সড়কপথের বিভীষণ by সোহেল নওরোজ

পরিবহন, যাতায়াত তথা যোগাযোগ কাঠামোর ওপর যে কোনো দেশের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে লাগসই পরিবহন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের দেশে লোকসংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সে তুলনায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি।


আকাশপথ, রেলপথ এবং নদীপথ চরম অব্যবস্থাপনা ও বঞ্চনার শিকার হওয়ায় সড়কপথকে মাত্রাতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। জনমানুষের উপচেপড়া ভিড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থবির হওয়ার উপক্রম। এক ঘণ্টার পথ যেতে লেগে যায় কয়েক ঘণ্টা। তার ওপর আবার শঙ্কা, এই বুঝি ঘটল দুর্ঘটনা! দেশের পরিবহন, সড়ক বা রাস্তা এ অতিরিক্ত মানুষকে ধারণ করতে গিয়ে প্রায়ই ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্ম দেয়। মুহূর্তেই প্রাণবায়ু উড়ে যায়; তাজা মানুষ হয়ে যায় নিথর লাশ। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনা প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি মেলে, নিহতের পরিবারকে সান্ত্বনাস্বরূপ কিছু অর্থ দেওয়া হয়, কালো পতাকা টানিয়ে শোক পালন করা হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে একসময় মিইয়ে যায় যাবতীয় উত্তাপ-আলোচনা-অঙ্গীকার।
পত্রিকার পাতা খুললে রোজই সড়ক দুর্ঘটনার হৃদয়বিদারক সংবাদে এবং নিহতদের সারিবদ্ধ নিথর লাশের দৃশ্যে চোখ ভিজে যায়। বিশ্বের আর কোথাও না হোক, সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে এমন নিত্যদিনের ব্যাপারে পরিণত হওয়ার পেছনে আইনের দুর্বলতা এবং তা লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতাই মূল কারণ। অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বাধাহীন চর্চায় অসহায় মানুষকে অজানা শঙ্কা নিয়ে, বাঁচা-মরা নিয়তির হাতে সোপর্দ করে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। পুলিশের দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। গত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। কত লোক যে আহত হয়ে যন্ত্রণাময় জীবনযাপন করছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন স্কুলছাত্রের নির্মম মৃত্যু আমাদের সড়কপথের দৈন্য ও অসচেতনতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এরপরও কি কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে না? আইন-সংলাপ-প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের অভাবে একসময় পরিহাসে রূপ নেয়। তাই চালকের আসনে অদক্ষ হেলপার বসে মোবাইল ফোনে কথা বলে ডেকে আনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা, করুণ মৃত্যু। কিছু পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। এগুলো হলো_ ১. রাস্তায় অনুপযোগী (ফিটনেসবিহীন) ও লাইসেন্সবিহীন যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধকরণ। চালকদের শিক্ষা, দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান। ২. যাত্রীবোঝাই গাড়ি চলাচলের সময় মোবাইল ফোনে বা অন্য কারও সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত থাকা। ৩. যত্রতত্র গাড়ি থামানো, গতিপথ পরিবর্তন (টার্নিং) ও পার্কিং বন্ধ করা। ৪. অপ্রশস্ত, অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা, সেতু, শোল্ডার মেরামত ও যান চলার উপযুক্তকরণ। ৫. যানবাহনের গতির তারতম্য নিয়ন্ত্রণ, ওভারটেকিং, লেন অবজ্ঞা প্রভৃতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। ৬. সাধারণ পথচারী, যাত্রী, চালক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। ৭. মালপত্র পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কপথের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে রেল বা নৌপথকে ব্যবহার করা। রাতে চলাচলের সময় ট্রাক বা অন্যান্য যানবাহনের হেডলাইট, সিগন্যাল লাইট, হর্ন প্রভৃতির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। ৮. দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি আরও কঠোর করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে কার্পণ্য না করা।
হ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
snawroz.bau@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.