কালান্তরের কড়চা-বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা নিয়ে কিছু স্মৃতিকথা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রতিবছর ১০ জানুয়ারি তারিখটি ফিরে এলেই আমরা পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিবসটি পালন করি। তাঁকে স্মরণ করি। মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য শেষে জাতির জনক জাতির কাছে ফিরে এসেছিলেন এবং দেশের মাটিতেই সমাহিত আছেন। আমি যখনই টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে যাই, তাঁর সমাধির পাশে দাঁড়াই, তখনই দিলি্লর কাছে সেকেন্দ্রায় মোগল সম্রাট আকবরের সমাধি দর্শন করে লেখা বাঙালি কবির
বিখ্যাত কবিতাটির প্রথম দুটি লাইন স্মরণ করি। আমি কবিতাটির মোগল কথাটির জায়গায় বাঙালি শব্দটি বসিয়ে সেটি মনে মনে পাঠ করি।
'এইখানে বাঙালির মুকুট-রতন
শায়িত শান্তির মাঝে, পথিক সুজন
নেহারিয়া এ সমাধি ভক্তিপ্লুত মনে
সম্ভ্রমে নোয়ায় শির হৃদয়-গগনে।'
তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের পর ইসমত ইনুনু (তাঁর সহকর্মী) প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর বলেছিলেন, 'আমি আতাতুর্ককে (তুরস্কের পিতাকে) তাঁর জীবনকালেই দেখেছি এবং তাঁর সাহচর্য পেয়েছি এটাই আমার গর্ব।' আমিও তাঁর মতো বলতে পারি, 'আমি বাঙালি জাতির পিতাকে তাঁর জীবনকালেই দেখেছি এবং তাঁর সাহচর্য পেয়েছি_এটাই আমার গর্ব।'
মুক্তিযুদ্ধের গোড়ায় আমি তখন কলকাতায়। ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি হানাদাররা ধরে নিয়ে গেছে_এটুকুই মাত্র তখন আমাদের জানা। তিনি কোথায় এবং তাঁকে হত্যা করা হয়েছে কি না তা কারো জানা নেই। সবার মনেই দারুণ নৈরাশ্য। এই সময় ননীগোপাল মিত্র নামে কলকাতার এক জ্যোতিষীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রে আমার তেমন বিশ্বাস নেই, তবু কৌতূহল এবং অর্ধবিশ্বাস নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কি না তিনি কি বলতে পারবেন? তিনি বললেন, 'কেন পারব না? তাঁর জন্ম তারিখ, দিনক্ষণ আমি জেনেছি এবং কিছুদিন হয় তাঁর ভাগ্য গণনা করেছি।' জ্যোতিষীকে বললাম, তাহলে বলুন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কি না? তিনি বললেন, 'বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এবং সুস্থ আছেন। তবে তিনি দেশের বাইরে।'
আনন্দে লাফিয়ে উঠেছি। বিশ্বাস আর কৌতূহল_দুই-ই তখন বেড়েছে। জিজ্ঞাসা করেছি, তিনি কি জীবিত অবস্থায় দেশে ফিরতে পারবেন? জ্যোতিষী বলেছেন, 'নিশ্চয়ই পারবেন। আগামী বছর আপনারা তাঁকে ফিরে পাবেন।' বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার চেয়েও তিনি বেঁচে আছেন_এই খবরটাই তখন আমার কাছে বড়, আমি দৌড়ে গেছি মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে। সব বাধা টপকে তাঁর কাছে গেছি এবং খবরটা তাঁকে জানিয়েছি। একজন জ্যোতিষীর কথা কতটা সঠিক কেউ জানেন না। তবু তাজউদ্দীন আহমদের চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। বলেছিলেন, 'ননীগোপাল মিত্রকে আমার কাছে একদিন নিয়ে আসুন।'
এর পর দুই দিনও যায়নি, ভারত সরকার নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর জেনে মুজিবনগর সরকারকে জানিয়ে দিল যে বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এবং তিনি পাকিস্তানের (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) কারাগারে বন্দি। এই খবরটা যেদিন জানা গেল, সেদিন আমি কলকাতার বালু হাক্কাক লেনে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা'র চলতি সংখ্যার প্রকাশ নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখি, জিল্লুর ভাই (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান), টাঙ্গাইলের এমপি (তখন এমএনএ) আবদুল মান্নান এবং চট্টগ্রামের এমপি অধ্যাপক খালেদ (দৈনিক আজাদীর সাবেক সম্পাদক) 'জয়বাংলা' অফিসে এসে উপস্থিত। বঙ্গবন্ধু যে বেঁচে আছেন, সেই খবরটি জিল্লুর রহমানই প্রথমে সবাইকে জানালেন।
