শিক্ষা-মান উন্নয়নে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির ভূমিকা by আকমল হোসেন
শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে শিক্ষার বিষয়বস্তুগত ব্যাপার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সে সঙ্গে শিক্ষকদের দক্ষতা, আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা সৃষ্টির জন্য মোটিভেশন প্রয়োজন। ফলে শিক্ষকরা নিজস্ব তাগিদ থেকেই দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবেন
শিক্ষা আমাদের মৌলিক এবং সাংবিধানিক অধিকার। বিশ্ব মানবাধিকার সনদে সব দেশের জন্যই শিক্ষা মৌলিক এবং সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, সে সঙ্গে শিক্ষার্থীর গুণগত মানের বৃদ্ধিকে বোঝায়। এ জন্য দেশে শতভাগ শিক্ষার হার নিশ্চিত যেমন জরুরি, সে সঙ্গে শিক্ষার দ্বারা যেন দেশ ও জাতির উন্নয়ন ঘটে সেটিও বিবেচ্য। শিক্ষা দ্বারা যদি মানুষের ইতিবাচক আচরণের পরিবর্তন না হয় সেটিকে প্রকৃত শিক্ষা বা মানসম্মত শিক্ষা বলা যায় না। স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের উৎপাদন বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সে সঙ্গে ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের আয়বৈষম্য ১:৮৪। পোশাক কারখানার একজন শ্রমিক সারা মাস কাজ করার পর মজুরি পান তিন হাজার টাকা আর ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি পান তিন লাখ টাকা। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন পিয়ন (চতুর্থ শ্রেণী) থেকে শুরু করে ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ (উপসচিব মর্যাদা) পর্যন্ত সবাইকে সরকার বাড়িভাড়া দেয় মাসিক একশ' টাকা। বাংলাদেশের কোথাও ওই সুবিধায় চলা যায় না। এ কাজগুলো যারা করেছেন তারাও শিক্ষিত। এ শিক্ষা কি গুণগত মানওয়ালা শিক্ষা বলা যায়? সে প্রশ্ন দেশবাসীর সামনে রাখলাম। দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষার গুণগত মানের বিষয়টি জড়িত। সমাজের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে শিক্ষার মান বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এ কারণেই শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসকদের হতে হবে দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ, স্বচ্ছ এবং দায়িত্বশীল। এ কাজটি সুচারুরূপে করার জন্য তাদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে প্রয়োজন স্বচ্ছতা এবং যোগ্যতার মূল্যায়ন করা।
শিক্ষকতা পেশার মানুষের জন্য একাডেমিক ক্যারিয়ার যেমন দরকার, সে সঙ্গে ওই কাজে তিনি আন্তরিক কি-না, মানসিক সন্তুষ্টির সঙ্গে শিক্ষকতার কাজটিকে গ্রহণ করেছেন কি-না, দেশপ্রেমের প্রতি অনুগত কি-না, নৈতিক চরিত্রে এবং স্বচ্ছতায় নির্ভেজাল কি-না সে যোগ্যতা তার থাকা দরকার। পেশার রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনের সঙ্গে তিনি নিজেকে মেলাতে পেরেছেন কি-না সে বিষয়টিও বিবেচ্য। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা রেখেই শিক্ষক নিয়োগকারীদের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা, সে সঙ্গে বৈষয়িক লেনদেনের বিষয়টি পরিহার করে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। প্রার্থী বাচাইয়ে প্রার্থীর মনস্তাত্তি্বক বিষয়টি জানার জন্য মৌখিক পরীক্ষার সময় অবশ্যই সাইকোলজিস্ট (মনোবিজ্ঞানী) থাকা জরুরি। আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। নিয়োগের পর পেশার আলোকে যে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন তাও সবক্ষেত্রে হয় না। প্রশিক্ষণের সুবিধার সীমাবদ্ধতার কারণে ১০-১৫ বছর চাকরির পরও কলেজ পর্যায়ে অনেক শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি। ফলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির পরিবেশটা নিশ্চিত হচ্ছে না। সম্প্রতি শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্রী নির্যাতনের হার বেড়েছে_ এটি দুঃখজনকই নয়, নিন্দাজনক এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়, আঞ্চলিকতা ও স্বজনপ্রীতি পরিহার করা জরুরি।
শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে শিক্ষার বিষয়বস্তুগত ব্যাপার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সে সঙ্গে শিক্ষকদের দক্ষতা, আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা সৃষ্টির জন্য মোটিভেশন প্রয়োজন। ফলে শিক্ষকরা নিজস্ব তাগিদ থেকেই দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবেন। এ কাজের জন্য তাদের দু'ধরনের ইনসেনটিভ প্রদান করতে হবে। ক. আর্থিক প্রেষণা। এর মাধ্যমে তাদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করবে। এর মধ্যে বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, বোনাস ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। খ. অনার্থিক প্রেষণা। এর মাধ্যমে শিক্ষকদের মানসম্মান ও ইজ্জতের বিষয়টি সুনিশ্চিত হবে।
