শ্রদ্ধাঞ্জলি-শহীদজননীর সেই ছবি by পাভেল রহমান
আজ শহীদজননী জাহানারা ইমামের জন্মদিন। তাঁর প্রতি প্রথম আলোর এই শ্রদ্ধাঞ্জলি আমার মা তখন সুদূর আমেরিকায়, মায়ের অবর্তমানে ছোট বোন স্কুলশিক্ষক রেহানা পারভীন আমার অভিভাবক। কিন্তু কোন ফাঁকে নিজ মায়ের ওই স্থানটি চলে গেছে আম্মা জাহানারা ইমামের কাছে, তা টেরও পাইনি বিন্দুমাত্র।
জাহানারা ইমামের প্রিয় সন্তান রুমী ও তাঁর সঙ্গীরা যখন আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেলেন, সেই ১৯৭১ ডিসেম্বরের পর থেকেই তিনি আমাদের আম্মা।
আজকের কাগজ-এ কর্মরত অবস্থায় তাঁর প্রতিটি অনুষ্ঠান কাভার করতে গিয়ে কাছ থেকে মমতাময়ী মায়ের রূপটিই যেন আরও বেশি চোখে পড়ে আমার। সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ রুমীর ক্র্যাকপ্লাটুনের সবাই তাঁকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতেন। তখন আমরাও তাঁকে ডাকতে শুরু করেছিলাম ‘আম্মা’।
শহীদজননীর স্বামী-সন্তান প্রিয় দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। আর জাহানারা ইমাম আমাদের দিয়েছেন অবিস্মরণীয়একাত্তরের দিনগুলি।
একাত্তরের দিনগুলি আর রুমীর কথা তো আগেই আমার জানা।
১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির বিশাল ছাত্রবিক্ষোভ কাভার করছিলাম আমি। স্বৈরাচারবিরোধী এমন ছাত্রবিক্ষোভ ছিল সে সময়ের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এমন বৃহৎঐক্য ভাঙতে স্বৈরাচারী সরকার ফাঁকফোকর খুঁজেছিল বৃথাই।
কার্জন হল, হাইকোর্টের মোড়ে তিনতলা কাটাতাঁরের প্রতিবন্ধকতা, বিশাল ছাত্রবিক্ষোভ স্বৈরাচারের ভিত কাঁপিয়ে দিল। পুলিশের ৩০৩ রাইফেলের নির্বিচার গুলিতে হারিয়ে গেল অনেক শিক্ষার্থীর প্রাণ। শিশু একাডেমী চত্বরে ছবি তুলতে গিয়ে রাইফেলের আঘাতে আমি প্রায় সংজ্ঞাহীন। সেই আঘাতের পর থেকে প্রায় সময়ই মাথার যন্ত্রণায় ভুগতাম। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় আমার মাথায় যন্ত্রণা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। তবে ছবি তোলা থেমে থাকেনি। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, এসেছে নতুন সরকার। এ সময় ঘাতক দালালদের বিচারের আন্দোলনে এসেছে নতুন মাত্রা। দাবি উঠেছে গণ-আদালতের। আমি তখন চিকিত্সার জন্য ছুটেছি বিদেশে। কোনো ফল নেই। ফিরে এলাম। সেই খবর গেল শহীদজননীর কানে। তিনি দারুণ উদ্বিগ্ন হলেন আমার সুচিকিত্সার ব্যাপারে। তাঁর ব্যাকুলতার যেন শেষ নেই। আমি যেন রুমী আর জামী হয়ে গেলাম তাঁর কাছে। চিকিত্সার জন্য খুঁজে ফিরছেন নির্ভরযোগ্য চিকিত্সক। দেশের প্রখ্যাত নিউরোসার্জন রশীদউদ্দীনের খোঁজ পেলেন। ব্যস্ততার জন্য তাঁর সাক্ষাৎপাওয়া মুশকিল। ব্যস্ততা শহীদজননী জাহানারা ইমামেরও। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিশাল দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। নিজ ঘরে তৈরি করেছেন সারা দেশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ। গণ-আদালত নিয়ে সারা দেশে বইছে উত্তাল গণজোয়ার। গণ-আদালতের বিশাল কর্মকাণ্ড নিয়ে রাতের ঘুম হারাম করছেন তিনি।
তার পরও সন্তানের চিকিত্সা বলে কথা! ব্যস্ত ডাক্তার রশীদউদ্দীনকে শহীদজননী নিমন্ত্রণ জানালেন এলিফ্যান্ট রোডের চায়নিজ হোটেলে। শহীদজননী জাহানারা ইমামের ডাকে ছুটে এলেন ডাক্তার রশীদউদ্দীন। চিকিত্সাপ্রার্থী আমিও উপস্থিত।
রোগের ইতিহাস নিয়ে প্রথম সাক্ষাৎশেষ হলো আমাদের। দ্বিতীয় সাক্ষাত্পর্ব এলিফ্যান্ট রোডের বাসভবনে। শহীদজননী নিজ হাতে খাবারের আয়োজন করলেন তাঁর ঝকঝকে রান্নাঘরে। সঙ্গে আছে মানিক।