তখন জয়বাংলা অফিসে অনেকেই উপস্থিত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের 'চরমপত্র'খ্যাত এম আর আখতার মুকুলও। তখন অফিসজুড়ে সে কি কান্না আর আনন্দের হুল্লোড়। জিল্লুর ভাই পকেট থেকে টাকা বের করলেন। 'জয়বাংলা' অফিসে তখন থাকতেন ঢাকার অধুনালুপ্ত সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক এবং চিত্র পরিচালক ফজলুল হক (ঢাকার চ্যানেল আই টেলিভিশনের ফরিদুর রেজা সাগরের বাবা)। তিনি ছুটে গেলেন মিষ্টি কিনে নিয়ে আসতে। সারা দিন ধরে চলেছিল জয়বাংলা অফিসে আনন্দোৎসব। সেদিনটিকেই তখন আমাদের কাছে মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে যেদিন বঙ্গবন্ধু সত্য সত্যই স্বাধীন স্বদেশে ফিরে এলেন (১০ জানুয়ারি, ১৯৭২), সেদিন আমি কলকাতায়। আমার মেয়ে ইন্দিরার সেদিন জন্ম বালিগঞ্জ হাসপাতালে। দেশে ফিরতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সারা ঢাকা শহরে যে জন-ভূকম্প শুরু হবে_তাতে আমি থাকতে পারব না_ভেবে একটু মনঃকষ্টে ছিলাম। তখন ফ্যাঙ্ আবিষ্কৃত হয়নি। ইন্টারনেট নেই। বিদেশে বসে দেশের টেলিভিশন দেখা যায় না। আমি আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়ে ঢাকা থেকে টেলেঙ্ েআসা বঙ্গবন্ধু সংবর্ধনার খবর পড়ে, রেডিও শুনে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছি।
আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক তখন ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরী। সিলেটে বাড়ি, শান্তি নিকেতনে লেখাপড়া করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরাট সমর্থক ছিলেন। এখনো বেঁচে আছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটিতে তিনি ছিলেন ঢাকায় এবং বিমানবন্দরেও হাজির ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে।
আমি তখনো কলকাতায়। শিশুকন্যাকে নিয়ে দেশে ফেরার উদ্যোগ নিয়েছি। কলকাতা ছাড়ার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আনন্দবাজার অফিসে গিয়েছি। অমিতাভ চৌধুরী আমাকে দেখেই বললেন, 'তোমাকে একটা কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছি।' বলেছি, অমিতাভ দা, কী কথা? তিনি বললেন, 'শেখ মুজিব যে সত্য সত্যই তোমাকে ভালোবাসেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি।' জিজ্ঞাসা করেছি, কী করে পেলেন? অমিতাভ দা বললেন, 'বিমানবন্দরে নেমে তিনি ২৫ মার্চ এবং ১৪ ডিসেম্বর রাতের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম জানছিলেন আর অঝোরে কাঁদছিলেন। হঠাৎ একসময় চোখ মুছে বললেন, গাফ্ফার কোথায়? তাঁকে জানানো হলো গাফ্ফার বেঁচে আছে এবং এখনো কলকাতায়। শুনে তিনি পরম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।' আমি অমিতাভ চৌধুরীর কথা শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। একেই বলে মহামানব। নইলে একটি ভয়াবহভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে এবং অসংখ্য স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে একজন নগণ্য সাংবাদিককে স্মরণ করা এবং তার খোঁজ নেওয়া একজন মহামানবের পক্ষেই সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি জসীমউদ্দীন, বেগম সুফিয়া কামাল ও প্রবীণ-নবীন আরো অনেকে। শামসুর রাহমান তখনই নয়, অনেক পরে তাঁকে নিয়ে তো দুটি অবিস্মরণীয় কবিতা লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে থাকতেই তাঁকে নিয়ে চার লাইনের একটি অমর ছড়া লিখেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়। এক বিখ্যাত ব্রিটিশ কলামিস্ট তো তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন, 'এ পোয়েট অব পলিটিকস।'
