জাবিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ জরুরি by সুস্মিতা চক্রবর্তী

জাবিতে শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবিসহ ভিসিবিরোধী আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এরই মধ্যে সেখানে এ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ভিসির মদদপুষ্ট ছাত্ররা ন্যক্কারজনকভাবে হামলা চালিয়েছে। নানা ধরনের অপতৎপরতা সেখানে চলছে বোঝাই যায়।


এত কিছুর পরও এখানকার শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য আন্দোলন থেকে পিছপা হননি। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়েছেন এখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা; শামিল হয়েছেন জাবির প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরাও। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসী জাবির ঘটনা জানতে পারছে। যে ভিসির উপস্থিতি আর প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতার দাপটে তার ক্যাম্পাসের শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরা অন্যায়ভাবে হামলার শিকার হন, সেই ভিসির স্বপদে টিকে থাকার ন্যায্যতা সাধারণভাবেই হারায়। এটা বোঝার জন্য খুব বেশি রাজনীতি বুঝতে হয় না; কিন্তু এত কিছু করেও যিনি ক্ষমতাকে নির্লজ্জভাবে আঁকড়ে ধরে থাকেন, বুঝতে হবে এর পেছনে নিশ্চয়ই দেশের ওপর মহলের ক্ষমতা-রাজনীতির সায় রয়েছে।
আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছি_ তারা সবাই জানি, এখানে কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আন্দোলন চালানোর কাজটি খুব সহজ নয়। প্রতিনিয়ত নানা ধরনের চাপ আর নিপীড়নের ঝুঁকি নিয়ে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়; কিন্তু বিদ্যমান ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও যে জাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দুর্বার আন্দোলন করে যাচ্ছেন_ তা এদেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঘুমন্ত নীতিবোধকে জাগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে মনে করি।
এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের দলীয় ক্ষমতাবৃত্তির রাজনীতি বহাল রয়েছে তা আমাদের কারও অজানা নয়। ক্ষমতার মদদে মত্ত হয়ে এখানে নানা ধরনের অন্যায়-দুর্নীতি চালান এখানকার কর্তৃপক্ষরা। যিনি যখন সে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন, নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় কৃপাপুষ্ট হয়ে তিনি আর তার প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রেই যাবতীয় নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করার চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে চলেন। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, রাবিতে গত বছর নাট্যকলা আর সঙ্গীত বিভাগের সব শিক্ষক তাদের বিভাগীয় চেয়ারপারসনের অপসারণের দাবিতে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিলেন। তাদের আন্দোলনের চারদিনের মাথায় ওই বিভাগের চেয়ারপারসন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন; কিন্তু ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। পরবর্তী সময়ে এখানকার আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রাবি কর্তৃপক্ষ দু'দফা তদন্ত কমিটি করেন; শিক্ষকদের ওপর নানা ধরনের মানসিক চাপ বহাল রাখেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষকরা এই সব 'মহান' 'তদন্ত কমিটির' রিপোর্ট সম্ব্বন্ধে তেমন কিছুই খোলাসা করে জানতে পারেন না। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, সে আন্দোলনে যারা নবীন শিক্ষক হিসেবে তাদের শিক্ষকদের আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন তারা তিনজনই অন্যায় আর অমানবিকভাবে তাদের চাকরি হারান। রাবি কর্তৃপক্ষ সুযোগমতো এই তিন শিক্ষকের 'অ্যাডহক নিয়োগ' বাতিল করেন স্রেফ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার শাস্তিস্বরূপ। ভবিষ্যতে অন্যায়ের বিরুদ্ধ যেন তরুণ শিক্ষকরা ন্যায্য কারণে আন্দোলনে নামতে না পারেন তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এহেন নজিরবিহীন শাস্তির ব্যবস্থা প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়। আরও দুঃখজনক ঘটনা হলো, যে আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্য রাবির তিন তরুণ শিক্ষক একতরফাভাবে কর্তৃপক্ষের দেওয়া শাস্তি আর নিপীড়ন ভোগ করলেন সেই আন্দোলনকারী রাবির নাট্যকলা আর সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষকরা পরবর্তী সময়ে নিপীড়িত শিক্ষকদের পক্ষে আর কোনো আন্দোলনে নামলেন না! এভাবে একটি ন্যায্য আন্দোলনকে রাবি কর্তৃপক্ষ প্রায় নিঃশেষ করে ফেলতে সমর্থ হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান গড়পড়তা রাজনীতির মধ্যে বসবাসকারী অনেকেই সাধারণভাবে এ ধরনের আন্দোলনগুলোকে স্রেফ বিএনপি আর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবে দেখতে আর দেখাতে অভ্যস্ত থাকেন। ফলে ন্যায্য দাবিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা রঙে বিভাজিত শিক্ষকরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একত্র হয়ে খুব বেশি মাঠে নামেন না। আওয়ামী লীগ প্রভাবিত শিক্ষকরা আওয়ামী প্রশাসনে কোনো দুর্নীতি হলে তারা সাধারণত মুখ খোলেন না_ তা যত ন্যায্যই হোক না কেন। অন্য পক্ষের রাজনৈতিক কৌশলও অনুরূপভাবেই জারি থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক পরিচয়ের ঊধর্ে্ব স্থান পায় অন্ধ দলীয় মনোবৃত্তি। সেদিক থেকে জাবিতে বিদ্যমান আন্দোলনকারীদের দৃঢ়তা হয়তো সামনের দিনে এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্দোলনে অন্যরকম মাত্রা নিয়ে আসবে।
জাবির বর্তমান পরিস্থিতি নিরসনে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ জরুরি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাবিতে আরও সহিংস ঘটনা ঘটে যেতে পারে, যার দায়ভার শেষ পর্যন্ত বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালকদের ওপর গিয়ে বর্তাবে। '৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব হচ্ছে চ্যান্সেলর তথা রাষ্ট্রপতির। ফলে জাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিদ্যমান আন্দোলনের প্রতি ন্যায্য সম্মান দেখানোর মধ্য দিয়ে সেখানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার নৈতিক দায়দায়িত্ব মাননীয় চ্যন্সেলরেরও।
স সুস্মিতা চক্রবর্তী : সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.