সহজিয়া কড়চা-জাতীয় সংহতি ও জাতীয় চরিত্র by সৈয়দ আবুল মকসুদ
দেশপ্রেম মালকোচা মেরে প্রকাশের জিনিস নয়। মাইক দিয়ে উচ্চ স্বরে ঘোষণার বিষয়ও নয়। দেশপ্রেম এমন এক আবেগ যা প্রকাশ করা যায় না, প্রয়োজনের সময় তা প্রকাশ পায়। দেশপ্রেম অদৃশ্য অবস্থায় প্রত্যেক মানুষের শরীরে প্রবাহিত হয় রক্তের মতো। তবু শরীর কাটলে রক্তটা দেখা যায় ও পরিমাপ করা যায়, দেশপ্রেম পরিমাপযোগ্য নয়। কেউ বলতে পারে না যে আমার মধ্যে অমুকের চেয়ে দেশপ্রেম আড়াই কেজি বেশি আছে। তবে দেশপ্রেম পরিমাপ করা না
গেলেও পরীক্ষা করা যায়। একজন দেশপ্রেমিক সাহসী ও ভীরু দুই রকমই হতে পারেন। যখন তাঁর দেশ ও জাতি আক্রান্ত হয় বাইরের শত্রুর দ্বারা, তাকে প্রতিরোধ ও পরাজিত করতে সাহসী এগিয়ে যান। জীবন চলে যেতে পারে জেনেও যিনি দেশের ডাকে ছুটে যান তিনি বীর। লড়াইয়ের ময়দান ছাড়া অন্য সময় বীরের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া বীরত্ব জিনিসটি বছরের পর বছর প্রদর্শনের বিষয়ও নয়। তাতে বীরের দাম থাকে না। তবে একবার একজন বীরের মর্যাদা পেলে তাঁর থেকে সেই গৌরব আর ছিনিয়ে নেওয়া যায় না। বীরের কোনো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, মতাদর্শ বিবেচনার বিষয় নয়। সে সব তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। বীর বীরই।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁর যাঁর নির্দিষ্ট রণাঙ্গনে, তাঁদের বীরত্ব তখনই প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা তখনই হয়ে গেছে। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রাখার চেয়ে বড় কাজ আর কী হতে পারে?
রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ একটি জাতির সর্বোচ্চ অর্জন। কিন্তু সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হলেও রাজনৈতিক স্বাধীনতাই একটি জাতির সব নয়। তার বাইরে রয়েছে আরও অনেক কিছু, যা একটি জাতিকে মহান করে। তার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, বুদ্ধিবৃত্তি ও সৌন্দর্যবোধের বিকাশ ও নৈতিক উন্নতি যদি না ঘটে, তাহলে তার কষ্টার্জিত স্বাধীনতাও তাকে কিছু দিতে পারে না। অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে উঁচু মানবিক মূল্যবোধ ও মানসম্মত নৈতিকতা সব সময় আশা করা যায় না। কিন্তু সমাজে যাঁরা বিশিষ্ট তাঁদের মানবিক গুণাবলি ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ক্ষমার যোগ্য নয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী স্বাধীনতা ছাড়াই, পরাধীন থেকেও একটি জাতি এগিয়ে যায়। বৈষয়িক ও নৈতিক উন্নতি ঘটায়। যদি থাকে সেই জাতির পর্যাপ্ত মেধা ও নিষ্ঠা। বাঙালি জাতিই তার বড় দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও অনর্ঘ্য স্থাপত্যশিল্পগুলো সবই পরাধীন যুগের। রেলগাড়ি, স্টিমার প্রভৃতি তো পরাধীন আমলের। কালজয়ী সাহিত্যকর্ম যা, তা তো সবই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের। স্বাধীনতা ছাড়াই তো আধুনিক বাংলার জনক রামমোহন রায়, সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি পেয়েছে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায় উপমহাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। ইংরেজ শাসকেরা যখন সবচেয়ে শক্তভাবে ভারতের ওপর চেপে বসেছিল, তখনই আবির্ভাব রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের। যাঁদের নাম বলা হলো তাঁরা প্রত্যেকেই একেকটি গ্রহ। তাঁদের সমকালে বড় বড় উপগ্রহ যে কত ছিলেন তার হিসাব ইতিহাসে খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে। স্বাধীন দেশ উপগ্রহের মতো প্রতিভারও জন্ম দিতে পারেনি।