আমার ধারণা, এ সময় কবি নজরুল ইসলাম যদি সুস্থ থাকতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লিখতেন, যে কবিতাটি হতো তাঁর আরেকটি শ্রেষ্ঠ অনুবাদ কবিতার মতো :
'দুঃখ কি ভাই, হারানো ইউসুফ
আবার কেনানে আসিবে ফিরে
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুনঃ
হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে।'
আমি ফেব্রুয়ারি ('৭২) মাসে কলকাতা থেকে দেশে ফিরেছি। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। জানতাম, তাঁর ৩২ নম্বর বাড়িতে এবং গণভবনেও এত ভিড় যে এখন দেখা করতে গেলেও ভিড় ঠেলে এগোতে পারব না। এ সময় একদিন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে বসে আছি, দেখি মোহাম্মদ হানিফ (পরবর্তীকালে ঢাকার মেয়র, তখন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী) এসে হাজির। আমাকে দেখে বললেন, গাফ্ফার ভাই, আমি আপনাকে খুঁজছি, আর আপনি এখানে বসে আছেন?' বলেছি, কেন খুঁজছেন? হানিফ বললেন, 'লিডারের নির্দেশ, আপনাকে ধরে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া।' হানিফ আমাকে টানতে টানতে তাঁর গাড়িতে তুলেছিলেন।
তখন বিকেল। গণভবনে পেঁৗছে দেখি, ওয়েটিং রুম থেকে বারান্দা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হলে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে জানি না! হানিফ বললেন, 'আমি লিডারকে খবর দিতে যাচ্ছি।' বলে তিনি চলে গেলেন। রফিকুল্লাহ চৌধুরী তখন বঙ্গবন্ধুর সচিব। ভিড় সামলাচ্ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার সহপাঠী। আমাকে দেখেই বললেন, 'তোকে আর এখানে বসতে হবে না। প্রাইম মিনিস্টার তোর জন্য অপেক্ষা করছে। চল-চল, ভেতরে চল।'
আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধু সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দুবাহু বাড়িয়ে দিলেন (এটা আমার জীবনের বিরল সৌভাগ্য)। আমি জীবনে প্রথম তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করেছি। তিনি আমাকে বুকে টেনে নিয়েছেন, বলেছেন, 'আজ মানিক ভাই (ইত্তেফাক সম্পাদক) নেই। তোমাকেও না দেখলে বড় কষ্ট পেতাম।' বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে মনে হয়েছে, এটা তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নয়, আমারই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
এর পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেক বিদেশি সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী সাক্ষাৎ করেছেন। তার কয়েকটিতেই আমি ছিলাম। যেমন সৈয়দ মুজতবা আলী, ফ্রান্সের আঁন্দ্রে মার্লো প্রমুখ। আঁন্দ্রে মার্লো ঢাকায় কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় বলেছেন, 'আমি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত প্যারিস শহর দেখেছি, তোমাদের ঢাকা শহরের অবস্থা তার চেয়ে ভালো নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফ্রান্সে দ্য গলে ফিরে এসেছিলেন মানুষের মনে আশা ও ভরসা জাগিয়ে। তোমাদের বঙ্গবন্ধুও বিজয় সাফল্য নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এটা তোমাদের পরম সৌভাগ্য। আমাদের দ্য গলের চেয়েও তাঁর কীর্তি ও মহত্ত্ব আরো বিরাট।'
