কালের আয়নায়-তালেবান ও আল কায়দার মধ্যে আসল পার্থক্যটা কী? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আফগান যুদ্ধেরও অবসান হবে, যদি আমেরিকা সময় থাকতে আল কায়দা ও তালেবানদের শর্ত মেনে আফগান ভূমি ত্যাগে সম্মত হয়ে শান্তি আলোচনায় বসে। আফগানিস্তানে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা পাবে কি-না সেটা পরের প্রশ্ন।


এখনকার প্রশ্ন, আফগানিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত থাবা থেকে মুক্ত হবে কি-না! আমেরিকা যদি এখনই তার নিজের ইচ্ছায় এই অবিশ্বাস্য অর্থক্ষয় ও রক্তক্ষয়ের যুদ্ধ থেকে সরে না যায়, তাহলে তার বর্তমান অর্থনৈতিক ধসই আরও বিপুলাকার ধারণ করে তাকে সরে
যেতে বাধ্য করবে


আমেরিকানরা এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে, আফগানিস্তান থেকে সম্মান বাঁচিয়ে প্রস্থানের জন্য তালেবানের সঙ্গে একটা আপসরফা করার। তাদের প্রধান শর্ত একটাই, আল কায়দার সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। প্রথম দিকে বলা হয়েছিল, ভালো তালেবানদের সঙ্গে তারা আপস বৈঠকে বসবেন। তালেবানদের তারা দু'ভাগে ভাগ করে ফেলেছিলেন। ভালো এবং মন্দ তালেবান (মড়ড়ফ ধহফ নধফ ঃধষরনধহং)। ভালো তালেবান হলো তারা, যারা নরমপন্থি এবং আমেরিকার সঙ্গে আপস করতে চায়। মন্দ তালেবান হলো তারা, যারা চরমপন্থি এবং আমেরিকার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে চায়।
এর আগে আমেরিকা আফগান জিরগা সরদারদের প্রচুর ঘুষ দিয়ে নিজেদের পক্ষে এনে কোনোভাবে সম্মান বাঁচিয়ে আফগানিস্তান থেকে পালাতে চেয়েছিল। সেই কৌশল যে কারণেই হোক ব্যর্থ হয়ে গেছে। এখন চলছে তালেবানদের কাছে ধরনা দেওয়া। এখন আর ভালো-মন্দ নেই, সব তালেবানের সঙ্গেই চলছে গোপন আলোচনা। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। যারা আফগান পরিস্থিতি ভালোভাবে অনুধাবন করেননি তারা হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, ওয়াশিংটন তালেবানদের সঙ্গে আপস করতে চায়। কিন্তু আল কায়দার সঙ্গে করতে চায় না, তার কারণটা কী? দুটিই তো ইসলামী জঙ্গি প্রতিষ্ঠান এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে এক সঙ্গে লড়ছে।
এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে একটু পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসন উৎখাত ও সোভিয়েত সৈন্য বিতাড়নের নামে আমেরিকা একাধিক ইসলামী জঙ্গি সংস্থা গড়ে তোলে। তাদের মধ্যে তালেবানরাই প্রধান। এই তালেবানদের পেছনে আমেরিকার হুকুমে পাকিস্তান ও সৌদি আরবও মদদ জুগিয়েছে। সোভিয়েতের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তো প্রায় তালেবানিস্তানেই পরিণত হয়েছিল।
সোভিয়েত সৈন্যের আফগানিস্তান ত্যাগের পর ক্ষমতার জন্য ইসলামী জঙ্গি দলগুলোর মধ্যে সিভিল ওয়ার প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাদের একে একে পতন ঘটিয়ে পাকিস্তান, সৌদি আরব, আমেরিকার মিলিত উদ্যোগে তালেবানদের সংগঠিত করা হয় এবং কাবুলে তারা সরকার গঠনে সক্ষম হয়। এ সরকারকে বিপুল অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য দিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছিল সৌদি ও পাকিস্তানের সহযোগিতায় আমেরিকা। এই তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মাত্র চার মাস আগেও আমেরিকা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের অর্থ সাহায্য ও অস্ত্র সাহায্য বরাদ্দ করেছে তালেবান সরকারের জন্য।