মানুষ স্বাধীনতা চায় কেন? কেন মানুষ স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন দেয়? অকল্পনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে? কোনো বড় রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে কোনো ভূখণ্ড যখন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন সে শুধু স্বাধীন হওয়ার জন্যই স্বাধীন হয় না। তার মূল লক্ষ্য জাতীয় সংহতি ও জাতীয় চরিত্র গড়ে তোলা। তার প্রশাসন, তার রাজনীতি, তার অর্থনীতি, তার সংস্কৃতি—সবই একটি নিজস্ব চারিত্র্য গ্রহণ করবে—যা স্বাধীনতার পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র না হলেও আলাদা, যা স্বাধীনতা ছাড়া অন্য একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে থেকে অর্জন সম্ভব নয়। যেমন আমরা স্বাধীন না হলে আমাদের সংস্কৃতিতে অবাঙালি উপাদান ঢুকে পড়ত এবং ধীরে ধীরে বহু বাঙালি উপাদান হারিয়ে যেত। অর্থাৎ বাঙালিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
একাত্তরে ভেবে দেখেছি এবং পরে ওই সরকারের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় সংহতি ও জাতীয় চরিত্র গঠনের সব সুযোগ আমাদের মধ্যে এনে দিয়েছিল। সব শ্রেণী-পেশা ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তা সম্ভব হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বেই স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার প্রভৃতির সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছিলেন ছাত্র, যুবক, এমনকি কিশোরেরা পর্যন্ত।
মুজিবনগর সরকারের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার যে ঐতিহ্য গড়ে ওঠে তা স্বাধীনতার পরে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। সেদিন রণাঙ্গনে যেমন ছিলেন তরুণ সামরিক অফিসার জিয়াউর রহমান, সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ ও অন্য বন্ধুরা, তেমনি মুজিবনগর সরকারের সচিবালয়ে ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম চাষী, নূরুল কাদের খান, আবদুস সামাদ, আনোয়ারুল হক খান, হোসেন তৌফিক ইমাম, টি হোসেন, জে জি ভৌমিক, আকবর আলি খান, খসরুজ্জামান চৌধুরী, তৌফিক-ই-এলাহী, কাজী রকিবউদ্দিন, কামাল সিদ্দিকী প্রমুখ। সেদিন সবাই একসঙ্গে কাজ করলেও স্বাধীনতার পরে রাজনীতিকদের সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের, বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সামরিক কর্মকর্তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেই মেঘাচ্ছন্ন করে দেয়।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকশিত না হওয়ার একটি কারণ এখানে দেশপ্রেমের একটি প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয় বাহাত্তর থেকেই। দেশপ্রেমের মতো একটি অমূল্য আবেগ ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তখন তাঁদের দেশপ্রেম মাত্রা ছাড়ায়। বিরোধী দলের নেতারা দেশপ্রেম প্রমাণ করতে মাঠ-ঘাট উত্তপ্ত করেন।
আজ আমরা এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়েছি যেখানে নিজের দলের না হলে অন্য দলের দেশপ্রেমিকের মৃত্যুও আমাদের বেদনার সৃষ্টি করে না। দুঃখ-শোক পর্যন্ত দলীয়করণের যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে, তা হয়তো একদিন জাতিকে আদিম বর্বরতার দিকে নিয়ে যাবে। প্রতিপক্ষ দলের কোনো নেতা-কর্মী চোখের সামনে গাড়িচাপায় মরলেও মুচকি হেসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে তাঁর লাশের পাশ দিয়ে চলে যাব। সমাজে বিশিষ্টদের মধ্যে আদিম নিষ্ঠুরতার পুনর্জাগরণ ঘটলে তার মূল্য শেষ পর্যন্ত গোটা সমাজকেই দিতে হয়।