এর পরও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, তাঁর মহত্ত্বকে খাটো করার অপচেষ্টারত এই বাংলাদেশেই কিছু কুসন্তানের দেখা পাওয়া যায়। আমি তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশেরই প্রাচীন কবির ভাষায় বলি : 'সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।'
লন্ডন, ৯ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১২
« পূর্ববর্তী সংবাদ
'এইখানে বাঙালির মুকুট-রতন
শায়িত শান্তির মাঝে, পথিক সুজন
নেহারিয়া এ সমাধি ভক্তিপ্লুত মনে
সম্ভ্রমে নোয়ায় শির হৃদয়-গগনে।'
তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের পর ইসমত ইনুনু (তাঁর সহকর্মী) প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর বলেছিলেন, 'আমি আতাতুর্ককে (তুরস্কের পিতাকে) তাঁর জীবনকালেই দেখেছি এবং তাঁর সাহচর্য পেয়েছি এটাই আমার গর্ব।' আমিও তাঁর মতো বলতে পারি, 'আমি বাঙালি জাতির পিতাকে তাঁর জীবনকালেই দেখেছি এবং তাঁর সাহচর্য পেয়েছি_এটাই আমার গর্ব।'
মুক্তিযুদ্ধের গোড়ায় আমি তখন কলকাতায়। ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি হানাদাররা ধরে নিয়ে গেছে_এটুকুই মাত্র তখন আমাদের জানা। তিনি কোথায় এবং তাঁকে হত্যা করা হয়েছে কি না তা কারো জানা নেই। সবার মনেই দারুণ নৈরাশ্য। এই সময় ননীগোপাল মিত্র নামে কলকাতার এক জ্যোতিষীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রে আমার তেমন বিশ্বাস নেই, তবু কৌতূহল এবং অর্ধবিশ্বাস নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কি না তিনি কি বলতে পারবেন? তিনি বললেন, 'কেন পারব না? তাঁর জন্ম তারিখ, দিনক্ষণ আমি জেনেছি এবং কিছুদিন হয় তাঁর ভাগ্য গণনা করেছি।' জ্যোতিষীকে বললাম, তাহলে বলুন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কি না? তিনি বললেন, 'বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এবং সুস্থ আছেন। তবে তিনি দেশের বাইরে।'
আনন্দে লাফিয়ে উঠেছি। বিশ্বাস আর কৌতূহল_দুই-ই তখন বেড়েছে। জিজ্ঞাসা করেছি, তিনি কি জীবিত অবস্থায় দেশে ফিরতে পারবেন? জ্যোতিষী বলেছেন, 'নিশ্চয়ই পারবেন। আগামী বছর আপনারা তাঁকে ফিরে পাবেন।' বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার চেয়েও তিনি বেঁচে আছেন_এই খবরটাই তখন আমার কাছে বড়, আমি দৌড়ে গেছি মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে। সব বাধা টপকে তাঁর কাছে গেছি এবং খবরটা তাঁকে জানিয়েছি। একজন জ্যোতিষীর কথা কতটা সঠিক কেউ জানেন না। তবু তাজউদ্দীন আহমদের চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। বলেছিলেন, 'ননীগোপাল মিত্রকে আমার কাছে একদিন নিয়ে আসুন।'
এর পর দুই দিনও যায়নি, ভারত সরকার নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর জেনে মুজিবনগর সরকারকে জানিয়ে দিল যে বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এবং তিনি পাকিস্তানের (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) কারাগারে বন্দি। এই খবরটা যেদিন জানা গেল, সেদিন আমি কলকাতার বালু হাক্কাক লেনে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা'র চলতি সংখ্যার প্রকাশ নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখি, জিল্লুর ভাই (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান), টাঙ্গাইলের এমপি (তখন এমএনএ) আবদুল মান্নান এবং চট্টগ্রামের এমপি অধ্যাপক খালেদ (দৈনিক আজাদীর সাবেক সম্পাদক) 'জয়বাংলা' অফিসে এসে উপস্থিত। বঙ্গবন্ধু যে বেঁচে আছেন, সেই খবরটি জিল্লুর রহমানই প্রথমে সবাইকে জানালেন।
তখন জয়বাংলা অফিসে অনেকেই উপস্থিত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের 'চরমপত্র'খ্যাত এম আর আখতার মুকুলও। তখন অফিসজুড়ে সে কি কান্না আর আনন্দের হুল্লোড়। জিল্লুর ভাই পকেট থেকে টাকা বের করলেন। 'জয়বাংলা' অফিসে তখন থাকতেন ঢাকার অধুনালুপ্ত সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক এবং চিত্র পরিচালক ফজলুল হক (ঢাকার চ্যানেল আই টেলিভিশনের ফরিদুর রেজা সাগরের বাবা)। তিনি ছুটে গেলেন মিষ্টি কিনে নিয়ে আসতে। সারা দিন ধরে চলেছিল জয়বাংলা অফিসে আনন্দোৎসব। সেদিনটিকেই তখন আমাদের কাছে মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে যেদিন বঙ্গবন্ধু সত্য সত্যই স্বাধীন স্বদেশে ফিরে এলেন (১০ জানুয়ারি, ১৯৭২), সেদিন আমি কলকাতায়। আমার মেয়ে ইন্দিরার সেদিন জন্ম বালিগঞ্জ হাসপাতালে। দেশে ফিরতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সারা ঢাকা শহরে যে জন-ভূকম্প শুরু হবে_তাতে আমি থাকতে পারব না_ভেবে একটু মনঃকষ্টে ছিলাম। তখন ফ্যাঙ্ আবিষ্কৃত হয়নি। ইন্টারনেট নেই। বিদেশে বসে দেশের টেলিভিশন দেখা যায় না। আমি আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়ে ঢাকা থেকে টেলেঙ্ েআসা বঙ্গবন্ধু সংবর্ধনার খবর পড়ে, রেডিও শুনে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছি।
আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক তখন ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরী। সিলেটে বাড়ি, শান্তি নিকেতনে লেখাপড়া করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরাট সমর্থক ছিলেন। এখনো বেঁচে আছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটিতে তিনি ছিলেন ঢাকায় এবং বিমানবন্দরেও হাজির ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে।
আমি তখনো কলকাতায়। শিশুকন্যাকে নিয়ে দেশে ফেরার উদ্যোগ নিয়েছি। কলকাতা ছাড়ার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আনন্দবাজার অফিসে গিয়েছি। অমিতাভ চৌধুরী আমাকে দেখেই বললেন, 'তোমাকে একটা কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছি।' বলেছি, অমিতাভ দা, কী কথা? তিনি বললেন, 'শেখ মুজিব যে সত্য সত্যই তোমাকে ভালোবাসেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি।' জিজ্ঞাসা করেছি, কী করে পেলেন? অমিতাভ দা বললেন, 'বিমানবন্দরে নেমে তিনি ২৫ মার্চ এবং ১৪ ডিসেম্বর রাতের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম জানছিলেন আর অঝোরে কাঁদছিলেন। হঠাৎ একসময় চোখ মুছে বললেন, গাফ্ফার কোথায়? তাঁকে জানানো হলো গাফ্ফার বেঁচে আছে এবং এখনো কলকাতায়। শুনে তিনি পরম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।' আমি অমিতাভ চৌধুরীর কথা শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। একেই বলে মহামানব। নইলে একটি ভয়াবহভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে এবং অসংখ্য স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে একজন নগণ্য সাংবাদিককে স্মরণ করা এবং তার খোঁজ নেওয়া একজন মহামানবের পক্ষেই সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি জসীমউদ্দীন, বেগম সুফিয়া কামাল ও প্রবীণ-নবীন আরো অনেকে। শামসুর রাহমান তখনই নয়, অনেক পরে তাঁকে নিয়ে তো দুটি অবিস্মরণীয় কবিতা লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে থাকতেই তাঁকে নিয়ে চার লাইনের একটি অমর ছড়া লিখেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়। এক বিখ্যাত ব্রিটিশ কলামিস্ট তো তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন, 'এ পোয়েট অব পলিটিকস।'
