হঠাৎ সক্রিয় নতুন-পুরোনো সব জঙ্গিগোষ্ঠী by টিপু সুলতান
হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের নতুন-পুরোনো সব জঙ্গিগোষ্ঠী। ছোট ছোট নানা দলে ভাগ হয়ে সংগঠিত হচ্ছে নতুন নতুন নামে। দলে ভেড়াচ্ছে শিক্ষিত তরুণদের। অস্ত্র-বিস্ফোরকের মজুত গড়ার চেষ্টাও করছে তারা। কেউ কেউ সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও তথ্য মিলছে।
অনেক দিন ধরে দেশে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম তদারক করছেন—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর যেসব তৎপরতা গোয়েন্দা নজরদারিতে এসেছে, ২০০৫ সালের পর নয় বছরে এমনটা দেখা যায়নি।
হঠাৎ জঙ্গিদের তৎপরতা বাড়ার কথা স্বীকার করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলামও। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে উগ্র মতাদর্শীদের মধ্যে আইএসকে কেন্দ্র করে যে উন্মাদনা চলছে, তার প্রভাব এ দেশেও পড়েছে। এর মধ্যে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারিও বেড়েছে। যার কারণে গত ছয় মাসে বিভিন্ন উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর প্রায় ১০০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। অস্ত্র-বিস্ফোরকসহ বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ উপাদান উদ্ধার করা হয়েছে।
জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি তৎপর ব্লগার হত্যার ঘটনায় বহুল আলোচিত ও সদ্য নিষিদ্ধঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। সংগঠনটির একটি উপদল গত এপ্রিলে রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে নয়জনকে হত্যা করেছে। তহবিল সংগ্রহের জন্য জঙ্গিরা এমন আরও ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করছিল বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে।
রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএস থেকে গত ৩১ মে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক এক সেনা কর্মকর্তার ছেলে আবদুল্লাহ আল-গালিব। ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, গালিব মূলত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সহ-সমন্বয়ক। তিনি সম্প্রতি ‘জুনুদ আত-তাওহিদ ওয়াল খিলাফা’ নামে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৫-২০ জন সদস্য সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণও শুরু করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশের ঘোষণাসংবলিত যে সিডি উদ্ধার করা হয়, তাতে আইএসের প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হয়। ওই ভিডিওতে তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের চিত্রও সংযুক্ত করা হয়, যা আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইন্টারনেটে নিজস্ব ওয়েবপেজে আপলোড করা হয়।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে র্যা ব জঙ্গি সন্দেহে ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছে বিপুল অস্ত্র ও বিস্ফোরকসামগ্রী উদ্ধার করা হয়। র্যা বের কর্মকর্তাদের দাবি, এরা সবাই নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেডের’ সদস্য। ২০১৩ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রামে সংগঠনটির জন্ম।
খোঁজখবর করে জানা গেছে, কথিত এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীরাও মূলত আনসারুল্লাহর প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানীর অনুসারী। ব্লগার রাজীব হত্যা এবং এরপর জসিমউদ্দিন রাহমানী গ্রেপ্তার হওয়ার পর আনসারুল্লাহ নামটি ব্যাপক জানাজানি হওয়ায় চট্টগ্রামে দলটি নতুন নামে কার্যক্রম শুরু করে।
কয়েক মাস আগে রাজশাহীতে ইসলামি লিবারেশন ফ্রন্ট (আইএলএফ) নামে উগ্র মতবাদসংবলিত বক্তব্যসহ প্রচারপত্র ছড়ানো হয়। যদিও রাজশাহীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (সম্প্রতি পাবনায় বদলি হন) আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, চারঘাট উপজেলার হলিদিয়া রেলস্টেশনে এ রকম প্রচারপত্র পাওয়ার পর পুলিশ এ নিয়ে তদন্ত করে। কিন্তু এই নামের সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি।
