সরবরাহকারী ঋণ বাংলাদেশের জন্য গলার ফাঁস by আবুল কাসেম হায়দার
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক প্রভৃতি সংস্থা অনুন্নত দেশে বা উন্নয়নগামী দেশে ঋণ দেওয়ার জন্য সব সময় সক্রিয় থাকে। এসব সংস্থা দরিদ্র দেশগুলোতে ঋণের নামে শোষকের ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকারের অর্থনৈতিক নানাবিধ সমস্যা সামনে রেখে ঋণ প্রদানের জন্য নানা কৌশল করে।
অনুন্নত দেশগুলো বাধ্য হয়ে নিজের অর্থনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে নানাবিধ অসম ও কঠিন শর্তের ভিত্তিতে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সরকার উচ্চ সুদ ও কঠিন শর্তে বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সরকারের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি হওয়ার কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের চাপের পরিপ্রেক্ষিতে কঠিন শর্তে অধিক সুদে সরবরাহকারী ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে ৭১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকার মূলে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট নেওয়ার জন্য সরকার ৪৫টি প্রকল্প যাচাই-বাছাই করেছে। একদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমেছে, অন্যদিকে আমদানি-ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার আইএমএফ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের অবস্থা মোটেই ভালো না। অন্যদিকে বরাদ্দের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত চার মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত বরাদ্দের চাহিদা তৈরি হয়েছে, যা ১৯ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা।
এসব সরবরাহকারী ঋণকে সাধারণত কঠিন শর্তের ঋণ বলা হয়। এর একদিকে থাকে সুদের হার অত্যধিক, অন্যদিকে পরিশোধের সময় থাকে অত্যন্ত কম। তা ছাড়া প্রদানকারীর কাছ থেকে সব রকমের পণ্য প্রদত্ত মূল্যে ক্রয় করতে হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল ভিত্তির ওপর বলে এই সরবরাহকারী দেশগুলো ঋণ দিতে বেশ আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হলো বিগত জোট সরকার ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত এসব সরবরাহকারী ঋণ বা সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ এবং ঋণ গ্রহণ করেছিল, তখন বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তীব্র বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার ঠিক ওইসব সরবরাহকারী ঋণ আরো কঠিন শর্তে গ্রহণ শুরু করেছে। পরিকল্পনা কমিশন প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ তথ্য পাওয়া গেছে যে চলতি অর্থবছর শুরুর আগে থেকে যেসব প্রকল্পের এডিপিতে বরাদ্দ ছিল, তার সঙ্গে আরো পাঁচ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত চাহিদা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই ধরনের প্রকল্প রয়েছে ৯১৬টি। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১১৯টি নতুন অনুমোদিত প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত অর্থের যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, তাতে চলতি অর্থবছরে এডিপি বরাদ্দের বাইরে আরো ছয় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে। তা ছাড়া এসব প্রকল্পের বেশির ভাগ হলো থোক বরাদ্দের। বিগত নভেম্বর ২০১০ থেকে আগামী জুন ২০১১ যে প্রকল্পগুলো অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে, সেগুলোর জন্য নির্ধারিত ব্যয়ের অতিরিক্ত আরো প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এ ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ২৩৮টি। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ বিরাট অঙ্কের বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় ও অর্থায়নের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত অর্থায়ন ঘাটতির কারণে বেশির ভাগ প্রকল্প অর্ধ সম্পন্ন বা আংশিক সম্পন্ন থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পরবর্তী সময়ে এ প্রকল্পের ব্যয় বা সময় দুটিই বৃদ্ধি পাবে। গুণগতমান কোনোক্রমেই রক্ষা করা সম্ভব হবে না। বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এদিকে এডিপি ফান্ড বাস্তবায়নের অবস্থা ও বিগত ব্যয়গুলোতে কোনো ভালো লক্ষণ দেখা যায়নি। অন্য উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যেও বেশ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ১৪ শতাংশ কাজেই দেখা যায়, অনেক প্রকল্পের অর্ধেক বা আংশিক অর্থ দেওয়া হচ্ছে। ফলে সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দেখা যাচ্ছে, যা অর্থ বরাদ্দ ছিল তার চেয়ে অধিক চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। যেমন_শিক্ষা খাতে ৪৯২ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ছিল, সেখানে আরো ৭১২ কোটি টাকা নতুন চাহিদার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে বরাদ্দ বেড়ে ৭৫ কোটি, স্বাস্থ্য খাতে ৬৫ কোটি, শ্রম ও কর্মসংস্থান খাতে ২৭৮ কোটি, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ খাতে ১৮৮ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা খাতের চাহিদা অনেকটা যুক্তিসংগত ও বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। কারণ আগে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল।