পদোন্নতি শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। কর্মীদের প্রেষণাদান, কাজকর্মে গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য পদোন্নতি দেওয়া হয়। কর্মীদের বর্তমান পদ থেকে অধিক দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগদান করা হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে_ ক. জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক, খ. যোগ্যতাভিত্তিক এবং গ. জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতাভিত্তিক পদোন্নতির মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক পদোন্নতি বেশি অনুসরণ করা হয়। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক পদে বর্তমানে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ এবং বৈষয়িক স্বার্থের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতির বেশি সুযোগ নেই। ৮ বছর চাকরি করার পর সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ থাকলেও সবার জন্য এ সুযোগ নেই। অনুপাত প্রথার (৫:২) কারণে একটি প্রতিষ্ঠানে ৭ প্রভাষকের জন্য ২ জন করে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ আছে, অন্যরা প্রভাষক হিসেবে থাকবেন। ৭ জনের মধ্যে যে দু'জন সহকারী অধ্যাপক হবেন তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি না দিয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদায়ন করা হয়। ফলে শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না। এ প্রক্রিয়া শিক্ষকদের মানসিক সন্তুষ্টি বিধান করে না। এ নীতিমালা পরিহার করে বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের পদোন্নতির আওতায় আনলে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বাড়বে, শিক্ষার গুণগত মানও বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের কাজের পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়নের (মনিটরিং এবং ইভালুয়েশন) ব্যবস্থা থাকতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো শুধুই ঊর্ধ্বতন কর্তৃক অধস্তনের এসিআরের মাধ্যমে এ মূল্যায়ন সঠিক হবে না। শিক্ষকদের পারফরম্যান্স অ্যাপরাইজাল করার জন্য সব ছাত্রছাত্রীর মতামত নেওয়া জরুরি। ফলে শিক্ষকদের পাঠদানে সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো যেমন বেরিয়ে আসবে, সে সঙ্গে বার্ষিক পরীক্ষা, বোর্ড পরীক্ষার ফল বিবেচনায় এনে সঠিকভাবে শিক্ষকদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা যাবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করলে তাদের মানসিক সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাবে, সে সঙ্গে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে বদলিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জনস্বার্থে এবং কর্মচারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বদলি করা হয়। অনেক সময় কর্মচারী কর্তৃক শৃঙ্খলাভঙ্গের লঘু শাস্তি হিসেবেও বদলীয় করা হয়ে থাকে। এক জায়গায় অনেক দিন থাকার কারণে কাজকর্মে একঘেয়েমিতা ও দায়িত্বে উদাসীনতার সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থা দূর এবং কাজকর্মে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে বদলি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষা সেক্টরের বৃহৎ অংশ বেসরকারি শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বদলির ব্যবস্থা হয়নি। স্থানীয়ভাবে গভর্নিং বডির মাধ্যমে তাদের নিয়োগ, একই জায়গায় সারাজীবন চাকরির কারণে কাজকর্মে উদাসীনতা ও একঘেয়েমিতার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। দলীয়ভাবে গভর্নিং বডি তৈরি হওয়ায় শিক্ষকদের মধ্যে ওই দলীয় প্রভাব পড়ে এবং তাদের মধ্যে দলাদলি ও গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের মানসিকতায় সৃষ্টি হয় নেতিবাচক প্রভাব। ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে বদলির ব্যবস্থা করলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে গতির সঞ্চার হতে পারে।