ঢাকায় একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁরা এখন আইএলএফ বিষয়ে জানার চেষ্টা করছেন। কারণ, সাম্প্রতিককালে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁরা জেনেছেন যে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো নতুন করে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে পুরোনো নাম ব্যবহার করছে না। কারণ তাদের পুরোনো বা পরিচিত সংগঠনের নামে কাজ করলে কাজ শুরুর আগেই ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকে। সহজে সংগঠনের তৎপরতা সম্পর্কে পুলিশ ধারণা পেয়ে যায়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, রাজশাহীতে অধ্যাপক শফিউল হত্যার পর ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামে ফেসবুকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। এরপর লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যার আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামে টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলে দায় স্বীকার করা হয়। সম্প্রতি ‘আনসার বাংলা-১৩’ নামে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি এসেছে। এসব জঙ্গিদের নতুন নতুন নামে সংগঠিত হওয়ার নমুনা কিংবা মানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশলও হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এর আগে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে ডিবি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে, যারা ‘বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ’ নামে সংগঠিত হচ্ছিল। তাদের একটি আস্তানা থেকে বোমা তৈরির বিপুল উপকরণও উদ্ধার হয়। ওই অভিযানের নেতৃত্ব দেন ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা মূলত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত হুজি নেতা মুফতি আবু সাঈদ ওরফে জাফরের অনুসারী। কারাবন্দী আবু সাঈদের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ নামে সংগঠিত হয়ে দেশের সব ‘জিহাদিকে’ এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছিল।
হুজি মূলত মাদ্রাসায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের সংগঠন হিসেবে পরিচিত হলেও এই গ্রুপের মো. উমর ওরফে ফয়জুল নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও গ্রেপ্তার হন। তিনি রসায়ন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। তিনি এই গ্রুপের বোমা বিশেষজ্ঞ বলে ডিবি দাবি করে।
সম্প্রতি ঢাকার পৃথক স্থান থেকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয় ১০ জনকে। তাদের ৮ জুন গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে ডিবি। তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এদের মধ্যে মাওলানা নুরুল্লাহ কাশেমী কারাবন্দী হুজি নেতা মুফতি আবদুর রউফের অনুসারীদের সংগঠিত করছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে কাশেমী স্বীকার করেছেন যে তিনি রউফের অনুসারীদের ‘প্রকৃত জিহাদ’ কী, সেটা শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আর তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া ছেলে ফাহাদ বিন কাশেমী আবার নিজেকে হুজি বা রউফের অনুসারী নন, আইএসের অনুসারী বলে দাবি করেছেন।
ওই কর্মকর্তা বলে, ফাহাদ আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া যাওয়ার পথ খুঁজছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন। তাঁর বাসা থেকে উদ্ধার করা ল্যাপটপে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা আইএসের অনেক অডিও-ভিডিও পাওয়া গেছে। অবশ্য ফাহাদ বলেছেন, ওই ল্যাপটপ তাঁর ভগ্নিপতি মায়মুন মুনাজের।
অপর একটি সূত্র জানায়, মায়মুন মুনাজ সাবেক একজন সচিবের ছেলে। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি মাধ্যমে। তিনি আগে জামায়াতুল মুসলেমিনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত এই সংগঠনটির তিনজন সদস্য ২০০৯ সালে ইয়ামেনে আল-কায়েদাবিরোধী অভিযানে ধরা পড়েছিল। পরে দেশে ফেরার পর তারা অনেক দিন গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিল।
পারিবারিক সূত্র দাবি করছে, মায়মুন প্রায় আট মাস আগে উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়া গেছেন। কিন্তু ছয় মাস ধরে পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। গোয়েন্দাদের ধারণা, মায়মুন মালয়েশিয়া থেকে সিরিয়া গেছেন।