গোড়ায় আমেরিকার আফগান নীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হটানো। সে লক্ষ্যে 'নাস্তিক কমিউনিস্ট শাসন' আখ্যা দিয়ে নজিবুল্লাহর সেক্যুলার শাসনকে উৎখাতের জন্য ইসলামী জিহাদিস্ট বা কট্টর মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করা হয়। এই একই কৌশল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্যের সময় আফগানিস্তানে প্রয়োগ করেছিল। তৎকালীন আফগানিস্তানের বাদশাহ আমানুল্লাহ ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের কাছে নতিস্বীকারে রাজি ছিলেন না। তিনি আধুনিকমনা শাসক ছিলেন। আফগানিস্তানের আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রবর্তন করেন। পর্দাপ্রথার কঠোরতা শিথিল করেন।
ব্রিটিশ সরকার এর সুযোগ গ্রহণ করে। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সার্ভিসের অফিসার ক্যাপ্টেন লরেন্সকে তারা একজন মুসলিম ফকির সাজিয়ে আফগানিস্তানে পাঠান। তিনি পরিচিত হন 'দরবেশ লরেন্স' নামে। লরেন্স প্রতিটি আফগান গির্জায় ঘুরে ঘুরে প্রচার চালান, বাদশাহ আমানুল্লাহ একজন নাস্তিক। তিনি আফগানিস্তানকে 'নাছাড়া দেশ' বানাতে চান। রানী সুরাইয়া পর্দাপ্রথা মানেন না। বিদেশে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে মদপান করেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফলে আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের সরলমতি, আধুনিক শিক্ষাদীক্ষাহীন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তার সুযোগ নিয়ে বাচ্চা-ই-সাক্কো নামে এক ডাকাত সরদার এসে কাবুল দখল করে। বাদশাহ আমানুল্লাহ ইতালিতে ছিলেন। তিনি সেখানেই আশ্রয় নেন। আফগানিস্তানে ব্রিটিশ চক্রান্ত সফল হয়। পরে অবশ্য এক আফগান সেনাপতি নাদির শাহ বাচ্চা-ই-সাক্কোকে বিতাড়িত করে কাবুলের সিংহাসন উদ্ধার করেন এবং নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন।
এ যুগে আমেরিকার আফগান নীতির সঙ্গে সে যুগের ব্রিটিশের আফগান নীতির একটা বড় মিল নিজেদের আধিপত্যবাদের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা এবং উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করা। এ যুগের পলিটিক্যাল ইসলামের স্রষ্টা আমেরিকা এবং এই পলিটিক্যাল ইসলামেরই রূপান্তর ইসলামিক টেরোরিজম। আফগানিস্তানে আধুনিক সমাজতন্ত্রী সরকার উৎখাত করে মৌলবাদী তালেবানি শাসন প্রবর্তন আমেরিকার এক সময়ের রণনীতি ও কূটনীতির সাফল্য। কিন্তু সে সাফল্য পরবর্তীকালে তার জন্য দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে।
আফগানিস্তানে তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠায় আমেরিকা, পাকিস্তান ও সৌদি আরব সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করলেও এই শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের লক্ষ্য অভিন্ন ছিল না। আমেরিকার লক্ষ্য ছিল, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে হটানো, নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ লুণ্ঠনে মার্কিন একক অধিকার স্থাপন। অন্যদিকে সৌদি আরবের লক্ষ্য ছিল, আফগানিস্তানে মধ্যযুগীয় কট্টর শরিয়া (ওহাবি) শাসন প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত এই ওহাবি শাসন পদ্ধতি সম্প্রসারণ। পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশ হারানোর পর আফগানিস্তানে তার ঔপনিবেশিক সীমানার বিস্তার।
আফগানিস্তান মুসলিম দেশ হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে তার মৈত্রী সম্পর্ক ছিল না। মৈত্রী সম্পর্ক ছিল ভারতের সঙ্গে। পাকিস্তানের মৌলবাদী জেনারেল জিয়াউল হকের ইচ্ছা ছিল একই সঙ্গে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সৌদি বাদশাহদের সাহায্যে ওহাবি শাসন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা দ্বারা কাবুলকে দিলি্লর প্রভাবমুক্ত করে ইসলামাবাদের প্রভাবের আওতায় আনা এবং কাশ্মীরে ভারতের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র জঙ্গিদের ব্যবহার করা।
এই তিন লক্ষ্যের মধ্যে যতদিন সমন্বয় ছিল ততদিন কাবুলে প্রতিষ্ঠিত তালেবান সরকারকে এই তিন দেশই সমানে সাহায্য ও সমর্থন জুগিয়েছে। তালেবানদের মধ্যযুগীয় বর্বরতা, নারী নির্যাতন, স্কুল-কলেজ বন্ধ করা, প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ও ভাস্কর্যগুলো ধ্বংস করা কোনো কিছুতেই তারা আপত্তি জানায়নি, বরং প্রশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু ওসামা বিন লাদেন ও তার সহমতাবলম্বীদের দ্বারা আল কায়দা প্রতিষ্ঠার পর এবং বিশেষ করে নিউইয়র্কে নাইন-ইলেভেনের ধ্বংসযজ্ঞের পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
ওসামা বিন লাদেন ধনী সৌদি নাগরিক। বুশ পরিবারের তেলের ব্যবসা, কনস্ট্রাকশন ব্যবসায়ের অংশীদার ছিল লাদেন পরিবার। ওসামা মনেপ্রাণে ছিলেন জিহাদিস্ট। সারাবিশ্বে ইসলামী শরিয়া শাসন প্রতিষ্ঠা তার লক্ষ্য ছিল কি-না জানি না, কিন্তু বিভিন্ন নামে প্রকাশিত আল কায়দার ইশতেহার, প্রচার পুস্তিকা ইত্যাদি পাঠ করে মনে হয়েছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যের সব মুসলিম দেশকে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করে খেলাফত ধরনের ইসলামী শাসনের আওতায় আনার লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। কমিউনিজমকে তারা নাস্তিকতাবাদ এবং ইসলামের দুশমন মনে করেন। সে জন্য আমেরিকার সহায়তায় আফগানিস্তানে সেক্যুলার সোশ্যালিস্ট সরকারকে উচ্ছেদের সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। ওসামাও আফগান যুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন।
ওসামা প্রথম আফগান যুদ্ধের পর নিউইয়র্কেই ঘাঁটি গেড়েছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, আফগানিস্তানে সোভিয়েত আধিপত্য উৎখাত দ্বারা মার্কিন স্বার্থ উদ্ধারে সহায়তাদানের পর ওয়াশিংটন ইসলামী জঙ্গিদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে, অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠায় বাধা দেবে না এবং ইসরায়েলকেও প্যালেস্টাইনি আরবদের অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করবে। আমেরিকা তা করেনি। বরং ইসরায়েলের বর্বর আন্দোলনে আরও সাহায্য জোগাতে থাকে এবং তাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সোভিয়েত আধিপত্য উৎখাত করে সেখানে একচ্ছত্র মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই ওয়াশিংটনের একমাত্র লক্ষ্য।
এই উপলব্ধি থেকেই আমেরিকাকে ইসলাম ও মুসলমানদের 'এক নম্বর শত্রু' হিসেবে চিহ্নিত করে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্ব ও আল কায়দা প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব। এক সময় যে ওসামা ছিলেন আমেরিকার পরম বন্ধু, তিনি হয়ে দাঁড়ালেন আমেরিকার চরম শত্রু। আমেরিকাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিদেশে বিভিন্ন মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা শুরু হয় এবং যার পরিণতি নিউইয়র্কে নাইন-ইলেভেনে বিশ্ব কাঁপানো হামলা। ওসামাকে ধরার জন্য আমেরিকা অভিযান শুরু করার পর ওসামা আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের আশ্রয় নেন।
তালেবান ও আল কায়দার মধ্যে লক্ষ্যের মিল আছে, লক্ষ্য অর্জনের পন্থায় মিল নেই। তালেবানদের জন্ম আমেরিকার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তারাও আল কায়দার মতো ওহাবি ডকট্রিনে বিশ্বাসী। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বা সৌদি রাজতন্ত্রের বিরোধিতা দ্বারা তারা এই লক্ষ্য অর্জন করতে চায় না। তারা চায় ওয়াশিংটন ও রিয়াদের (এবং ইসলামাবাদের) সাহায্য-সহযোগিতায় তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা ও তার স্থায়িত্ব রক্ষা। তাই কাবুলে তারা দীর্ঘকাল ওয়াশিংটন-রিয়াদ ও ইসলামাবাদের প্রটেকশনেই রাজত্ব চালিয়েছে।
ওসামাকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দেওয়ার পর তালেবান সরকার বিপদে পড়ে। তাকে গ্রেফতার করে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বারবার অনুরুদ্ধ হয়েও কাবুলের তালেবান সরকার রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমেরিকা তার পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে ওয়ার অন টেরোরিজমের নামে তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে এবং কাবুলে তাদের সরকারের উচ্ছেদ ঘটায়। কারজাই নামে এক চরম দুর্নীতিবাজকে (বাচ্চা-ই-সাক্কোর সগোত্র) প্রেসিডেন্ট পদে বসায়, যার কর্তৃত্ব কাবুলের বাইরে কোথাও বিস্তৃত নয়।
তালেবানদের মধ্যে নরমপন্থি ও চরমপন্থি দুই গ্রুপই আছে। তবে তারা আল কায়দার মতো চরম পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বা মার্কিনবিরোধী নয়। কিন্তু বলদর্পী আমেরিকার বর্বর হামলার মুখে তালেবান ও আল কায়দা মিলেমিশে যায় এবং শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধ; যে যুদ্ধে আমেরিকা এখন আর চূড়ান্ত জয়লাভের আশা করে না। আফগানিস্তানের এই যুদ্ধ এখন পাকিস্তানেও সম্প্রসারিত হয়েছে এবং তালেবানদের মিত্র ও পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে এই তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে বাধ্য করায়, বিশেষ করে পাকিস্তানের মাটিতেই আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানকে না জানিয়ে হত্যা করায় আজ আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
আমেরিকা জানে, যতদিন আল কায়দা ও তালেবান মিলিত শক্তি হিসেবে লড়বে, ততদিন তার কিংবা ন্যাটোর যুদ্ধজয়ের কোনো আশা নেই। ফলে দীর্ঘদিন ধরে তারা চেষ্টা করেছে, আল কায়দা ও তালেবানদের মধ্যে একটা বিরোধ বাধাতে। এখন ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর তারা আশা করছেন, নেতৃত্বহীন আল কায়দা কিছুটা হলেও শক্তিহীন হয়েছে এবং তালেবানরাও আল কায়দার চাপমুক্ত হয়ে আমেরিকার সঙ্গে আপসে আগ্রহী হবে। এই আশা ফলবতী হবে কি-না সেটা পরের কথা।
এই কৌশল আমেরিকা ও ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সমস্যা সমাধানের ব্যাপারেও প্রয়োগ করেছিল। হামাস ও আল ফাতাহর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে ফাতাহর নরমপন্থিদের সঙ্গে আপস দ্বারা হামাসকে টেরোরিস্ট আখ্যা দিয়ে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ কৌশল সফল হয়নি। ইতিপূর্বে ফাতাহর আপসপন্থি নেতৃত্ব ইসরায়েলকে বহু ছাড় দিয়ে আপস করেও দেখেছে এই দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রটি কোনো ধরনের আপস ও চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করে না। তাই ফাতাহর বদলে হামাস প্যালেস্টাইনি জনগণের মধ্যে এখন অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং ভবিষ্যতে প্যালেস্টাইন সমস্যার প্রকৃত সমাধান চাইলে ইসরায়েল ও আমেরিকাকে শান্তি আলোচনায় হামাসকেও ডেকে আনতে হবে, যার সূচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে।
আফগান যুদ্ধেরও অবসান হবে, যদি আমেরিকা সময় থাকতে আল কায়দা ও তালেবানদের শর্ত মেনে আফগান ভূমি ত্যাগে সম্মত হয়ে শান্তি আলোচনায় বসে। আফগানিস্তানে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা পাবে কি-না সেটা পরের প্রশ্ন। এখনকার প্রশ্ন, আফগানিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত থাবা থেকে মুক্ত হবে কি-না! আমেরিকা যদি এখনই তার নিজের ইচ্ছায় এই অবিশ্বাস্য অর্থক্ষয় ও রক্তক্ষয়ের যুদ্ধ থেকে সরে না যায়, তাহলে তার বর্তমান অর্থনৈতিক ধসই আরও বিপুলাকার ধারণ করে তাকে সরে যেতে বাধ্য করবে। ওবামা প্রশাসন আফগান যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে লিবিয়া যুদ্ধে আর সরাসরি জড়িত হয়নি। আফগান যুদ্ধেও এই সুবুদ্ধি এখন দেখাতে না পারলে আরেকটি ভিয়েতনামি নাক ডলা খাওয়া তাদের জন্য অপেক্ষা করবে।
লন্ডন, ২৯ জুলাই, শুক্রবার, ২০১১
 

No comments

Powered by Blogger.