ভূমিকার তারতম্য থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সব সেক্টর কমান্ডারের মর্যাদা সমান। সব সাব সেক্টর কমান্ডারের মর্যাদা অভিন্ন। কার কী ধর্ম, কার কী রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাস, তা বিবেচ্য নয়। মেজর জেনারেল সি আর দত্ত, লে. কর্নেল কাজী নূর-উজ জামান, মেজর এম এ জলিল, লে. কর্নেল আবু তাহের এবং অন্য সেক্টরে তাঁদের সহযোদ্ধাদের মর্যাদা সমান। পরবর্তী সময়ে কে কোন দলের রাজনীতি করলেন, কোন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করে কত বিত্তের অধিকারী হলেন, তা অন্য বিষয়। তার সঙ্গে একাত্তরের কোনো সম্পর্ক নেই।
একইভাবে যেসব ব্যক্তি ও রাজনীতিক একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন, পাকিস্তানিদের গণহত্যায় সহযোগিতা করেছেন, নানা রকম মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, পরবর্তী সময়ে যদি তাঁদের কেউ সুফি-দরবেশেও পরিণত হন, তাতে তাঁর সেদিনের অপরাধ ক্ষমা করা যায় না।
মেজর জলিল একজন উত্তম বীর ছিলেন, কিন্তু ‘বীর উত্তম’ খেতাব পাননি রাজনৈতিক বিশ্বাসের দোষে। একইভাবে শাসকের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ায় কর্নেল তাহেরকে বিচার বিভাগীয় হত্যার শিকার হতে হয়। প্রধান বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে এখন প্রতিদিন বলা হচ্ছে পাকিস্তানের এজেন্ট। উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান কয়েক দিন আগেই মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যু তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এবং তাঁদের অনুগ্রহভাজনদের মধ্যে শোকের সৃষ্টি করেনি। হামিদুল্লাহ খানের একাত্তরের যেসব সহকর্মী বেঁচে আছেন, একদিন তাঁদেরও মৃত্যু হবে। তাঁদের মৃত্যুতেও এক গোত্র শোক প্রকাশ করবে, অন্য গোষ্ঠী অবলম্বন করবে নীরবতা। একবার টিভিতে জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছিল।
আমরা প্রথমে মানুষ। তার পরে কেউ রাজনীতিক, কেউ সেক্টর কমান্ডার, কেউ মুক্তিযোদ্ধা, কেউ মন্ত্রী, কেউ আমলা, কেউ কলাম লেখক, কেউ ঠিকাদার, কেউ-বা বিভিন্ন পেশার দালাল। ন্যূনতম মানবিক গুণই যদি না থাকল, তাহলে অন্য পেশায় যত কৃতিত্বই দেখানো হোক, তার মূল্য সামান্য।
সমাজের ভেতর থেকেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আগে সমাজ। প্রত্যেক সমাজের একটি চিরন্তন সামাজিক সংবিধান বা মূল্যবোধ রয়েছে। সে সংবিধানের বিধান শত শত বছরে তৈরি হয়। রাষ্ট্রের যে সংবিধান তা রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনৈতিক দলিল ও সর্বোচ্চ আইন। ওই দলিলের মাঝেমধ্যে সংশোধন ও পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। কিন্তু সামাজিক যে সংবিধান হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হয়, তাতে নতুন উপাদান যোগ হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু পুরোনো কিছু মূল্যবোধ অপরিবর্তনীয় থাকে। বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান দেখানো, শিশুকে আদর ও স্নেহ করা, কোনো ক্ষেত্রে কেউ কৃতিত্ব দেখালে তাকে অভিনন্দন জানানো ও প্রশংসা করা, পরিচিত কারও মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশ, কারও দুঃখে সমবেদনা জানানো—এগুলো মানবিক গুণ ও সামাজিক মূল্যবোধ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোতে কোনো পরিবর্তন আসে না। কোনো প্রচণ্ড দেশপ্রেমিকও যদি এসবকে অবহেলা করেন, তাহলে তিনি নিন্দনীয়।
যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব নিয়ে আমরা প্রতিদিন সভা-সমাবেশ করছি দেশি ও বিদেশি টাকায়, সেই স্বাধীনতাকে কি আমরা অর্থবহ করতে পারছি? সীমাহীন রক্তের বিনিময়ে এবং চরম দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। এ দেশে অপরাধীকে বিচার করে জেল-ফাঁসি-জরিমানা কার্যকর করার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে—বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন? দেশে এ পর্যন্ত তেমন হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা প্রায় হাজার খানেক। মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যাহীন নারী হারিয়েছেন সম্ভ্রম। গত বছর ৭১১ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, লজ্জায় অভিযোগ প্রকাশ করেননি এমন নারীর সংখ্যা কত কেউ তা জানবে না।
কী হবে নারীনীতি করে? ৫১৬ নারী এ বছর যৌতুকের শিকার হয়েছেন। এসিডে মুখ ও শরীর ঝলসে দেওয়া হয়েছে ১০১ নারীর। ৩০ ব্যক্তিকে করা হয়েছে অপহরণ ও গুম। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন ৩১ জন। হামলা হয়েছে ২০৬ সাংবাদিকের ওপর। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকায় রাষ্ট্র এসব দিকে দৃষ্টি দিতে পারছে না।
কী যায় আসে যদি বাংলাদেশের সব নদ-নদী, বিল-বাঁওড়ের ওপর সেতু বানানো হয়, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন ধর্ষিত হতে থাকে কিশোরী-যুবতী, তরুণী গৃহবধূ ও পোশাকশিল্পের নারীশ্রমিক। স্কুলঘর পাকা করে ও শিক্ষার্থীদের হাতে ল্যাপটপ দিয়ে কী লাভ, যদি নিরাপদে তারা রাস্তায় না চলতে পারে? কী লাভ শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়িয়ে, যদি শিক্ষকেরা খেতে থাকেন কিল-ঘুষি চড়-থাপ্পড়। কী মূল্য সেই গণতন্ত্রের, যেখানে প্রকাশ্যে নারী সাংবাদিকদের হাত মুচড়ে দেন একজন সাংসদ। কীভাবে পাব দক্ষ প্রশাসন, যেখানে অনবরত মারধর করা হয় সরকারি কর্মকর্তাদের? কী মূল্য সেই রাষ্ট্রের, যেখানে অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকদের তালাবদ্ধ করে অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রণাঙ্গন। কনসার্ট দেখা নিয়ে মারামারি। ৫০ জন শিক্ষক ১৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ।
আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের যাঁরা অধিপতি, তাঁরা পুরোনো মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছেন, নতুন কোনো উন্নত মূল্যবোধও সৃষ্টি করতে পারেননি। প্রতিপক্ষ সম্পর্কে গড় গড় করে মিথ্যা বলতে মুখে বাধে না। সৌজন্য ও ঔচিত্যবোধের কোনো মূল্য নেই। তরুণ সমাজের কাছ থেকে কীভাবে শিষ্টাচার আশা করব?
মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছিল যে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি তা হারিয়ে গেছে নষ্ট রাজনীতির কারণে অনেক আগেই। এখনকার এই প্রতিহিংসার রাজনীতি বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতি, সম্প্রীতি ও শিষ্টাচার পর্যন্ত শেষ করে দেবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁর যাঁর নির্দিষ্ট রণাঙ্গনে, তাঁদের বীরত্ব তখনই প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা তখনই হয়ে গেছে। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রাখার চেয়ে বড় কাজ আর কী হতে পারে?
রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ একটি জাতির সর্বোচ্চ অর্জন। কিন্তু সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হলেও রাজনৈতিক স্বাধীনতাই একটি জাতির সব নয়। তার বাইরে রয়েছে আরও অনেক কিছু, যা একটি জাতিকে মহান করে। তার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, বুদ্ধিবৃত্তি ও সৌন্দর্যবোধের বিকাশ ও নৈতিক উন্নতি যদি না ঘটে, তাহলে তার কষ্টার্জিত স্বাধীনতাও তাকে কিছু দিতে পারে না। অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে উঁচু মানবিক মূল্যবোধ ও মানসম্মত নৈতিকতা সব সময় আশা করা যায় না। কিন্তু সমাজে যাঁরা বিশিষ্ট তাঁদের মানবিক গুণাবলি ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ক্ষমার যোগ্য নয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী স্বাধীনতা ছাড়াই, পরাধীন থেকেও একটি জাতি এগিয়ে যায়। বৈষয়িক ও নৈতিক উন্নতি ঘটায়। যদি থাকে সেই জাতির পর্যাপ্ত মেধা ও নিষ্ঠা। বাঙালি জাতিই তার বড় দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও অনর্ঘ্য স্থাপত্যশিল্পগুলো সবই পরাধীন যুগের। রেলগাড়ি, স্টিমার প্রভৃতি তো পরাধীন আমলের। কালজয়ী সাহিত্যকর্ম যা, তা তো সবই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের। স্বাধীনতা ছাড়াই তো আধুনিক বাংলার জনক রামমোহন রায়, সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি পেয়েছে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায় উপমহাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। ইংরেজ শাসকেরা যখন সবচেয়ে শক্তভাবে ভারতের ওপর চেপে বসেছিল, তখনই আবির্ভাব রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের। যাঁদের নাম বলা হলো তাঁরা প্রত্যেকেই একেকটি গ্রহ। তাঁদের সমকালে বড় বড় উপগ্রহ যে কত ছিলেন তার হিসাব ইতিহাসে খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে। স্বাধীন দেশ উপগ্রহের মতো প্রতিভারও জন্ম দিতে পারেনি।
মানুষ স্বাধীনতা চায় কেন? কেন মানুষ স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন দেয়? অকল্পনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে? কোনো বড় রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে কোনো ভূখণ্ড যখন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন সে শুধু স্বাধীন হওয়ার জন্যই স্বাধীন হয় না। তার মূল লক্ষ্য জাতীয় সংহতি ও জাতীয় চরিত্র গড়ে তোলা। তার প্রশাসন, তার রাজনীতি, তার অর্থনীতি, তার সংস্কৃতি—সবই একটি নিজস্ব চারিত্র্য গ্রহণ করবে—যা স্বাধীনতার পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র না হলেও আলাদা, যা স্বাধীনতা ছাড়া অন্য একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে থেকে অর্জন সম্ভব নয়। যেমন আমরা স্বাধীন না হলে আমাদের সংস্কৃতিতে অবাঙালি উপাদান ঢুকে পড়ত এবং ধীরে ধীরে বহু বাঙালি উপাদান হারিয়ে যেত। অর্থাৎ বাঙালিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
একাত্তরে ভেবে দেখেছি এবং পরে ওই সরকারের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় সংহতি ও জাতীয় চরিত্র গঠনের সব সুযোগ আমাদের মধ্যে এনে দিয়েছিল। সব শ্রেণী-পেশা ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তা সম্ভব হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বেই স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার প্রভৃতির সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছিলেন ছাত্র, যুবক, এমনকি কিশোরেরা পর্যন্ত।
