শ্রীলঙ্কা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমবে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে by জগ্লুল আহেমদ চৌধূরী
অবশেষে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ২৬ জানুয়ারি এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। দেশের বিরোধী দলগুলো বেশ কিছুদিন ধরে এই নির্বাচনের জন্য জোর দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার এ নিয়ে কোনো স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা না করায় বিরোধী দলের সঙ্গে তিক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকার মনে করেছে, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আরও প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে পারেন সংবিধানসম্মতভাবে এবং সে কারণে এত শিগগির নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। এই মেয়াদকাল নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি বিরাজ করছে এবং সে কারণে বিরোধী দলগুলো আশু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দাবি নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় সরকার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। যদিও বলছে, মহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতায় থেকে যেতে পারেন। ‘তথাপি প্রেসিডেন্ট মনে করছেন, নতুন ম্যান্ডেট বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে বিভিন্ন কারণে সুবিধা দেবে এবং সে কারণেই ভোট হতে যাচ্ছে।’ একজন সরকারি মুখপাত্রের এই বক্তব্য নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ও সন্দেহের অবসান ঘটাল।
দক্ষিণ এশীয় এই দ্বীপদেশটির জন্য আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচিত হচ্ছে একাধিক কারণে এবং অন্যান্যবারের নির্বাচন থেকে এবারের ভোটপর্বকে নতুন পটভূমিকায় বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ বলেই মনে করা যেতে পারে। মাত্র কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কা দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি তামিলসংকট থেকে মুক্ত হয়েছে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে। দেশটির দুই কোটির বেশি জনগোষ্ঠীর ১৮ শতাংশ তামিলদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে দেশটিতে অনেক বছর ধরে রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তামিল বিদ্রোহীরা বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বীয় শাসন প্রবর্তিত করেছিল। অবশ্য, সম্প্রতি সরকারি সেনাদর সঙ্গে যুদ্ধে তাদের বিপর্যয় ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষ দিকে বিদ্রোহীরা সম্পূর্ণভাবেই পর্যুদস্ত হয়। তাদের নেতা ভিল্লুপাই প্রভাকরণ যুদ্ধে নিহত হন এবং সরকারি বাহিনী তাদের বিজয় ঘোষণা করে। পুরো শ্রীলঙ্কা গত মে মাস থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং তামিল বিদ্রোহীরা হয় নিহত হয়েছে, ধরা পড়েছে কিংবা পালিয়ে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা সরকারের এই বিশাল সাফল্যের দুই বড় দাবিদারই ঘটনাচক্রে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে নিঃসন্দেহে তামিল বিদ্রোহীদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের অবসানের নায়ক। কেননা আগে অনেক প্রেসিডেন্টই এই সংকটের সমাধান দিতে পারেননি, যদিও যুদ্ধ ও আলোচনা উভয় পন্থায়ই সমস্যার নিরসনে প্রচেষ্টা হয়েছে। রাজাপক্ষের ফ্রিডম পার্টি এবং অন্যান্য দলীয় সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করা যেতে পারে। এই যুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে তামিল ও সরকার পক্ষ, উভয়ই সফলতার পরিচয় দিয়েছিল এবং মাঝেমধ্যে এটাও মনে হয়েছিল যে শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী তামিলদের পরাজিত করা সম্ভব হবে না। অনেকটা অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছেন এই প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে এবং স্বাভাবিকভাবেই শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের কাছে তিনি অত্যন্ত সফল প্রেসিডেন্ট হিসেবেই বিবেচিত এবং রাজাপক্ষে সংগতভাবেই এই অভূতপূর্ব সাফল্যের দাবিদার। সুতরাং আরও একটি মেয়াদে যখন তিনি প্রার্থী হচ্ছেন, তাঁর এই সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজাপক্ষে যে একজন বেশ শক্তিশালী প্রার্থী হয়েই আবির্ভূত হয়েছেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তবে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি, তিনিও একইভাবে এই সাফল্যের বড় নায়ক এবং সে কারণেই নির্বাচনের চালচিত্র উত্তপ্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় যে জয় সরকার সাধন করতে সমর্থ হয়েছে, সেটা হয়েছে সামরিক পন্থায় এবং প্রচণ্ড যুদ্ধেরই মাধ্যমে। আর এই কঠিন সংঘর্ষে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে দক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শরথ ফোরসেঙ্কা। তিনিই দেশের একমাত্র চার তারকাবিশিষ্ট জেনারেল, যেখানে আগে অনেক সেনাপ্রধান আকাঙ্ক্ষিত বিজয় আনতে পারেননি, এই জেনারেল সেটাই সম্ভব করেছেন। যদিও সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এই সময়ে বিচরণ করেছেন প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে, তথাপি সামরিক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন সেনাপ্রধান এবং তিনিই হতে যাচ্ছেন রাজাপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বী, যদি অপ্রত্যাশিতভাবে চালচিত্রের পরিবর্তন না ঘটে।
তামিলদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ের পর থেকেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সেনাপ্রধানের মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয় এবং এর মাঝে দুই সফলতার দাবিদারের মধ্যে সাফল্য নিয়ে ঈর্ষাও বড়ভাবে কাজ করেছে। পরে জেনারেল শরথকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান করা হয়, যা কিনা মূলত একটি গুরুত্বহীন আনুষ্ঠানিক পদমাত্র।
জেনারেল শরথ সরকারি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তাঁকে অতিমাত্রায় অবজ্ঞা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি নিয়ম অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বলে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। এতেই এটা প্রতীয়মান হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে বিরোধী দলগুলো রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে একজন শক্তিশালী প্রার্থী খুঁজেছিল, যিনি তামিল যুদ্ধের সাফল্যের দাবি করতে পারেন। তারা জেনারেল শরথকে পেয়ে গেছেন এবং ভালো প্রার্থী পেয়েছেন বলেই মনে করছেন। প্রায় সব বিরোধী দলই এ বিষয়ে সম্মত বলে ধারণা করা হচ্ছে, যদিও কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এই কলাম লেখা পর্যন্ত আসেনি। এ বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মতব্যবধান থাকলেও তা নিরসনের চেষ্টা চলছে। জেনারেল শরথ নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেই সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার শাসনপদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং তাঁর ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় একমত পোষণ করলেও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় এ লক্ষ্যে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। জেনারেল শরথ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি নির্বাচিত হলে এ ক্ষেত্রে কার্যকরী ও ত্বরিত পদক্ষেপ নেবেন। প্রেসিডেন্ট জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন নির্বাচিত পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা মোর্চার নেতা। কিন্তু প্রেসিডেন্টের হাতে রয়েছে অসীম ক্ষমতা—তিনি নির্বাচিত সংসদ এবং প্রধানমন্ত্রীকেও বরখাস্ত করতে পারেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, প্রেমাদাসাসহ অনেকেই সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। অনেকেই মনে করেন, এই সাংবিধানিক ধারা সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক নয়।
মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও শরথ ফোরসেঙ্কার কিছু সমস্যাও আছে। উভয়ই তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধের শেষপর্যায়ে অতিমাত্রায় নির্মমতার পরিচয় দিয়েছেন এবং মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্ব এ বিষয়ে বক্তব্যও দিয়েছে। বিরাটসংখ্যক তামিল নাগরিককে যুদ্ধের পর বিভিন্ন শিবিরে রেখে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করার অভিযোগও তাঁদের, বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে। তবে যেহেতু হিন্দু তামিলদের পরাজিত করে বৌদ্ধ সিংহলিরা জয়ী হয়েছে এবং সিংহলিরাই দেশের প্রায় ৭৭ শতাংশ, তাই ভোটে দুজনেরই সুবিধা রয়েছে। গত নির্বাচনে রাজাপক্ষে তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে অপেক্ষাকৃত নমনীয় ইউএনপির রনিল বিক্রমাসিংকে অল্প ব্যবধানে পরাজিত করেন। এবার দুই কট্টরপন্থী—যাঁরা যুদ্ধে সফলতা এনেছেন—চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতারই সম্মুখীন।
জগ্লুল আহেমদ চৌধূরী: সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক।
দক্ষিণ এশীয় এই দ্বীপদেশটির জন্য আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচিত হচ্ছে একাধিক কারণে এবং অন্যান্যবারের নির্বাচন থেকে এবারের ভোটপর্বকে নতুন পটভূমিকায় বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ বলেই মনে করা যেতে পারে। মাত্র কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কা দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি তামিলসংকট থেকে মুক্ত হয়েছে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে। দেশটির দুই কোটির বেশি জনগোষ্ঠীর ১৮ শতাংশ তামিলদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে দেশটিতে অনেক বছর ধরে রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তামিল বিদ্রোহীরা বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বীয় শাসন প্রবর্তিত করেছিল। অবশ্য, সম্প্রতি সরকারি সেনাদর সঙ্গে যুদ্ধে তাদের বিপর্যয় ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষ দিকে বিদ্রোহীরা সম্পূর্ণভাবেই পর্যুদস্ত হয়। তাদের নেতা ভিল্লুপাই প্রভাকরণ যুদ্ধে নিহত হন এবং সরকারি বাহিনী তাদের বিজয় ঘোষণা করে। পুরো শ্রীলঙ্কা গত মে মাস থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং তামিল বিদ্রোহীরা হয় নিহত হয়েছে, ধরা পড়েছে কিংবা পালিয়ে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা সরকারের এই বিশাল সাফল্যের দুই বড় দাবিদারই ঘটনাচক্রে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে নিঃসন্দেহে তামিল বিদ্রোহীদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের অবসানের নায়ক। কেননা আগে অনেক প্রেসিডেন্টই এই সংকটের সমাধান দিতে পারেননি, যদিও যুদ্ধ ও আলোচনা উভয় পন্থায়ই সমস্যার নিরসনে প্রচেষ্টা হয়েছে। রাজাপক্ষের ফ্রিডম পার্টি এবং অন্যান্য দলীয় সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করা যেতে পারে। এই যুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে তামিল ও