অচল-সচল পূর্বাচল by কে জি মোস্তফা
মানুষ কী যে করবে, সবসময় সে সত্যিই বুঝতে পারে না। মাঝেমাঝে জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, সবকিছু গণ্ডগোল হয়ে যায়। তখন মাথা কাজ করে না। আমি তখন ডিএফপি থেকে প্রকাশিত নবারুণ সম্পাদনায় বেশ মশগুল ছিলাম। হঠাত্ বদলির অর্ডার—নবারুণ থেকে মাসিক ‘পূর্বাচল’ সম্পাদনার দায়িত্বে। দীর্ঘদিন যাবত এ দায়িত্বে রয়েছেন বিশিষ্ট গবেষক-লেখক-অনুবাদক কবি আবদুস সাত্তার। তাকে দেয়া হলো আমার জায়গায় অর্থাত্ নবারুণের দায়িত্বে।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তান আমলের ঐতিহ্যবাহী মাসিক ‘মাহে নও’ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ‘পূর্বাচল’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি তালিম হোসেন। তার অবসর গ্রহণের পর স্বাভাবিকভাবে কবি আবদুস সাত্তার সম্পাদনার দায়িত্ব পান। কবি তালিম হোসেনের মতো কবি আবদুস সাত্তারও সাহিত্যজগতের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। স্বনামধন্য এদের স্থলাভিষিক্ত হওয়া আমার জন্য ছিল যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি কিছুটা অস্বস্তিকর।‘পূর্বাচল’ সাহিত্য মাসিক। সাহিত্যজগতের বিশিষ্ট লেখকদের সঙ্গে কবি আবদুস সাত্তারের যথেষ্ট যোগাযোগ, সে অর্থে আমি স্বল্প পরিচিত একজন। দ্বিতীয়ত, সাত্তার সাহেবকে আমি সমীহ করে চলতাম। আমার প্রতি তার মনোভাব কেমন দাঁড়াবে, এসব চিন্তায় কিছুটা অস্থির ছিলাম। যাই হোক কিছুটা মানসিক অস্থিরতা, কিছুটা দ্বিধার মধ্যে আমাকে ‘পূর্বাচল’ সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে হলো। একজন অতিশয় দুর্বলচিত্ত, দিশাহীন নির্জীব মানুষ আমি সর্বদাই সব পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকি। এখনও আছি। মোটের ওপর নিজের বিবেক, নিজের মূল্যবোধের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে অহেতুক অশোভন আচরণ না করেই। তবু অধিকারের লড়াইয়ে দেখি মানুষ কালচার-লেভেল মানে না। যেহেতু পৃথিবীতে সব মানুষ একরকম নয়। সবার চাহিদাও একরকম নয়। জীবনযাত্রাও এক নয়। এই সহজ সত্যটাকে মেনে নিতে কারও কারও অসুবিধা হয়।
যাই হোক, একটা সাংঘাতিক সত্য কথা। কবি আবদুস সাত্তার একজন হৃদয়বান মানুষ। হাসিখুশি দিলখোলা মানুষটি রস-রসিকতায় প্রায়ই মশগুল হয়ে থাকতেন। পত্রিকার দায়িত্ব সহকর্মীদের হাতেই ন্যস্ত থাকত। এই ঔদাসীন্য ও নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই। পরিণামে মান যাই হোক দীর্ঘদিন ধরে পত্রিকাটির প্রকাশনা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। দায়িত্ব গ্রহণের পর তাই গোড়া থেকে আমাকে কাজ শুরু করতে হলো।
বলাবাহুল্য, সাহিত্য পবিত্র। সাহিত্য মানে জ্ঞান, সাহিত্য মানে মনুষ্যত্বের বিকাশ। কোনো লেখকের বা কবির প্রতিভার বিকাশ শূন্যে ঘটে না। ঘটে পরিপার্শ্ব, পরিজন, সমাজ-ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। সেই ফসলের বীজ লেখকের চেতনায় অগুনতি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। তার চিন্তা-কল্পনার উর্বর ভূমিতে অনেক বন্ধ্যা, অকিঞ্চিতকর বীজও অঙ্কুরিত হয়।
একজন লেখক কল্পনা থেকে বাস্তবের দিকে এগিয়ে চলেন—কাব্য থেকে গদ্য, কাহিনী থেকে সমাজ ইতিহাসের বিশেষণ, এমনকি আধ্যাত্মিক আলোচনা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—‘হাতের কাছে যে কিছু সামান্য মাল-মশলা পান তাহা দিয়াই নিজের জীবনকে মহত্ করেন এবং তাহাদিগকে বৃহত্ করিয়া তোলেন।’
আসলে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলো অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেগুলোকে রূপ দেয়া হয় সাহিত্যে। মনের মধ্যে জাগে নানা ধরনের জিজ্ঞাসা—‘কেন’ রোগের আক্রমণ? অন্যদিকে বাস্তবকে সমগ্রভাবে দেখার বা একটা জীবনদর্শন খোঁজার মতো সমগ্র জিজ্ঞাসা! তবে ভাঙা সময়ের কথকতা নিয়েও অনেক সময় অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিতে হয় গল্পে-উপন্যাসে। প্রাধান্য পেয়ে যায় তার ব্যাখ্যাও।
যাই হোক আমার সৌভাগ্য। ব্যক্তিগত যোগাযোগ, আবেদন-নিবেদনে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশিষ্ট লেখকদের সাড়া পেয়ে গেলাম। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার বিষয়। সরকারি মাধ্যমে অংশগ্রহণে বামপন্থী তথা প্রগতিশীল লেখকদের অনীহা। অলিখিত একটা বিধিনিষেধ অবশ্য এর প্রধান কারণ হতে পারে। তবু এদের কেউ কেউ আমাকে একেবারে নিরাশ করেননি। সেটা ছিল আমার শ্লাঘার বিষয়। যাই হোক, স্বল্প সময়ের মধ্যে ‘পূর্বাচল’ আবার সচল হয়ে উঠল। স্ব-মর্যাদায় নিয়মিত প্রকাশ হতে লাগল।
প্রিয়কবি জীবনানন্দের ভাষায়—‘পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন।’ সেই অসুখের সুস্পষ্ট সঞ্চার আজ আমরা টের পাচ্ছি। বিশ্বায়নে ভোগবাসনাসঞ্জাত সামাজিক অস্থিরতা বা অর্থনৈতিক অসাম্যের সঙ্গে হিংসার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে লেখকরা নীরব থাকতে পারে না। নবীন প্রজন্মের কাছে আমরা সবাই আশাবাদী।
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক
No comments