আইএমএফের ঋণ ও শর্ত : আইএমএফ সব সময় তার ঋণ দেওয়ার জন্য নতুন নতুন শর্ত আরোপ করে। বেশ কিছুদিন আগে আইএমএফ লিখিতভাবে সরকারের কাছে বেশ কিছু কঠিন শর্তযুক্ত ঋণ প্রস্তাব প্রেরণ করেছে। এসব শর্ত পূরণে বাংলাদেশ সরকার রাজি হলে আগামী জানুয়ারিতে আইএমএফের বোর্ড সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে এবং বোর্ড সভায় এ ঋণ পাস হলে ২০১১ সালের জুন মাসে আইএমএফের প্রথম কিস্তির টাকা বাংলাদেশ পাবে। আইএমএফ এই ঋণ দেবে সাতটি কিস্তিতে। আইএমএফের শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৮-২০০৯ ও ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের সমন্বয়কৃত আর্থিক হিসাব-নিকাশ। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের জাতীয় সংশোধিত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক কর্মসূচি ব্যয়ের অগ্রাধিকার নির্ধারিত এবং এ খাতে প্রকল্প খরচ তদারকি করা ও নতুন ভ্যাট এবং আয়কর আইনের প্রাথমিক খসড়া চূড়ান্ত করা। ঋণ কর্মসূচির প্রথম বছরে জাতীয় সংসদে নতুন কর ও ভ্যাট এবং আয়কর আইন পাসের জন্য উত্থাপন করতে হবে। কর্মসূচির প্রথম ও দ্বিতীয় বছরে এ দুটি আইন কার্যকর করতে হবে। করনীতি ও কর প্রশাসনের কার্যক্রম আলাদা করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পরিষ্কারভাবে উপস্থাপনের জন্য একটি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বিপিসি, বিসিআইসি ও পিডিবির জন্য একটি মনিটরিং কাঠামো তৈরি করতে হবে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ২০০১-২০০৫ সালে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৭৫ হাজার কোটি টাকা সরবরাহকারী ঋণ নেওয়া হয়। তখন আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দলে এবং এই ঋণ গ্রহণে দারুণভাবে বিরোধিতা করেছিল। মজার ব্যাপার এই, আওয়ামী লীগ সরকার তথা মহাজোট সরকার সরবরাহকারী ঋণ নেওয়ার সব বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করেছে। ইতিমধ্যে সরকার ৪৫টি অগ্রাধিকার প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ৭১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করে।
সরবরাহকারী ঋণপ্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের কাছে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রেরণ করেছে। আর এ ঋণের পরিমাণ হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনের জন্য বিদেশি ঋণের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া সহজ ছিল বলে সরবরাহকারী ঋণ নিতে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার পরও এই সরবরাহকারী ঋণ নেওয়া কমেনি। বাংলাদেশ অধিকাংশ সময় পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ হারে সরবরাহকারী ঋণ নিয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যে। তাই বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের জন্য দেশের অর্থনীতি সব সময় চাপের মুখে থাকে।
যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি
১. সরকারকে উন্নয়ন কাজের বাস্তবায়ন আরো বৃদ্ধি করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাতের প্রক্রিয়াগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নিজের আয়ের ওপর ভিত্তি করে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে। নিজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে হবে। আয়করদাতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আয়ের মাত্রা বৃদ্ধির উদ্যোগ আরো বাড়াতে হবে। ২. আইনের শাসন যথাযথ ও নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ৩. অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজেটের ঘাটতি নিরূপণে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি বাড়ানো বাজেটের ঘাটতি পূরণের একমাত্র উপায়। তাই জনশক্তি রপ্তানি ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের নীতি ও প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। বিশেষ করে জনশক্তি রপ্তানির জন্য মুসলিম দেশের সঙ্গে নতুন করে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে। ৪. দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক সহাবস্থান অপরিহার্য। সরকারকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তৎপরতায় সময় কম দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। ৫। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী সমাধান ব্যতিরেকে কোনোক্রমে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট নেওয়ার উদ্যোগ বন্ধ করা যাবে না। চার বছর ধরে নতুন কোনো শিল্পকারখানা গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে স্থাপিত হতে পারছে না। তাই কর্মসংস্থান ও বিদেশে নতুন বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে না। শুধু ঋণ নিয়ে টেকসই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই
এসব সরবরাহকারী ঋণকে সাধারণত কঠিন শর্তের ঋণ বলা হয়। এর একদিকে থাকে সুদের হার অত্যধিক, অন্যদিকে পরিশোধের সময় থাকে অত্যন্ত কম। তা ছাড়া প্রদানকারীর কাছ থেকে সব রকমের পণ্য প্রদত্ত মূল্যে ক্রয় করতে হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল ভিত্তির ওপর বলে এই সরবরাহকারী দেশগুলো ঋণ দিতে বেশ আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হলো বিগত জোট সরকার ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত এসব সরবরাহকারী ঋণ বা সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ এবং ঋণ গ্রহণ করেছিল, তখন বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তীব্র বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার ঠিক ওইসব সরবরাহকারী ঋণ আরো কঠিন শর্তে গ্রহণ শুরু করেছে। পরিকল্পনা কমিশন প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ তথ্য পাওয়া গেছে যে চলতি অর্থবছর শুরুর আগে থেকে যেসব প্রকল্পের এডিপিতে বরাদ্দ ছিল, তার সঙ্গে আরো পাঁচ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত চাহিদা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই ধরনের প্রকল্প রয়েছে ৯১৬টি। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১১৯টি নতুন অনুমোদিত প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত অর্থের যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, তাতে চলতি অর্থবছরে এডিপি বরাদ্দের বাইরে আরো ছয় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে। তা ছাড়া এসব প্রকল্পের বেশির ভাগ হলো থোক বরাদ্দের। বিগত নভেম্বর ২০১০ থেকে আগামী জুন ২০১১ যে প্রকল্পগুলো অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে, সেগুলোর জন্য নির্ধারিত ব্যয়ের অতিরিক্ত আরো প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এ ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ২৩৮টি। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ বিরাট অঙ্কের বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় ও অর্থায়নের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত অর্থায়ন ঘাটতির কারণে বেশির ভাগ প্রকল্প অর্ধ সম্পন্ন বা আংশিক সম্পন্ন থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পরবর্তী সময়ে এ প্রকল্পের ব্যয় বা সময় দুটিই বৃদ্ধি পাবে। গুণগতমান কোনোক্রমেই রক্ষা করা সম্ভব হবে না। বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এদিকে এডিপি ফান্ড বাস্তবায়নের অবস্থা ও বিগত ব্যয়গুলোতে কোনো ভালো লক্ষণ দেখা যায়নি। অন্য উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যেও বেশ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ১৪ শতাংশ কাজেই দেখা যায়, অনেক প্রকল্পের অর্ধেক বা আংশিক অর্থ দেওয়া হচ্ছে। ফলে সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দেখা যাচ্ছে, যা অর্থ বরাদ্দ ছিল তার চেয়ে অধিক চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। যেমন_শিক্ষা খাতে ৪৯২ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ছিল, সেখানে আরো ৭১২ কোটি টাকা নতুন চাহিদার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে বরাদ্দ বেড়ে ৭৫ কোটি, স্বাস্থ্য খাতে ৬৫ কোটি, শ্রম ও কর্মসংস্থান খাতে ২৭৮ কোটি, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ খাতে ১৮৮ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা খাতের চাহিদা অনেকটা যুক্তিসংগত ও বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। কারণ আগে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল।
