ঘুরে দাঁড়ানো বিশ্ব অর্থনীতি থেকে ফল পেতে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা কাটাতে হবে -মেট্রো চেম্বারের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা

দুর্বল অবকাঠামো, বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা, ব্যাংক ঋণের অত্যধিক সুদ, দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে দেশের অর্থনৈতিক নিম্ন প্রবৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রভাবশালী বাণিজ্য সংগঠন এমসিসিআই। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স (এমসিসিআই) মনে করে, ‘মন্দা কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তার সুফল পেতে হলে আমাদের এসব অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও পদক্ষেপ নিতে হবে।’
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অর্থনৈতিক অবস্থার পর্যালোচনা করে শীর্ষস্থানীয় এ বাণিজ্য সংগঠনটি গতকাল বৃহস্পতিবার এ মতামত জানিয়েছে।
এমসিসিআই বলেছে, চলতি অর্থবছর শুরু হয় বিশ্বমন্দার বিরূপ প্রভাব কিছুটা কাটিয়ে ওঠার লক্ষণ নিয়ে। আন্তর্জাতিক অর্থবাজার স্থিতিশীল হতে থাকে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিও চাঙা হতে আরম্ভ করে।
অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কিছু অবনতি পরিলক্ষিত হয়, যা বিস্ময়কর। যদিও গত অর্থবছরে বিশ্বমন্দার প্রথম আঘাত দেশ বেশ সফলতার সঙ্গে উের গেছে, রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধিও হয়েছে।
কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিনিয়োগ কমে গেছে, রপ্তানি আয়েও বড় আঘাত এসেছে। একই সময়ে সরকারি উন্নয়ন ব্যয় এডিপিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার নিচে ছিল। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ৩৭ শতাংশ। উত্পাদনমুখী খাতে প্রবৃদ্ধি না থাকায় বেকারত্ব বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে শুরু করেছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে বিশালাকারের নগদ তারল্য জমা হয়েছে।
পর্যালোচনায় এমসিসিআই বলেছে, ‘বড় আকারের মূল্যস্ফীতি আগামী মাসগুলোতে প্রতিহত করা যাবে না, যদি না অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এ বিশাল আকারের তারল্য ব্যবহার করা যায়।’ এ সমস্যা দেশের মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধা হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে মত চেম্বার সংগঠনটির। তাদের পরামর্শ, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত এ ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ নেওয়া।
এসব সত্ত্বেও মেট্রো চেম্বার মনে করে, অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক লক্ষণ বিদ্যমান। বিশেষ করে কিছু শিল্প খাতের উত্পাদন ও রপ্তানি, যেমন—চামড়া, জুতা, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত খাদ্য, পাটজাত দ্রব্য ইত্যাদি খুবই উত্সাহব্যঞ্জক। ইতিমধ্যেই যে সহায়ক আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিধিবিধান নেওয়া হয়েছে, তা অব্যাহত রাখলে এসব শিল্প খাত ভালো করবে। এর সঙ্গে অন্যান্য শিল্প খাতকেও অনুরূপ সহায়তার আওতায় নিয়ে আসা উচিত বলে সংগঠনটি মত দিয়েছে।
এমসিসিআই বলেছে, অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টির প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে সুষ্ঠু সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ, সুশাসন এবং উন্নত অবকাঠামো। এর সবগুলোতেই অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।
বাণিজ্য সংগঠনটি বলেছে, ‘যখন বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন আমরা আমাদের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য বাহ্যিক কোনো কারণকে দায়ী করলে চলবে না। বরং আমাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাই যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে অন্তরায় তা বুঝতে হবে।’
এমসিসিআই আগের মতোই কৃষি খাতের প্রতি সরকারের অব্যাহত নীতিগত সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। যাতে এ খাতটি শুধু টিকে না থেকে আরও বেশি প্রবৃদ্ধি করতে পারে। একইভাবে শিল্প ও সেবা খাতে সরকারের দৃষ্টি প্রত্যাশা করেছে। যাতে বিশ্বমন্দার প্রভাব কাটিয়ে আরও প্রসার ঘটানো যায়। অনুরূপভাবে রপ্তানিকারকদের সহায়ক বাণিজ্য নীতিমালা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছে সংগঠনটি। যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের পণ্য আরও প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রবেশ করতে পারে ও প্রসার ঘটে।
অবকাঠামো বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে পিপিপি দ্রুত বাস্তবায়ন এবং এ জন্য সরকারের প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়েছে এমসিসিআই। তারা বলেছে, ‘আমরা সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করছি, যাতে বিশালাকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাধাগ্রস্ত না হয়।’
এমসিসিআই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, বিশ্ববাজারে খাদ্য ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যার প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারেও অবধারিতভাবে পড়বে। সবার ওপরে যেটি রয়েছে সেটি হলো ব্যাংকগুলোতে বড় আকারের উদ্বৃত্ত তারল্য, যা মূল্যস্ফীতির জন্য একটা হুমকি। তারা বলেছে, ‘আমরা এটাও আশা করছি যে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে বাড়তি তারল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’

No comments

Powered by Blogger.