উভয়ের (৪০ শতাংশ)। ভারতকে যেভাবে ট্রানজিট দিতে চাইছে, তাতে বাংলাদেশ লাভবান হবে না বলে মনে করেছেন ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা। টিপাইমুখ নিয়েও কি এমন অবস্থা?
গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি রাজনৈতিক দল। যত দায়বদ্ধ, আদর্শনিষ্ঠ ও পরিচালনায় স্বচ্ছ হয়, ততই গণতন্ত্র স্থিতি পায়। কিন্তু গত তিন বছরে রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাননি ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা। নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উত্তরণ ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং গণতন্ত্রের ভিত রচনায় প্রয়োজনীয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ও বিরোধী দলের যে সম্পর্ক, তাতে সাংঘর্ষিক অবস্থার আশঙ্কা আবার মাথা চাড়া দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্ক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করাকে সমর্থন করেননি ৭৪ শতাংশ এবং এমন সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না মনে করেন ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা। ভবিষ্যতে সাংঘর্ষিক রাজনীতি ফিরে আসবে বলে মনে করেন ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া দলীয় ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এটি নিবারণ কি সম্ভব?
গণমাধ্যম গণতন্ত্রের একটি প্রয়োজনীয় স্তম্ভ। সরকার ও তার অনুগত কর্মী বাহিনীর গণমাধ্যমের প্রতি যে আচরণ, তাকে অসমর্থনযোগ্য মনে করেছেন ৭১ শতাংশ উত্তরদাতা।
এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আচরণগতভাবে গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। পরস্পরের প্রতি আচরণ শিষ্টাচারবহির্ভূত। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম চলবে কি না, এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। উত্তরদাতার ৪০ শতাংশ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে কার্যক্রম চালাতে দেওয়া ঠিক নয় বলে মনে করেছেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলের ধর্মকে অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করাকেও অনুচিত বলে মনে করেন ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মুসলিম সংস্কৃতির যে প্রভাব রয়েছে, সেখানে এমন আদর্শ ইহজাগতিক রাজনীতি কতটুকু সম্ভব?
সার্বিক মূল্যায়নে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকে ভালো মনে করেছেন ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন নেমে এসেছে ৩৮ শতাংশ। দলের চেয়ে ব্যক্তি এখানে উজ্জ্বলতর অবস্থানে আছেন।
বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে খালেদা জিয়াকে ভালো মনে করেছেন ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা। বিএনপি জোটের প্রতি সমর্থন উন্নীত হয়েছে ৪৩ শতাংশে। এখানেও দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়।
এই প্রথমবার আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির প্রতি সমর্থন বেশি। এখনই নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ৩৮ শতাংশ ও বিএনপি ৪৩ শতাংশ সমর্থন পাবে। ২০০৯ সালে এ পরিসংখ্যান ছিল ৫৬ ও ২৫; ২০১০ সালে ৪৬ ও ৩৯। আওয়ামী সরকারের এখন সতর্ক বিবেচনা নিয়ে এগোনোর সময়। আওয়ামী লীগের কারণে বিএনপির জনসমর্থন বাড়ছে।
মোজাফ্ফর আহমদ: অর্থনীতিবিদ।
No comments