এ দেশে আইএস সন্দেহে গত ছয় মাসে ১৭ জন গ্রেপ্তার হয়। তারা দেশে আইএসের মতাদর্শ প্রচারে জড়িত ছিল এবং সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে অভিযোগ আছে। আইএস অনুসারী এই গোষ্ঠীটি দেশি-বিদেশি জঙ্গিনেতাদের বক্তব্য, পুস্তিকা, ফতোয়া এবং বোমা তৈরি ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের নির্দেশিকা বাংলায় অনুবাদ করে ইন্টারনেটে নিজস্ব ওয়েবপেজ ও অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে প্রচার করছিল। মূলত শিক্ষিত তরুণদের লক্ষ্য করে এসব তৎপরতা চলছিল।
ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ছোট আকারের দল গঠন করে এ দেশের কিছু যুবক আইএসের পক্ষে লড়াই করতে সিরিয়া বা ইরাক যাওয়ার চেষ্টা করছে। গত ২৪ মে গ্রেপ্তার হওয়া একটি বহুজাতিক কোমল পানীয় কোম্পানির তথ্যপ্রযুক্তি শাখার প্রধান আমিনুল বেগ এমন একটি দলের নেতা বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা। আমিনুল ও তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক সাকিব বিন কামাল জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেছেন, আইএসে যোগ দিয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করছে বাংলাদেশি দুই যুবক। আরও ১৫-২০ জন সিরিয়ায় যেতে সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এমন একজনকে গত শুক্রবার রাতে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর নাম ফায়েজ ইমাম খান, তিনিও একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার ছেলে।
তবে বাংলাদেশ থেকে কেউ সিরিয়া বা ইরাকে গিয়ে আইএসের হয়ে লড়ছে, এমন নিশ্চিত তথ্য দায়িত্বশীল কোনো সূত্র থেকে পাওয়া যায়নি। আইএসে যোগ দিতে দেশ ছেড়েছে, এমন অন্তত চারজনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এদের একজন ২১ বছরের তরুণী, যাকে আগাম খবর পেয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় ফেরত পাঠিয়েছে ওই দেশের কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ডা. আরাফাত, আশিকুর রহমান ও নিয়াজ মোর্শেদ নামের তিনজন দেশ ছেড়েছেন কয়েক মাস আগে। তাঁরা সিরিয়া পৌঁছেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে সিরিয়া গিয়ে লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে, এমন সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ তাঁরা পাননি। তবে আইএসে যোগ দিতে যাওয়ার চেষ্টা ও প্রস্তুতিকালে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অনেক দিন ধরে দেশে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম তদারক করছেন—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর যেসব তৎপরতা গোয়েন্দা নজরদারিতে এসেছে, ২০০৫ সালের পর নয় বছরে এমনটা দেখা যায়নি।
হঠাৎ জঙ্গিদের তৎপরতা বাড়ার কথা স্বীকার করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলামও। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে উগ্র মতাদর্শীদের মধ্যে আইএসকে কেন্দ্র করে যে উন্মাদনা চলছে, তার প্রভাব এ দেশেও পড়েছে। এর মধ্যে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারিও বেড়েছে। যার কারণে গত ছয় মাসে বিভিন্ন উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর প্রায় ১০০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। অস্ত্র-বিস্ফোরকসহ বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ উপাদান উদ্ধার করা হয়েছে।
জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি তৎপর ব্লগার হত্যার ঘটনায় বহুল আলোচিত ও সদ্য নিষিদ্ধঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। সংগঠনটির একটি উপদল গত এপ্রিলে রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে নয়জনকে হত্যা করেছে। তহবিল সংগ্রহের জন্য জঙ্গিরা এমন আরও ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করছিল বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে।
রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএস থেকে গত ৩১ মে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক এক সেনা কর্মকর্তার ছেলে আবদুল্লাহ আল-গালিব। ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, গালিব মূলত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সহ-সমন্বয়ক। তিনি সম্প্রতি ‘জুনুদ আত-তাওহিদ ওয়াল খিলাফা’ নামে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৫-২০ জন সদস্য সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণও শুরু করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশের ঘোষণাসংবলিত যে সিডি উদ্ধার করা হয়, তাতে আইএসের প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হয়। ওই ভিডিওতে তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের চিত্রও সংযুক্ত করা হয়, যা আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইন্টারনেটে নিজস্ব ওয়েবপেজে আপলোড করা হয়।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে র্যা ব জঙ্গি সন্দেহে ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছে বিপুল অস্ত্র ও বিস্ফোরকসামগ্রী উদ্ধার করা হয়। র্যা বের কর্মকর্তাদের দাবি, এরা সবাই নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেডের’ সদস্য। ২০১৩ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রামে সংগঠনটির জন্ম।
খোঁজখবর করে জানা গেছে, কথিত এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীরাও মূলত আনসারুল্লাহর প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানীর অনুসারী। ব্লগার রাজীব হত্যা এবং এরপর জসিমউদ্দিন রাহমানী গ্রেপ্তার হওয়ার পর আনসারুল্লাহ নামটি ব্যাপক জানাজানি হওয়ায় চট্টগ্রামে দলটি নতুন নামে কার্যক্রম শুরু করে।
কয়েক মাস আগে রাজশাহীতে ইসলামি লিবারেশন ফ্রন্ট (আইএলএফ) নামে উগ্র মতবাদসংবলিত বক্তব্যসহ প্রচারপত্র ছড়ানো হয়। যদিও রাজশাহীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (সম্প্রতি পাবনায় বদলি হন) আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, চারঘাট উপজেলার হলিদিয়া রেলস্টেশনে এ রকম প্রচারপত্র পাওয়ার পর পুলিশ এ নিয়ে তদন্ত করে। কিন্তু এই নামের সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি।
ঢাকায় একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁরা এখন আইএলএফ বিষয়ে জানার চেষ্টা করছেন। কারণ, সাম্প্রতিককালে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁরা জেনেছেন যে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো নতুন করে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে পুরোনো নাম ব্যবহার করছে না। কারণ তাদের পুরোনো বা পরিচিত সংগঠনের নামে কাজ করলে কাজ শুরুর আগেই ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকে। সহজে সংগঠনের তৎপরতা সম্পর্কে পুলিশ ধারণা পেয়ে যায়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, রাজশাহীতে অধ্যাপক শফিউল হত্যার পর ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামে ফেসবুকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। এরপর লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যার আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামে টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলে দায় স্বীকার করা হয়। সম্প্রতি ‘আনসার বাংলা-১৩’ নামে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি এসেছে। এসব জঙ্গিদের নতুন নতুন নামে সংগঠিত হওয়ার নমুনা কিংবা মানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশলও হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এর আগে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে ডিবি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে, যারা ‘বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ’ নামে সংগঠিত হচ্ছিল। তাদের একটি আস্তানা থেকে বোমা তৈরির বিপুল উপকরণও উদ্ধার হয়। ওই অভিযানের নেতৃত্ব দেন ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা মূলত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত হুজি নেতা মুফতি আবু সাঈদ ওরফে জাফরের অনুসারী। কারাবন্দী আবু সাঈদের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ নামে সংগঠিত হয়ে দেশের সব ‘জিহাদিকে’ এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছিল।
হুজি মূলত মাদ্রাসায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের সংগঠন হিসেবে পরিচিত হলেও এই গ্রুপের মো. উমর ওরফে ফয়জুল নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও গ্রেপ্তার হন। তিনি রসায়ন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। তিনি এই গ্রুপের বোমা বিশেষজ্ঞ বলে ডিবি দাবি করে।
সম্প্রতি ঢাকার পৃথক স্থান থেকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয় ১০ জনকে। তাদের ৮ জুন গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে ডিবি। তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এদের মধ্যে মাওলানা নুরুল্লাহ কাশেমী কারাবন্দী হুজি নেতা মুফতি আবদুর রউফের অনুসারীদের সংগঠিত করছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে কাশেমী স্বীকার করেছেন যে তিনি রউফের অনুসারীদের ‘প্রকৃত জিহাদ’ কী, সেটা শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আর তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া ছেলে ফাহাদ বিন কাশেমী আবার নিজেকে হুজি বা রউফের অনুসারী নন, আইএসের অনুসারী বলে দাবি করেছেন।
ওই কর্মকর্তা বলে, ফাহাদ আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া যাওয়ার পথ খুঁজছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন। তাঁর বাসা থেকে উদ্ধার করা ল্যাপটপে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা আইএসের অনেক অডিও-ভিডিও পাওয়া গেছে। অবশ্য ফাহাদ বলেছেন, ওই ল্যাপটপ তাঁর ভগ্নিপতি মায়মুন মুনাজের।
অপর একটি সূত্র জানায়, মায়মুন মুনাজ সাবেক একজন সচিবের ছেলে। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি মাধ্যমে। তিনি আগে জামায়াতুল মুসলেমিনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত এই সংগঠনটির তিনজন সদস্য ২০০৯ সালে ইয়ামেনে আল-কায়েদাবিরোধী অভিযানে ধরা পড়েছিল। পরে দেশে ফেরার পর তারা অনেক দিন গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিল।
পারিবারিক সূত্র দাবি করছে, মায়মুন প্রায় আট মাস আগে উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়া গেছেন। কিন্তু ছয় মাস ধরে পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। গোয়েন্দাদের ধারণা, মায়মুন মালয়েশিয়া থেকে সিরিয়া গেছেন।
এ দেশে আইএস সন্দেহে গত ছয় মাসে ১৭ জন গ্রেপ্তার হয়। তারা দেশে আইএসের মতাদর্শ প্রচারে জড়িত ছিল এবং সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে অভিযোগ আছে। আইএস অনুসারী এই গোষ্ঠীটি দেশি-বিদেশি জঙ্গিনেতাদের বক্তব্য, পুস্তিকা, ফতোয়া এবং বোমা তৈরি ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের নির্দেশিকা বাংলায় অনুবাদ করে ইন্টারনেটে নিজস্ব ওয়েবপেজ ও অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে প্রচার করছিল। মূলত শিক্ষিত তরুণদের লক্ষ্য করে এসব তৎপরতা চলছিল।
ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ছোট আকারের দল গঠন করে এ দেশের কিছু যুবক আইএসের পক্ষে লড়াই করতে সিরিয়া বা ইরাক যাওয়ার চেষ্টা করছে। গত ২৪ মে গ্রেপ্তার হওয়া একটি বহুজাতিক কোমল পানীয় কোম্পানির তথ্যপ্রযুক্তি শাখার প্রধান আমিনুল বেগ এমন একটি দলের নেতা বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা। আমিনুল ও তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক সাকিব বিন কামাল জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেছেন, আইএসে যোগ দিয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করছে বাংলাদেশি দুই যুবক। আরও ১৫-২০ জন সিরিয়ায় যেতে সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এমন একজনকে গত শুক্রবার রাতে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর নাম ফায়েজ ইমাম খান, তিনিও একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার ছেলে।
তবে বাংলাদেশ থেকে কেউ সিরিয়া বা ইরাকে গিয়ে আইএসের হয়ে লড়ছে, এমন নিশ্চিত তথ্য দায়িত্বশীল কোনো সূত্র থেকে পাওয়া যায়নি। আইএসে যোগ দিতে দেশ ছেড়েছে, এমন অন্তত চারজনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এদের একজন ২১ বছরের তরুণী, যাকে আগাম খবর পেয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় ফেরত পাঠিয়েছে ওই দেশের কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ডা. আরাফাত, আশিকুর রহমান ও নিয়াজ মোর্শেদ নামের তিনজন দেশ ছেড়েছেন কয়েক মাস আগে। তাঁরা সিরিয়া পৌঁছেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে সিরিয়া গিয়ে লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে, এমন সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ তাঁরা পাননি। তবে আইএসে যোগ দিতে যাওয়ার চেষ্টা ও প্রস্তুতিকালে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
No comments