মুজিবনগর সরকারের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার যে ঐতিহ্য গড়ে ওঠে তা স্বাধীনতার পরে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। সেদিন রণাঙ্গনে যেমন ছিলেন তরুণ সামরিক অফিসার জিয়াউর রহমান, সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ ও অন্য বন্ধুরা, তেমনি মুজিবনগর সরকারের সচিবালয়ে ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম চাষী, নূরুল কাদের খান, আবদুস সামাদ, আনোয়ারুল হক খান, হোসেন তৌফিক ইমাম, টি হোসেন, জে জি ভৌমিক, আকবর আলি খান, খসরুজ্জামান চৌধুরী, তৌফিক-ই-এলাহী, কাজী রকিবউদ্দিন, কামাল সিদ্দিকী প্রমুখ। সেদিন সবাই একসঙ্গে কাজ করলেও স্বাধীনতার পরে রাজনীতিকদের সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের, বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সামরিক কর্মকর্তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেই মেঘাচ্ছন্ন করে দেয়।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকশিত না হওয়ার একটি কারণ এখানে দেশপ্রেমের একটি প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয় বাহাত্তর থেকেই। দেশপ্রেমের মতো একটি অমূল্য আবেগ ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তখন তাঁদের দেশপ্রেম মাত্রা ছাড়ায়। বিরোধী দলের নেতারা দেশপ্রেম প্রমাণ করতে মাঠ-ঘাট উত্তপ্ত করেন।
আজ আমরা এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়েছি যেখানে নিজের দলের না হলে অন্য দলের দেশপ্রেমিকের মৃত্যুও আমাদের বেদনার সৃষ্টি করে না। দুঃখ-শোক পর্যন্ত দলীয়করণের যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে, তা হয়তো একদিন জাতিকে আদিম বর্বরতার দিকে নিয়ে যাবে। প্রতিপক্ষ দলের কোনো নেতা-কর্মী চোখের সামনে গাড়িচাপায় মরলেও মুচকি হেসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে তাঁর লাশের পাশ দিয়ে চলে যাব। সমাজে বিশিষ্টদের মধ্যে আদিম নিষ্ঠুরতার পুনর্জাগরণ ঘটলে তার মূল্য শেষ পর্যন্ত গোটা সমাজকেই দিতে হয়।
ভূমিকার তারতম্য থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সব সেক্টর কমান্ডারের মর্যাদা সমান। সব সাব সেক্টর কমান্ডারের মর্যাদা অভিন্ন। কার কী ধর্ম, কার কী রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাস, তা বিবেচ্য নয়। মেজর জেনারেল সি আর দত্ত, লে. কর্নেল কাজী নূর-উজ জামান, মেজর এম এ জলিল, লে. কর্নেল আবু তাহের এবং অন্য সেক্টরে তাঁদের সহযোদ্ধাদের মর্যাদা সমান। পরবর্তী সময়ে কে কোন দলের রাজনীতি করলেন, কোন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করে কত বিত্তের অধিকারী হলেন, তা অন্য বিষয়। তার সঙ্গে একাত্তরের কোনো সম্পর্ক নেই।
একইভাবে যেসব ব্যক্তি ও রাজনীতিক একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন, পাকিস্তানিদের গণহত্যায় সহযোগিতা করেছেন, নানা রকম মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, পরবর্তী সময়ে যদি তাঁদের কেউ সুফি-দরবেশেও পরিণত হন, তাতে তাঁর সেদিনের অপরাধ ক্ষমা করা যায় না।
মেজর জলিল একজন উত্তম বীর ছিলেন, কিন্তু ‘বীর উত্তম’ খেতাব পাননি রাজনৈতিক বিশ্বাসের দোষে। একইভাবে শাসকের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ায় কর্নেল তাহেরকে বিচার বিভাগীয় হত্যার শিকার হতে হয়। প্রধান বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে এখন প্রতিদিন বলা হচ্ছে পাকিস্তানের এজেন্ট। উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান কয়েক দিন আগেই মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যু তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এবং তাঁদের অনুগ্রহভাজনদের মধ্যে শোকের সৃষ্টি করেনি। হামিদুল্লাহ খানের একাত্তরের যেসব সহকর্মী বেঁচে আছেন, একদিন তাঁদেরও মৃত্যু হবে। তাঁদের মৃত্যুতেও এক গোত্র শোক প্রকাশ করবে, অন্য গোষ্ঠী অবলম্বন করবে নীরবতা। একবার টিভিতে জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছিল।
আমরা প্রথমে মানুষ। তার পরে কেউ রাজনীতিক, কেউ সেক্টর কমান্ডার, কেউ মুক্তিযোদ্ধা, কেউ মন্ত্রী, কেউ আমলা, কেউ কলাম লেখক, কেউ ঠিকাদার, কেউ-বা বিভিন্ন পেশার দালাল। ন্যূনতম মানবিক গুণই যদি না থাকল, তাহলে অন্য পেশায় যত কৃতিত্বই দেখানো হোক, তার মূল্য সামান্য।
