জামদানি রফতানি-বিশ্ববাজারে ঐতিহ্য ধরে রাখুন

শত শত বছর ধরে সুনাম ও চাহিদায় বিশ্বজুড়েই শীর্ষে থাকলেও সাম্প্রতিককালে এসে জামদানি শাড়ি ও অন্যান্য পণ্যের রফতানি কেন বছর বছর কমে যাচ্ছে, বুধবারের সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উত্থাপিত এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া কঠিন।


বাংলাদেশের এই ঐতিহ্যের প্রধান বাজার ভারতের পক্ষ থেকে উচ্চ আমদানি শুল্ক এবং অন্যায্য শুল্কবহির্ভূত প্রতিবন্ধকতা কেন আরোপ করা হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়। দুনিয়া জানে মসলিনের উত্তরসূরি জামদানির উদ্ভব ও বিকাশ বৃহত্তর ঢাকা জেলা তথা আজকের বাংলাদেশে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, উৎকৃষ্ট জামদানি উৎপাদনের জন্য যে বিশেষ জলবায়ু প্রয়োজন, তা কেবল শীতলক্ষ্যা-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা তীরেই সুলভ। কিন্তু ২০০৭ সালে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী এই বিশেষ বস্ত্রটিকে 'ভৌগোলিক নির্দেশনাসূত্রে' নিজেদের পণ্য হিসেবে ডবি্লউআইপিওতে নিবন্ধের আবেদন করে। অথচ এই ইতিহাস আর গোপন নয় যে বাংলাদেশ থেকেই কারিগর নিয়ে গিয়ে অন্ধ্র প্রদেশে জামদানি পল্লী স্থাপনের চেষ্টা বেশ কয়েক দশক ধরেই চালানো হয়েছে। গুণে ও মানে ক্রেতার মনোরঞ্জনে সফল হতে না পারায় শেষ পর্যন্ত সেটার নামের আগে 'উপ্পাদা' শব্দটি বসাতে হয়েছে। মুক্তবাজারের এই যুগে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া আদি সংস্করণটির 'ভারত-বিজয়' ঠেকাতেই উচ্চ শুল্ক বসানো হচ্ছে কি-না সংশ্লিষ্টরা খতিয়ে দেখতে পারেন। ৪০ ডলারের বেশি দামের জামদানি পণ্য গ্রহণে ভারতীয় শুল্ক ও আবগারি কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞাও সাদা চোখে দেখার অবকাশ নেই। অপেক্ষাকৃত কম দামের সাধারণ পণ্যই যাতে সেখানকার ক্রেতাদের হাতে পেঁৗছে এবং জামদানির চাহিদা ও সুনাম ক্ষুণ্ন হয়_ এই বিধিনিষেধের নেপথ্য কারণ কি সেটাই? সংশ্লিষ্ট উৎপাদক ও রফতানিকারকদের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার বলে আমরা মনে করি। আবার সেখানকার বাজারে উৎকৃষ্ট মানের যেসব জামদানি মিলছে, তার উৎস কী? বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে গিয়ে ভারতীয় ট্রেডমার্ক বহন করছে কি-না জানা জরুরি। সীমান্ত ও শুল্ক কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে সঠিক চিত্র উদ্ধার কঠিন নয় বলে আমরা বিশ্বাস করি। ভারতের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য আমরা নিঃসন্দেহে অগ্রাধিকার দেব। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা ক্ষুণ্ন করে নয়। এ জন্য কেবল অন্যকে দোষারোপ নয়; নিজেদের বাণিজ্যিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাও জরুরি। আমরা জানি, কয়েকটি স্পর্শকাতর পণ্য ছাড়া ভারত ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের প্রায় সব পণ্যের শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা দিয়েছে। সেই তালিকায় জামদানি ছিল না কেন, এই জবাব সমঝোতায় অংশ নেওয়া আমাদের কর্মকর্তাদেরই দিতে হবে। এই খাতের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আবেদন সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ে নির্লিপ্ততা কেবল ক্ষোভেরই জন্ম দেয়। জামদানি রফতানিতে প্রণোদনা ১০ শতাংশ কমিয়ে আনার বিষয়টিও প্রশ্নাতীত হতে পারে না। ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনে জামদানি পণ্যের নিবন্ধন করতে প্রয়োজন আইন ও বিধি প্রণয়নের যে উদ্যোগ কয়েক বছর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়েছিল, তার অগ্রগতিও জানতে চাই আমরা। এই ধরনের কাজে দীর্ঘসূত্রতা আত্মঘাত ছাড়া আর কী? বিলম্বে হলেও বিষয়টি সম্পন্ন হবে বলে প্রত্যাশা। ভারতের বাইরে জামদানির যে বাজার রয়েছে, সেগুলো সমৃদ্ধকরণেও সংশ্লিষ্টরা কতটা মনোযোগ দিয়েছেন, তাও জানার সময় হয়েছে। আমরা আশা করি, জামদানি উৎপাদন, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও রফতানির বিষয়টি শীর্ষ পর্যায় থেকে অগ্রাধিকার পাবে। ভৌগোলিক ও উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই জাতীয় সম্পদ কিছু ব্যক্তির অবিমৃষ্যকারিতায় হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না।
 

No comments

Powered by Blogger.