আমার ধারণা, এ সময় কবি নজরুল ইসলাম যদি সুস্থ থাকতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লিখতেন, যে কবিতাটি হতো তাঁর আরেকটি শ্রেষ্ঠ অনুবাদ কবিতার মতো :
'দুঃখ কি ভাই, হারানো ইউসুফ
আবার কেনানে আসিবে ফিরে
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুনঃ
হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে।'
আমি ফেব্রুয়ারি ('৭২) মাসে কলকাতা থেকে দেশে ফিরেছি। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। জানতাম, তাঁর ৩২ নম্বর বাড়িতে এবং গণভবনেও এত ভিড় যে এখন দেখা করতে গেলেও ভিড় ঠেলে এগোতে পারব না। এ সময় একদিন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে বসে আছি, দেখি মোহাম্মদ হানিফ (পরবর্তীকালে ঢাকার মেয়র, তখন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী) এসে হাজির। আমাকে দেখে বললেন, গাফ্ফার ভাই, আমি আপনাকে খুঁজছি, আর আপনি এখানে বসে আছেন?' বলেছি, কেন খুঁজছেন? হানিফ বললেন, 'লিডারের নির্দেশ, আপনাকে ধরে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া।' হানিফ আমাকে টানতে টানতে তাঁর গাড়িতে তুলেছিলেন।
তখন বিকেল। গণভবনে পেঁৗছে দেখি, ওয়েটিং রুম থেকে বারান্দা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হলে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে জানি না! হানিফ বললেন, 'আমি লিডারকে খবর দিতে যাচ্ছি।' বলে তিনি চলে গেলেন। রফিকুল্লাহ চৌধুরী তখন বঙ্গবন্ধুর সচিব। ভিড় সামলাচ্ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার সহপাঠী। আমাকে দেখেই বললেন, 'তোকে আর এখানে বসতে হবে না। প্রাইম মিনিস্টার তোর জন্য অপেক্ষা করছে। চল-চল, ভেতরে চল।'
আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধু সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দুবাহু বাড়িয়ে দিলেন (এটা আমার জীবনের বিরল সৌভাগ্য)। আমি জীবনে প্রথম তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করেছি। তিনি আমাকে বুকে টেনে নিয়েছেন, বলেছেন, 'আজ মানিক ভাই (ইত্তেফাক সম্পাদক) নেই। তোমাকেও না দেখলে বড় কষ্ট পেতাম।' বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে মনে হয়েছে, এটা তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নয়, আমারই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
এর পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেক বিদেশি সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী সাক্ষাৎ করেছেন। তার কয়েকটিতেই আমি ছিলাম। যেমন সৈয়দ মুজতবা আলী, ফ্রান্সের আঁন্দ্রে মার্লো প্রমুখ। আঁন্দ্রে মার্লো ঢাকায় কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় বলেছেন, 'আমি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত প্যারিস শহর দেখেছি, তোমাদের ঢাকা শহরের অবস্থা তার চেয়ে ভালো নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফ্রান্সে দ্য গলে ফিরে এসেছিলেন মানুষের মনে আশা ও ভরসা জাগিয়ে। তোমাদের বঙ্গবন্ধুও বিজয় সাফল্য নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এটা তোমাদের পরম সৌভাগ্য। আমাদের দ্য গলের চেয়েও তাঁর কীর্তি ও মহত্ত্ব আরো বিরাট।'
এর পরও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, তাঁর মহত্ত্বকে খাটো করার অপচেষ্টারত এই বাংলাদেশেই কিছু কুসন্তানের দেখা পাওয়া যায়। আমি তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশেরই প্রাচীন কবির ভাষায় বলি : 'সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।'
লন্ডন, ৯ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১২
« পূর্ববর্তী সংবাদ
No comments