সমাজের ভেতর থেকেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আগে সমাজ। প্রত্যেক সমাজের একটি চিরন্তন সামাজিক সংবিধান বা মূল্যবোধ রয়েছে। সে সংবিধানের বিধান শত শত বছরে তৈরি হয়। রাষ্ট্রের যে সংবিধান তা রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনৈতিক দলিল ও সর্বোচ্চ আইন। ওই দলিলের মাঝেমধ্যে সংশোধন ও পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। কিন্তু সামাজিক যে সংবিধান হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হয়, তাতে নতুন উপাদান যোগ হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু পুরোনো কিছু মূল্যবোধ অপরিবর্তনীয় থাকে। বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান দেখানো, শিশুকে আদর ও স্নেহ করা, কোনো ক্ষেত্রে কেউ কৃতিত্ব দেখালে তাকে অভিনন্দন জানানো ও প্রশংসা করা, পরিচিত কারও মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশ, কারও দুঃখে সমবেদনা জানানো—এগুলো মানবিক গুণ ও সামাজিক মূল্যবোধ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোতে কোনো পরিবর্তন আসে না। কোনো প্রচণ্ড দেশপ্রেমিকও যদি এসবকে অবহেলা করেন, তাহলে তিনি নিন্দনীয়।
যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব নিয়ে আমরা প্রতিদিন সভা-সমাবেশ করছি দেশি ও বিদেশি টাকায়, সেই স্বাধীনতাকে কি আমরা অর্থবহ করতে পারছি? সীমাহীন রক্তের বিনিময়ে এবং চরম দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। এ দেশে অপরাধীকে বিচার করে জেল-ফাঁসি-জরিমানা কার্যকর করার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে—বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন? দেশে এ পর্যন্ত তেমন হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা প্রায় হাজার খানেক। মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যাহীন নারী হারিয়েছেন সম্ভ্রম। গত বছর ৭১১ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, লজ্জায় অভিযোগ প্রকাশ করেননি এমন নারীর সংখ্যা কত কেউ তা জানবে না।
কী হবে নারীনীতি করে? ৫১৬ নারী এ বছর যৌতুকের শিকার হয়েছেন। এসিডে মুখ ও শরীর ঝলসে দেওয়া হয়েছে ১০১ নারীর। ৩০ ব্যক্তিকে করা হয়েছে অপহরণ ও গুম। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন ৩১ জন। হামলা হয়েছে ২০৬ সাংবাদিকের ওপর। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকায় রাষ্ট্র এসব দিকে দৃষ্টি দিতে পারছে না।
কী যায় আসে যদি বাংলাদেশের সব নদ-নদী, বিল-বাঁওড়ের ওপর সেতু বানানো হয়, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন ধর্ষিত হতে থাকে কিশোরী-যুবতী, তরুণী গৃহবধূ ও পোশাকশিল্পের নারীশ্রমিক। স্কুলঘর পাকা করে ও শিক্ষার্থীদের হাতে ল্যাপটপ দিয়ে কী লাভ, যদি নিরাপদে তারা রাস্তায় না চলতে পারে? কী লাভ শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়িয়ে, যদি শিক্ষকেরা খেতে থাকেন কিল-ঘুষি চড়-থাপ্পড়। কী মূল্য সেই গণতন্ত্রের, যেখানে প্রকাশ্যে নারী সাংবাদিকদের হাত মুচড়ে দেন একজন সাংসদ। কীভাবে পাব দক্ষ প্রশাসন, যেখানে অনবরত মারধর করা হয় সরকারি কর্মকর্তাদের? কী মূল্য সেই রাষ্ট্রের, যেখানে অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকদের তালাবদ্ধ করে অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রণাঙ্গন। কনসার্ট দেখা নিয়ে মারামারি। ৫০ জন শিক্ষক ১৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ।
আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের যাঁরা অধিপতি, তাঁরা পুরোনো মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছেন, নতুন কোনো উন্নত মূল্যবোধও সৃষ্টি করতে পারেননি। প্রতিপক্ষ সম্পর্কে গড় গড় করে মিথ্যা বলতে মুখে বাধে না। সৌজন্য ও ঔচিত্যবোধের কোনো মূল্য নেই। তরুণ সমাজের কাছ থেকে কীভাবে শিষ্টাচার আশা করব?
মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছিল যে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি তা হারিয়ে গেছে নষ্ট রাজনীতির কারণে অনেক আগেই। এখনকার এই প্রতিহিংসার রাজনীতি বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতি, সম্প্রীতি ও শিষ্টাচার পর্যন্ত শেষ করে দেবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments