সহজ-সরল-মিছেমিছি দেশ দেশ খেলা আর ভালো লাগে না by কনকচাঁপা
আমাদের এই দেশে কত কিছুই না আছে গর্ব করার। এ দেশের প্রকৃতি-পলি-নদী-সহজিয়া মানুষ-শিকড়ের গান, বিভিন্ন সময়ের বড় বড় কবি-সাহিত্যিক-রাজনৈতিক নেতারা_কত কিছুই না আমাদের গর্বের। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান আমাদের মাটিতে জন্ম নিয়েছেন_আমাদের শেখ মুজিবুর রহমান! আমাদের আছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি জসীমউদ্দীন, শিল্পাচার্য
জয়নুল আবেদিন, সংগীতসম্রাট আব্বাসউদ্দীন_কাদের নাম বলব আর বলব না! তাঁরা যুগ থেকে যুগান্তরে গিয়ে নিজেরাই 'লোগো' হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। তাঁরা প্রায় সবাই সারা জীবন যুদ্ধ করে গেছেন। জীবন তাঁদের স্বস্তি দেয়নি। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা জীবনের নানা বাঁকে-খাঁজে সরাসরি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্ভীক এসব সৈনিক যাঁর যাঁর পথে নিমগ্ন হয়ে কাজ করে গেছেন। আশপাশের ছড়ানো কাঁটা দুপায়ে মাড়িয়ে পথ চলেছেন কোনো সাহায্য ছাড়াই। আর তাতেই তাঁরা আজ আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় একটা ছাপচিত্র এঁকে দিতে পেরেছেন। যাঁরা শিল্পী-বৈজ্ঞানিক-ভাষাবিদ ছিলেন, তাঁদের কথা না বলে আমি আজকে রাজনীতিবিদদের কথাই একটু বলি। কোথাও যদি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার এক ইঞ্চি ছবি দেখি, তো দেখেই বলে দেওয়া যাবে কার ছবি। সেটা অস্পষ্ট ছাপা হলেও। শেখ মুজিবের বেলায়ও তা-ই। আমাদের দুই প্রধান দলের নেতাদ্বয়ের ছবিও এখন লোগো হয়ে গেছে। ভালো-খারাপ মিলিয়ে তাঁদেরও পথ অনেকটা লম্বা হয়েছে। দেশের জন্য জীবনের সবটা সময়ই তাঁরা ব্যয় করছেন, কখনো নন্দিত, কখনো নিন্দিত হয়েছেন। এর পরও তাঁদের দুজনের প্রতিই আমাদের শুভ কামনা, তাঁরা এ দেশের জন্য তাঁদের জীবনের সেরা অবদান অবশ্যই রেখে যাবেন। ঘরের শিক্ষাই হোক, পথের দীক্ষাই হোক_দুজনেরই সে অভিজ্ঞতা তাঁদের সমৃদ্ধ করছে। কিন্তু তাঁরা কাদের রেখে যাচ্ছেন? যাঁদের রেখে যাচ্ছেন তাঁরা একা একা দাঁড়াতে পারেন তো? কেন এমন প্রশ্ন? বলছি। লং ড্রাইভে গেলেই বড় বড় হোর্ডিং ও পোস্টার প্রকৃতি ছাপিয়ে দিগন্তে গিয়ে ঠেকে। কার সাধ্য সেগুলো না দেখে বা না পড়ে পার হয় রাস্তা! তো সেখানে কিছু রাজনৈতিক পোস্টার দাঁড়িয়ে থাকে। সেগুলো দেখেই এই লেখার অবতারণা। কেউ একজন হয়তো রাজনৈতিক একটা পদে দাঁড়ানোর (বসার) প্রচেষ্টায় রত। সেখানে পোস্টারে থাকেন পাড়ার বড় ভাই, চেয়ারম্যান_সেই রাজনৈতিক