আইএমএফের ঋণ ও শর্ত : আইএমএফ সব সময় তার ঋণ দেওয়ার জন্য নতুন নতুন শর্ত আরোপ করে। বেশ কিছুদিন আগে আইএমএফ লিখিতভাবে সরকারের কাছে বেশ কিছু কঠিন শর্তযুক্ত ঋণ প্রস্তাব প্রেরণ করেছে। এসব শর্ত পূরণে বাংলাদেশ সরকার রাজি হলে আগামী জানুয়ারিতে আইএমএফের বোর্ড সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে এবং বোর্ড সভায় এ ঋণ পাস হলে ২০১১ সালের জুন মাসে আইএমএফের প্রথম কিস্তির টাকা বাংলাদেশ পাবে। আইএমএফ এই ঋণ দেবে সাতটি কিস্তিতে। আইএমএফের শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৮-২০০৯ ও ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের সমন্বয়কৃত আর্থিক হিসাব-নিকাশ। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের জাতীয় সংশোধিত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক কর্মসূচি ব্যয়ের অগ্রাধিকার নির্ধারিত এবং এ খাতে প্রকল্প খরচ তদারকি করা ও নতুন ভ্যাট এবং আয়কর আইনের প্রাথমিক খসড়া চূড়ান্ত করা। ঋণ কর্মসূচির প্রথম বছরে জাতীয় সংসদে নতুন কর ও ভ্যাট এবং আয়কর আইন পাসের জন্য উত্থাপন করতে হবে। কর্মসূচির প্রথম ও দ্বিতীয় বছরে এ দুটি আইন কার্যকর করতে হবে। করনীতি ও কর প্রশাসনের কার্যক্রম আলাদা করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পরিষ্কারভাবে উপস্থাপনের জন্য একটি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বিপিসি, বিসিআইসি ও পিডিবির জন্য একটি মনিটরিং কাঠামো তৈরি করতে হবে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ২০০১-২০০৫ সালে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৭৫ হাজার কোটি টাকা সরবরাহকারী ঋণ নেওয়া হয়। তখন আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দলে এবং এই ঋণ গ্রহণে দারুণভাবে বিরোধিতা করেছিল। মজার ব্যাপার এই, আওয়ামী লীগ সরকার তথা মহাজোট সরকার সরবরাহকারী ঋণ নেওয়ার সব বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করেছে। ইতিমধ্যে সরকার ৪৫টি অগ্রাধিকার প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ৭১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করে।
সরবরাহকারী ঋণপ্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের কাছে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রেরণ করেছে। আর এ ঋণের পরিমাণ হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনের জন্য বিদেশি ঋণের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া সহজ ছিল বলে সরবরাহকারী ঋণ নিতে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার পরও এই সরবরাহকারী ঋণ নেওয়া কমেনি। বাংলাদেশ অধিকাংশ সময় পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ হারে সরবরাহকারী ঋণ নিয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যে। তাই বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের জন্য দেশের অর্থনীতি সব সময় চাপের মুখে থাকে।
যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি
১. সরকারকে উন্নয়ন কাজের বাস্তবায়ন আরো বৃদ্ধি করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাতের প্রক্রিয়াগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নিজের আয়ের ওপর ভিত্তি করে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে। নিজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে হবে। আয়করদাতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আয়ের মাত্রা বৃদ্ধির উদ্যোগ আরো বাড়াতে হবে। ২. আইনের শাসন যথাযথ ও নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ৩. অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজেটের ঘাটতি নিরূপণে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি বাড়ানো বাজেটের ঘাটতি পূরণের একমাত্র উপায়। তাই জনশক্তি রপ্তানি ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের নীতি ও প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। বিশেষ করে জনশক্তি রপ্তানির জন্য মুসলিম দেশের সঙ্গে নতুন করে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে। ৪. দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক সহাবস্থান অপরিহার্য। সরকারকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তৎপরতায় সময় কম দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। ৫। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী সমাধান ব্যতিরেকে কোনোক্রমে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট নেওয়ার উদ্যোগ বন্ধ করা যাবে না। চার বছর ধরে নতুন কোনো শিল্পকারখানা গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে স্থাপিত হতে পারছে না। তাই কর্মসংস্থান ও বিদেশে নতুন বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে না। শুধু ঋণ নিয়ে টেকসই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই
No comments