বুড়ো ভোলানো ছড়া by শহিদুল ইসলাম

এক. 'ছেলে ভোলানো ছড়ায়' শিশুরা ভোলে, আর 'বুড়ো ভোলানো ছড়ায়' আমরা বুড়োরা ভুলি। গত আমেরিকার নির্বাচনে 'গণতান্ত্রিক দলের' প্রার্থী ওবামার কালো রং নামের সঙ্গে 'হোসেন' শব্দটির সম্পৃক্ততা এবং তাঁর 'যুদ্ধবিরোধী' প্রচারণায় আমরা বুড়োরা ভুলেছিলাম।


আজকের ওবামার যুদ্ধংদেহী চেহারা আমাদের শুধু হতাশই করেনি, লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। শিশুদের থেকে আমাদের পার্থক্য কোথায়? আমেরিকার দীর্ঘদিনের ইতিহাস আমাদের সামনে থাকা সত্ত্বেও আমরা বুঝি না, আমেরিকার 'গণতান্ত্রিক' ও 'রিপাবলিকান' দলের মধ্যে আদর্শগত কোনো পার্থক্য নেই। বিশেষ করে অন্যের দেশ দখল, অন্য দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে। তেমনি আমরা ক্লুজনারের '২০২৫ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী', ড. মুহাম্মদ ইউনূসের '২০২৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর ঘোষণা' এবং জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) ঘোষণায় বিশ্বাস স্থাপন করে বসে আছি। ড. ইউনূস তাঁর এই মহান উদ্দেশ্যের জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, আর ক্লুজনার ২০০৮ সালে ওই বইখানা লিখে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। প্রায় একই উদ্দেশ্য নিয়ে ক্লুজনার ও ইউনূস বই দুখানা লেখেন। ক্লুজনারের বইটা পড়ার সৌভাগ্য হলেও ইউনূসের বইটা ঢাকায় আমার পড়ার টেবিলে পড়ে আছে। তেমনভাবে পড়া হয়নি। চোখ বুলিয়ে এসেছি। দুজনার বইয়ের নামের মধ্যে যেমন কোনো পার্থক্য নেই, ভেতরেও তেমন আলাদা কোনো বক্তব্য চোখে পড়েনি। অর্থনীতিবিদ না হয়েও এটুকু বলতে পারি, বই দুইটিতে কোনো নতুন তত্ত্ব খুঁজে পাইনি। দুজনেই যেন 'কী বলবেন' আগে থেকেই তা ঠিক করে নিয়েই বই দুটি লিখতে বসেছিলেন। ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে এমডিজির অর্ধেক সাফল্য লাভ করা যাবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে তা পূর্ণতা পাবে। ২০২৫ সালের পর অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও পৃথিবীতে কোথাও অভুক্ত ও অপুষ্টিজনিত মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে না। দারিদ্র্যকে অতি যত্নসহকারে জাদুঘরে রেখে দেওয়া হবে। দারিদ্র্য কী তা জানতে চাইলে আমাদের জাদুঘরে যেতে হবে। পৃথিবী তখন কী সুন্দর হয়ে উঠবে! আমরা কি তা দেখে যেতে পারব?
দুই. গত ৪ এপ্রিল সোমবার বাংলাদেশের প্রায় সব কাগজে প্রকাশিত একটি খবরে চোখ পড়তেই আমার সব আশা-আকাঙ্ক্ষা মুখ থুবড়ে পড়ল। মনে হলো, আমরা আবারও 'বুড়ো ভোলানো ছড়ায়' ভুলেছিলাম। জানলাম, জাতিসংঘ হুঁশিয়ারি দিয়েছে এই বলে যে এশিয়ায় বিগত এক বছরে দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে দুই কোটি মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। গত শুক্রবার ১ এপ্রিল ২০১১, জাতিসংঘের এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক কমিশন (ইসকেপ) এক গবেষণায় এ তথ্য প্রকাশ করেছে। ইসকেপের নির্বাহী পরিচালক নেলিন হাজরি বলেছেন, "খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে ভারত, বাংলাদেশ, লাওস ও নেপালে আগামী পাঁচ বছরে দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে 'এমডিজি' অনেকটা পিছিয়ে পড়বে।" প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অধিক খাদ্যমূল্য এশিয়া অঞ্চলে মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণ। জ্বালানির দাম বাড়াতে ভবিষ্যতে আরো এক কোটি চার লাখ মানুষ অতিরিক্ত দুর্ভোগে পড়বে। জনকণ্ঠ বাংলাদেশের টিসিবির একটি হিসাবও তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে যে গত এক বছরে চাল ১৯ শতাংশ, আটা ১৬ শতাংশ, সয়াবিন ৪৬ শতাংশ, ডিম সাড়ে ৭ শতাংশ, পামতেল ৫১ শতাংশ, পেঁয়াজ সাড়ে ১২ শতাংশ, রসুন ২০ শতাংশ ও চিনির দাম ১৯ শতাংশ বেড়েছে। মধ্যবিত্তের আয়ের ৬৫ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে খাদ্যের পেছনে। ক্লুজনার ও ড. ইউনূসের মতো খাদ্যমন্ত্রীও আমাদের অভয়বাণী শুনিয়েছেন, '২০১২ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে তাঁর সরকার কাজ করে চলেছে। তাঁর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিই, আর মাত্র আট মাস পর আমরা ২০১২ সালে পা দেব।