সরকার পক্ষ, উভয়ই সফলতার পরিচয় দিয়েছিল এবং মাঝেমধ্যে এটাও মনে হয়েছিল যে শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী তামিলদের পরাজিত করা সম্ভব হবে না। অনেকটা অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছেন এই প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে এবং স্বাভাবিকভাবেই শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের কাছে তিনি অত্যন্ত সফল প্রেসিডেন্ট হিসেবেই বিবেচিত এবং রাজাপক্ষে সংগতভাবেই এই অভূতপূর্ব সাফল্যের দাবিদার। সুতরাং আরও একটি মেয়াদে যখন তিনি প্রার্থী হচ্ছেন, তাঁর এই সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজাপক্ষে যে একজন বেশ শক্তিশালী প্রার্থী হয়েই আবির্ভূত হয়েছেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তবে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি, তিনিও একইভাবে এই সাফল্যের বড় নায়ক এবং সে কারণেই নির্বাচনের চালচিত্র উত্তপ্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় যে জয় সরকার সাধন করতে সমর্থ হয়েছে, সেটা হয়েছে সামরিক পন্থায় এবং প্রচণ্ড যুদ্ধেরই মাধ্যমে। আর এই কঠিন সংঘর্ষে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে দক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শরথ ফোরসেঙ্কা। তিনিই দেশের একমাত্র চার তারকাবিশিষ্ট জেনারেল, যেখানে আগে অনেক সেনাপ্রধান আকাঙ্ক্ষিত বিজয় আনতে পারেননি, এই জেনারেল সেটাই সম্ভব করেছেন। যদিও সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এই সময়ে বিচরণ করেছেন প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে, তথাপি সামরিক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন সেনাপ্রধান এবং তিনিই হতে যাচ্ছেন রাজাপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বী, যদি অপ্রত্যাশিতভাবে চালচিত্রের পরিবর্তন না ঘটে।
তামিলদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ের পর থেকেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সেনাপ্রধানের মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয় এবং এর মাঝে দুই সফলতার দাবিদারের মধ্যে সাফল্য নিয়ে ঈর্ষাও বড়ভাবে কাজ করেছে। পরে জেনারেল শরথকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান করা হয়, যা কিনা মূলত একটি গুরুত্বহীন আনুষ্ঠানিক পদমাত্র।
জেনারেল শরথ সরকারি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তাঁকে অতিমাত্রায় অবজ্ঞা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি নিয়ম অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বলে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। এতেই এটা প্রতীয়মান হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে বিরোধী দলগুলো রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে একজন শক্তিশালী প্রার্থী খুঁজেছিল, যিনি তামিল যুদ্ধের সাফল্যের দাবি করতে পারেন। তারা জেনারেল শরথকে পেয়ে গেছেন এবং ভালো প্রার্থী পেয়েছেন বলেই মনে করছেন। প্রায় সব বিরোধী দলই এ বিষয়ে সম্মত বলে ধারণা করা হচ্ছে, যদিও কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এই কলাম লেখা পর্যন্ত আসেনি। এ বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মতব্যবধান থাকলেও তা নিরসনের চেষ্টা চলছে। জেনারেল শরথ নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেই সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার শাসনপদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং তাঁর ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় একমত পোষণ করলেও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় এ লক্ষ্যে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। জেনারেল শরথ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি নির্বাচিত হলে এ ক্ষেত্রে কার্যকরী ও ত্বরিত পদক্ষেপ নেবেন। প্রেসিডেন্ট জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন নির্বাচিত পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা মোর্চার নেতা। কিন্তু প্রেসিডেন্টের হাতে রয়েছে অসীম ক্ষমতা—তিনি নির্বাচিত সংসদ এবং প্রধানমন্ত্রীকেও বরখাস্ত করতে পারেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, প্রেমাদাসাসহ অনেকেই সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। অনেকেই মনে করেন, এই সাংবিধানিক ধারা সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক নয়।
মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও শরথ ফোরসেঙ্কার কিছু সমস্যাও আছে। উভয়ই তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধের শেষপর্যায়ে অতিমাত্রায় নির্মমতার পরিচয় দিয়েছেন এবং মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্ব এ বিষয়ে বক্তব্যও দিয়েছে। বিরাটসংখ্যক তামিল নাগরিককে যুদ্ধের পর বিভিন্ন শিবিরে রেখে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করার অভিযোগও তাঁদের, বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে। তবে যেহেতু হিন্দু তামিলদের পরাজিত করে বৌদ্ধ সিংহলিরা জয়ী হয়েছে এবং সিংহলিরাই দেশের প্রায় ৭৭ শতাংশ, তাই ভোটে দুজনেরই সুবিধা রয়েছে। গত নির্বাচনে রাজাপক্ষে তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে অপেক্ষাকৃত নমনীয় ইউএনপির রনিল বিক্রমাসিংকে অল্প ব্যবধানে পরাজিত করেন। এবার দুই কট্টরপন্থী—যাঁরা যুদ্ধে সফলতা এনেছেন—চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতারই সম্মুখীন।
জগ্লুল আহেমদ চৌধূরী: সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক।
No comments