গুম-অপহরণ-প্রতিকারের দায় কার? by আবু সাঈদ খান

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ঘটনার এখনও সুরাহা হলো না। দুই মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা গেল, পুলিশের তদন্তের ফল শূন্য। ৫ এপ্রিল আশুলিয়ার শ্রমিক নেতা আমিনুলের লাশ পাওয়া গেল। এ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন তৎপরতা দেখা গেল না।


সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তার খুনের ঘটনার অগ্রগতি শুনছি না, বরং দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত উক্তিই শুনতে হচ্ছে। মন্ত্রীদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে_ এমন কিছু ঘটনা ঘটতেই পারে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর রুনি সম্পর্কে রসাত্মক গল্প ফাঁদা শুরু হয়েছিল, যা সংবাদকর্মীদের প্রতিবাদের মুখে বন্ধ হয়েছে। ইলিয়াস আলীর অতীত নিয়ে কথোপকথন শুরু হয়েছে। দৃষ্টি অন্যদিকে না ফেরানোর চেষ্টা করে তাকে উদ্ধার করাই সরকারের কর্তব্য। কিন্তু সরকার যেন সাংবিধানিক কর্তব্য বিষয়ে উদাসীন!



যেসব সামাজিক উপসর্গ দেখা দিলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বলে বিবেচিত হয়, তা সাধারণত সমাজের ক্ষমতাবানদের স্পর্শ করতে পারে না। যেমন চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি ও খুনের মতো ঘটনার প্রভাব জনজীবনে পড়ে। যাদের অরক্ষিত অবস্থায় পথ চলতে হয় এবং বসবাসের ঘরটিও যাদের সুরক্ষিত নয়, তারা স্বাভাবিক কারণেই আতঙ্কিত বোধ করেন। তবে এতে ক্ষমতাবানদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় ক্ষমতাবানরাও আতঙ্কিত।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড, রাজধানীর অভিজাত এলাকায় সৌদি কর্মকর্তা খুন এবং বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর অপহরণের ঘটনা কেবল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সিনড্রোম নয়, রাজনৈতিক দুর্যোগেরও লক্ষণ। এসব ঘটনায় রাজনীতিকরা তো বটেই, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ীসহ বিশিষ্টজনরাও খুবই উদ্বিগ্ন।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর টিভি চ্যানেলের টক শোতে বিএনপির এক নেতা বললেন, 'এখানে আসতে আমার ছেলেমেয়ে বাধা দিয়েছিল। আমি না শোনায় ওরা বলেছে, সাবধানে যেন কথা বলি।' বিএনপির নেতাদের একা পথ চলতে বারণ করা হয়েছে। যুক্তির খাতিরে ধরে নেওয়া যায়, এসব বিরোধী দলের চালবাজি। কিন্তু মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন যখন বলেন, রাজনীতিক হিসেবে তিনিও নিরাপত্তা বোধ করেন না, তখন কী ভাবব? গত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর শাহজাহানপুর থানার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের উপস্থিতিতে মেনন বলেছেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে গুম-অপহরণের মতো ঘটনা অপরাধ জগতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিকও গুম হচ্ছেন। রাজনীতিক হিসেবে আমিও নিরাপদবোধ করি না।' মহাজোটের অন্য শরিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বলেছেন, ঘরে থাকলে খুন, রাস্তায় বেরোলে গুম।
রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের পথ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সংবাদকর্মী হিসেবে দিনাতিপাত করার পরও আমাকে স্বজন-বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীরা সাক্ষাৎ বা ফোন, ই-মেইলে পরামর্শ দেন_ সভা-সেমিনার বা টক শোতে যেন সতর্ক হয়ে কথা বলি। অর্থাৎ সত্য কথনে সমূহ বিপদ। সত্য কথার জন্যই অনেক সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যও আতঙ্কে আছেন।
এ জনপদে সন্ত্রাস কোনো নতুন ঘটনা নয়। বলা হয়ে থাকে_ দারিদ্র্য-বেকারত্বের কারণে, অভিভাবকত্বের অভাবে যুবকরা সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়। কথাটি খানিকটা সত্য। তবে এর চেয়ে বেশি সত্য, ভোগবাদী সংস্কৃতির অশুভ প্রভাবে অধিকমাত্রায় সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটছে। ঠিকাদার, স্মাগলার, অবৈধ ব্যবসায়ী, বিপথগামী রাজনীতিকদের কোলে-কাঁখে সন্ত্রাসীরা লালিত-পালিত হচ্ছে। সন্ত্রাসের আরেক অধ্যায় দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে দলীয়ভাবে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভয়ানক, যখন খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২৭ মাস ১৯ দিনে ১০০ ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অপহরণের শিকার হয়েছেন। এই ১০০ জনের মধ্যে ২১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৩ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি ৭৬ জনের কোনো খোঁজ নেই (সূত্র : প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল, ২০১২)। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে_ তুরাগ নদের তীরে, কেরানীগঞ্জ, ঢাকার আশপাশে ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেছে। দু'চারটি লাশের পরিচয় মিললেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লাশ হওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় অজ্ঞাত_ এসব ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নির্লিপ্ত।