তিন. তেমনি জাতিসংঘের এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক কমিশনের (ইসকেপ) নির্বাহী পরিচালক নেলিন হাজরিও বলেননি যে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা কোনো দিনই অর্জিত হওয়ার নয়। তিনি বলেছেন, এমডিজি 'অনেকটা' পিছিয়ে পড়বে। অনেকটা কত দিন বা কত বছর তারও উল্লেখ করেননি। বুড়োদের এখনো ভুলিয়ে রাখার একটা চেষ্টা করেছেন। না করে তাঁর কোনো উপায় নেই। সত্যি কথা বলে অমনি মূল্যবান একটি চাকরি হারানোর 'রিস্ক' কজন নিতে পারে? নয়া সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির এ রকম কেনা বিশেষজ্ঞ পৃথিবী ছেয়ে গেছে। তাঁদের গবেষণার ফলাফল সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়ায় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বিকল্প ধারার ক্ষীণকণ্ঠ মিডিয়ায় জায়গা পায় না। ওই সব বিপণনযোগ্য পণ্যগবেষক বা বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ হয়, আর ঢেকে রাখার কোনো উপায় থাকে না, তখন মিথ্যার সঙ্গে একটু সত্য মিশিয়ে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়। যখন তা-ও ব্যর্থ হয়, তখন বেচারা 'প্রকৃতি' আছে। বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামি, খরা, জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। যেন এমডিজির সাফল্যের জন্য কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সৃষ্টিকর্তা সে চুক্তি ভঙ্গ করায় এমডিজি বা দারিদ্র্য নিরসনের সময় অনেকটা পিছিয়ে গেল। সত্যি সৃষ্টিকর্তার এই বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেওয়া যায় না। ক্লুজনার-ইউনূস ও এমডিজির এই ব্যর্থতা যে মানবসৃষ্ট 'নিয়তির' সঙ্গে বাঁধা, সে কথা কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে একবারও উচ্চারিত হয় না। অর্থনীতির কথা একবারও তাঁদের মুখ থেকে বের হয় না। পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতির এটাই যে পরিণতি, সে কথা তাঁরা সবাই আমাদের ভুলিয়ে দিতে চান। 'বুড়ো ভোলানো ছড়া' দিয়ে। এই অর্থনীতিতে এটাই হয়ে চলেছে_ভবিষ্যতে আরো গতিপ্রাপ্ত হয়ে আরো বেশি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দেবে। এমডিজির প্রবক্তা হলেন ক্লুজনার। নিজেকে মস্তবড় একটি পণ্যে পরিণত করেছেন। তাঁর প্রভুরাই আজকের জাতিসংঘের মালিক। তাই তাঁর সে এমডিজি জাতিসংঘে গৃহীত হয়। পৃথিবীর ১৯২টি সদস্যের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা হাততালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। 'যুদ্ধবিরোধী' ওবামা লিবিয়া আক্রমণের আগে জাতিসংঘের মহাসচিবের ভূমিকা কী হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। মহাসচিব সেভাবেই কথা বলছেন, কাজ করছেন। ওবামার চেহারা বিশ্ববাসীর কাছে আজ স্পষ্ট। এমডিজির অর্ধেকটা বাস্তবায়নের দিন (২০১৫) যত ঘনিয়ে আসছে, ততই তা নিয়ে আমাদের মধ্যে সন্দেহের দানা বুনতে শুরু করেছে করপোরেটতন্ত্র। 'গণতান্ত্রিক' ওবামা যেন 'প্রজাতান্ত্রিক' বুশের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে বিন্দুমাত্র বিব্রত বোধ করছেন না, তেমনি আর কয়েক দিন পর বিপণনযোগ্য গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করবেন, এমডিজি অর্জন সম্ভব নয়। এ কথাটা বলতে আরো কয়েক শ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে নয়া সাম্রাজ্যবাদের। হয়তো আবার কোনো নতুন অর্থনীতিবিদের আবির্ভাব ঘটবে। গলায় তাঁর নোবেল পুরস্কারের প্রতীক উঠবে। মিল্টন ফ্রিডম্যান ক্লুজনার, ইউনূস সাহেবদের অভাব পৃথিবীতে কখনো হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। এদের সংখ্যা যত বাড়বে, পৃথিবীতে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও ততই বাড়বে। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ (২০০ কোটি) আজ দারিদ্র্য, অনাহার ও অপুষ্টির শিকার। বর্তমান অর্থনীতি যদি এভাবেই চলতে থাকে, তবে ২০২৫ সালে এ সংখ্যা দুই ভাগের এক ভাগে (৩০০) কোটিতে পেঁৗছে যাবে। কারোই সাধ্য হবে না সবার মুখে অন্ন তুলে দিতে।
পার্থ, অস্ট্রেলিয়া, ৭ এপ্রিল ২০১১
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.