দলের জেলাপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, তাঁর ছেলে অথবা স্বামী, অথবা বাবা! বড় থেকে ছোট আকারে সাজানো সে পোস্টারে রাজনৈতিক নেতা হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে চেনাই দায়। তারপর কার সৌজন্যে পোস্টারটি ছাপানো হলো, অর্থায়ন কে করল_সব মিলিয়ে মোট সাত-আটজনের মধ্যে মধ্যমণিকে খুঁজে পাওয়ার একটাই উপায় হলো, তাঁর ছবিটি কম্পিউটারে ভীষণভাবে এডিট করে নায়ক নায়ক চেহারা বানানোর চেষ্টাটা অপচেষ্টা হয়ে ফুটে ওঠা! তাঁরা প্রায় সবাই ছবি তোলার সময় একটু লিপস্টিকও দিয়ে থাকেন। ভবিষ্যতে হয়তো মেকআপম্যানের নাম-ঠিকানা, কম্পিউটার এডিটরের ওয়েব অ্যাড্রেসের সঙ্গে তাঁদের ছবিও থাকবে। তখন! একটা পোস্টার যত বড়ই হোক না কেন, তাতে যদি ১০ জনের ছবি থাকে তো কাকে মনোনয়নপ্রার্থী ধরে নেব? আমাদের ধরে নেওয়া বাদ। যাঁরা পোস্টারে তাঁদের নেতাদের (হাতের পাখিসহ) ও আঞ্চলিক ভাইদের ছাড়া ছবি উঠাতে ভয় পান, তাঁরা কিভাবে জীবনের উজানে সাঁতার দেবেন? তাঁরা কিভাবে জনগণের বিপদে রুখে দাঁড়াবেন? এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। কারণ জনগণের পক্ষ হয়ে জীবন-নদীর উজানে সাঁতার তাঁরা দেবেনই না। সে প্রয়োজনও তাঁদের নেই। কারণ রাজনীতিতে তাঁরা আদর্শ হয়ে ওঠা_সৎ কোনো মৌলিক চিন্তা প্রতিষ্ঠা করা বা দেশের জন্য জীবনদান_এসব চিন্তা তাঁদের রুটিনেই নেই। তাঁরা শুধু চান নেতা-নেত্রীদের নেক নজর-দোয়া পড়ুন দয়া, আর প্লাটফর্ম। তা পেলে তাঁর চার পুরুষকেই আর কামাইরুজি করতে হবে না। তা-ই কি জীবনের বড় সুখ নয়? নিজের জীবনই তো আগে! পাগলও তা বোঝে। আর তাঁরা তো পাগল নন। তাঁদের এই রাজনৈতিক জীবনে নেতা-নেত্রী দলের পাটাতন, জেলাপ্রধান, পাড়ার বড় ভাই ও নিজস্ব জীবন_এর মধ্যে 'জনগণ' কোথাও নেই। জনগণ হলো ভোটভিক্ষা করার সময় হাত 'মোছাফা' করে বুকে ঠেকানোর উপাত্ত। হায় জনগণ_ফি বছর একই কাণ্ড, তাও যদি তারা এই শুভঙ্করের ফাঁকি একটুও বুঝত, তবে আমাদের দেশের পূর্ববর্তী শক্তিমান নেতাদের মতো আরো কোনো নেতার জন্ম হতো। এ দেশকে আর অভাগা বলে করুণা করার শক্তি কারো হতো না। হে সৃষ্টিকর্তা, এই কিছু ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদের কবল থেকে মুক্তি দাও এ দেশবাসীকে। আর যাঁরা দেশকে ভালোবাসে, রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করে, তাঁদের একটু পোস্টারে ছবি তোলার ও নেতাদের নেক নজরে পড়ার সুযোগ দাও। মিথ্যামিথ্যি (হাঃ হাঃ হঃ) দেশ দেশ খেলা আর ভালো লাগে না।
লেখক : সংগীতশিল্পী
লেখক : সংগীতশিল্পী
No comments