এবারও সময়মতো রাতের খাওয়া খেতে এলেন ডাক্তার সাহেব। রোগীও উপস্থিত। খাবার টেবিলের মাঝখানে বসে আছেন আম্মা। আজ ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার পালা। সরিষার দানার চেয়ে কিঞ্চিৎবড় গোলাপি রং ডেনজিট হলো একমাত্র ওষুধ।
তৃতীয় সাক্ষাৎএলিফ্যান্ট রোডের বাসায় আবারও। আর ওই ওষুধই আমার জীবন বদলে দিল, সুস্থ হয়ে উঠলাম আমি। এর পর থেকে প্রতি রাতেই তিনি ফোন করে আমার শরীরের খবর নিতেন।
ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও আমাদের মতো প্রতিটি সন্তানের খোঁজ রাখতেন তিনি। বিদেশে চিকিত্সার জন্য সুদূর আমেরিকায় জামীর বাড়িতে চোখ বন্ধ করে যেন বাংলাদেশে আমাদের চলাফেরা দেখতে পেতেন। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে প্রলয়ংকরী ঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড উপকূলে স্বজনহারা মানুষের জন্য যেমন ব্যথিত হলেন তিনি, তেমনি উপকূলে রাত-দিন ক্যামেরা হাতে আমরা যারা ছুটে চলেছি, ভাবতেন তাদের কথাও। সুদূর আমেরিকা থেকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছিলেন তিনি। কল্পনায় তিনি দেখতে পেতেন, আমি যেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছুটছি ছবির খোঁজে।
সেই সময়ের কথা ভোলা যায় না। আমরা তখন শহীদজননীর পেছনে ঐক্যবদ্ধ। প্রতিদিনই প্রায় এলিফ্যান্ট রোডে তাঁর বাসভবনে ছোটাছুটি করি। শাহরিয়ার কবির, বেবী মওদুদ, স্বাধীন বাংলা বেতারের বেলাল ভাই, মাসুক হেলালসহ আরও কতজন, আর সঙ্গে আমার ক্যামেরা।
কী দারুণ এক রাত ভোর হয়ে এল! গণ-আদালতের সেই সকাল। রাজপথ কাঁপিয়ে হাজারো মানুষ ছুটে চলেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে, যেখানে একদিন স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আবারও জড়ো হলো হাজারো মানুষ। বিচার শুরু হলো। গণ-আদালতের রায় ঘোষণা করা হলো। শহীদজননী সেই রায়ের পক্ষে নিজের হাতের দুটি আঙুল উঁচিয়ে ‘বিজয়চিহ্ন’ দেখালেন। ওই মুহূর্তটি ছিল গণ-আদালতের চূড়ান্ত মুহূর্ত, যার প্রতীক্ষায় ছিলাম আমি। ক্যামেরায় সেই ছবি তুলতে আমি মুহূর্ত বিলম্ব করিনি।
পাভেল রহমান
আজকের কাগজ-এ কর্মরত অবস্থায় তাঁর প্রতিটি অনুষ্ঠান কাভার করতে গিয়ে কাছ থেকে মমতাময়ী মায়ের রূপটিই যেন আরও বেশি চোখে পড়ে আমার। সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ রুমীর ক্র্যাকপ্লাটুনের সবাই তাঁকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতেন। তখন আমরাও তাঁকে ডাকতে শুরু করেছিলাম ‘আম্মা’।
শহীদজননীর স্বামী-সন্তান প্রিয় দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। আর জাহানারা ইমাম আমাদের দিয়েছেন অবিস্মরণীয়একাত্তরের দিনগুলি।
একাত্তরের দিনগুলি আর রুমীর কথা তো আগেই আমার জানা।
১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির বিশাল ছাত্রবিক্ষোভ কাভার করছিলাম আমি। স্বৈরাচারবিরোধী এমন ছাত্রবিক্ষোভ ছিল সে সময়ের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এমন বৃহৎঐক্য ভাঙতে স্বৈরাচারী সরকার ফাঁকফোকর খুঁজেছিল বৃথাই।
কার্জন হল, হাইকোর্টের মোড়ে তিনতলা কাটাতাঁরের প্রতিবন্ধকতা, বিশাল ছাত্রবিক্ষোভ স্বৈরাচারের ভিত কাঁপিয়ে দিল। পুলিশের ৩০৩ রাইফেলের নির্বিচার গুলিতে হারিয়ে গেল অনেক শিক্ষার্থীর প্রাণ। শিশু একাডেমী চত্বরে ছবি তুলতে গিয়ে রাইফেলের আঘাতে আমি প্রায় সংজ্ঞাহীন। সেই আঘাতের পর থেকে প্রায় সময়ই মাথার যন্ত্রণায় ভুগতাম। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় আমার মাথায় যন্ত্রণা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। তবে ছবি তোলা থেমে থাকেনি। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, এসেছে নতুন সরকার। এ সময় ঘাতক দালালদের বিচারের আন্দোলনে এসেছে নতুন মাত্রা। দাবি উঠেছে গণ-আদালতের। আমি তখন চিকিত্সার জন্য ছুটেছি বিদেশে। কোনো ফল নেই। ফিরে এলাম। সেই খবর গেল শহীদজননীর কানে। তিনি দারুণ উদ্বিগ্ন হলেন আমার সুচিকিত্সার ব্যাপারে। তাঁর ব্যাকুলতার যেন শেষ নেই। আমি যেন রুমী আর জামী হয়ে গেলাম তাঁর কাছে। চিকিত্সার জন্য খুঁজে ফিরছেন নির্ভরযোগ্য চিকিত্সক। দেশের প্রখ্যাত নিউরোসার্জন রশীদউদ্দীনের খোঁজ পেলেন। ব্যস্ততার জন্য তাঁর সাক্ষাৎপাওয়া মুশকিল। ব্যস্ততা শহীদজননী জাহানারা ইমামেরও। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিশাল দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। নিজ ঘরে তৈরি করেছেন সারা দেশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ। গণ-আদালত নিয়ে সারা দেশে বইছে উত্তাল গণজোয়ার। গণ-আদালতের বিশাল কর্মকাণ্ড নিয়ে রাতের ঘুম হারাম করছেন তিনি।
তার পরও সন্তানের চিকিত্সা বলে কথা! ব্যস্ত ডাক্তার রশীদউদ্দীনকে শহীদজননী নিমন্ত্রণ জানালেন এলিফ্যান্ট রোডের চায়নিজ হোটেলে। শহীদজননী জাহানারা ইমামের ডাকে ছুটে এলেন ডাক্তার রশীদউদ্দীন। চিকিত্সাপ্রার্থী আমিও উপস্থিত।
রোগের ইতিহাস নিয়ে প্রথম সাক্ষাৎশেষ হলো আমাদের। দ্বিতীয় সাক্ষাত্পর্ব এলিফ্যান্ট রোডের বাসভবনে। শহীদজননী নিজ হাতে খাবারের আয়োজন করলেন তাঁর ঝকঝকে রান্নাঘরে। সঙ্গে আছে মানিক।
এবারও সময়মতো রাতের খাওয়া খেতে এলেন ডাক্তার সাহেব। রোগীও উপস্থিত। খাবার টেবিলের মাঝখানে বসে আছেন আম্মা। আজ ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার পালা। সরিষার দানার চেয়ে কিঞ্চিৎবড় গোলাপি রং ডেনজিট হলো একমাত্র ওষুধ।
তৃতীয় সাক্ষাৎএলিফ্যান্ট রোডের বাসায় আবারও। আর ওই ওষুধই আমার জীবন বদলে দিল, সুস্থ হয়ে উঠলাম আমি। এর পর থেকে প্রতি রাতেই তিনি ফোন করে আমার শরীরের খবর নিতেন।
ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও আমাদের মতো প্রতিটি সন্তানের খোঁজ রাখতেন তিনি। বিদেশে চিকিত্সার জন্য সুদূর আমেরিকায় জামীর বাড়িতে চোখ বন্ধ করে যেন বাংলাদেশে আমাদের চলাফেরা দেখতে পেতেন। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে প্রলয়ংকরী ঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড উপকূলে স্বজনহারা মানুষের জন্য যেমন ব্যথিত হলেন তিনি, তেমনি উপকূলে রাত-দিন ক্যামেরা হাতে আমরা যারা ছুটে চলেছি, ভাবতেন তাদের কথাও। সুদূর আমেরিকা থেকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছিলেন তিনি। কল্পনায় তিনি দেখতে পেতেন, আমি যেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছুটছি ছবির খোঁজে।
সেই সময়ের কথা ভোলা যায় না। আমরা তখন শহীদজননীর পেছনে ঐক্যবদ্ধ। প্রতিদিনই প্রায় এলিফ্যান্ট রোডে তাঁর বাসভবনে ছোটাছুটি করি। শাহরিয়ার কবির, বেবী মওদুদ, স্বাধীন বাংলা বেতারের বেলাল ভাই, মাসুক হেলালসহ আরও কতজন, আর সঙ্গে আমার ক্যামেরা।
কী দারুণ এক রাত ভোর হয়ে এল! গণ-আদালতের সেই সকাল। রাজপথ কাঁপিয়ে হাজারো মানুষ ছুটে চলেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে, যেখানে একদিন স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আবারও জড়ো হলো হাজারো মানুষ। বিচার শুরু হলো। গণ-আদালতের রায় ঘোষণা করা হলো। শহীদজননী সেই রায়ের পক্ষে নিজের হাতের দুটি আঙুল উঁচিয়ে ‘বিজয়চিহ্ন’ দেখালেন। ওই মুহূর্তটি ছিল গণ-আদালতের চূড়ান্ত মুহূর্ত, যার প্রতীক্ষায় ছিলাম আমি। ক্যামেরায় সেই ছবি তুলতে আমি মুহূর্ত বিলম্ব করিনি।
পাভেল রহমান
No comments