সংকট মোকাবিলায় অর্থনীতির গতি কমাচ্ছে সরকার by শওকত হোসেন

নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান করতে মেয়াদি ঋণ নিতে উদ্যোক্তাকে এখন সুদ দিতে হবে ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ। কোনো কোনো ব্যাংক এর চেয়েও বেশি নিচ্ছে। শিল্প চালাতে চলতি মূলধন নিলেও দিতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ হারে সুদ। আর শিল্পের জন্য যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল আনতে হলে ৮৬ টাকা দিয়ে কিনতে হবে ডলার। তাও সব ব্যাংক দিতে পারছে না। এত অর্থ ব্যয় করে শিল্প গড়লেও চালু করা যাবে না। কারণ, নেই প্রয়োজনীয় জ্বালানির সংযোগ।


এই হচ্ছে বর্তমানে দেশের বিনিয়োগ চিত্র। অথচ বাংলাদেশ বিশ্বের সেই বিরল দেশের একটি, যেখানে জাতীয় বিনিয়োগের তুলনায় সঞ্চয় বেশি। অর্থাৎ দেশে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ রয়েছে।
অর্থনীতির যে তত্ত্ব পাঠ্যবইতে পড়ানো হয়, তাতে বলা আছে—কম উন্নত দেশগুলোতে সঞ্চয়ের হার কম থাকে, ফলে বিনিয়োগও কম হয়। বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই এই তত্ত্ব মানছে না। ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের জাতীয় সঞ্চয়ের হার ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, আর বিনিয়োগের হার ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
এমনিতেই গত কয়েক বছর বিনিয়োগ খাত ছিল মন্দা। অর্থনৈতিক সংকটে বিনিয়োগ করও কমেছে। আর সুদ ও ডলারের দর বাড়ার কারণে নতুন বিনিয়োগ এক প্রকার বন্ধ হয়েই গেছে।
তবে এখন যে বিনিয়োগ মন্দা দেখা দিয়েছে, এর কারণ সরকারের কিছু নীতি। সরকারই সিদ্ধান্ত নিয়ে মুদ্রা সরবরাহ কমাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ঋণের সুদের হারও বেড়েছে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি নিরুৎসাহিত করার কাজটি শুরু হয়েছে গত ডিসেম্বর থেকে। এর আরেক উদ্দেশ্য হচ্ছে, ডলারের দর আর বাড়তে না দেওয়া।
মূলত অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচতে অর্থনীতির গতি কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কমানো হচ্ছে দেশের সামগ্রিক চাহিদা। সরকার মনে করছে, এতে মূল্যস্ফীতি কিছু কমবে। তবে এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারও কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও গতকাল বুধবার এফবিসিসি-আইয়ের অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিতেও তিনি রাজি আছেন।
বর্তমান সরকারের সময়ে ২০০৯-১০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার মতে, এবার প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ হবে না। সরকার বিভিন্ন সময় ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বললেও এখন নীতি বদল হয়েছে বলে জানা গেছে। গত বৃহস্পতিবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতি শীতল করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের পদক্ষেপ উন্নত দেশের জন্য কার্যকর হলেও বাংলাদেশের মতো দেশে কাজ না-ও দিতে পারে। এমন যদি হয়, প্রবৃদ্ধি কমল কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমল না, তাহলে কী হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, সরকার মুদ্রা সরবরাহ কমাচ্ছে। এর ফলে বিনিয়োগও কমবে। আর বিনিয়োগ কমলে কর্মসংস্থান বাড়বে না, মানুষের আয় কমবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রবৃদ্ধি কমানোর নীতি সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আমদানি কমছে: কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তাঁরা এখন আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করছে। নতুন করে বেশ কিছু পণ্যকে বিলাসবহুল পণ্যের তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করাই উদ্দেশ্য। এ নিয়ে কাজ করছে ট্যারিফ কমিশন।
২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে আমদানির প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৪২ শতাংশ। আর গত নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমদানির প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। এর পরই আমদানি আরও কমানোর চেষ্টা শুরু হলে ডিসেম্বর শেষে প্রবৃদ্ধি হয় ১৯ শতাংশের কিছু বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জ্বালানি তেলের আমদানি কমানো সম্ভব হয়নি। মূলত বিদ্যুৎ খাতের জন্য প্রতি মাসেই বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আনতে হচ্ছে বিপিসিকে। বিপিসির এলসি মূলত খুলছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। ডলার সংকটে তারাও এখন বিপিসির এলসি খুলতে অনীহা দেখাচ্ছে বলে জানা গেছে।
নতুন এলসি খোলার তথ্য পর্যালোচনা করেও বিনিয়োগ মন্দার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য নতুন এলসি খোলায় ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর হার ছিল (-) ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য নতুন ঋণপত্র খোলায় প্রবৃদ্ধি প্রায় (-) ৮ শতাংশ। অথচ এই পাঁচ মাসে জ্বালানি তেল আমদানিতে নতুন ঋণপত্র খোলায় প্রবৃদ্ধির হার ১৩৫ শতাংশ।
আবারও আইএমএফ: অর্থনীতিকে শীতল করে সংকট কমানোর ধারণা মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে পাওয়া। সরকার বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়াতে আইএমএফ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিতে আলোচনা করছে। পাশাপাশি সার্বভৌম ঋণ নেওয়ারও পরিকল্পনা চলছে। এ নিয়ে সরকারের মধ্যেও দুই ধরনের মতামত আছে। অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত মাসে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠক করেছে। এই বৈঠকে আইএমএফ থেকে ঋণ না নিয়ে সার্বভৌম ঋণ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কেননা, আইএমএফের ঋণের শর্ত কঠিন। এতে অর্থনীতির গতি কমে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইএমএফকেই আদর্শ মানছে সরকার।

No comments

Powered by Blogger.