তমসাচ্ছন্ন সময়ে জননী সাহসিকা by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর একটি কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। তা হলো, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের অপরাধে অংশগ্রহণকারীদের বিচার করা। ১৯৭২ সালের দালাল আইনে অনেক দালাল এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোদ্ধাকে গ্রেফতার এবং বিচার শুরু হয়।
তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার আইন অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন পাস করতে দেরি হয়। এটি সংসদে পাস করা হয় ১৯৭৩ সালে। এরপর ঘটল পঁচাত্তরের আগস্টের সেই মর্মান্তিক ঘটনা। বাংলাদেশ বেতার হলো রেডিও বাংলাদেশ। জয় বাংলার পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। অল্পদিনের ভেতর বিচারপতি সায়েম জেনারেল জিয়া সরকার দালাল আইন বাতিল করল, দালাল-রাজাকারদের ছেড়ে দেওয়া হলো। দুই লে. জেনারেল যথা জিয়া ও এরশাদের সরকার রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ব্যাপকভাবে পুনর্বাসন করল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব অপরাধী কী জঘন্য অপরাধ করেছে, কীভাবে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে_ এসব যেন নতুন প্রজন্ম না জানে সে জন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে তৎকালীন শাসকরা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো তেমন দৃঢ়তার সঙ্গে এই ইতিহাস বিকৃতির কাজকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেনি। ঠিক এমনই তমসাচ্ছন্ন সময়ে এগিয়ে এলেন মহীয়সী নারী শহীদজননী জাহানারা ইমাম। গঠন করা হলো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। অবশ্য তার এ কাজে আরেকজন মহীয়সী নারী বেগম সুফিয়া কামাল সমর্থন জুগিয়েছেন। সে সঙ্গে দেশের প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিকরা এগিয়ে আসেন। ১৯৯২ সালের ২৫ মার্চ গণ-আদালত গঠন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার উপস্থিতিতে গোলাম আযমের দণ্ড ঘোষণা করা হয়। এটি গোটা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না যুদ্ধাপরাধীদের ছাড়া। লৌহ সংকল্প নিয়ে তিনি এগিয়ে গেছেন। তৎকালীন সরকার তাকেসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দিয়েছিল। তার মেধাবী ছেলে রুমী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমাম পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শহীদজননী জাহানারা ইমাম দেশদ্রোহের মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার উদাত্ত আহ্বান এবং অসাধারণ সাংগঠনিক তৎপরতায় সবাই একত্র হন। গড়ে ওঠে আন্দোলনের জোয়ার। নতুন প্রজন্ম জানতে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের কলঙ্কময় ঘটনা। দেশব্যাপী এই আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয়েছে বহু প্রতীক্ষিত যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার। কার্যক্রম মন্থর। আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে বিচার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার। তবে এটা মনে রাখতে হবে, যারা এ বিচারকার্যে বাধা দিচ্ছে তারা কিন্তু বলছে না যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা চলবে না। তাদের বক্তব্য, বিচারকার্য সুষ্ঠুভাবে হতে হবে। আইন পর্যাপ্ত নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এটাই আমাদের অর্জন। বিশ্বের দরবারে গোলাম আযম, নিজামীদের তো আরেকটা পরিচয় সবাই জেনেছে যে, এরা যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত। এই বিচারকার্য কতদিনে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে নির্মূল কমিটির কোনো চিন্তা-ভাবনা করার সময় নেই। সেই চিন্তা করার সময় তারা হেলায় হারিয়েছে। তাদের কর্তব্য হলো নতুন প্রজন্মকে সচেতন এবং অবহিত করার কাজ চালিয়ে যাওয়া। তাহলে পরবর্তী সরকার এসে এই বিচারকাজ বন্ধ করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে যেন দেশব্যাপী প্রতিবাদ আসে। আর নতুন প্রজন্ম সে ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। কত বড় ঝুঁকি নিয়ে শহীদজননী জাহানারা ইমাম কী অসাধারণ কাজ করেছেন! এ ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সংবলিত একটি জীবনী প্রকাশ করে তা ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ইতিহাসে সবার নাম লেখা থাকবে না বা তা সম্ভব নয়। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসে তিনটি নাম বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকবে; তাঁরা হলেন_ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ এবং শহীদজননী জাহানারা ইমাম। আজ জন্মদিনে জাহানারা ইমামের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : মুক্তিযোদ্ধা
সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : মুক্তিযোদ্ধা
No comments