নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-একটি শহর আনন্দময়, একটি বিষণ্ন by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

০১১ সালের শেষ দিনটিতে পর্যটন নগর কক্সবাজারে গিয়ে চোখ প্রায় কপালে ওঠার দশা। লোকে-লোকারণ্য! ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশ থেকে মানুষের ঢল এসে পৌঁছেছে সমুদ্রসৈকতে। এদিন শহরে পর্যটকের সংখ্যা ছিল তিন লাখেরও বেশি। তরুণ-তরুণীরা তো আছেনই, বৃদ্ধ পর্যন্ত কে নেই সেই ভিড়ে? উৎসবপাগল মানুষের উচ্ছ্বাস যেন ছাপিয়ে গেছে সমুদ্র-ঢেউয়ের গর্জনকেও। এত বড় আয়োজনের ডামাডোলে কোথাও একটুও ছন্দপতন হয়নি। কোনো সংঘাত-


সংঘর্ষ নেই, নেই কোনো ছোটখাটো অপ্রীতিকর ঘটনাও। মানুষের ওপর চড়াও না হয়েও যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়, তার একটা চমৎকার নজির যেন তৈরি করল প্রশাসন। কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ জন্য ধন্যবাদ দিদতে হয়।
৩১ ডিসেম্বর নিয়ে প্রস্তুতিটাও ছিল অনেক দিনের। কাগজে-কলমে এখানে হোটেল মোটেল রেস্ট হাউসের সংখ্যা সাড়ে তিন শর মতো। কিন্তু এই কটা দিন যে এতে সবার ঠাঁই হবে না বোঝাই গিয়েছিল। ফলে স্থানীয় অধিবাসী অনেকের বাসাবাড়িও হয়ে উঠেছিল পর্যটকদের ঠিকানা। দু-তরফেরই লাভ—কেউ পেল আপাতত আশ্রয়, কেউবা বাড়তি কিছু টাকা।
সমুদ্রসৈকতে বর্ষবরণের সবচেয়ে বড় আয়োজনটি ছিল দেশটিভির। দেশের খ্যাতিমান ব্যান্ড তারকাদের জড়ো করেছিল তারা। এই কনসার্টে দর্শক উপস্থিতির সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। এ ছাড়া বড় বড় হোটেল-রেস্টুরেন্টেও ছিল নানা আয়োজন। কলাতলী ও লাবণী পয়েন্টের আশপাশে সি-গাল, লংবিচ, কক্স টু-ডে, ওশান প্যারাডাইসের মতো তারকা হোটেলগুলোতে গ্রাহকদের জন্য যেমন ছিল গান, নাচ, গেম শো, সুস্বাদু খাবারের প্যাকেজ, আবার তেমনি হিমছড়ির অদূরে বিচ সালসা বা পেঁচার দ্বীপে মারমেইড ক্যাফেতেও ছিল বর্ষবরণের মনোমুগ্ধকর আয়োজন। খাবার হোটেল বা ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোতেও বিক্রেতাদের দম ফেলার ফুরসত ছিল না মধ্যরাত পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক চেইন রেস্টুরেন্ট কেএফসি বা চিকেন কিং মালয়েশিয়াতে যেমন ছিল উপচে পড়া ভিড়, তেমনি মধ্যবিত্তের স্বাচ্ছন্দ্যের নিরিবিলি পউশী, ডায়মন্ড, ঝাউবন, রোদেলাতেও ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে পর্যটকদের। এমনকি সস্তা খাবারের ঝুপড়ি হোটেলগুলোও ফাঁকা ছিল না।
সব মিলিয়ে কক্সবাজার শহরটা পর্যটকের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কতটা প্রাণবন্ত ছিল, তার একটা বিবরণ দিতে বলা হলে রাত তিনটার কলাতলী ও লাবণী পয়েন্টের জনাকীর্ণ রাস্তাগুলোর কথা উল্লেখ করব আমি। কে বলবে শেষরাত। এ যেন দিনদুপুরের কোনো মেলা প্রাঙ্গণ। বাপের কাঁধে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে শিশু, হাত ধরাধরি করে হাঁটছে নবদম্পতি, ‘আজ কেন মন উদাসী হয়ে...’ সুরে-বেসুরে কোরাস গেয়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটছে একঝাঁক তরুণ-তরুণী।
আবার বলি, সবচেয়ে মন ভালো করা বিষয়টি হচ্ছে চারপাশে এত আনন্দ-কোলাহল, কিন্তু কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই।
এবার এর ঠিক উল্টো একটা ছবির কথা বলি। পুলিশের অনেক প্রহরা পেরিয়ে মধ্যরাতে চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে পৌঁছাতে পেরেছিলেন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদক ও চিত্রগ্রাহক। সৈকতে ঢোকার মুখে পুলিশের একজন সহকারী পরিদর্শক হেসে বললেন, ‘কী দেখতে এসেছেন, নববর্ষ? যান দেখেন, কয়েকটা কুকুর ছাড়া আর কেউ তো নাই...।’
প্রতিবেদক ও চিত্রগ্রাহক সৈকতে ঢুকে বিস্মিত হয়ে দেখলেন সত্যি এক ভুতুড়ে পরিবেশ। খাঁ খাঁ করছে বিস্তৃত বালিয়াড়ি। সমুদ্রের ভীতিকর গর্জনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কয়েকটি বেওয়ারিশ কুকুরের কান্না!
