কল্পকথার গল্প-'...মূর্তি ভাবে আমি দেব_' by আলী হাবিব

ত রকমের মানুষ আছে এই পৃথিবীতে? পৃথিবীর কথা বাদ দিয়ে আমাদের দেশের কথাই বলা যাক। কত রকমের মানুষ আছে আমাদের দেশে? কিছুদিন আগে তো আদমশুমারি হয়ে গেল। সে হিসাব থেকে জানা গেছে, দেশে মানুষের সংখ্যা কত। মানুষের পেশা, থানাসংখ্যা ইত্যাদির হিসাব নিশ্চয়ই তাতে আছে। আছে পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা। শিশু ও যুবকের সংখ্যা থাকাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কত প্রকার মানুষ আছে আমাদের দেশে? মনে হতে পারে, মানুষ তো মানুষই, তার


আবার প্রকারভেদ কী? মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মানুষের প্রকারভেদ হতেই পারে। না হওয়ার কোনো কারণও নেই। এ কালের এক গায়ক তো গলা ছেড়ে গেয়েছেন, '... পুরুষ মানুষ দুই প্রকার_জীবিত বিবাহিত'। এই যুক্তিটাই মেনে নেওয়া যাক। পুরুষ মানুষ যদি দুই প্রকার হতে পারে, তাহলে মানুষের প্রকারভেদ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মানুষও অনেক রকমের হতে পারে। আপাতত আমরা এই জীবিত বা জীবন্ত মানুষের সঙ্গে আরেক ধরনের মানুষ নিয়ে আলোচনা করি। কেমন মানুষ? ঘুমন্ত।
ঘুম আমাদের শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই। ঘুমের ওষুধ দেদারসে বিকোচ্ছে ওষুধের দোকানে। একটা সময় ছিল, যখন নেশার জন্যও ব্যবহৃত হতো ঘুমের ওষুধ। হিসাব করলে বোধ হয় দেখা যাবে, ওষুধের দোকানে ঘুমের ওষুধই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। আর চারদিকের যা অবস্থা, তাতে ঘুমের ওষুধ ছাড়া স্বাভাবিক মানুষের ঘুম সহজে আসবে না। অবশ্য ঘুমন্ত মানুষ হলে অন্য কথা। এক মনীষী বলেছেন, 'জীবন্ত মানুষের চেয়ে ঘুমন্ত মানুষ বেশি উপভোগ্য ও বৈচিত্র্যময়'। যত্রতত্র, যখন-তখন ঘুমিয়ে পড়া মানুষের কথাও আজকাল শোনা যায়। খবরের কাগজে তো প্রায়ই দেখা যায় গাড়ি চালাতে চালাতে ড্রাইভারের ঘুমিয়ে পড়ার খবর। কিন্তু এর বাইরেও এক ধরনের ঘুমন্ত মানুষের দেখা মেলে আজকাল। এই শ্রেণীর মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জীবনটা পার করে দিল। এটা অনেকটা জেগে ঘুমানো। এভাবে না ঘুমিয়ে উপায়ও নেই। ঘুম অনেকটা ওষুধের মতো কাজ করে। রাতের ঘুম যেমন আমাদের দিনের ক্লান্তি দূর করে পরদিন কাজ করার শক্তি দেয়, তেমনি এভাবে ঘুমোতে পারলে আর কোনো চিন্তা নেই। ঘুমিয়ে গেলে আমরা চোখে দেখি না, স্বপ্ন দেখি। তেমনি জেগে ঘুমোতে পারার মতো আরামদায়ক ব্যাপার আর কিছু নেই। বিশেষ করে আজকের দিনে। জেগে জেগে ঘুমিয়ে যেতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সংসারে সমস্যার অন্ত নেই। সংসারী লোকের জন্য আজকের দিনে সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গাটি হচ্ছে বাজার। বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম শুনলে অনেকের সুগার লেভেল বেড়ে যায়। বেড়ে যায় রক্তচাপ, হার্টবিট। যাঁদের এমন হয়, তাঁদের বলছি, ঘুমিয়ে যান। নিজের অস্তিত্ব ভুলে যান। দেখবেন বাজারদর আর আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে না। এর পাশাপাশি অনেক সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে। ঘুমিয়ে গেলে তো আর কোনো অনুভূতি থাকে না। নাকের ডগায় ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে, ঘুমিয়ে যান। দেখেও দেখবেন না। সয়ে যাবে। দেখলেই ঝামেলা।
জীবন্ত মানুষ, ঘুমন্ত মানুষ_এসবের পাশাপাশি আছে কিছু পাগল মানুষ। নানা ধরনের পাগল মানুষ সমাজে দেখতে পাওয়া যায়। কাজপাগল মানুষ তো আমরা দেখতেই পাই। এর পাশাপাশি কিছু ভাবের পাগলও ঘুরে-ফিরে বেড়াতে দেখা যায়। কত রকমের পাগল থাকতে পারে? প্রেমে পাগল কারা হয়, এটা আমাদের জানা। কে কার প্রেমে পাগল সেটাও আমরা জানি। সময়ে সময়ে নানা রকম পাগলের আমদানি দেখি আমরা। কয়েক দিন আগে খবরের কাগজে এক বিয়েপাগল মানুষের খবর বেরিয়েছিল। দেশে যখন নির্বাচন আসে, তখন ভোটপাগল কিছু মানুষ দেখা যায়। এমনিতেই প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষ তো মানুষই। তার মধ্যে জীবন্ত, ঘুমন্ত কিংবা পাগল আসে কী করে?