শিক্ষার বৃহত্তর অংশজুড়ে রয়েছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং বদলির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার দাবি রাখে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৭ (ক, খ, গ) ধারার আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়তে দক্ষ শিক্ষক ও দক্ষ শিক্ষা প্রশাসক জরুরি। আর দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসক গড়তে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং বদলি যেমন দরকার, সে সঙ্গে এ কাজগুলো যাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আলোকে হয় সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদান প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতার জন্য শিক্ষক সংগঠনগুলো দাবি করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য পিএসপির আদলে পৃথক নিয়োগ কমিশন গঠনের। ক্ষমতাসীন শাসক মহল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও অনুরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিষয়টি অচিরেই বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় যাওয়া দরকার। সরকারি-বেসরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পৃথক নিয়োগ সেল করা যেতে পারে। গুণসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে অর্থায়ন বাড়াতে হবে। এ জন্য জাতীয় আয়ের ৮ শতাংশ এবং বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় নিশ্চিত করা জরুরি। এ কাজের জন্য সরকারের সদিচ্ছা এবং পরিকল্পনা দরকার। তবে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য এ কাজগুলোও করা জরুরি।
আকমল হোসেন :কলেজ শিক্ষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস), কেন্দ্রীয় কমিটি
শিক্ষকতা পেশার মানুষের জন্য একাডেমিক ক্যারিয়ার যেমন দরকার, সে সঙ্গে ওই কাজে তিনি আন্তরিক কি-না, মানসিক সন্তুষ্টির সঙ্গে শিক্ষকতার কাজটিকে গ্রহণ করেছেন কি-না, দেশপ্রেমের প্রতি অনুগত কি-না, নৈতিক চরিত্রে এবং স্বচ্ছতায় নির্ভেজাল কি-না সে যোগ্যতা তার থাকা দরকার। পেশার রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনের সঙ্গে তিনি নিজেকে মেলাতে পেরেছেন কি-না সে বিষয়টিও বিবেচ্য। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা রেখেই শিক্ষক নিয়োগকারীদের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা, সে সঙ্গে বৈষয়িক লেনদেনের বিষয়টি পরিহার করে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। প্রার্থী বাচাইয়ে প্রার্থীর মনস্তাত্তি্বক বিষয়টি জানার জন্য মৌখিক পরীক্ষার সময় অবশ্যই সাইকোলজিস্ট (মনোবিজ্ঞানী) থাকা জরুরি। আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। নিয়োগের পর পেশার আলোকে যে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন তাও সবক্ষেত্রে হয় না। প্রশিক্ষণের সুবিধার সীমাবদ্ধতার কারণে ১০-১৫ বছর চাকরির পরও কলেজ পর্যায়ে অনেক শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি। ফলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির পরিবেশটা নিশ্চিত হচ্ছে না। সম্প্রতি শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্রী নির্যাতনের হার বেড়েছে_ এটি দুঃখজনকই নয়, নিন্দাজনক এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়, আঞ্চলিকতা ও স্বজনপ্রীতি পরিহার করা জরুরি।
শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে শিক্ষার বিষয়বস্তুগত ব্যাপার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সে সঙ্গে শিক্ষকদের দক্ষতা, আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা সৃষ্টির জন্য মোটিভেশন প্রয়োজন। ফলে শিক্ষকরা নিজস্ব তাগিদ থেকেই দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবেন। এ কাজের জন্য তাদের দু'ধরনের ইনসেনটিভ প্রদান করতে হবে। ক. আর্থিক প্রেষণা। এর মাধ্যমে তাদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করবে। এর মধ্যে বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, বোনাস ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। খ. অনার্থিক প্রেষণা। এর মাধ্যমে শিক্ষকদের মানসম্মান ও ইজ্জতের বিষয়টি সুনিশ্চিত হবে।
পদোন্নতি শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। কর্মীদের প্রেষণাদান, কাজকর্মে গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য পদোন্নতি দেওয়া হয়। কর্মীদের বর্তমান পদ থেকে অধিক দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগদান করা হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে_ ক. জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক, খ. যোগ্যতাভিত্তিক এবং গ. জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতাভিত্তিক পদোন্নতির মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক পদোন্নতি বেশি অনুসরণ করা হয়। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক পদে বর্তমানে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ এবং বৈষয়িক স্বার্থের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতির বেশি সুযোগ নেই। ৮ বছর চাকরি করার পর সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ থাকলেও সবার জন্য এ সুযোগ নেই। অনুপাত প্রথার (৫:২) কারণে একটি প্রতিষ্ঠানে ৭ প্রভাষকের জন্য ২ জন করে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ আছে, অন্যরা প্রভাষক হিসেবে থাকবেন। ৭ জনের মধ্যে যে দু'জন সহকারী অধ্যাপক হবেন তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি না দিয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদায়ন করা হয়। ফলে শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না। এ প্রক্রিয়া শিক্ষকদের মানসিক সন্তুষ্টি বিধান করে না। এ নীতিমালা পরিহার করে বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের পদোন্নতির আওতায় আনলে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বাড়বে, শিক্ষার গুণগত মানও বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের কাজের পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়নের (মনিটরিং এবং ইভালুয়েশন) ব্যবস্থা থাকতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো শুধুই ঊর্ধ্বতন কর্তৃক অধস্তনের এসিআরের মাধ্যমে এ মূল্যায়ন সঠিক হবে না। শিক্ষকদের পারফরম্যান্স অ্যাপরাইজাল করার জন্য সব ছাত্রছাত্রীর মতামত নেওয়া জরুরি। ফলে শিক্ষকদের পাঠদানে সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো যেমন বেরিয়ে আসবে, সে সঙ্গে বার্ষিক পরীক্ষা, বোর্ড পরীক্ষার ফল বিবেচনায় এনে সঠিকভাবে শিক্ষকদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা যাবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করলে তাদের মানসিক সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাবে, সে সঙ্গে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে বদলিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জনস্বার্থে এবং কর্মচারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বদলি করা হয়। অনেক সময় কর্মচারী কর্তৃক শৃঙ্খলাভঙ্গের লঘু শাস্তি হিসেবেও বদলীয় করা হয়ে থাকে। এক জায়গায় অনেক দিন থাকার কারণে কাজকর্মে একঘেয়েমিতা ও দায়িত্বে উদাসীনতার সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থা দূর এবং কাজকর্মে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে বদলি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষা সেক্টরের বৃহৎ অংশ বেসরকারি শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বদলির ব্যবস্থা হয়নি। স্থানীয়ভাবে গভর্নিং বডির মাধ্যমে তাদের নিয়োগ, একই জায়গায় সারাজীবন চাকরির কারণে কাজকর্মে উদাসীনতা ও একঘেয়েমিতার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। দলীয়ভাবে গভর্নিং বডি তৈরি হওয়ায় শিক্ষকদের মধ্যে ওই দলীয় প্রভাব পড়ে এবং তাদের মধ্যে দলাদলি ও গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের মানসিকতায় সৃষ্টি হয় নেতিবাচক প্রভাব। ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে বদলির ব্যবস্থা করলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে গতির সঞ্চার হতে পারে।
শিক্ষার বৃহত্তর অংশজুড়ে রয়েছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং বদলির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার দাবি রাখে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৭ (ক, খ, গ) ধারার আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়তে দক্ষ শিক্ষক ও দক্ষ শিক্ষা প্রশাসক জরুরি। আর দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসক গড়তে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং বদলি যেমন দরকার, সে সঙ্গে এ কাজগুলো যাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আলোকে হয় সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদান প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতার জন্য শিক্ষক সংগঠনগুলো দাবি করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য পিএসপির আদলে পৃথক নিয়োগ কমিশন গঠনের। ক্ষমতাসীন শাসক মহল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও অনুরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিষয়টি অচিরেই বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় যাওয়া দরকার। সরকারি-বেসরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পৃথক নিয়োগ সেল করা যেতে পারে। গুণসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে অর্থায়ন বাড়াতে হবে। এ জন্য জাতীয় আয়ের ৮ শতাংশ এবং বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় নিশ্চিত করা জরুরি। এ কাজের জন্য সরকারের সদিচ্ছা এবং পরিকল্পনা দরকার। তবে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য এ কাজগুলোও করা জরুরি।
আকমল হোসেন :কলেজ শিক্ষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস), কেন্দ্রীয় কমিটি
No comments