কেন? ইংরেজি বছরের শেষ দিনটিকে বিদায় জানাতে সারা বিশ্বের অধিকাংশ সমুদ্রতীর যেখানে উৎসবের আলোয় মাতোয়ারা, সেখানে পতেঙ্গা কেন এত বিষণ্ন্ন?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষায়, এর নাম শৃঙ্খলা। ‘কবরের শান্তি’ বলে একটা কথা চালু আছে, সেই শান্তি প্রতিষ্ঠারই একটি নমুনা পাওয়া গেল পতেঙ্গা সৈকতে। সৈকতে প্রবেশের সব পথই রুদ্ধ করে রেখেছিল পুলিশ। রাত সাড়ে আটটার পর সিমেন্ট ক্রসিং এলাকা থেকে কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। নেভাল একাডেমি-সংলগ্ন কর্ণফুলীর মোহনায়ও যেতে পারেননি কেউ।
শুধু পতেঙ্গা সৈকত এলাকা কেন, পুরো চট্টগ্রাম শহরটিকেই যেন একটি নিরুত্তাপ-নিরানন্দ শহরে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর ছিল নগর পুলিশ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেহ তল্লাশি ও গাড়িতে তল্লাশির বাড়াবাড়ি নগরবাসীকে বিষণ্ন বদনে ঘরে ফিরতে বাধ্য করেছিল। সবচেয়ে অন্যায্য আচরণটি করা হয়েছে বেসরকারি চ্যানেল এনটিভির সঙ্গে। চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে ইংরেজি বর্ষবরণ উপলক্ষে কনসার্টের আয়োজন করেছিল তারা। জেলা প্রশাসন থেকে মাঠ ব্যবহারের অনুমতি নেওয়া হয়েছে মাস খানেক আগে। কমিশনারসহ মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্পর্কে নগরবাসীকে বিস্তারিত জানানো হয়েছিল। টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচার হয়েছে, বিলবোর্ড ও পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে নগরবাসীর আগ্রহ ও কৌতূহল সৃষ্টির সব ধরনের উদ্যোগই সম্পন্ন হয়েছে ভালোভাবেই। কিন্তু অনুষ্ঠানের ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হঠাৎ অনুমতি বাতিলের চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হলো উদ্যোক্তাদের হাতে।
মাত্র একদিন আগে অনুমতি বাতিল করে উদ্যোক্তাদের যে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলা হলো সে কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু যে বিপুলসংখ্যক দর্শক দূর-দূরান্ত থেকে নগরে এসে জড়ো হয়েছিলেন তাঁদের আর্থিক ও মানসিক ক্ষতির কথা কে ভাববে? শেষ মুহূর্তে অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিল হওয়ায় দর্শকদের অনেকেই তা সময়মতো জানতে পারেননি। নির্ধারিত দিনে অনুষ্ঠানস্থলে এসে জড়ো হওয়া লোকজনকে সামাল দিতে যে পরিমাণ পুলিশ নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, অনেকের ধারণা, সেই একই সংখ্যার পুলিশ দিয়ে পুরো অনুষ্ঠানটিই সামলে নেওয়া যেত।
বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি করতে না দেওয়ার পেছনে শুধুই নিরাপত্তার প্রশ্ন, না অন্য কোনো কারণ আছে, তা নিয়ে একটা খটকা থেকেই গেল নগরবাসীর মনে।
নিরাপত্তা বিধান করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। কক্সবাজারে এ রকম উৎসব আয়োজনে নিরাপত্তা বিধান করা গেলে চট্টগ্রাম শহরে তা কেন করা যাবে না আমাদের বোধগম্য হয় না। অভাবটা বোধ করি বিবেচনাবোধ ও সদিচ্ছার।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.