মনোজ বসুর একটা গল্পের আশ্রয় নেওয়া যাক। স্বর্গরাজ্যের নিয়ম এ রকম যে, ঊধর্ে্ব চলে যাওয়া আত্মা আবার ভ্রূণের মাধ্যমে মর্ত্যে জন্ম লাভ করবে। এভাবেই জন্ম নেবে নতুন মানব সন্তান। রিসাইকল বিন বলে একটা কথা আজকাল চালু হয়েছে, অনেকটা সেই ব্যবস্থা। এই আত্মা সাপ্লাই দেওয়ার দায়িত্ব যমরাজের। তাঁর দপ্তর থেকেই আত্মা সাপ্লাই করা হতো। দেখা গেল, সাপ্লাইতে টান পড়েছে। ডিমান্ড আর সাপ্লাই মিলছে না। ডিমান্ডের চেয়ে সাপ্লাই কম। ফলে জন্মহার কমে গেল। কী হবে? এমন হলে তো আর ঈশ্বরের চলবে না। আগে কখনো স্টকে টান পড়েনি। খবর গেল যমের দপ্তরে। খবর পেয়ে যমরাজ স্বয়ং গেলেন যমালয়ে অবস্থা দেখতে। গিয়ে দেখেন, সেখানকার ম্যানেজার অর্থাৎ চিত্রগুপ্ত নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। কড়া ধমক দিলেন যমরাজ। যমরাজের ধমকে বিষম খেতে খেতে উঠে বসলেন চিত্রগুপ্ত। যমরাজ তাঁর কাছে আত্মার স্টকের কথা জানতে চাইলেন। চিত্রগুপ্ত জানালেন, ভাঁড়ার শূন্য। তাই ডিমান্ড থাকলেও সাপ্লাই নেই। সাপ্লাই না থাকলে তাঁর কোনো কাজ থাকে না বলেই দিবানিদ্রা দিচ্ছিলেন তিনি। চিত্রগুপ্তের কথা শুনে যমরাজের কপালে ভাঁজ পড়ল। যমদূতদের পাঠানো হলো আত্মা সংগ্রহে। কিন্তু কেউ মরছে না। তিনি ছুটলেন মর্ত্যে। আত্মা চাই তাঁর। মানুষের অসাধ্য কোনো কাজ নেই। মানুষ নানা ধরনের ওষুধ বের করেছে। কী সব অ্যান্টি এজিং ওষুধ। দীর্ঘায়ু হওয়ার ওষুধ। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ_হেন শাস্ত্র নেই, যে শাস্ত্রমতে এসব ওষুধ তৈরি হয়নি। যার যেমন রেস্ত, সে তেমন কিনে খাচ্ছে। সবার চাওয়া দীর্ঘজীবন। মর্ত্যের এক কবি, যিনি এখন স্বর্গে, তিনি আবার এক কবিতা লিখে একটা ঝামেলা বাধিয়েছেন। 'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে'। কবিদের কবিতা আবার মারাত্মক টনিক। সবাই ওষুধ কিনে খাচ্ছে। মরছে না। মরছে না বলে আত্মা স্বর্গে যাচ্ছে না। রিসাইকল হচ্ছে না। যমরাজ সব দেখেশুনে এসে ঈশ্ব্বরের কাছে লিখিত রিপোর্ট দিলেন। কে শোনে কার কথা! কড়া হুকুম, আত্মা চাই। নতুন আত্মা। সৃষ্টিকর্ম বিঘি্নত করা যাবে না। যমরাজ বুঝলেন, যমদূতদের দিয়ে হবে না। বুড়ো চিত্রগুপ্তকে নিয়ে তিনি নিজেই গেলেন মর্ত্যে। মর্ত্যে গিয়ে দুজন নামলেন দুদিকে। অনেককেই মরার জন্য বললেন। বোঝালেন যে বেশি দিন বেঁচে থাকা মানেই ঝক্কি। ব্লাড সুগার, ব্লাড প্রেশার, পালসবিট ওপরের দিকে। কখনো আবার অনিয়মিত। লাগাও পেসমেকার। পানির মতো টাকা বেরিয়ে যাবে। ডাক্তারের চেম্বারের সামনে বসে ঝিমুতে হবে। বিরক্তির একশেষ। কিন্তু তার পরও কেউ তাঁদের কথা শুনতে চায় না। এত ঝক্কি, এত ঝামেলা। অফিসে বড় কর্তা, বাড়িতে স্ত্রীর মুখ ঝামটা সইতে হয়। মৃত্যুর কথা বলতেই এক সাবেক মস্তান সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তাড়া করে যমরাজকে। কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচা। এক ব্যর্থ নায়িকা পায়ের জুতো খুলে চিত্রগুপ্তকে ছুড়ে মারেন। চিত্রগুপ্ত তাঁকে বোঝাতে গিয়েছিলেন, 'মাগো, অনেক তো হলো, কোথাও তো আর থই পেলে না। পসার যখন জমছে না, তখন আর এ জীবন রেখে কী লাভ? মরে যাও। আর জনমে নায়িকা হয়ে জন্মিও। পাকা কথা দিচ্ছি। লিখিত ডিড করে দেব মা। মরতে রাজি হও। আত্মহত্যা করো।' অমনি পায়ের জুতো খুলে ছুড়ে মারেন সেই ব্যর্থ নায়িকা। ভাগ্যিস লাগেনি, লাগলে চিত্রগুপ্তকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো। বিফল-মনোরথ হয়ে ফিরলেন দুজন। কী করা যায়, এ নিয়ে আলোচনায় বসলেন। ঠিক করলেন, আর্টিফিসিয়াল আত্মা তৈরি করবেন।
মর্ত্যে তাঁরা দেখেছেন, আর্টিফিসিয়াল অনেক অর্গান তৈরি হয়। আজকাল আবার রোবট হাত তৈরি হচ্ছে। এসব দেখেশুনে যমরাজ আর চিত্রগুপ্ত মিলে ঠিক করেছেন যে তাঁরা আর্টিফিসিয়াল আত্মা তৈরি করবেন। কিন্তু দেখা গেল, তা হওয়ার জো নেই। যমরাজের দরবারে বাজেট ঘাটতি। আর্টিফিসিয়াল আত্মা তৈরি করতে গেলে যে খরচ হবে, তাতে বাজেটে কুলোবে না। ঘাটতি দেখা দেবে। নতুন বাজেট বরাদ্দ নিতে গেলে তা নিয়ে কথা উঠবে।
কী করা যায়? মুখে হাত দিয়ে ভাবতে ভাবতে যমরাজের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ভেজাল দিতে হবে। মর্ত্যে গিয়ে দুজনই দেখেছেন, সেখানে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া হয়। চালে কাঁকর মেশানো হয়। যমরাজ চিত্রগুপ্তকে হুকুম দিলেন, চালাও ভেজাল। ভেজাল মিশিয়ে সাপ্লাই বাড়িয়ে দাও। খাঁটি মানুষের আত্মা শর্ট পড়েছে তো কী হয়েছে, মিশেল দিয়ে আত্মা সাপ্লাই দিয়ে দাও। কেউ বুঝতে পারবে না। যেমন কথা তেমন কাজ। সাপ্লাই দেওয়া হলো। সেই থেকে ঘুমন্ত ও পাগল কিছু চলে এলো মর্ত্যে। ওই পাগলদের মধ্যে ভোটপাগলও যে পাওয়া যাবে, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? ভোটের সময় এলে ভোটপাগলদের দেখা মিলবে।
তো ভোটের কথা যখন এলো, তখন সাম্প্রতিক ভোট নিয়ে কথা বলা যাক। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর নানা আলোচনা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পদপ্রার্থীর পরাজয় এবং বিএনপি থেকে বিতাড়িত প্রার্থীর জয়ে অনেকেই বলছেন, দুই নেত্রীর পরাজয় হয়েছে। আসলে কি তা-ই? সাক্কু জিনেছেন, আফজল খান জিতেছেন। মাঝখান থেকে কিন্তু জিতে গেল ইভিএম পদ্ধতি। এটাই হচ্ছে বড় প্রাপ্তি। আরেক প্রাপ্তি হচ্ছে, দলীয় সরকারের আমলেও যে নিরপেক্ষ ভোট হতে পারে, সেটা প্রমাণ করে দিল নির্বাচন কমিশন। কোনো ব্যক্তি বা দলের জয়-পরাজয়ের চেয়ে এই দুই প্রাপ্তিই বোধ হয় কুমিল্লা নির্বাচনের বড় পাওয়া। জয়ী হয়েছে ইভিএম ও নির্বাচন কমিশন।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.