জননেতা নূরুল ইসলাম -স্মরণ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
কীভাবে, কবে নূরুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল মনে পড়ে না; তবে কোথায়, সেটি বলতে পারি—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের যে ইউনিয়ন রয়েছে, যা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সমশ্রেণীর ইউনিয়ন থেকে অনেক বেশি নিয়মতান্ত্রিক এবং আদর্শনিষ্ঠ, তিনি তার সভাপতি ছিলেন। যে কমিউনিস্ট আদর্শে, ট্রেড ইউনিয়নমন্ত্রে আজীবন তিনি বিশ্বাসী ছিলেন, সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন জীবনে ও কর্মে। যখন তাঁর বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে লোভনীয় নানা চাকরি করছেন, ক্ষমতার অন্দরমহলে ঘোরাঘুরি করছেন, নূরুল ইসলাম তখন একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে এসব প্রান্তিক মানুষের জন্য লড়াইয়ে নেমেছেন। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাজনৈতিক সরকারও প্রান্তিক মানুষজনের পক্ষে থাকে না; তাদের প্রতিপক্ষ হয়েই থাকে বরং। নূরুল ইসলামকে তাই সারা জীবন সংগ্রাম করতে হয়েছে অনেক বড় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। সেই সংগ্রামের অবশ্য অনেক মিত্রও পেয়েছেন তিনি—মিল কারখানার শ্রমিক, অনেক ছাত্র সংগঠন এবং অন্যান্য সচেতন মানুষের সঙ্গে, শিক্ষকদের একটি অংশও। কোনো এক সরকারি নীতি অথবা পদক্ষেপবিরোধী সভায় তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়, তারপর ঘনিষ্ঠতা।
স্পষ্টবাদী, ভরাকণ্ঠ এবং সুদর্শন নূরুল ইসলাম জনসভার মঞ্চে যেমন ছিলেন আকর্ষণীয় বক্তা, ব্যক্তিগত জীবনে তেমনি ছিলেন অমায়িক এবং সদাহাস্যময়। নূরুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়টা আরও গাঢ় হলো রুবী রহমান—রুবী আপার কল্যাণে। কবি রুবী রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে এমএ পাস করেছিলেন। একবার এক মার্কিন কবি এলেন তাঁরসহ আরও কয়েকজন নারী কবির কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য। রুবী আপার কবিতা অনুবাদের অনুরোধ এলে আমি তা সানন্দে গ্রহণ করি। তাঁর জীবনসঙ্গী নূরুল ইসলাম; তাঁদের বাসায় যেতাম, কবিতার অনুবাদ থেকে আড্ডা হতো বেশি। ২০ বছর আগের ওই আড্ডাগুলোতে নূরুল ইসলাম থাকার চেষ্টা করতেন এবং আড্ডারছলে জানাতেন তাঁর অনেক স্বপ্নের কথা। তাঁর কাছে সংগ্রাম ও স্বপ্ন ছিল পরিপূরক দুই শক্তি। এখনো ভেবে অবাক হই, একজন মাঠের মানুষ কী অকাতরে বিশ্বাস করতেন স্বপ্নের শক্তিতে।
ছোট্ট সাজানো পরিবার ছিল রুবী রহমানের। তাঁর ঘরটিও থাকত পরিপাটি, ছবির মতো সাজানো। দুই সন্তান তমোহর আর মৌটুসী। মানুষের মতো মানুষ হয়েছে দুজনই। ওদের নিয়েও নূরুল ইসলাম ভাইয়ের হয়তো অনেক স্বপ্ন ছিল। সব পিতারই থাকে। পিতা হিসেবেও তাঁর তুলনা পাওয়া ছিল ভার।
সেই স্বপ্নগুলো ভেঙে দিল একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা অথবা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড—রাষ্ট্রযন্ত্রের গোয়েন্দাযন্ত্র এ সত্য উদ্ঘাটনে কোনো আগ্রহ দেখায়নি শুরু থেকে। আজ থেকে এক বছর আগে লালমাটিয়ায় তাঁর বাসায় আগুন লাগে। রহস্যময় আগুন—একেবারে গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ডের পদচ্ছাপ সর্বত্র। সেই আগুনে পুড়ে প্রথমে গেল তমোহর, আর ৩৬ ঘণ্টা যুদ্ধ করে গেলেন নূরুল ইসলাম ভাই। তমোহর ছিল আলো-ঝলমলে এক তরুণ, সুন্দরে বিশ্বাসী, সংগীতে নিমগ্ন। তমসার রাক্ষসেরা তাকে নিয়ে গেল। নূরুল ইসলাম ভাইয়ের নামেও আলো ছিল। তাঁকেও প্রাণ দিতে হলো অন্ধকারের শক্তিদের কাছে। অথচ আর কটা সপ্তাহ পরই নির্বাচন ছিল, সেই নির্বাচনে তাঁর জেতাও নিশ্চিত ছিল এবং জিতে, সংসদে এসে প্রান্তিক মানুষজনের পক্ষে তাঁর কথা বলার কথা ছিল।
তাঁর ও তমোহরের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত কি হতে পারে না? কেন হতে পারে না? এই দাবি আমরা করছি; এই দাবি কি রাষ্ট্রযন্ত্রের কানে পৌঁছাবে না?
নূরুল ইসলাম ভাইয়ের মৃত্যুর সময় রুবী আপা যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন, মৌটুসীও। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেও টেলিফোনে কথা হয়েছে নূরুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে। রুবী আপার খবর জানিয়েছেন। নির্বাচনের বিষয়ে বলেছেন। তাঁকে ঋণখেলাপি করার চেষ্টা হচ্ছে, হাসতে হাসতে এ খবর দিয়েছেন। আমি তেমন আমলে নিইনি তাঁর পেছনে কিছু মানুষের এই লেগে পড়াকে। সংগ্রামে অভ্যস্ত মানুষ জানেন কীভাবে এসব প্রতিকূলতা সামাল দিতে হয়। কিন্তু প্রতিকূলতা যদি বীভত্সতার পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে কীভাবে তা সামাল দেবেন একজন মানুষ, যিনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন, সুন্দরের পক্ষে ছিলেন এবং কিছু আদর্শে অবিচলিত ছিলেন, যেসব আদর্শ ছিল মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণ নিয়ে?
আমার মোবাইল ফোনে তাঁর নম্বরটা এখনো আছে। এখনো মনে হয় কোনো দিন হয়তো তা বেজে উঠবে এবং তিনি বলবেন, ‘কেমন আছেন?’ তাঁর সেই ভরা গলায়, যেমন প্রতিবার ফোন করেই বলতেন।
স্পষ্টবাদী, ভরাকণ্ঠ এবং সুদর্শন নূরুল ইসলাম জনসভার মঞ্চে যেমন ছিলেন আকর্ষণীয় বক্তা, ব্যক্তিগত জীবনে তেমনি ছিলেন অমায়িক এবং সদাহাস্যময়। নূরুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়টা আরও গাঢ় হলো রুবী রহমান—রুবী আপার কল্যাণে। কবি রুবী রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে এমএ পাস করেছিলেন। একবার এক মার্কিন কবি এলেন তাঁরসহ আরও কয়েকজন নারী কবির কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য। রুবী আপার কবিতা অনুবাদের অনুরোধ এলে আমি তা সানন্দে গ্রহণ করি। তাঁর জীবনসঙ্গী নূরুল ইসলাম; তাঁদের বাসায় যেতাম, কবিতার অনুবাদ থেকে আড্ডা হতো বেশি। ২০ বছর আগের ওই আড্ডাগুলোতে নূরুল ইসলাম থাকার চেষ্টা করতেন এবং আড্ডারছলে জানাতেন তাঁর অনেক স্বপ্নের কথা। তাঁর কাছে সংগ্রাম ও স্বপ্ন ছিল পরিপূরক দুই শক্তি। এখনো ভেবে অবাক হই, একজন মাঠের মানুষ কী অকাতরে বিশ্বাস করতেন স্বপ্নের শক্তিতে।
ছোট্ট সাজানো পরিবার ছিল রুবী রহমানের। তাঁর ঘরটিও থাকত পরিপাটি, ছবির মতো সাজানো। দুই সন্তান তমোহর আর মৌটুসী। মানুষের মতো মানুষ হয়েছে দুজনই। ওদের নিয়েও নূরুল ইসলাম ভাইয়ের হয়তো অনেক স্বপ্ন ছিল। সব পিতারই থাকে। পিতা হিসেবেও তাঁর তুলনা পাওয়া ছিল ভার।
সেই স্বপ্নগুলো ভেঙে দিল একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা অথবা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড—রাষ্ট্রযন্ত্রের গোয়েন্দাযন্ত্র এ সত্য উদ্ঘাটনে কোনো আগ্রহ দেখায়নি শুরু থেকে। আজ থেকে এক বছর আগে লালমাটিয়ায় তাঁর বাসায় আগুন লাগে। রহস্যময় আগুন—একেবারে গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ডের পদচ্ছাপ সর্বত্র। সেই আগুনে পুড়ে প্রথমে গেল তমোহর, আর ৩৬ ঘণ্টা যুদ্ধ করে গেলেন নূরুল ইসলাম ভাই। তমোহর ছিল আলো-ঝলমলে এক তরুণ, সুন্দরে বিশ্বাসী, সংগীতে নিমগ্ন। তমসার রাক্ষসেরা তাকে নিয়ে গেল। নূরুল ইসলাম ভাইয়ের নামেও আলো ছিল। তাঁকেও প্রাণ দিতে হলো অন্ধকারের শক্তিদের কাছে। অথচ আর কটা সপ্তাহ পরই নির্বাচন ছিল, সেই নির্বাচনে তাঁর জেতাও নিশ্চিত ছিল এবং জিতে, সংসদে এসে প্রান্তিক মানুষজনের পক্ষে তাঁর কথা বলার কথা ছিল।
তাঁর ও তমোহরের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত কি হতে পারে না? কেন হতে পারে না? এই দাবি আমরা করছি; এই দাবি কি রাষ্ট্রযন্ত্রের কানে পৌঁছাবে না?
নূরুল ইসলাম ভাইয়ের মৃত্যুর সময় রুবী আপা যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন, মৌটুসীও। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেও টেলিফোনে কথা হয়েছে নূরুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে। রুবী আপার খবর জানিয়েছেন। নির্বাচনের বিষয়ে বলেছেন। তাঁকে ঋণখেলাপি করার চেষ্টা হচ্ছে, হাসতে হাসতে এ খবর দিয়েছেন। আমি তেমন আমলে নিইনি তাঁর পেছনে কিছু মানুষের এই লেগে পড়াকে। সংগ্রামে অভ্যস্ত মানুষ জানেন কীভাবে এসব প্রতিকূলতা সামাল দিতে হয়। কিন্তু প্রতিকূলতা যদি বীভত্সতার পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে কীভাবে তা সামাল দেবেন একজন মানুষ, যিনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন, সুন্দরের পক্ষে ছিলেন এবং কিছু আদর্শে অবিচলিত ছিলেন, যেসব আদর্শ ছিল মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণ নিয়ে?
আমার মোবাইল ফোনে তাঁর নম্বরটা এখনো আছে। এখনো মনে হয় কোনো দিন হয়তো তা বেজে উঠবে এবং তিনি বলবেন, ‘কেমন আছেন?’ তাঁর সেই ভরা গলায়, যেমন প্রতিবার ফোন করেই বলতেন।
No comments