একদিনে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। একের পর এক ঘটনাগুলো মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধের অভাবকে তীব্র করেছে। যুবলীগ নেতা লিয়াকত, বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ অনেক গুমের ঘটনা চাপা পড়ে গেছে। সেসব ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হলে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিলে অবস্থার উন্নতি ঘটত। এ ক্ষেত্রে সরকার-প্রশাসনের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা পীড়াদায়ক। শুধু তা-ই নয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের শাস্তি হয় না, বরং প্রমোশন হয়। দলীয় বিবেচনায় খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্তদের ছেড়ে দেওয়া হয় এবং হচ্ছে। এসব 'ক্ষমার মহিমায়' সন্ত্রাসী চক্র উৎসাহিত হচ্ছে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ঘটনার এখনও সুরাহা হলো না। দুই মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা গেল, পুলিশের তদন্তের ফল শূন্য। ৫ এপ্রিল আশুলিয়ার শ্রমিক নেতা আমিনুলের লাশ পাওয়া গেল। এ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন তৎপরতা দেখা গেল না। সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তার খুনের ঘটনার অগ্রগতি শুনছি না, বরং দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত উক্তিই শুনতে হচ্ছে। মন্ত্রীদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে_ এমন কিছু ঘটনা ঘটতেই পারে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর রুনি সম্পর্কে রসাত্মক গল্প ফাঁদা শুরু হয়েছিল, যা সংবাদকর্মীদের প্রতিবাদের মুখে বন্ধ হয়েছে। ইলিয়াস আলীর অতীত নিয়ে কথোপকথন শুরু হয়েছে। দৃষ্টি অন্যদিকে না ফেরানোর চেষ্টা করে তাকে উদ্ধার করাই সরকারের কর্তব্য। কিন্তু সরকার যেন সাংবিধানিক কর্তব্য বিষয়ে উদাসীন! সাগর-রুনি বা ইলিয়াসের চরিত্র নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কৌতূহল থাকলেও ৭০ লাখ টাকার অর্থ কেলেঙ্কারির হোতাদের প্রশ্নে অনেকেই নীরব। বরং দুর্নীতির কালো বিড়ালকে ধোলাই করে সাদা করার প্রয়াসই লক্ষণীয়।
পেছনে ফিরে যেতে চাই। ২০০১ সালে বিএনপি শাসনামলে 'অপারেশন ক্লিনহার্টের' নামে অর্ধশত লোকের মৃত্যু ঘটে। তখন এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিটিকে বলা হতো হৃদরোগে মৃত্যু। এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। র‌্যাব গঠনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল আওয়ামী লীগসহ অনেকেই। কিন্তু এখনও র‌্যাবের সদস্যদের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। এ ছাড়া পুলিশের হাতে এবং হেফাজতেও মৃত্যুর ঘটনার নজির রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে এখন কৌশল বদলানো হয়েছে। আগে 'ক্রসফায়ার' বলা হতো, এখন নাগরিকদের তুলে নিয়ে গুম করা হচ্ছে। এ উক্তি পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট।
গুমের পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সম্পত্তিজনিত বিষয়াদিও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এসবের প্রমাণ মিলেছে। তবে সন্দেহের তীর যখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিকে উত্তোলিত হয়, তখন তা খতিয়ে দেখা জরুরি। সে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে তদন্তের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কেবল নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমেই আসল রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। আর সেদিকে মনোনিবেশ না করলে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, আইনের শাসন হবে সুদূরপরাহত।
অভিযোগ কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, বিভিন্ন দেশে বিচারবহির্ভূতভাবে সন্ত্রাস দমনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে, সন্ত্রাসীদের হাত থেকে জনগণের জানমাল রক্ষার জন্যই তা করা হয়। এর পেছনে সৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে, কিন্তু এটি আখেরে ভালো নয়। কোনো সন্ত্রাসীর মৃত্যু ঘটলে জনসমর্থন মিলতে পারে, বাহবা পাওয়া যেতে পারে, তবে তা সাময়িক। এ ক্ষেত্রে আমরা বিস্মৃত হতে পারি না যে, কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না আর তা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এখানে সবকিছুই দলীয়করণ হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দলীয় প্রভাবের বাইরে থাকতে পারে না। এটি বিপজ্জনক। এখন জননিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই গুম সংস্কৃতি। অনেক ক্ষেত্রে কোনো চিহ্ন রাখা হয় না, কোনো ক্লু খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তদন্ত প্রক্রিয়া এখন এতই বিজ্ঞানভিত্তিক যে, অনেক গোপন তথ্যও বের করে আনা সম্ভব। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার সেই দক্ষতা আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা এবং প্রশাসনের পেশাগত অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ। সেটি না থাকলে এ দক্ষতার অপব্যবহার হতে বাধ্য।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা যারাই ঘটাক, সরকার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। ধামাচাপা দিতে পারে না নিখোঁজ হওয়ার অন্যান্য ঘটনা। গুম ও অপহৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার বা সত্য উদ্ঘাটন সরকারের সাংবিধানিক কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের কর্তব্য হচ্ছে সহযোগিতা করা; হীন রাজনৈতিক স্বার্থে কোনো ঘটনা ব্যবহারের প্রবণতাও সমর্থনযোগ্য নয়।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.